আম্মা বিছানা চাদরের আপডেট নিতে থাকন, ‘ওই যে বাটিকেরটা, তোমারে দিছিলাম, কী করছো ওইটা? খাটে হয়?’
‘হয় আম্মা। এখনো আগের মতোই নতুন রয়ে গেছে। কই থেকে কিনছিলা?’ বলি আম্মাকে। আম্মা হাসেন। বলেন, ‘কিনি নাই তো! ওইটা পয়লা বৈশাখের তোমার নানার দোকানের। তোমার নানা শাড়ি আর বিছানার চাদর দিয়ে দোকান সাজাইত। রামগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের বৈশাখী মেলায় দোকান ফাস্ট হইত, আব্বার দোকান টানা ছয়বার ফাস্ট হইছিল। তোমরা তখন হও নাই।’
‘জ্বি আম্মা’
‘এলাকার মহিলারা নিজেদের সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা দিত আর বিছানা চাদর। শাড়ি কুঁচি করে দোকানের দেয়াল দেওয়া হইত, আর বিছানা চাদরও আনাচ-কানাচে গুঁজে দেওয়া থাকত। তোমার নানার পিঠা, মিষ্টির দোকানের নাম ছিল কালিতারা। কালিতারার বিছানাচাদর এইটা। সেইবার দোকান ফাস্ট হইলে পুরস্কারের আনন্দে চর বাতেন থেকে আসা আমাদের এক আত্মীয় বিছানাচাদরটা উপহার হিসেবে দিয়া দিছিল আব্বারে। তখন আব্বা আশপাশে তাকাইতেছিলেন আর আমাকেই আপনজন হিসেবে কাছে পাওয়ার আনন্দে বলছিলেন, তুই বিছাইয়া শুইস।’
আম্মার শেষ হবে না। তাই পরে আবার কথা হবে বলে রেখে দিলাম। আমাদের তিন ভাই, এক বোনকে আম্মা ঢাকা আসার সময় বিছানার চাদর দিয়ে দিছিলেন একটা করে। মেজভাই নিতে চায় নাই। জোর করে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে নাকি ছোটভাইকে পাহারা দিতে পাঠাইছিল বাস পর্যন্ত, ফেলে যায় কিনা খবর দিতে! মেজ ফ্যালে নাই।
আমি বিয়ের পর ফারিয়াকে দেখিয়ে বলেছিলাম, এইটা আম্মার দেওয়া চাদর। সে বেশ যত্ন আত্তির সঙ্গে আলমারিতে রেখে দিছিল। বিছায় না দেখে আমি বললাম, ‘চাদরটাতে একদিন শুই? নাকি?’
‘স্টুডেন্ট লাইফে শোও নাই? আর কত?’
‘দেওয়ার সময় আম্মার ইঙ্গিত ছিল, যেন বিয়ের পর এইটা বিছাই, সেজন্য বললাম।’
‘আম্মা তো আরো অনেক কিছুই বলছিল! সব শুনছিলা?’
‘আম্মা ফোন করলে তুলে রাখছো বলার দরকার নাই, বলবা, বিছাও।’
‘মিথ্যুক! মার সাথে মিথ্যা বলব!’
আমি আর কথা বাড়াই না। ঠিকই একদিন আম্মা জানতে চাইল, ‘ফারিয়া, রিয়াজের কাছে আমার দেওয়া একটা চাদর আছে, পাইছিলা?’
‘জ্বি আম্মা, খুব সুন্দর চাদর। কিন্তু আম্মা, এইটা ছেলেরে দেওয়া আপনের একমাত্র স্মৃতি, বিছিয়ে নষ্ট করে ফেলা কি উচিত হবে?’
তারপর থেকে চাদর না বিছানোতেই দেখি আম্মার সুখ! মানুষের কথা না রেখেও যদি বোঝানো যায়, এটা তার স্বার্থেই রাখা যাচ্ছে না তবে মানুষ কষ্ট পায় না।
দুই.
‘কদমগাছের খাট! আর কতকাল ভালো থাকব?’ কদমগাছের কী সমস্যা আমরা সেকালে বুঝতাম না। আম্মা প্রায়ই আব্বাকে বলতেন এই কথাটা। আব্বা বলতেন, ‘কাঠ কি লোহা! ঘুণে তো ধরবেই।’
খাটটা ছিল বিরাট। মোটা মোটা পায়া, দুইপাশে রেলিং, হলুদ রঙ। কয় ফিট বাই কয় ফিট, আজ আর খেয়াল নাই। আম্মা-আব্বাসহ আমরা তিনভাই একবোন এঁটে যাইতাম। আমি সবার বড়, সবার ছোট ভাই, বোন আমার ছোট—সব পিঠাপিঠি। আমার ক্লাস সেভেন পর্যন্ত খাটটা শোয়ার উপযুক্ত ছিল। আমাদের ঘরটা ছিল দুই কক্ষ বিশিষ্ট। এক কক্ষে আমরা থাকতাম, আরেক কক্ষে আমাদের চাচা। চাচার দুয়ার উত্তরে, আর আমাদের দুয়ার পশ্চিমে। চাচার দুয়ারে ছিল একটা বেলগাছ আর আমাদের দুয়ারে ছিল হরিতকী। হরিতকীর উদীয়মান সবুজ মরিচা পড়া টিনের চাল আড়াল করে রাখত! পশ্চিম থেকে দক্ষিণে যেতে যেতে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছিল, আমরা সেভাবে উত্তরে যাই নাই, সেজন্য বেলগাছ ঠিক দেখতে কেমন আমরা জানতাম না। শুনেছিলাম, বেলগাছের পাশে একটা পেয়ারাগাছও ছিল, সেই পেয়ারা আমরা কোনোদিন খাই নাই। এখন চাচাত ভাই-বোনের মুখে এর স্বাদের কথা শুনি, ভালো লাগে। বলি, তোমাদের পেয়ারার আর কী কী টেস্ট ছিল?
রাতে আব্বা হিসু করতে উঠলে, সিরিয়ালি আমি, তারপর আমার বোন, আমার ভাই, আমার ভাই উঠে পিছ পিছ যেতাম; আম্মা বলতেন, রাতে পানি কম খেয়ে শুতে পারিস না তোরা!
বৃষ্টি হয়ে যাবার পর যদি হতো সেই হাঁটা, তবে সকালে উঠে দেখতাম আব্বার প্লাস্টিকের জুতার দাগ উঠানে, আর বড় বড় দাগের মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্যান্ডেলের দাগ! কিংবা শীতের কুয়াশার ভেতর অথবা অধিক অমাবশ্যার ভেতর আমরা কেউ কাউকে দেখতে পেতাম না, আমরা আওয়াজ শুনতাম একে অন্যের।
আমার বোনের চুলের ব্যান্ড হারিয়ে যেত; ঘরটা এতই ছোট যে আম্মা বুঝতেন কোথায় হারাইছে। খাটের কোনো এক কোনায় অথবা বিছানার চাদরের ভাঁজে অথবা বালিশের তল থেকে খুঁজে এনে দিতেন। আমার ছোটভাই যখন খুব ছোট ছিল; কয়েক ঘণ্টা পর পর সে খিদায় কাঁদত অথবা গরমে! তার সাথে সাথে আমাদেরও ঘুম ভেঙে যেত, খুব কাছ থেকে আমরা আমাদের ছোটভাইয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম, এবং তা অনবরত। আমরা নিশ্চিত জানতাম, কয়েকবার আমাদের ঘুম ভাঙবে, সেই সুবাদে তিন ভাই-বোন একে-অন্যকে পাল্টা-পাল্টি করে কয়েকবার জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে যাবার সুযোগ পাব। আমার মেঝভাই রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটতে পারত। সে খাট থেকে উঠে নিজে নিজে দরজা খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিত, যদিও জেগে থাকলে রাতে সে একা ঘরের মধ্যেই ভয় পেত। আব্বা কিভাবে যেন টের পেত, মেঝভাই দরজা খোলার আগেই আব্বা তাকে কোলে করে এনে খাটে শুইয়ে দিত। সবার মাঝখানে। বালিশ ছাড়া, যেন তার গভীর ঘুম না পায়!
এভাবেই গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ল, আমাদের মেঝভাইর মধ্যে অলৌকিক কিছু আছে। তারপর কোত্থেকে যেন শুনলাম, আমার মেঝভাইর সুন্নতে খতনা নাকি ঘুমের মধ্যে ফেরেশতারা করিয়ে দিয়ে গেছে। অথচ আমরা তো জড়াজড়ি করে একই খাটে ঘুমিয়ে থাকতাম, কোনো ব্যথায়, না কোনো দিন সে জেগে উঠে নাই! আমাদের আব্বার বালিশ রোজ সকালবেলা ঝাড়তে হতো। আম্মা সবার আগে ঘুম থেকে উঠে নিচ থেকে বালিশ কুড়াতেন আর বলতেন, ‘মাথা কই আর বালিশ কই!’ এভাবে বলতে বলতে তিনি ভোর আনতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আম্মার ঝাড়ু দেওয়ার শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। আমরা সন্তান, একখাটে ঘুমন্ত পিতার পাশে উঠে বসতাম। বড়দের খেলনা থাকত খাটের নিচে, ছোটদের খেলনা খাটের উপরে; ঘুম থেকে উঠেই আমরা আগে দেখতাম যার যার খেলার সামগ্রী ঠিকঠাক জায়গায় আছে কিনা। কাঠ দিয়ে বানানো ব্যাট, পলিথিনের ফুটবল, সুপারির খোল, ঘুড়ি, বেত লাফানোর দড়ি ইত্যাদি থাকত খাটের নিচে। আর উপরে থাকত বিশেষত, সবচেয়ে ছোটভাইয়ের খেলনা, ঝুনঝুনি, প্লাস্টিকের গাড়ি, বন্দুক, চরকি ইত্যাদি। মেঝভাইয়ের গাড়ির চাকাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত বিছানার এদিক-ওদিক। ভালো করে খেয়াল না করলে দেখার উপায় নেই। সবাই বিছানা ছাড়লে সে একটা একটা করে খুঁজে নিত। আর সব পাওয়ার পর শুধু একটা যদি না পেত, সবাইকে বাধ্য করত তার চাকা খুঁজতে, যেন সবাই মিলে ঘুমানোর কারণেই তার চাকা হারাইছে!
মশারি নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকায় ওটা উপরেই ঝুলত! গোপনে আম্মা টানানোর ব্যবস্থা করতেন বেশি মশায়, আমরা ঘুমিয়ে গেলে। একটা খাটের জন্যে অনেকগুলো বিছানার চাদর ছিল আমাদের। কম করে হলেও দশ-বারোটা। বিভিন্ন রঙের আর ডিজাইনের চাদর। আম্মা বাপের বাড়ি যাবার সময় রেলস্টেশনে ট্রেন বদলানোর ফাঁকে কিনতেন। রাতে ঘুমানোর সময় আমরা আওয়াজ শুনতে পেতাম, কুটকুট কুটকুট। আম্মার মন খারাপ থাকত, ভেতরে ভেতরে পোকায় খাট খাচ্ছে; এতগুলা চাদর তিনি বিছাবেন কোথায়?
তিন.
মা কাকটা বাসাই ছাড়ছে না; ডিমে তা দিচ্ছে। বেশ কয়েকটা ছবি পাঠাল ফারিয়া, ম্যাসেঞ্জারে। আমাদের বাসার রান্নাঘরের পাশে কাঁঠালের ডালে হুট করে বাসাটা বানিয়েছে কাক দম্পতি, ডিম পাড়ার আগে আগে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মা কাক বাসায় বসা, আর পাশে পাহারা দিচ্ছে বাবা কাক। বাসায় জায়গা নেই তার জন্য। গ্রীষ্মের উত্তাপের মধ্যে শরীরে রোদের বাসা নিয়ে বাসায় বসে মা কাক। আমি যখন বাসায় আসব, তখন দেখব, কয়টা ডিম, যদি কাক ডানা গুটায় অথবা বাসা ছাড়ে কোনো ছুঁতায়। আমার বোনের কোয়েল পাখিগুলোকে এখন কে দেখে কে জানে! রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে ঢাকা ছেড়ে, সংসার ছেড়ে সে ওখানেই। মানবাধিকার সংস্থার হয়ে কাজ করছে, বাসা ভাড়া নিয়ে একা থাকছে কক্সবাজারে। শুরুর দিকে ওকে ফোন করলে সে জানায়, ‘ভাইয়া, ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে আসতেছে।’
মেঝভাইকে ফারিয়ার পাঠানো কাকের বাসার ছবিটা ফরোয়ার্ড করতেই সে রিপ্লাই দিল, ‘তোমার প্রিয় পাখি কাক, তুমি কাকের মতো সংসার করো গা। আমারে এসব পাঠিয়ে লাভ হবে না। আমি একাই ভালো আছি। নেক্সট উইকে আবার পাহাড়! তাঁবু করে থাকব ক মাস।’
কিছু দিন একটা মেয়ের সঙ্গে লিভইন করতো ও। তারপর কী যে হলো। ওদের আর এক করা গেল না। দুইজনেরই যোগাযোগ আছে, দেখা সাক্ষাতও হয়, কিন্তু একঘরে আর রইবে না, বিয়ে তো না-ই। এটাও একটা জীবন। আপত্তিটা একছাদের নিচে থাকায়, একসাথে থাকায় না। শুনলাম, মেয়েটাও পাহাড়ে যাবে সাথে!
রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়াতে বোনের সুবিধা হইছে। দুইজন দুই জায়গায় থাকায় সংসারের মেয়াদ কিছুদিন বাড়ল ওদের। ওদের সমস্যাটা কিসে, যদিও বেশি পরিষ্কার না আমার কাছে, তবুও ভাসাভাসা বুঝি, সামান্যতে বাঁধে। সম্পর্কে ইমোশন নাই আর। অথবা একত্রে থাকবার ইচ্ছাও। তবুও কেন জানি ছিল, একই বাসায়, হয়তো আলাদা ঘরে, হতে পারে একই ঘরে, আমাদের জানায় নাই, আমরা জানতে চাইও নাই। বোন মাঝেমধ্যে খুব চটলে আমাকেই ফোন করে আর একই বাক্য রিপিট করে, ‘ভাইয়া, এভাবে কি থাকা যায়, একটা বাসায়?’ বলে ফোন কেটে দেয়, আমিও আর ব্যাক করি না। এই একটা বাক্য শুনতে শুনতে আমার এমন মনে হয়, ওরা বোধহয় আলাদাই থাকে, একই ঘরে।
সবচেয়ে ছোটভাই সোশাল মিডিয়ায় তেমন একটা নাই, কানাডায় পড়তে গিয়ে আর আসছে না, যোগাযোগ কম। ওরে কিছু পাঠিয়ে লাভ হয় না, সিন করে না।
আমি আর মাহজাবিন চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ ক্যাপপরা একটা ছেলে, চুল ঝুটি করা, এলো। ব্যাগ থেকে বের করে কী একটা কাগজ ওর দিকে বাড়িয়ে দিল মাহজাবিন। তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার বন্ধু, পরে পড়ো, আগে পরিচিত হও।’ আমি হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিয়ে জানত চাইলাম, ‘ভালো আছেন?’ মাহজাবিন আমাকে শুধরে দিয়ে বলল, ‘ওকে আমি ছেলে ডাকি। আমার ছেলে। আপনি করে বলতেছো ক্যান!’ তবুও আমি, আপনি ছাড়লাম না। বললাম, ‘আপনার হাসিটা খুব সুন্দর! আপনার মায়েরই মতো।’ ছেলেটা আবার হাসতে হাসতে কাগজটায় চোখ বুলাচ্ছিল।
মাহজাবিন পরে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। এই ছেলের বাড়ি বরিশাল। ঢাকায় এসে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সিনেমার সাথে যুক্ত হতে চাইছিল। এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়। তারপর থেকে মাহজাবিনের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছে। মাহজাবিনকে মা ডাকে। বয়সে বড়জোড় দশ-বারো বছরের গ্যাপ ওদের। হঠাৎ গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলো এমনই, কোথা থেকে কী রূপে শুরু হয়, কিভাবে শেষ হয় ধারণা করা যায় না। এখন আমাকে বলতেছে, ওকে আপনি বলা যাবে না। ব্যাপারটা বিব্রতকর। সে দেখে সন্তানের মতো, আমাকে দেখতে হবে। আমি যেন অভ্রকে ছেলে হিসেবেই দেখি। আমি মাহজাবিনকে বললাম, এই কর্তব্য তো তোমার হাজব্যান্ডের। তাই না! আমি তো সামাজিক না এক্ষেত্রে। আমি তুমি পর্যন্ত মেনটেইন করলেই হলো। এর আগে-পরে আমার কোনো কর্তব্য নাই। ‘আরে, ও তো ছেলেই মনে করে, তুমি বলে। কিন্তু ওকে এর বাবা হিসাবে আমি কেন জানি মানতে পারি না। বেমানান লাগে। তোমারে ঠিক লাগে। আমার এমন মনে হয়, আমি কী করব বলো।’ বলল মাহজাবিন।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, নেক্সট টাইম তুমিই বলব। প্রথম পরিচয়ে কাউকে তুমি ডাকাটা সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট সীমা আগে থেকে ঠিক করে রাখার সামিল।’
মাহজাবিন ফোন করে একদিন জানাল, ‘শোন, তোমার ছেলে একটা খাট কিনতে চায়। তুমি একটু ওর সাথে যাবে, যেতে হবে।’
‘ও কি শিশু? নিজের খাট নিজে কিনতে পারে না!’
‘আহা! গেলেই বুঝতে পারবে, কেন যেতে বলছে। কাল বিকালেই যাবে, গুলশান অটবি শোরুমে।’
‘ভাগ্যিস ঢাকায় আছি, না থাকলে পেতে কোথায়?’
গিয়ে দেখি, খাটের বিজ্ঞাপন! মাহজাবিন বানাচ্ছে। আগেই পুরোটা ভেঙে বললে হয়তো রাজি হতাম না। অভিনয় ওরা শিখিয়ে দিল। একটাই ডায়লগ, ‘খাটের জন্য খেটে মরার কী আছে, এই তো চোখের সামনে কত খাট! কোনটা নিবে বাবা?’ অর্থাৎ আমি আমার আর মাহজাবিনের পাতানো, সরি মাহজাবিন শুনলে কষ্ট পাবে, আমি এভাবে ভাবি, আমার আর মাহজাবিনের ছেলেকে উদ্দেশ্য করে এমন বলব। ছেলে কিছুই বলবে না, শুধু শুনে বাবার সাথে থেকে খাট পছন্দ করবে।
চার.
কাকের বাসায় বাচ্চা চলে আসছে। চারটা। মা কাক একবার ওদের ঢেকে বসে, আবার বাইরে গিয়ে বসে।
বাবাটা পাশের ডালে বসা। ফারিয়াকে দেখিয়ে বললাম, ‘ওদের সংসার জমে উঠেছে। দেখছো, তিনটা ফুটফুটে বাচ্চা।’
ফারিয়া বলল, ‘আমাদের তো কোনো বাবু নাই। তাই বলে কি আমাদের সংসার জমেনি?’
‘তুমি মানুষের দিকে টানো ক্যান! আমি তো কাকেদের অর্থে বললাম। বাচ্চাগুলো বড় হলেই ওরা সংসার ভেঙে দিবে বা ভেঙে যাবে। মানুষ তো তেমন না, নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেরা ভাঙে।’
‘শোনো, মাহজাবিন কোত্থেকে যেন পঁচিশ বছরের একটা ছেলে আনছে। আমাকে বলল, আমিও যেন তারে ছেলের মতোই দেখি। তুমি কি ডাকবে ওরে ছেলে?’
‘মাহজাবিন কেন এগুলা করে? তোমারে আবার এসবে জড়ায় ক্যান? বুঝছি, ওর হাজব্যান্ড নিশ্চয় এসব পাগলামোতে সায় দেয় না। তাই তোমারে পাইছে। বাহ্, ভালো তো, প্রেম করতেছিলা, করো, এখন আবার বাচ্চাও পয়দা হইচে! আর কী কী আছে তোমাদের? সিনেমা, বিজ্ঞাপন না বানিয়ে ওরে বলো নাটক বানাইতে।’
ফারিয়া বলতে বলতে রুটি ছিটিয়ে দিল কয়েক টুকরো, বাইরে জানালার কার্নিশে। কাক খাক বা না খাক কিংবা বাচ্চাদের খাওয়াক। তারপর বলল, ‘২৭ তারিখ আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী, গ্রামে টাকা পাঠিয়ে দিও, ওরা মসজিদে একটা আয়োজনের ব্যবস্থা করুক। আমি-তুমি ওইদিন গেলেই হবে, আম্মাকে বলে রেখো।’
‘আচ্ছা।’
ফারিয়া বলে চলে যায়। আমি কাকের পশমছাড়া চর্ম-কঙ্কালসার বাচ্চাগুলোকে দেখছি আর ভাবছি, বাচ্চাগুলো বড় হয়ে যদি শোনে কাক তাদের মা না, বাবা না অথবা কাক যদি জানে এরা তাদের সন্তান নয়। ফারিয়ার অবর্তমানে যদি কিছু ঘটে থাকে এই বাসায়! ফারিয়ার অদেখায় যদি কিছু হওয়ার থাকে। জানি না। এদিকটায় খুব গাছ-গাছালি; কোকিলও ডাকে!
পাঁচ.
আমার আর আমার ছেলের অভিনীত খাটের বিজ্ঞাপন টিভিতে প্রচারিত হওয়ার দিনগুলিতে আমার সত্যিই মনে হতে থাকল, ও আমার সন্তান। অভিনয় বেশিবার হয়ে গেলে আর অভিনয় থাকে না, অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়।
আমি, মাহজাবিন আর আমাদের সন্তান! ফারিয়া কাকের বাসা পাহারা দিচ্ছিল। ওর আশঙ্কা হচ্ছিল, দিন-রাত পাহারা না দিলে যদি কোকিল এসে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে যায়! তাই! কাকের বাসায় কেন কোকিল বেড়ে উঠবে? কোকিলের অক্ষমতা কাক কেন নেবে? আর কতকাল নেবে? কোকিল কি কোনোদিনও শিখবে না ঘরবাঁধা?
আম্মা কাঁদতে থাকে ফোনে। টিভি বিজ্ঞাপনে আমাকে আর আমার ছেলেকে খাট কিনতে দেখলে তার নাকি অনেক খারাপ লাগে। আমি জানতে চাইলাম, কেন আম্মা? আম্মা জানায়, আমার এমন একটা সন্তান থাকলে তার খুব ভালো লাগত। আমি বলি, এইটাও আমাদেরই সন্তান! কিন্তু আম্মা মানতে রাজি না।
তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের খাটের কথা মনে আছে তোমার, বাবা? আমরা একসাথে ঘুমাইতাম, সেই যে কদমগাছের খাট, ঘুণে খাইছিল।’
আম্মাকে সান্ত্বনা দিই, ‘জ্বি আম্মা, মনে আছে।’
তারপর আম্মা যা বললেন তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি শুধু একটা বাক্য বলে ফোনটা কেটে দিলেন। কথাটা হলো, ‘কেমন আছে আমার একখাটের সন্তানরা?’
আম্মা শুনছেন না জেনেও আমি উত্তর দিলাম, ‘তারা খুব ভালো আছে আম্মা, খুব ভালো আছে।’
কিন্তু ফোনটা কান থেকে নামাতে নামাতে উপলব্ধি হলো, আম্মার এক খাটের সন্তানদের কারোরই এখন আর বাস্তবিকই কোনো খাট নাই!