প্রথমে আসুন দেখি মহান শিল্পীদের ক্ষতগুলো। মহান শিল্পীদের জীবনীতে প্রায়শই পড়ি তাঁদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার কথা। পড়ি, এবং ভীষণ বিভ্রান্তবোধ করি। ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিজীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তাঁর শিল্পের আদৌ আমি কী বিবেচনা করব? বোদলেয়ার বলেছিলেন তার হৃদয় নেই। বালজাক ব্রথেলে ব্রথেলে ঘুরে বেড়াতেন। দস্তয়ভস্কি প্রতিটি লেখা শুরুর আগে জুয়া খেলতেন এবং হেরে যাওয়ার পর যে বেদনাবোধ জাগত সেখান থেকে লিখতেন। বিপ্লবী লেনিনের কথাই বা ভুলে যাই কী করে? এপ্রিল থিসিস লিখছেন আর লেখা শেষে স্ক্রুপস্কায়া আবিষ্কার করলেন তার ঘরে একুশ লিটার ভদকার খালি বোতল। সতর্ক করলে লেনিন হাত তুলেছিলেন স্ক্রুপস্কায়ার ওপর। র্যাবো ড্রাগস না নিয়ে লিখতেই পারতেন না। কিন্তু তার সৃষ্টিগুলো যখন আমরা পড়ি তখন কি মনে থাকে সেসব কথা? বা প্রভাব ফেলে তাদের লেখা পড়ার সময়? উত্তর, না। অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক লেনিনই। লেনিনকে ভালোবাসি।
ভালোবাসি বোদলেয়ার, দস্তয়ভস্কি, র্যাবোকে। জানি একজন ব্যক্তিজীবনে খারাপ মানুষও ভালো সৃষ্টিশীল হতে পারেন। লেখকসত্তা ও ব্যক্তিসত্তা সম্পূর্ণ আলাদা এও মানি। কিন্তু যতই মহৎ হোক সেই শিল্পকীর্তি, তবু আমরা তার কানাকড়ি মূল্যও দেব কি? এ প্রশ্ন তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের কবি রনজিৎ দাশ। পণ্ডিতেরা বলেন, ভুল, এই বিচার ভুল। শিল্পীও একজন মানুষ, আর সব মানুষের মতো তার ভিতরেও রয়েছে একই সঙ্গে সাধু এবং শয়তান। নিজের ভিতরে এই সাধু-শয়তানের দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে তার শিল্প। সুতরাং, শিল্পীর ব্যক্তিজীবন দিয়ে তার শিল্পের বিচার এক মারাত্মক ভুল। পণ্ডিতেরা সর্বদাই এত ঠিক কথা বলেন! এত খাঁটি সত্য কথা! এবং রণজিৎ দাশ বলছেন সব সত্যই কী অদ্ভুত নির্মম! কোমলতার পক্ষে কি কোনো সত্য নেই? না, কোমলতার পক্ষে কোনো সত্য নেই, শুধু বেদনা রয়েছে। সেই বেদনার কাছে আমি আজীবন গুম হয়ে থাকি। দেখি যে, আমার মনে গোঁজ হয়ে আছে একটিই কঠিন কথা। কথাটা এই যে, শিল্পী হবার তাড়নায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সংসার ভেঙে দিয়ে, এবং নিজেদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে তার গ্রামের মামাবাড়িতে ফেলে রেখে, প্যারিসে এসে রদ্যাঁর শিষ্য বনে যাওয়ার জন্যে রিলকের সমস্ত কবিতা আমার কাছে অস্পৃশ্য মনে হয়; অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলোর গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্যে পিকাসোর সব ছবি আমি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারি। জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না। সেই অপরাধ, সেই আঘাত আরেকটি নীরব প্রাণে যে ক্ষত সৃষ্টি করে, শিল্পীর আজীবনের সকল শিল্পকর্ম দিয়েও সেই ক্ষতটির ক্ষমা হয় না, শুশ্রূষা হয় না। সমস্ত শিল্পের চেয়ে সেই ক্ষতটি বড়।
সমস্ত শিল্পের বিরুদ্ধে, সেই ক্ষতটিই ঈশ্বরের বা নিরীশ্বরের বিষণ্ণ কবিতাও বটে। সেই ক্ষতটি সেই বিষণ্ণ কবিতাটি রচিত হয় না বলে আমরা বিরচিত শিল্পকর্মগুলোর আস্বাদন নিই। মজার ব্যাপার রাজনীতিকদের চেয়ে এখানে ক্রিয়েটিভরা নেতিবাচকভাবে সুবিধাভোগী।
আমি বলছি না ভালো লেখক হওয়ার জন্যে ভালো চরিত্রবান হতেই হবে। শিল্পসৃষ্টি একটি টেকনিক। লেখক-শিল্পী-কবিদের নিয়ে অপবাদ কম নয়। তারা পাগলাটে, তারা নারীলোলুপ এমন অনেক কিছু। কিন্তু আপনি কোনো গ্রামারে বিচার করতে যাবেন না কোনো সম্প্রদায়কে। তবেই ভুল হবে। যেমন গ্রেগর সামসা নামের এক সেলসম্যান এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে একটা তেলাপোকায় পরিণত হয়ে গিয়েছে; কিন্তু বেচারা তখনও ভাবছে অফিসে যাওয়ার ট্রেনটা যেন আবার মিস না হয়ে যায় (গল্প ‘রূপান্তর’, মেটামরফসিস); জোসেফ কে. নামের এক নিরপরাধ ব্যাংকারকে একদিন সকালে অজানা এক অপরাধের দায়ে দুজন সরকারি এজেন্ট আকস্মিক গ্রেফতার করে বসে। জোসেফের প্রতিবেশি মহিলার ঘরে তার একটা ছোটখাটো বিচার হয়ে যায়। তাকে কেউ গ্রেফতার করে কোথাও নিয়ে যায় না, শুধু ‘মুক্ত’ভাবে ঘোরাফেরা করার অনুমতি আর পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার আদেশ দেওয়া হয় তাকে (উপন্যাস ‘বিচার’, ট্রায়াল)। এই যে কাফকা তিনি আজ বিশ্বখ্যাত। কিন্তু কাফকা তাঁর জীবদ্দশায় লেখক হিসেবে বলতে গেলে অপরিচিত ছিলেন; লেখা প্রকাশে তাঁর ছিল বিরাট অনীহা। কাফকা তাঁর সমস্ত লেখা ম্যাক্স ব্রডকে তাঁর মৃত্যুর পরে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন। কারণ তিনি খ্যাতি পছন্দ করতেন না। তার কোনো কিছুর প্রতিই মোহ ছিল না। সারাদিন কাজ করতেন। রাতে অসুস্থ স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন। কাফকা জীবনের বহু বছর যক্ষ্মা রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। কাফকা তাঁর জীবনে আসা নারীদের সঙ্গে অসম্ভব রকমের সৎ ছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ ও অসহায়। একই অবস্থা বাংলার জীবনানন্দ দাশের। জীবনানন্দ দাশের নোটবই থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ বেরিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘বিভাব’ জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ স্মরণ সংখ্যায়। কয়েকটি পড়া যাক :
২৩. ৭. ৩১
প্রেমে প্রেমে হয়তো আমার জীবন সুরভিত করে তুলতে পারত গেঁয়ো এক মেয়ে। ওয়াই তা পারে, তবু কত দূরে সে এসব থেকে। হয়তো সে তা-ই, তবু সে তা নয়… আহ, কোথায় যে খোঁজ পাওয়া যাবে তার… যদি পাওয়া যেত!
২৪. ৭. ৩১
হাতের ১০টা আঙুলেরই দরকার আছে। একটা কেটে গেলেই বুঝতে পারা যায়। আজ অনেক নোংরা লেগে যাওয়া এক দিন : আত্মার অপমান (প্রত্যেকটা কুকুর-বেড়ালকে আজ আমি কুর্ণিশ করেছি)। বিতাড়িত হয়েছে এক ব্যর্থ, এক বেকার, এক অসফল মানুষ : কম সফলতা দেখাও, তোষামোদ পাবে।
১৪. ৯. ৩১
স্ত্রী আর সন্তান গ্রহণের কারণে (এ জন্য ক্ষমাপ্রার্থী) অনুরাগ, প্রেম, এমনকি সহানুভূতি অব্দি থেকে আমার দাবি খারিজ হয়ে গেছে। ‘সাহায্য করো তোমার সহযোদ্ধাদের’ বরিশালের অধ্যাপক আর জনতার কাছে এ জন্য লজ্জিত। মায়ের ক্যাট্ ক্যাট্ খ্যাট্ খ্যাট্। কারো পৌরুষ বা আচরণের অবধারিত অবনমন আর অপমান—কারো কিছু বলার অধিকার নেই।
নোবেলজয়ী উইলিয়াম ফকনারের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতা লিখে। ১৮৮১ সালে একটি জনপ্রিয় রোমান্টিক উপন্যাস লেখেন যার নাম ছিল ‘দ্য হোয়াইট রোজ অভ মেমফিস’। এই বইটি লেখার সময় তিনি লিডা এস্টেলের প্রেমে মত্ত। লিডা একটু প্যারানয়েড ছিলেন। ফকনার তাকে স্যানাটোরিয়ামে দেখতে যেতেন। লিডা অসুস্থ বলেই না বুঝে ফকনারকে মারতেন। শরীরে চুরুটের ছ্যাঁকা দিতেন। কিন্তু এসব কিছুই সহ্য করে ফকনার বইটি লিখেছেন। এবং ১৯২৯ সালেই তিনি তাঁর স্কুলজীবনের বান্ধবী লিডা এস্টেল ওল্ডহ্যাম ফ্র্যাংকলিনকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে দুই মেয়ে হয়। তার জীবনে অনেক ভক্ত নারী এসেছিলেন। কিন্তু তিনি সবসময়ই বিশ্বস্ত ছিলেন লিডার। ফকনার মোট ১৯টি উপন্যাস ও বহু ছোট গল্প লেখেন। চিত্রশিল্পী ভ্যানগগ তো প্রেমিকার জন্য মানসিক ভারসাম্য হারালেন। পাগলাগারদে আঁকলেন সেরা পেইন্টিং ‘ইয়েলো গার্ডেন’। কান কাটার প্রচলিত গল্প থাক, না বলাই ভালো, কিন্তু ভ্যানগগ একবার প্যারিসের টেসস শহরে গেলেন ইন্ডাভার সঙ্গে দেখা করতে। প্রেমিকা বললেন, ‘তুমি আর্টিস্ট হয়ো না। আর্টিস্টদের জীবন গোছানো হয় না। তুমি বরং ব্যাংকে জব করো। বিশ্বাস করবেন, ভ্যানগগ এরপর সাতবছর পেইন্টিং করেননি। এবং কডওয়েল ব্যাংকে কেরানির চাকরি করেছেন। কিন্তু তারপর যখন তার প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখান করল তখনই তিনি ফের পেইন্টিংয়ে ফিরে এলেন এবং সেরা কাজগুলো করলেন।
ইতালীয় লেখক যার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্যা জার্মিনাল’, হ্যাঁ, আমি ‘এমিল জোলা’র কথাই বলছি। সেই এমিল জোলা, যেদিন তার বউ সুইসাইড করলেন, সেদিন তিনিও আত্মহত্যা করতে গেলেন। কিন্তু মারা গেলেন না ঘটনাক্রমে। পরের বছেরগুলো অবসাদে ভুগতেন।
আহা ডিলানটমাস, তাকে নিয়ে কত বদনাম! ব্রথেলে যেতেন। মদ খেতেন। এসব মিথ্যা নয়। কিন্তু সত্য ছিল অন্যরূপে। কী সেটি? ডিলান টমাসের মা ছিলেন সেক্স ওয়ার্কার। তো ডিলান কিশোর বয়স থেকেই তার মাকে খুঁজতে ব্রথেলে যেতেন। কিন্তু কারো সাথে শুতেন না।
ডিলানের আকুতি ও হাহাকার আপনারা শুনতে পান?