বুকশপ ক্যাফে : রাজধানীর বইপ্রেমী মানুষের নিয়মিত গন্তব্য

সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 19:35:54

বই পড়া হোক, বা বইয়ের সাথে সংযুক্ত থাকার ব্যাপার, তার জন্য প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট পরিবেশ। তাই তো বই সাধারণত বাসাতেই পড়ে বেশিরভাগ মানুষ। ধোঁয়া ওঠা চা বা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে একটু কাত হয়ে, হেলান দিয়ে, আরাম করে বই পড়ার অভ্যাস অধিকাংশ মানুষের। পাঠক ও বইপোকাদের সেরকম পরিবেশই দিচ্ছে বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বুকশপ ক্যাফেগুলো। পাশাপাশি সেখানে বন্ধুবান্ধবের সাথে হালকা নাস্তা খেতে খেতে আড্ডা দিতে পারেন পাঠকরা। আলাপ করতে পারেন সাহিত্যজগৎসহ রাজ্যের সব বিষয়ে।

এধরনের অসাধারণ ও ‘হোমলি’ পরিবেশের জন্যই শহরের তরুণ-তরুণীসহ প্রায় সব বয়সের মানুষ ভিড় করছে বিভিন্ন বুকশপ ক্যাফেতে। বুকশপ ক্যাফেগুলো হয়ে উঠছে তাদের নিয়মিত গন্তব্য। নিজেদের মতো করে সময়টা কাটাতে পারছেন। আর যেতে-আসতে সংগ্রহ করছেন পছন্দানুযায়ী দেশি-বিদেশি বই। পাশাপাশি বুকশপ ক্যাফেগুলোতে মাঝেমধ্যেই অনেকে আয়োজন করছে শিল্প-সাহিত্যের ওপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান। সেখানে লোকজনের উপস্থিতিও কম নয়। এভাবে ক্যাফেগামী মানুষের স্রোত নাগরিকজীবনে এনেছে নতুন মাত্রা, জীবনধারায় যোগ করেছে উন্নত এক সংস্কৃতি।

বুক ক্যাফে কালচার উন্নত দেশগুলোতে অনেকদিন ধরে উপস্থিত থাকলেও বাংলাদেশে এর আগমন সমসাময়িক। দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বুকক্যাফে ধরনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরা যেতে পারে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থিত ‘দীপনপুর’কে। এরপর এই অঙ্গনে এসেছে বাতিঘর, বেঙ্গল বই, কবিতা ক্যাফে ও নালন্দা বুকক্যাফে।

◤ বাংলাদেশে বুকশপ ক্যাফের অগ্রপথিক ‘দীপনপুর’ ◢

 

প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের ৪৫তম জন্মদিনে, ২০১৭-তে এলিফ্যান্ট রোডে যাত্রা শুরু করে বুকশপ ক্যাফে ‘দীপনপুর’। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে উগ্রবাদীদের হামলায় নিহত হন প্রকাশক দীপন। দীপনের মৃত্যুর পর তার সহধর্মিনী ডা. রাজিয়া রহমান জলি দীপনের স্মৃতি ও চেতনাকে ধরে রাখতে রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেন ভিন্নধর্মী বুকশপ ক্যাফে ‘দীপনপুর।’ এলিফ্যান্ট রোডের ২৩০ নম্বর ভবনে প্রায় তিন হাজার স্কয়ার ফুটের বিশাল পরিসরে এই বুকশপ ক্যাফে করা হয়েছে। ঢুকতেই চোখে পড়বে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের মৃত্যুকালীন তিনি যে চেয়ারে বসেছিলেন সেটি, সঙ্গে টেবিল এবং রক্তাক্ত পাণ্ডুলিপি, কলম ও অন্যান্য জিনিসপত্র।

দীপনপুরে বই ছাড়াও রয়েছে ‘দীপনতলা’ নামের অনুষ্ঠানস্থল। চাইলে যে কেউ এখানে সাহিত্য, কবিতা পাঠ, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে পারবেন। রয়েছে ‘ক্যাফে দীপাঞ্জলি।’ এখানে বই পড়া ও দেখার পাশাপাশি চা, কফি ও ফ্রেশ জুস পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে স্বাস্থ্যসম্মত নাস্তা। রয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য স্বপ্নরাজ্য ‘দীপান্তর।’ শিশুরা এ কর্নারে বই পড়তে পারবে, আঁকতে পারবে, পাশাপাশি পারবে খেলতেও।

◤ নান্দনিক নকশার বাতিঘর ঢাকা, যেখানে নিয়মিত আসা-যাওয়া রুচিশীল বইপ্রেমীদের ◢

 

এরপরই বলতে হয় বাতিঘর ঢাকার কথা। ২০১৭-এর ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা এই নান্দনিক বুক ক্যাফেটি ইতোমধ্যেই সব ধরনের বইপ্রেমী মানুষের প্রিয় একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। লাল ইটের দেয়াল এবং মোঘল সম্রাজ্যের অন্যতম বিখ্যাত স্থাপত্য লালবাগ কেল্লার আদলে তৈরি এই বুকশপ ক্যাফেটি। প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট জায়গা জুড়ে লক্ষাধিক বই নিয়ে রাজধানীর বাংলামটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৮ম তলায় এর অবস্থান। এখানে রয়েছে সফট ড্রিংকস ও কফির ব্যবস্থা। পাঠকের গল্প করবার জন্য রয়েছে খোলা বারান্দা।

বাতিঘরের ভেতরে রয়েছে ছোট্ট একটি মঞ্চ। যেখানে হয় সাহিত্য আলোচনা কিংবা বই সম্পর্কিত কোনো অনুষ্ঠান। এখানে এসে ঘুরে গিয়েছেন ওপার বাংলার সমরেশ মজুমদার। মজার ব্যাপার হলো, মঞ্চটির অভ্যন্তরীণ সজ্জা করা হয়েছে লালবাগ কেল্লার পরীবিবির মাজারের মতো করে। এখানে থাকা চেয়ারগুলোও সাজানো মোঘল রীতি অনুসারে। সেলস কর্নারটি সাজানো আছে ফতেহপুরের সিক্রির মতো করে, যেখানে বসে গান করতেন সংগীতজ্ঞ তানসেন। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা কর্নার। সেই জায়গাটি সজ্জিত হয়েছে কাচ ও কাঠ খোদাইয়ের বাহারি সব নকশায়। বাতিঘরে সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ইচ্ছেমত বই পড়া যাবে কোনো ধরনের ফি প্রদান ছাড়াই। রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের বিশাল সমাহার।

‘বেঙ্গল বই’ নামের বুকশপ ক্যাফেটি অবস্থিত ধানমন্ডিতে। মিরপুর রোড থেকে ২৭ নম্বর রোডে ঢুকে প্রায় শেষের দিকে বামপ্রান্তের এক রাস্তায় এর অবস্থান। তিনতলা ভবনের পুরোটা জুড়েই এই বুকক্যাফে। মন কাড়বে এর চমৎকার সব স্থাপত্যশৈলি ও খোলামেলা পরিবেশ। প্রতিটি তলা ভাগ করা হয়েছে আলাদা আলাদাভাবে। একদম উপর থেকে অর্থাৎ তৃতীয় ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে দেশি ও বিদেশি বইয়ের সমাহার। নিচতলায় রয়েছে ক্লাসিক সব বই ও ম্যাগাজিন, যেগুলোর অনেকাংশই অবশ্য পুরনো। দেয়ালজুড়ে রয়েছে সব অনন্য চিত্রকর্ম। অসুস্থ কিংবা চলাফেরায় অক্ষম মানুষদের জন্য রয়েছে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা কিংবা বই পড়ার সুযোগ।

‘বেঙ্গল বই’ নামের বুকশপ ক্যাফেটিকে ভাগ করা হয়েছে চারটি অংশে। আর সেগুলো হলো, ‘বারান্দায় কফি’, ‘বইয়ের হাট’, ‘আকাশকুসুম’ ও ‘বৈঠক খানা’। শিগগিরই ছাদে শুরু হবে নতুন আয়োজন ‘চিলেকোঠায় কাবাব’। বারান্দায় কফি নামের আয়োজন দোতলায়। বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে বই পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেখানে। এখানে কবিতা পাঠের আসর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করা হয় মাঝেমধ্যেই, যেখানে উপস্থিত থাকেন লেখকেরাও। বেঙ্গল বইয়ের ‘বৈঠকখানা’য় কেউ পুরনো দুইটি বই ডোনেট করলে বিনিময়ে বেঙ্গল বইয়ের পুরনো সংগ্রহ থেকে নিতে পারবে সে একটি বই।

বেঙ্গল বইয়ের স্থাপত্যের নকশা করেছেন তাহমিদা আফরোজ। পুরো ভবনজুড়ে তিনি রেখেছেন সবুজের ছোঁয়া। তারই ধারাবাহিকতায় বেঙ্গল বইতে দেখা মিলবে ঝুলন্ত বারান্দার। এখান থেকে যে কোনো দেশি বিদেশি বই কেনা যাবে নির্দিষ্ট ডিসকাউন্টে। ভেতরে বসে সকাল নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত বই পড়া যাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। লাগবে না কোনো অর্থ কিংবা রেজিস্ট্রেশন।

দোতলাতেই রয়েছে ‘বইয়ের হাট’, যা আসলে বই কেনার জায়গা। এখানে রয়েছে ১২ হাজার আইটেমের প্রায় ৭০ হাজার বই। সবাই কিনতে পারবে এসব বই। অসুস্থ বা প্রতিবন্ধীরা হুইলচেয়ারে পুরো জায়গা ঘুরে নিজের পছন্দমাফিক বই কিনতে পারবে। রয়েছে বারান্দায় বসে কফি খাওয়ার ব্যবস্থা।

তৃতীয় তলাটা শিশুদের জন্য। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘আকাশকুসুম’। বাচ্চাদের বই পড়া ও খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে এখানে। পাওয়া যায় পাঠ্যপুস্তকও। খাতা-কলম-পেনসিল ছাড়াও মিলবে ছবি আঁকার কাগজ, তুলি, রঙ। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের জন্যও এখানে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সঙ্গে আসা অভিভাবকদের জন্য আছে ম্যাগাজিন পড়ার ব্যবস্থা।

নিজের বাসার মতো পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে বসে বই পড়ার সুযোগ বুক ক্যাফেগুলোর মধ্যে কেবল বেঙ্গল বইতেই পাওয়া যায়। চেয়ার-টেবিলে বসে বসে বই পড়া ছাড়াও দোতলার একপাশে এমন ব্যবস্থা করা আছে, যাতে পাঠক হেলান দিয়ে বা পা-তুলে বসেও বই পড়তে পারেন।

◤ ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থী ও ধানমন্ডির স্থানীয় অভিজাতদের গন্তব্য ‘দ্য নার্ডি বিন কফি হাউজ’ ◢

 

ইংরেজি সাহিত্য পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের স্বর্গরাজ্য বইলা যায় ধানমন্ডিতে অবস্থিত ‘দ্য নার্ডি বিন কফি হাউজ’কে। ভিনটেজ স্টাইলে করা অভ্যন্তরীণ সজ্জা ও মনোরম পরিবেশে কফির ধোঁয়া ওঠানোর সাথে সাথে হাতে ইংরেজি বই নিয়ে মেতে থাকতে অনেকেই ভিড় করছেন এখানে। তাদের বেশিরভাগই অবশ্য অল্পবয়স্ক বা তরুণ। এখানের ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহশালাটা বেশ ভালোই। হালকা স্ন্যাক, আড্ডা ও কফি থাকায় কিশোর কিশোরী পাঠকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এটি। মাঝেমধ্যে এখানে আয়োজন করা হয় লাইভ মিউজিকের।

◤ ‘কবিতা ক্যাফে’তে আয়োজিত নানারকম অনুষ্ঠানে আগমন ঘটছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ◢

 

কবিতা ক্যাফে চালু হয়েছে ২০১৮-এর সেপ্টেম্বর থেকে। এলিফ্যান্ট রোডে দীপনপুরের পাশের ভবনেই এর অবস্থান। ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে এনে পূর্ণাঙ্গ বুক ক্যাফে হিসেবেই এখন কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। তাদের সংগ্রহে রয়েছে ১২,০০০-এর মতো বই। ক্যাফেতে রয়েছে হালকা নাস্তা থেকে শুরু করে চাওমিন, বার্গারের মতো আইটেমও। এমনকি দুপুরের লাঞ্চেরও ব্যবস্থা রয়েছে। একপাশে ছোট একটি মঞ্চে নিয়মিত আয়োজিত হয় অনুষ্ঠানমালা। প্রতি সপ্তাহে ২-৩টি অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। শিল্প-সাহিত্যভিত্তিক অনুষ্ঠানই সেখানে বেশি হয়ে থাকে।

◤ সম্প্রতি চালু হওয়া নালন্দা বুক ক্যাফেতে রয়েছে দেশি, ভারতীয় বাংলা সেরা বইগুলোর সমাহার ◢

 

সম্প্রতি জুলাইয়ের ১২ তারিখে চালু হয়েছে ‘নালন্দা বুক ক্যাকে’ নামের নতুন বুকশপ ক্যাফে। এটিরও অবস্থান এলিফ্যান্ট রোডের দীপনপুরের পাশের ভবনে, কবিতা ক্যাফের পাশে। ১৫,০০০ বুক আইটেম নিয়ে বেশ ছিমছাম নকশায় চালু হয়েছে এটি। মোটামুটি স্বল্প পরিসরে পাঠকদের বুক ক্যাফের অভিজ্ঞতা প্রদান করতে সক্ষম। ভেতরে বসে বই পড়ার ও আড্ডা দিতে দিতে চা, কফি, সিঙ্গারা, সমুচার মতো খাবার উপভোগ করতে পারবেন পাঠকরা। দেশি বইয়ের ওপর এখানে রয়েছে ২৫% ডিসকাউন্ট এবং ভারতীয় বই কেনা যাবে গায়ের দামের ১.৬ গুণ টাকায়। ভিতরে অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে, তবে সেক্ষেত্রে তা হতে হবে কেবল শিল্প-সাহিত্যের ওপর।

বহুমুখী সুবিধা দিচ্ছে বলে এইসকল বুকশপ ক্যাফেগুলো প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছে সামাজিক মিলনমেলার এক উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। পাঠক বা কাস্টোমারদের জন্য এগুলো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে সপ্তাহের প্রতিটি দিন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর