বিলের ধারে ঘাসের ভেতর রূপকথার মতো জেগেছিল একসময় তিনকাঁটার মাছ। বহুক্ষণ তার দেখা পায়নি আর। খলুইয়ের ভেতর ছটফট করতে করতে কখন যেন মিইয়ে গেছে মাছগুলো। তেঁতে ওঠা সূর্যের তেজে কোনোকিছুই ঠিক থাকছে কি? এই যেমন, রুপার শ্যামলা গালের ঠিক মাঝ বরাবর বেগুনি হয়ে উঠেছে। ঠোঁট শুকিয়ে খড়খড় করছে। গায়ের আঁটসাঁট জামাটা ঘামে চুপচুপে। মেঘের মতো চুলের ভেতর থেকে গড়িয়ে আসা ঘাম কপাল বেয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে ঘাসের মাঝে ছলকে আসা বিলের জলে। পণ করেছে ও, আজ অন্তত দুপুরে খাওয়ার সমান মাছ নিয়ে যাবে।
ওর আগেই বিলের এদিকটায় এসে বসে ছিল হাসানের ব্যাটা জব্বার। তাড়িয়ে দিয়েছে রুপা। ছোঁড়া বদের আঁটি। বয়স রুপার হাঁটুর সমান, কিন্তু কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! আবার চোখ রাঙায় রুপাকে, কী সাহস! বলে কিনা, এই বিল কি তুমার শ্বশুরের সম্পত্তি? রুপা দিয়েছে এক থাবড়া কানের ওপর। তাও ঝাল মেটেনি রুপার। সুযোগমতো পেলে আবার শিক্ষা দেবে। কান কচলাতে কচলাতে ছোঁড়াটা যেই না গেল, অমনি বিলের জলে একঝাঁক তিনকাঁটার মাছ চকচক করে উঠল। জলের ঢেউয়ে কিছু আবার ঘাসের মাঝে লুটোপুটি। গামছা দিয়ে সেই ঝাঁকটা ধরার কথা ভুলে গিয়ে ঘাসের ভেতরের মাছগুলো কুড়াতে লাগল রুপা। কী ভুলটাই না করেছে সে, মুখ তুলে দেখে ঝাঁকটা উধাও! তারপর থেকে সেই যে বসে আছে তো আছেই। আর কোনো ঝাঁক তো আসে না! ছোঁড়াটা কি বদদোয়া দিয়ে গেল? এই ক’টা মাছ তো মাছিতেও ছোঁবে না। রুপার বাপের হাভাতে সংসারে এই মাছ নিয়ে গিয়ে হবেটা কী! চাখতে চাখতেই তো শেষ!
একটা ঢিল রুপার কাঁধ ছুঁয়ে ছুটে গিয়ে ঝপাৎ করে পড়ল বিলে। ঘুরে তাকাল রুপা, ছোঁড়াটা বদলা নিতে এলো নাকি?
কেউ নেই!
কিছুক্ষণ পর একটা খসখস আওয়াজ পেয়ে আবার ঘুরে তাকাল সে। হিজলতলায় দাঁড়িয়ে আছে মনোহারি মফিজ। সুগন্ধী তেল, আলতা, স্নো, পাউডার, লিপস্টিক, কাজল, টিপ… সব একটা বাক্সে ভরে বিক্রি করে সে গাঁয়ে গাঁয়ে। বড় সৌখিন লোক। সুগন্ধী তেলের বাস ছড়ানো চুলগুলো আঁচড়ায় এমন করে, কপালের ডানপাশটায় কী সুন্দর ঢেউ খেলে থাকে! রুপাকে ইশারা দেয়, পিরিতের ইশারা। আজও দিচ্ছে। কানদুটো যেন হঠাৎ করেই গরম হয়ে যায় রুপার। তাকিয়ে দেখে, সেই তখনকার ঢিল পড়া বিলের পানি এখনো কাঁপছে তিরতির করে।
তিরতির করে কাঁপে রুপাও। বিলের এ ধারটা একেবারে সুনশান। আর বিলের ওপারে ঘন বৃক্ষের আড়াল। রুপা যে এই সুনশান এলাকায় একলা বসে আছে মাছের আশায়, কেমন করে জানল মনোহারি মফিজ? কী চায় ও? ওর ওই চাহনি দেখে ভয় লাগে যে রুপার খুব!
মনোহারি এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে। অবশ রুপা যেন পাথর। একটা মাছরাঙা ঠোঁটে মাছ নিয়ে উড়ে এসে বসে হিজলের ডালে। ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে হিজল। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় হিজলের তল।
হ্যাজাকের আলো ফেলল কে মুখের ওপর? দিনের বেলা হ্যাজাকের আলো এত তীব্র হয়! সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছিল রুপা, হায়দার আলীর মেয়ের বিয়েতে তিরিশটা হ্যাজাকের আলো। গায়ে হলুদের সন্ধ্যে থেকেই হ্যাজাকের আলোয় ফকফকা বিশাল বাড়িটা। গাঁয়ের সব্বাই পেটপুরে খেয়েছিল সেই বিয়েতে। সে কী খানদানি খানা! এখনো তার বাস লেগে আছে যেন রুপার হাতে। হাতখানা নাকের কাছে এনে শুঁকতে লাগল সে।
— উঠোস না ক্যান? এই রুপা, ওঠ!
আহা, এই বাস, এই খানদানি খানার বাসের মাঝে কে আবার ডাক দেয়? কে এমন নিঠুরের মতো খানাপিনার সুবাসটাও মুছে দিতে চায় হাত থেকে? বড় আয়েশ করে পাশ ফিরে হাতটা নাকের সাথে চেপে ধরে জোরে। বুকটা ভরে শ্বাস নেওয়ার আগেই এক জোর ধাক্কা। ধড়মড় করে উঠে দেখে শীতলপাটির ওপর কী রোদ, কী রোদ! দাঁত কেলিয়ে হাসছে ছোট ভাইটা। এই ছোঁড়াও বদের আঁটি। ইচ্ছে করছে এক চড়ে সবকটা দাঁত ফেলে দেয়। শান্তিতে স্বপনটাও দেখবার দিব না কেউ তারে? যে স্বপনে কতবছর আগের খাবারের সুবাসটা ধরা দিয়েছিল এসে, সেই স্বপনটা তো রোজ রোজ আসে না! রোজ আসে না মনোহারি মফিজও স্বপনে। আর ওই তিনকাঁটার মাছ, আহা!
চোখ কচলাতে কচলাতে চেয়ে দেখে রুপা, সূর্য তেঁতে আগুন। সেই আগুনই হ্যাজাকের আলো ভেবে ভুল হয়েছিল তার। এমন ভুল তার হামেশাই হয়। ভুল হয় বলেই না এই যৌবন বয়সেও বাপ মা’র ঘাড়ে চেপে আছে। তারা না পারছে রাখতে, না পারছে ফেলতে। তারওপর আবার এই সময়ে, এই এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপন দেখা হচ্ছে! ঘরের দাওয়া থেকে উনুনে চোখ যায় রুপার। উনুন জ্বলছে। শুকনো পাতা জ্বলছে দাউ দাউ করে। স্বপন দেখার অপরাধে অপরাধী রুপার দিকে মা তাকিয়ে আছে আগুনচোখে।
কিন্তু স্বপন তো রুপা জেনেশুনে দেখে না। চলে আসে। আগে থেকে জানিয়েও আসে না। জানালে হয়তো আটকানো যেত। আটকানো যেত ভুলভাল জীবন। অনেকদিন আগে যখন কাদেরের প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ঘর ছেড়েছিল, তখনও তো আটকাতে পারেনি। একে তো কাঁচা বয়স, তারওপর কাদেরের মিষ্টি মিষ্টি কথা। স্বপন না দেখে থাকতে পারত রুপা? কাদেরের সাথে ঘর বাঁধার স্বপন তো তাকে পাগল করবেই! কিন্তু সেই কাদেরের পেটে যে এত বদবুদ্ধি ছিল, তা কেমন করে জানবে রুপা? অজানা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বেচে দেয়ার ধান্দা ছিল তার পেটে, সেটা তো রুপার জানার কথা নয়! কিন্তু যখন জানল, তখন তো কাদেরের মাথায় মোটা লাঠির তিন ঘা দিয়ে ঘর ছাড়ার তিনদিন পর পালিয়ে এসেছিল।
তবে ওই তিনদিন বড় লম্বা সময়। ওই তিনদিনের মধ্যেই গাঁয়ে রটে গেছিল, খারাপ ব্যবসায় কাদেরের সঙ্গী হইছে রুপা। পাল্টে গেছিল সব। বাপ মাও। বাড়ি ফিরে দেখে, যে বাপ মা’র জানের জান ছিল রুপা, সেই বাপ মা-ই মুখ ঘুরিয়ে থাকে। আর গাঁয়ে তো ছিছিক্কার। কানে হাত দিয়ে রাখলেও কোন ফাঁক দিয়ে যেন শোনা যায় সব। সেই যে দাগ লাগল চরিত্রে, আর উঠল না। এঁটো খাবার যদিও খাওয়া যায়, কিন্তু এঁটো মেয়েমানুষ? ছিঃ ছিঃ!
তারপর বহুদিন আর স্বপন দেখেনি রুপা। বাপ-মা বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল দুই তিন বার, কিন্তু নষ্ট মেয়েছেলেরে কে বিয়া করব?
ভরা পাটক্ষেতে চাইর পোলার বাপ আকমইল্যা একবার চেপে ধরেছিল। তার তলপেটের নিচে কষে এক লাথি দেওয়ায় বলেছিল, ক্যান রে ছেঁড়ি, বিয়া তো হইব না তোর জীবনেও। দেহ নাই তোর? আগুন লাগে না ওই দেহে? এমন করোস ক্যান?
আগুন লাগে, বোঝে রুপা। মনোহারি মফিজের ইশারা তাই তো পাগল করে তোলে। ইচ্ছে হয় ইশারায় সাড়া দেয়। কিন্তু আবার যদি ভুল হয়ে যায়! দাগের ওপর আবার যদি দাগ লাগে? তারচাইতে এই ভালো। এইভাবেই কাটিয়ে দেবে সে জীবন।
উঠে হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের কাজে হাত লাগাতে যায় রুপা। দুপুরের রান্নার জোগাড় তো ভালোই হইছে দেখা যায়! কচুশাক আর কয়টা টাকি মাছ। মায়ের হাতের টাকি মাছের ভর্তা এক্কেরে ফাস কেলাস, কচুশাকও। মনটা চনমন করে উঠল তার। হাঁড়িতে একটু চা পড়ে আছে রুপার জন্যে। রুপার বাপের খুব চায়ের নেশা। সকাল বিকাল দুই কাপ না খেলেই নয়। একে অভাবের সংসার, পরের জমিতে কামলা খাটে, তবুও ক্যান যে এই নেশা ধরল তারে? মা রাগ হয় মাঝে মাঝে। শুধু তো পানি ফুটাইলেই চা হয় না! চিনি লাগে, চা পাতা লাগে। এগুলা কিনতে পয়সা লাগে না? পাঁচ পাঁচটা পোলা মাইয়া। চা বানাইলে তাগোরও শখ জাগে, একটু চাইখা দেখনের। না দিয়া পারা যায়?
একখান করে মোটা রুটি আর চা, এই হলো ভোরবেলার খাওয়া। রুপাও খেয়ে নিল নিজের ভাগের চা রুটি। ভাইবোনগুলো বোধহয় স্কুলে চলে গেছে। একসময় রুপাও যেত। ক্লাস নাইনে উইঠাই তো কাদেরের লগে পালাইল। ফিরা আসোনের পর আর যায় নাই। ক্যামনে যাইব? এই মুখ নিয়া ক্যামনে সে স্কুলের স্যারগো চোক্ষের সামনে দাঁড়াইব! যারা তার সাথে পড়ত, তারাও তো কেউ কথা বলে না এখন। এমন ভাব করে, যেন রুপার সাথে কথা বললেই তারা অপবিত্র হয়ে যাবে। আরে তাজ্জব ব্যাপার, কী এমন করছে রুপা, পালাইছিল, ওই পর্যন্তই। ও তো যেমুন গেছিল, তেমুনই ফিইরা আসছে। তয়?
যাউগগা, এইসব নিয়া আর ভাইব্বা কাজ নাই।
ভাইবা ভাইবা কি জীবনটা শ্যাষ করব নাকি সে? এক্কেরে না। যে যা ভাবে ভাবুক, যে যা কয় কউক, রুপা চলব নিজের মতো কইরা। সবার চোক্ষের সামনে দিয়াই চলব।
চাই আলতা, সুনো, পাউডার! কাচের চুড়ি আনছি, রেশমি চুড়ি। জোরে হাঁক দেয় মনোহারি মফিজ। রুপাদের বাড়ির সামনে এসে গলা চড়ায় আরো। মেজাজ চড়ে যায় রুপার। ব্যাটাকে আজ দুইটা কড়া কথা শুনাতে মন চায়। মা টাকি মাছের ভর্তা বানাতে ব্যস্ত। কলসিটা নিয়ে রুপা বলে, মা পানি লইয়া আসি গা। কটমট করে তাকিয়ে মা বলে, যা...।
বাড়ির ডানদিকে চলে গেছে যে রাস্তা, সেই রাস্তার বাঁকে শানবাঁধানো বিশাল পাকুড়গাছটার নিচে টিউবওয়েল। রুপাকে আসতে দেখে মফিজ তার সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে যায় ওখানে। শানের ওপর বাক্সটা নামিয়ে ওটার ভেতর থেকে বের করে একগোছা রেশমিচুড়ি, টুকটুকে লাল। বলল সে, নিবা এই চুড়ি?
কলসিটা নামিয়ে দু’হাত কোমরে রেখে ফোঁস করে উঠল রুপা। আমার পিছে লাগছো ক্যান? জানো না আমার চরিত্রে দোষ আছে?
—আরে না না। লোকের কথায় আমি কান দিই না।
তোমারে নিয়া যা ইচ্ছা কউক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
—ক্যান?
—আমি তোমারে ভালোবাসি রুপা!
—সত্যি?
—হ, একদম সত্যি। আমি তোমারে বিয়া করবার চাই। তোমার বাপের কাছে প্রস্তাব নিয়া আসবার চাই। এই চুড়ি য্যান সারাজীবন পরাইতে পারি তোমার হাতে, সেই ব্যবস্থা করনের লাইগা।
—এমুন ভালোবাসা কত দেখলাম! পুরুষ মাইনষেরে বিশ্বাস নাই।
—আমারে বিশ্বাস করলে ঠকবা না, গ্যারান্টি।
—ইশ্ রে গ্যারান্টিওয়ালা! এ গাঁয়ে আর আসবা না। আমারে চিনো না তুমি, বেশি তেড়িবেড়ি করলে ঠ্যাং ভাইঙা দিমু। যাও এইখান থাইকা!
শুকনো মুখে সাইকেলে বাক্স বেঁধে চলে গেল মনোহারি মফিজ। একটু যেন দমে গেল রুপা। চলেই গেল! দুটো কড়া কথা শোনাল বটে, তবে তারও তো ভালোলাগে মনোহারিকে। মনে মনে তো কতবার চেয়েছে সে মফিজকে। স্বপনেও আসে সে, এ কথা তো মিথ্যা না। চোরাচোখে রুপাও তো দেখে তাকে। মফিজের কপালের ওপরের ওই ঢেউ খেলানো চুল, মিটিমিটি হাসি মনের মাঝে কেমন এক ঝড় তোলে। এই ঝড় কি থামায়া রাখবার পারব রুপা? আর থামায়া রাখবই বা ক্যান?
যতই ভাবুক, এমন করেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন, পারবে কি? সবাই তো কাদেরের মতো নাও হতে পারে! দুপুরে খেতে বসে মায়ের হাতের টাকি মাছের ভর্তাও কেমন যেন বিস্বাদ লাগে রুপার। শুকনা মুখে মফিজের চলে যাওয়ার কথাই মনের মাঝে ঘোরে শুধু। চিন্তা হয়, লোকটা যদি সত্যি সত্যি আর না আসে? কেমন যেন অস্থির লাগে রুপার।
দুপুর গড়ায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। তারপর নামে রাত। গুমসা গরমে ঘরের দাওয়ায় শীতল পাটি পেতে শুয়ে পড়ে ওরা গাদাগাদি করে। তারাভরা মস্ত আকাশটা তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। ঘুমে ওলটপালট ভাইবোনের মাঝে একলা রুপা জেগে। ওর চোখে ঘুম নেই। স্বপনও নেই। সারাজীবন কি কাদেরের দাগ লাগানো চরিত্র নিয়ে একলাই থেকে যাবে? যতদিন বাপ-মা বেঁচে থাকবে, থাকবে রুপা তাদের গলার কাঁটা হয়ে? একদিন বাপ-মা থাকবে না, তখন কে দেখবে রুপাকে? কে হবে দরদী ওর দুঃখের! কেউ হবে না। গলার কাছটায় একটা কষ্ট ঠেলে এসে কান্নার রূপ নেয়। নীরবে কাঁদতে থাকে রুপা। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে ওর শরীর। এভাবে কাঁদেনি কখনো সে। আজ সব বেদনা একসাথে কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে দু’চোখ বেয়ে। পড়ুক। বেদনাগুলো ঝরে ঝরে শেষ হয়ে যাক। ধীরে ধীরে কান্না কমে। ধীরে ধীরে শিথিল হয় দেহ। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে রুপা। ধীরে ধীরে ওর কান্না রূপান্তরিত হয় রূপকথায়। যে রূপকথায় একটি রাজ্য আছে, আছে রাজা রাণী, আছে অনাবিল সুখ। আর আছে , আর আছে...