ছেলের নখ কাটছিলাম। তখনই চোখে পড়ল ওর বাঁ পায়ের দুটো আঙুলের চামড়ায় ছোট ছোট কেমন দুটো দাগ! নেইলকাটার হাতে আমি গভীর আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় ওর আঙুলের দাগগুলো পরীক্ষা করতে থাকি আর মনে করতে থাকি, কবে কোথায় যেন এমন কিছু দাগ আগেও দেখেছি। সাত মাসের শিশুপুত্রের কুসুম-কোমল ও তুলতুলে দুটি পা আর পায়ের আঙুল। অথচ ছেলের আঙুলে স্পর্শ করলে চামড়ার আবরণটুকু হাতে বাজছে।
একটু আগে ওর মা ওকে গোসল করিয়ে, গায়ে লোশন মাখিয়ে, খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে, আমার হাতে নেইলকাটার ধরিয়ে দিয়ে নিজে গোসলে গেছে। যখন বাসায় থাকি, ছেলের নখ বড় দেখলে আমিই কেটে দিই। মাসে একবার ছুটিতে আসি বলে বলতে গেলে ছেলের পেছনে সময় দিতেই পারি না। লালনপালনের সব ধকল যায় ওর মায়ের ওপর দিয়ে। তবু ওর প্রতি ওর মায়ের সর্বস্ব করার পাশাপাশি আমার নখ কাটার কাজটাকে নিতান্ত সামান্য মনে হলেও যখনই পাই, এই সুযোগটুকু আমি গভীর আগ্রহের সাথে কাজে লাগাই।
ওর নখের ওপর চামড়া ওঠার লক্ষণটা আজই চোখে পড়ল এবং কেন পড়ল ও কোথায় দেখেছি ভাবনাটা যখন গভীর হচ্ছিল তখনই মনে পড়ল, আরে, আমার পায়েও তো ক’মাস আগে এমন দাগ ছিল। ডান পায়ের দুটো আঙুলে! আমার পায়ের দাগগুলো বেশ ভুগিয়েছে। প্রথম প্রথম চুলকাত খুব। এরপর চামড়া শক্ত হতে হতে একসময় একটু একটু করে উঠতে থাকল। ডাক্তার দেখালে জানতে পারলাম, এগজিমা। ছেলের আঙুলেও এমন কিছুর লক্ষণ না তো?
ছোট্ট শিশুপুত্রের আঙুলে কষ্টদায়ক ও বিশ্রী রোগটির কথা মনে হতেই মুহূর্তে একটা ভয়ের প্রেত আমার দিকে যেন ধাবিত হয়। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস হঠাৎ অনেক বেশি শীতল মনে হয়। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসায় চারপাশ ঝাপসা লাগে। ওয়ালক্লথের ওপর পদ্মাসনে বসেছি বলে নিজের পা দেখতে পারছি না। এতেই আপাতত স্বস্তি। কিন্তু আমার পায়ের প্রায় মুছতে থাকা দাগটার সাথে শিশুপুত্রের পায়ের আঙুলের দাগগুলো যে করেই হোক মিলিয়ে দেখব, দেখতেই হবে, ঝাপসা দৃষ্টিতে এমনটা যত দ্রুত ভাবছি তত দ্রুত আমার চারপাশ যেন শ্লথ হয়ে আসে। দ্রুত ভাবার চেষ্টা করি, এগজিমা এমন কোনো কঠিন রোগ নয় যে কখনো সারবে না। আমারটা যেমন সেরে যাচ্ছে, পুত্রের হয়ে গেলেও একদিন তা সেরে যাবে, এটা নিশ্চিত। তাহলে এত ভয় কেন পাচ্ছি আমি?
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী সুন্দর আর পবিত্র ওর ঘুমের ধরন, বুকের ওঠানামা!
সাত মাস আগে ক্লিনিকে ছেলে হবার সংবাদে অনেকেই জানতে চেয়েছে, ছেলে কার মতো দেখতে হয়েছে? মা না বাবা, কার মতো, আমি এর উত্তর তখন কাউকেই দিতে পারিনি। আসলে বুঝতেই পারিনি। ওর মুখটা এত নরম আর নিষ্পাপ ছিল যে, যতবার দেখেছি, একবারও ওকে আমি বা আমার স্ত্রীর মতো না ভেবে প্রতিবার ওর মতোই ভেবেছি। ভাবতে ভালো লেগেছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে দেখছি, কোথাও কোথাও আমি বা আমার স্ত্রীর অনেক কিছুর সাথেই ওর অনেক কিছু যেন কিভাবে কিভাবে মিলে যাচ্ছে। এবারই খেয়াল করলাম, ওর মুচকি হাসিটা ঠিক যেন আমারই মুচকি হাসি। পার্থক্য এটাই, আমি হাসির সময় ঠোঁটগুলোকে ডান গালের দিকে টেনে নিই আর ও টেনে নেয় বাম গালে। কিছুদিন আগে ওকে কোলে নিয়ে একবার চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসতেই সেও হেসে ওঠে আর তখন ওর হাসি আমার ভেতরে প্রচণ্ড একটা নাড়া দেয়। মুহূর্তের জাদুতে ভীষণ চমকে উঠি। মনে হয়, প্রকাণ্ড ও স্বচ্ছ একটা আয়নার সামনে স্নান শেষে আমি নিজেই হেসে উঠেছি। তখনই মূলত ওর মুচকি হাসির সাথে আমার হাসির সামঞ্জস্যের ব্যাপারটা খেয়াল করি।
আমার মুচকি হাসিটা পরিচিত সবারই পছন্দের। অনেকের ঈর্ষারও কারণ। আর সে কারণেই চেহারা বা স্বাস্থ্যের সবকিছু ছাপিয়ে মুচকি হাসির সাথে শিশুপুত্রের এমন দারুণ মিল টের পেয়ে ভীষণ শিহরিত হই আর কী আশ্চর্য, তখনই নিজের মনকে আমার কানে বারবার জপ করতে শুনি, শোনো, তুমি তার পিতা, তুমি তার পিতা! স্বর্গ ছুঁয়ে আসা গভীর মায়া ও মমতার এক চাদর জড়ানো পিতৃত্ববোধ তখন আমার ভেতর ধীরে ধীরে প্রবলভাবে জাগতে থাকে। তার হাসির শব্দে আমার গভীরে পবিত্র হাজারও সংগীত বেজে ওঠে। তার প্রতিটি নড়াচড়ায় আমাকে কৈশোরের চাঞ্চল্যে পায়, শিহরিত হই। তার প্রতিটি কান্নায় ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠি।
পুত্রের প্রতি শরীর ও মনের সাথে লেপ্টে থাকা মমত্ব ও পিতৃত্ববোধ থেকেই ভাবি, জন্মগতভাবে আমার সাথে আমার পুত্রের নানা মিল থাকাটাই তো স্বাভাবিক। মুচকি হাসির ব্যাপারটা আমার কাছে অধিক সুখের বলেই সম্ভবত, পুত্রের পায়ের আঙুলের দাগগুলো আমার পায়ের বিশ্রী দাগগুলোর মতো হতে পারে ভেবে অধিক দুঃখ পাবার আশঙ্কায় ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল আমার।
তার থেকেও বড় ভাবনা ও দুশ্চিন্তা আমায় পেয়ে বসে, যদি আমার কোঁকড়া চুলের সাথে ওর চুল মিলে যায়, যদি আমার মুচকি হাসির মতোই ও সারা জীবন হাসে, যদি আমার পায়ের দাগ ওর পায়েও এসে ঠাঁই নেয় তাহলে আমার কৃতকর্মের ভালো-মন্দও কি ওর জীবনকে একদিন ছুঁয়ে যাবে? যদি তাই হয় তবে সেও কি একটি বিড়ালহত্যার দায় নিয়ে বড় হবে? আমৃত্যু সশব্দ বিড়াল দেখে অনুশোচনায় ভুগবে?
বিড়ালহত্যার ঘটনাটা কি ভুলতে পেরেছি কখনো?
তখন গ্রামে থাকি। আমাদের আর ছোটচাচার ঘরের মাঝখানে ছিল এজমালি রান্নাঘর। রান্নাঘরে একটা গোলাপি ঠোঁটের সাদা বেড়াল সারাদিন ঘুরঘুর করত। বিড়ালটা ছিল ছোটচাচার। ছোটচাচা বিএডিসিতে চাকরি করতেন। বাড়ি আসতেন প্রতি মাসে দুবার। আর এসে সারাক্ষণ এই বিড়াল নিয়ে মেতে থাকতেন। বিড়াল কোলে নিয়ে খেতেন। ঘরের বাইরে যেতে বিড়াল পিছু নিলে মুখে চুচুচু শব্দ করে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে বিড়ালটিকে তিনি তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতেন। গোসলের সময় পুকুরঘাটে বিড়ালটিকে তিনি কসকো সাবান দিয়ে গোসল করাতেন।
লক্ষ করতাম, ছোটচাচা যতদিন বাড়ি থাকতেন ততদিন বিড়ালটা রাজার হালে থাকত। মাঝে মাঝে অধিক আনন্দে মোচ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিচিত্র সব শব্দ করে গজরাত। অকারণেই বিছানার আশেপাশে এসে গড়াগড়ি দিত। ছোটচাচার উপস্থিতিতে বিড়ালটির রাজাগিরি দেখে আমরা হাসতাম। ক্ষেত্রবিশেষ আমরাও নানা অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ করে ওকে গজরানোর উৎসাহ দিতাম। কিন্তু ছোটচাচার বিড়ালপ্রীতির বিপরীতে একজন মানুষ ছিলেন, যিনি আড়চোখে তাকিয়ে থাকতেন আর বিড়ালটিকে অসহ্য বলে তাড়িয়ে দিতে চাইতেন, তিনি আমাদের ছোটচাচী। ছোটচাচার বিড়ালটিকে যত পছন্দ ছোটচাচীর ছিল ঠিক তার বিপরীত কিন্তু অনেক দিন পরপর ছোটচাচা বাড়ি আসেন বলে, বিড়ালটিকে তিনি অনেক অনেক ভালোবাসেন বলে বা অন্য কী কারণে জানি না, ছোটচাচার উপস্থিতিতে ছোটচাচী প্রকাশ্যে বিড়ালটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন না বা নিতে বলেন না।
কিন্তু একবার, তখন ছোটচাচা বাড়ি নেই, কিভাবে যেন আমার চার মাসের চাচাত বোন যে চৌকির ওপর ঘুমিয়েছিল তার পায়ে বিড়ালটি আঁচড় কেটে বসে। ছোটবোনটি চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলে ছোটচাচী দৌড়ে আসেন ও ওর পায়ে আঁচড়ের দাগ দেখতে পান। দেখতে পান আঁচড়ের স্থানে বিন্দু বিন্দু রক্ত উঁকি দিয়েছে আর ওমনিই ছোটচাচী তীব্র হুংকারে হাতের কাছের ঝাড়ু দিয়ে বিড়ালটিকে মারতে গেলে বিড়ালটি ছোটচাচীর উদ্দেশ্য বুঝে গিয়ে কৌশলে ধানের গোলার নিচে পালিয়ে যায়। ছোটচাচীর নির্দেশে সেদিন থেকে শুরু হয় বিড়াল তাড়াবার কাজ। আর সে কাজ এসে জোটে আমাদের ওপর।
আমরা বিপুল উৎসাহে বিড়াল তাড়াবার কাজে লেগে পড়লাম।
একবার বিড়ালটিকে ধরে পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের দশ-বারোটি বাড়ি দূরে একজনের গোয়ালঘরে রেখে আসি। বাড়ি এসে বিরাট কিছু করে আসার ভঙ্গিতে ছোটচাচীকে যখন বিড়াল রেখে আসার কথা বলছিলাম তখন ছোটচাচী তর্জনীর ইশারায় চৌকির নিচে তাকাতে বললেন। চৌকির নিচে তাকিয়ে দেখি, বিড়ালটা দুপায়ের ওপর ভর দিয়ে মাথা সোজা করে বসে আছে। যেন কোথাও কিছু হয়নি এমন একটা আয়েশী ভাব। আমরা বাড়ি পৌঁছার আগেই সে কী করে বাড়ি ফিরে আসে! বিড়ালটির ফিরে আসায় তার স্মৃতিশক্তি ও দক্ষতা যত ফুটে ওঠে, ততই আমাদের ব্যর্থতার কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আর ততই ক্রোধে আমরা লাল হয়ে উঠি। বারো-তেরোর আমরা ব্যর্থতা মানতে পারি না।
পরদিন বিড়ালটিকে বস্তায় ভরে পাশের গ্রামের সুনশান গোরস্তানে রেখে এলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পরদিন দেখি, গোরস্তানে রেখে আসা বিড়াল ছোটচাচীর ঘরের সামনে এসে জোরে জোরে মিঞমিঞ ডাকছে। যেন কোথাও থেকে বেড়িয়ে এসে ভীষণ ক্ষুধার্ত, খেতে দিতে হবে। ছোটচাচী মুরগি তাড়াবার কোটা দিয়ে দৌড়ানি দেন। বিড়ালটি সে মুহূর্তে দৌড়ে পালালেও কিছুতেই বাড়ি ছাড়ল না। সেবার ছোটচাচা বাড়ি এলে ছোটচাচী আমার চার মাসের চাচাত বোনকে তাঁর কোলে দিয়ে বিড়ালের আঁচড়বৃত্তান্ত শোনান আর হাত দিয়ে বোনের দাগটাও দেখিয়ে দেন। এও বলেন, ‘এত্তগুলা রক্ত গেছে।’
বৃত্তান্ত শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হতাশ ছোটচাচা সিদ্ধান্ত দেন, ‘দাও, এটাকে তাড়িয়েই দাও।’
এর মধ্যে ছোটচাচার অনুপস্থিতিতে বিড়ালটি আরেকবার ছোটবোনকে আঁচড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটায় এবং আঁচড়ের স্থানে রক্তের উপস্থিতি মেলে। ছোটচাচী একহাতে ছোটবোনকে কোলে নিয়ে মেয়ের কান্না থামাবার চেষ্টা করেন আরেক হাতে লাঠি নিয়ে প্রচণ্ড রাগ ও ক্রোধে প্রাণান্ত চেষ্টায় বিড়ালটিকে খুঁজে বের করে আঘাত করার অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি বিড়ালের নাগাল পান না।
তখন বর্ষাকাল। আমরা নৌকা বেয়ে বিরাট হাওর পার হয়ে তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে যাই। একদিন ছোটচাচী স্কুলে যাবার আগে চুপিচুপি আমাদের কাজ বুঝিয়ে দেন আর বলে দেন, আমরা কেউ যেন ছোটচাচার মতো কোনো মায়া দেখাতে না যাই। ছোটচাচীকে এবার চূড়ান্ত সফলতার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বিড়ালটাকে চটের বস্তায় ভরে আমরা রওয়ানা দিই। নৌকা চলতে থাকে। স্রোতের অনুকূলে কিছুক্ষণ নৌকা চালাবার পর আমাদের গ্রামটা যখন নিজেদের চোখে ছোট ও ঝাপসা হয়ে আসে আর যথেষ্ট দূরবর্তী মনে হয় ঠিক তখন আমরা বস্তাবন্দী বিড়ালটিকে স্রোতাল পানিতে ছেড়ে দিই। বিড়ালটি তখন আকস্মিক পড়া বিপদে জোরে জোরে মিঞমিঞ করতে থাকে আর বস্তার ভেসে থাকা অংশগুলো দ্রুত নাড়িয়ে নাড়িয়ে পানির নিচে নামাতে থাকে। পাটের বস্তায় বন্দী বিড়ালটি কিছুক্ষণ ভেসে থাকার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে বিড়ালটির সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমরা কোনো মায়া না দেখিয়ে জোরে জোরে বৈঠা চালাতে থাকি। আর বিড়ালটির করুণ মিঞমিঞ ধীরে ধীরে আমাদের শ্রবণসীমা পার হয়ে যেতে থাকে।
বিড়ালটি আর ফিরে আসবে না আমরা এমন ধারণা করেছিলাম এবং তাই হয়েছিল। আমরা আর কখনোই বিড়ালটিকে দেখতে পাইনি। কিন্তু যেদিন আমরা বিড়ালটিকে হাওরের জলে ভাসিয়ে এলাম সেই রাতে আমি ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখি। দেখি, শিয়রের কাছে এসে বিড়ালটি আমার গাল চাটছে আর কাঁদতে কাঁদতে ডাকছে, ‘এই শোন, তোমার গায়ে এত রক্ত কেন?’ আমি বিড়ালের কথামতো নিজের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, সাদা স্যান্ডু গেঞ্জি রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে। একলাফে আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি আর আমার হাতের দশটি নখ দিয়ে টপটপ করে মাটিতে তাজা রক্ত পড়ছে। রক্তের প্রতিটি ফোঁটার যেন প্রাণ আছে। ঝরছে আর কাতর স্বরে শব্দ করছে, মিঞ মিঞ।
স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্মা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘কী হয়েছে বাবা?’ আমি কিছুই বলতে পারি না। কেবল কাঁপতে থাকি। বিরামহীন কাঁপুনিতে সে রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে আমার।
এরপর থেকে বহু বছর আমি যে কোনো বিড়ালের শব্দে কেঁপে উঠেছি। ছোটচাচার বিড়ালটি মেরে ফেলার দায়বোধ এখনো মন থেকে সরাতে পারিনি।
২.
আমার জন্ম গ্রামে হলেও আমার পুত্রের জন্ম শহরে এবং ও ওর মায়ের সঙ্গে শহরেই থাকে। কিন্তু শহরেও বিড়ালের উৎপাত আছে। প্রায়ই চোখে পড়ে। ভাবতে থাকি, আমার ছেলের জীবনেও কি এমন একটা বিড়ালের ঘটনা ঘটবে? অবশ্য নাও তো ঘটতে পারে। কিন্তু তবু আমার মুচকি হাসির সাথে ওর মুচকি হাসি মিলে যাওয়ায় পায়ের আঙুলের দাগের সাথে আমার পায়ের আঙুলের দাগ মিলে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েই যায়। আর যদি তাই হয় তবে একটা বিড়ালহত্যাই তো আমার জীবনের একমাত্র পাপ নয় যার জন্যে আমি সব সময় অনুশোচনায় ভুগি?
একহাতে শিশুপুত্রের পায়ের আঙুল আর অন্য হাতে নেইলকাটার নিয়ে তখন আমি গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে থাকি। যে সকল ভাবনায় আমার নিষিদ্ধ কৃতকর্ম জড়িয়ে আছে। যেসব কৃতকর্মের সঙ্গে আমার গোপনতর অনৈতিকতা বা পাপ জড়িয়ে আছে। ওসবও কি আমার পুত্রকে স্পর্শ করবে?
ও মাবুদ, আমি দশ বছর বয়সে মসজিদ থেকে দু-দুবার পাঁচ টাকার নোট চুরি করেছি।
ও মাবুদ, পরীক্ষার হলে বিশ্বস্ত বন্ধুদের ইচ্ছাকৃতভাবে আমি ভুল উত্তর বলে দিয়েছি।
ও মাবুদ, সরকারি কোষাগার থেকে ব্যক্তিগত একাউন্টে আমি অর্থ পাচার করেছি।
ও মাবুদ, স্ত্রী ছাড়াও আমি আরো আটটা নারীর স্তনে হাত দিয়েছি, চুমু খেয়েছি।
এমন আরো আরো অজস্র পাপে ভরা আমার জীবন কি মুচকি হাসির মতো, পায়ের আঙুলের মতো, মাথার চুলের মতো, শোয়ার ভঙ্গির মতো আমার নিষ্পাপ শিশুপুত্রকেও কলুষিত করবে? পিতার পাপে সেও কি জড়িয়ে যাবে এসবে? ও মাবুদ!
বাথরুমের ছিটকিনি খোলার শব্দ হয়। আমার স্ত্রী বেরিয়ে আসে। ও আমাকে দেখে অবাক হয়, ‘ছেলের পা ধরে বসে আছো? নখ কাটা হয়নি এখনো?’
আমি পদ্মাসন ছেড়ে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই ডান পাটা সামনে বেরিয়ে আসে আর পায়ের দিকে চোখ যেতেই আতঙ্কে চুপসে যাই, আমার পায়ের দাগের সাথে পুত্রের পায়ের দাগ অবিকল মিলে গেছে! আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি। আমার কান্নার শব্দে ছেলে জেগে ওঠে। পলকের আকস্মিকতায় হতবাক স্ত্রী এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে মহাবিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। গালে ঠান্ডা হাতে আদর করতে করতে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার?’
আহারে, আমার স্ত্রী এমনই দরদ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে যে, প্রশ্ন শুনে আমার কান্না আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ও তখন বাসায় থাকা আর কেউ যাতে আমার কান্না না দেখতে বা শুনতে পায় এজন্য দরজাটা আস্তে করে চাপিয়ে দেয়। এরপর ছেলেকে আমার কোলে নামিয়ে দিয়ে পিঠের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ও আমার কাঁধ স্পর্শ করে, ‘কী হয়েছে, আমায় বলবে?’
আমি কিছুটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করি, ‘একটা কথা বলব?’
ও হেসে ফেলে, ‘বলো না..।’
বাবার কান্না দেখেই মনে হয় ছেলে তার কান্না থামিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার টি-শার্টের ফেব্রিক্স নিয়ে টানতে থাকে। আমি আমার স্ত্রীর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘বিয়ের রাতে একটা কথা বলেছিলে, মনে আছে?’
ও কপাল সোজা করে, ‘কোন কথাটা?’
‘ওই যে বলেছিলে, আমার এমন কোনো কথা আছে কিনা যা তোমার কাছে গোপন করেছি? যদি থেকে থাকে তবে এ রাতে স্বীকার করতে, করলে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দেবে!’
ও ভ্রু নাড়ায়, ‘হ্যাঁ, তো?’
‘আমি আজ তোমাকে কিছু গোপন কথা বলব।’
‘বলো না।’
ওর চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না, ‘ছোটবেলায় আমি একটা বিড়াল মেরে ফেলেছিলাম।’
বিড়ালের কথা শুনে আমার স্ত্রী হো হো করে হেসে ওঠে। ওর হঠাৎ হাসি দেখে আমাদের ছেলে একবার হাসতে থাকা মায়ের দিকে আরেকবার ওর কাঁদোমুখো বাবার দিকে তাকায়।
‘একটা বিড়ালের জন্য এখন তুমি এভাবে কেঁদে উঠলে? একটা বিড়াল মেরেছো এই জন্য?’
‘শোন, আমি বিড়ালটাকে বস্তায় ভরে হাওরের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আমার সাথে আমার চাচাত ভাইবোনেরাও ছিল।’
ও শুনে কথাটা উড়িয়ে দেয়, ‘এটা কোনো ব্যাপার হলো? ছেলেবেলায় মানুষ বুঝে না-বুঝে অনেক ভুলই করে। এর জন্য এখন এত ভাবছো কেন বলো তো?’
এবার আমি ওর চোখের দিকে তাকাই, ‘আমি বিড়ালটাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি!’
ও তখন একটু কেঁপে ওঠে মনে হলো কিন্তু স্বীকার করে না, ‘এটা তোমার মনের দুর্বলতা। চলো, এখন খেতে চলো। বিড়ালের গল্প আরেকদিন শুনব।’
আমি থামি না, ‘আমি মসজিদ থেকে টাকা চুরি করেছি!’
খাট ছেড়ে ও উঠে দাঁড়ায়, ‘আজ কী হয়েছে তোমার, বলো তো?’
আমি ওঠার চেষ্টা করি না, ‘আমি কী বলি আগে শোনো…’
দাঁড় করাবার জন্য ও আমার একটা হাত ধরে টান দেয়, ‘বাদ দাও না প্লিজ। ছেলেবেলার ভুলভাল ছেলেবেলায় ফেলে এসেছো। এ বেলায় এসে এসব ভেবে কষ্ট পেয়ে তো লাভ নেই। খেতে চলো।’
‘আমি আমার বন্ধুদের ইচ্ছে করেই ঠকিয়েছি!’
‘আহ, আর নয় প্লিজ। থামো এবার।’
‘আমি আরো আরো অনেক ভুল করেছি, তোমাকে বলা দরকার।’
আমার স্ত্রী তখন খুব সহজভাবে এ প্রসঙ্গটা চাপা দেয়, ‘যে ভুলের কথা তুমি প্রথম রাতে বলতে পারোনি সে ভুলের কথা আমি আর কখনোই শুনতে চাই না। আমরা তো ভালো আছি। সেসবের চর্চা করে এখন আর কী লাভ? চলো তো, অনেক হয়েছে। এবার খেতে চলো। বাবুর ঘুম হয়নি। আবার ঘুম পাড়াতে হবে।’
আমার দৃষ্টি থেকে অসহায়ত্ব সরে না। স্ত্রীর চোখের দিকে একবার তাকাই, ও হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে আমাকে উঠে আসতে বলে। ছেলের দিকে তাকাতেই ছেলেও মুচকি হাসে। আহারে, কী মধুর আর মায়াময় সেই হাসি! আমি তখন ছেলেকে বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরি আর মনে মনে বলি, হে পরম করুণাময়, আমার পাপের জন্য ছেলেকে তুমি কষ্ট দিও না। আমার ছেলেকে তুমি রক্ষা করো। প্লিজ, রক্ষা করো।