ক্ষতচিহ্ন

অনুবাদ গল্প, শিল্প-সাহিত্য

মুস্তাক আহমদ মুস্তাক | 2023-09-01 22:34:30

অনুবাদ : ফজল হাসান

সিঁড়ি ঝাড়পোছ করার জন্য পিয়ারী এই নিয়ে তিনবার উপরে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার জন্য ইতোমধ্যে সেখানে লালা সায়েব নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। পিয়ারীর চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠে। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে লালা সায়েবের দিকে তাকায়, কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। ভীষণ রাগে পিয়ারী ফুঁসতে থাকে। লালা সায়েব ধীরেসুস্থে বসেন। এরই মধ্যে বিকেলটা পশ্চিমে ঝুলে পড়েছে এবং ছায়া এসে ঢেকে দিয়েছে আঙিনা। সূর্যের মলিন আলোয় বাগানের একমাত্র ডালিম গাছের ঝোপের মাথা জ্বলজ্বলে দেখাচ্ছে। সবুজতা ছাড়া এবং পুষ্পবিহীন বেচারা বাগানটা দেখতে একগোছা শুকনো ও মরা ডালপালার মতো লাগে।

বাগানের মধ্যে ক্ষতচিহ্নের মতো দেখতে ডালিম ঝোপের জঞ্জাল কেটে ফেলার জন্য পিয়ারী অনেকবার তার স্বামীকে বলেছে। কিন্তু লালা সাহেব তাদের থামিয়েছেন। লালা সায়েবের সঙ্গে পিয়ারীর প্রায় প্রতিটি বিষয়ে, বিশেষ করে শীর্ণ-জীর্ণ ও শুষ্ক ডালিম গাছের ঝোপ নিয়ে, কথা কাটাকাটি হয়। তারপরও তারা একই বাড়িতে বসবাস করে।

কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে লালা সায়েব পেনশনে আছেন। অবসর নেওয়ার পরে প্রথম দিকে তিনি অফিসের কাছাকাছি সময়ে বাইরে বের হতেন। ঘরের মধ্যে অনেক ধরনের কাজকর্ম সেরে তিনি খবরের কাগজ পড়ার জন্য গ্রন্থাগারে যেতেন। এছাড়া তিনি নাপিতের দোকানে গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন এবং সকল আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতেন। অনেক সময় রান্নাঘরে স্ত্রীর কাজেও সাহায্য করতেন। একদিন তার স্ত্রী দেহত্যাগ করে এবং তিনি ‘শর্করা রোগ’-এ আক্রান্ত হন। তাঁর জীবনে এমন এক সময় আসে যখন তিনি আশেপাশে হাঁটাচলা করতে পারেন না, এমনকি পেনশন তুলতেও যেতে পারেন না। তিনি হয় ঘরের মধ্যে বিশ্রাম করেন, নতুবা নির্বিকার বসে গভীর ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন। মনের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন আনার জন্য মাঝে মাঝে টেলিভিশন দেখেন। যখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না, তখন তিনি বারান্দায় বসেন এবং ডালিম গাছের ঝোপের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন।

রোদের বিবর্ণ আলোয় লালা সায়েবের ক্ষণস্থায়ী ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিল যে শুকনো ডালিম গাছে পুনরায় পাতা ধরবে এবং লাল ফুলে আবার সয়লাব হয়ে উজ্জ্বল দেখাবে। তাঁর মনে পড়ে, ত্রিশ কিংবা পঁত্রিশ বছর আগের দৃশ্য। তখন তাঁর মাটির ঘরের চারপাশে ডালিম ফুলে ভরা থাকত। তিন কন্যা সন্তানের জন্মের পরে ছেলের জন্ম হওয়ার সুবাদে বাড়িতে আনন্দ-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর সেই শিশু ছেলে স্কুলে যাওয়ার আগে বড় বোনদের সঙ্গে একই ডালিম বাগানে দৌড়াদৌড়ি করত। বোনেরা ছোট ভাইকে শাহজাদাহ্ (রাজকুমার) বলে ডাকত।

লালা সায়েব এবং তাঁর স্ত্রীর মনে হতো তারা দু জনেই জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি পেয়েছেন এবং সবটুকু আনন্দ উপভোগ করেছেন। তাঁদের কোনো কিছুতেই অভাব ছিল না, এমনকি কোনো ব্যাপারে তাঁরা নিঃসহায়ও ছিলেন না। দিনে দিনে শাহাজাদাহ্ বড় হতে থাকে। যেখানে ডালিম গাছের ঝোপ ছিল, সেখানেই লালা সায়েবের ভাইয়েরা নতুন বাড়িঘর তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ডালিম গাছ কেটে ফেলে।

প্রথমে সাবা লালা নিজের জন্য বাড়ি তৈরি করেন। তারপর বাড়ি নির্মাণ করেন গোলাম রসুল এবং সব শেষে লালা সায়েব। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পরে লালা সায়েবের কাছে যা অর্থকড়ি অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে তিনি পাকা বাড়ি তৈরি করেন। তার কারণ ছিল, শাহজাদা যেন চাচাত ভাইবোনের তুলনায় কখনোই নিজেকে গরীব না ভাবে।

বাড়ি তৈরি করার সময় প্রায় সবগুলো ডালিম গাছ কাটা হয়। বর্তমানে ডালিম ঝোপের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা বাড়ির সীমানার একপাশে। লালা সায়েবের স্ত্রী দেখভাল করার কারণে বর্তমানের গাছগুলো কাটা হয়নি। কংক্রিটের দেওয়ালের পাশে থাকা সত্ত্বেও গাছগুলো প্রতিবছর ডালপালা গজিয়ে তরতাজা হতো। কিন্তু লালা সায়েবের স্ত্রী স্বর্গের পথে যাত্রা করলে গাছগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে।

লালা সায়েব অথৈ ভাবনার গভীরে হারিয়ে গেলে তাঁর চোখ আটকে থাকে শুষ্ক ডালিম গাছের ঝোপে। অকস্মাৎ পিয়ারী ঘরের ভেতর টেলিভিশন চালু করে। তখন সন্ধ্যার খবর হচ্ছিল। লালা সায়েব খবর শুনে চমকে ওঠেন যখন তিনি স্পষ্ট শুনেছেন, ‘মানবতার কারণে আজ দুইশ যুবককে চাকুরি দেওয়ার হুকুম জারি করা হয়েছে।’

‘তাহলে শেষপর্যন্ত সরকার একটা কিছু করার পদক্ষেপ নিয়েছে। আল্লাহ যদি সহায় থাকেন, তাহলে আমাদের শাহজাদাহ্ জীবনে সুস্থির হতে পারবে’—লালা সায়েব স্বগোক্তির মতো করে বললেন। একটু থেমে তিনি আপনমনে আরো বললেন, ‘বৃদ্ধ বয়সের প্রতিটি দিনই পাহাড়ের মতো ভারী মনে হয়। এখন আমি অন্য দুনিয়ায় যেতে চাই। কিন্তু সে কী করবে? সে একটা দোকান শুরু করেছে, কিন্তু কোনো সাফল্য নেই। আমি খুশি যে, সে আমার পেনশন থেকে সামান্য অর্থকড়ি নিয়ে কোনোভাবে চলছে। আমি আশাকরি সে শীঘ্রই একটা চাকুরি পাবে। তাহলে আমি শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারব।’

এসব ভাবনা-চিন্তা মাথায় নিয়ে লালা সায়েব পুনরায় শুষ্ক ডালিম ঝোপের দিকে তাকান। গোধূলির আলো প্রায় নিভে গেছে। লন এবং সারিবদ্ধভাবে লাগানো ফুলগাছের সঙ্গে জরাজীর্ণ ডালিম ঝোপের শুকনো অংশ সত্যি বেমানান লাগছিল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তিনি দেওয়ালে ভর করে উঠে দাঁড়ান এবং শোবার ঘরে প্রবেশ করেন।

একটু পরে পিয়ারী এসে তাঁকে ঔষধ খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। লালা সায়েব ঔষধ সম্পর্কে কিছুই বললেন না, বরং তিনি পিয়ারীকে জিজ্ঞেস করলেন সে খবর শুনেছে কি না।

‘তারা বলেছে যে, সরকার দুইশ যুবককে চাকুরি দেওয়ার হুকুম দিয়েছে’—পিয়ারী বলল। বলার সময় তার কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠে।
‘তাহলে তুমি শাহজাদাহকে বলছো না কেন যে সে কিছু অর্থকড়ি রোজগার করে এবং নিজের জীবন শুরু করে। সেটা আমার মৃত্যুকে সহজ করে দিবে’—লালা সায়েব খুবই ভীত গলায় বললেন।
‘কীসব আজেবাজে বলছেন? এই অশান্ত সময়ে যারা আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছে, দুইশ চাকুরি তাদের জন্য’—মুখ ঝামটা দিয়ে বলল পিয়ারী। তারপর সে আরো বলল, ‘আলতামাশ, শাহজাদাহ্’র বন্ধু, আপনি ওকে চেনেন, চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছে। আপনি তো জানেন, ওর বাবা পেনশনের টাকা তুলতে ব্যাংকে যাচ্ছিলেন এবং পথেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আলতামাশ শুধু চাকুরিই পায়নি, তার সঙ্গে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লক্ষ রুপিও পেয়েছে’—বলেই পিয়ারী আরেকবার মুখ ঝামটা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

পিয়ারীর কথা শোনার পরে লালা সায়েবের সারা শরীরে ঠান্ডা ঘামের স্রোত বয়ে যায়। তিনি রীতিমতো স্তম্ভিত, হতবাক। তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে, কয়েকজন ক্রুদ্ধ লোক কুঠার নিয়ে এসে শুষ্ক ডালিম গাছের ঝোপ কেটে পরিষ্কার করছে।

সমকালীন কাশ্মিরী সাহিত্যের অন্যতম লেখক মুস্তাক আহমদ মুস্তাক। তিনি একজন ছোটগল্প লেখক। এছাড়াও তিনি কাশ্মিরের একজন প্রসিদ্ধ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় ছোটগল্প সংকলন ‘দ্য স্কার’-এর জন্য তিনি ২০১৮ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমির ‘শ্রেষ্ঠ গল্পগ্রন্থ’ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্প সংকলন এবং প্রকাশের পরপরই পাঠক সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর জন্য তিনি ২০১৪ সালে ‘জম্মু ও কাশ্মির অ্যাকাডেমি অব আর্ট, কালার এবং লেঙ্গুয়েজ’ থেকে কাশ্মিরের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প সংকলন পুরস্কার অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি শ্রীনগরে বসবাস করেন এবং সেখানে রেডিও কাশ্মিরের আঞ্চলিক সংবাদ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগতভাবে নিয়োজিত আছেন।

‘ক্ষতচিহ্ন’ গল্পটি মুস্তাক আহমদ মুস্তাকের ‘দ্য স্কার’ গল্পের অনুবাদ। কাশ্মিরী ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন প্রফেসর শাফি শৌক। ইংরেজিতে গল্পটি ‘কাশ্মির লিট’ সাহিত্য ম্যাগাজিনে (৩০ জানুয়ারি ২০১৯) প্রকাশিত হয় এবং বাংলায় অনুবাদের জন্য সেখান থেকেই নেওয়া হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর