জংগলঘেরা কবরস্থানে ঠাঁয় দাঁড়ানো ডালিম গাছটায় একটা মাত্র ডালিম তেরো বছর যাবৎ পেকে টনটন করলেও কালের ঝাপটায় বোঁটা থেকে কেন খসে পড়ছে না এবং ফাঁটলের রসালো দানায় পাখিদেরও কেন ভ্রক্ষেপ নাই, ভাবতে ভাবতে কফিল সাধু হঠাৎ টের পায় একটা শুকনো ডালিমপাতা চক্কর দিয়ে এসে আটকে পড়েছে তার চুলে। চুল বলতে চিরুনি করা রুচির বিন্যাস নয়, ভাটার মৌসুমে মজা পুকুর থেকে ডাঙায় তোলা পানাকচুর তাজা শেকড়ও নয়। রোদের আঁচে পচা জলের রেণু শুকিয়ে পানার শেকড়ে মেটে প্রলেপ পড়লে যে চেহারা দাঁড়ায় কফিল সাধুর চুলে তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। চুলের জটায় আটকে পড়া ঝরা পাতাটি তুলে এনে দুই হাতের তালুতে পিষে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিতে থাকে কফিল সাধু। কবে কোথায় কিসের সাধানা করে ভাটিবয়েসী এই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষটা ‘সাধু’ নামের তকমা পেয়েছে, কেউ বলতে পারে না। জানা যায় তল্লাটের স্থায়ী বাসিন্দারা একটা বিশেষ ঘটনার পরে একদিন হঠাৎ তাকে সাধু নামে ডাকতে শুরু করেছিল। পরে গলা থেকে অন্য গলায় নানা সূত্রে নানা ছত্রে সেই নাম ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামান্তরে সেই ঘটনার রেশ পৌঁছে যেতে সময় লাগে না। গ্রামের ঘটনা দিনে দিনে রাষ্ট্র হয়ে যায়। পেছনে একটা ঝাপসা বিত্তান্ত অবশ্য আছে। তবে পরিস্থিতির তোপে সামনের দিকে যেভাবে তাকে পা চালাতে হয়েছিল তাতে পেছনের সেই কাহিনী কাফনের পুটলায় মৃতের মতো আটকা পড়ে যায়।
সাঁওতাল পাড়ার পশ্চিম কোণা থেকে হাতশতেক এগিয়ে কাসিন্দা নদীর পাড়ঘেঁষা এই জংগলে জনবসতির চিহ্ন মেলা ভার। একটা গা-ছমছম কবরস্থান, গুটি কতেক পাকা কবর এখানে ওখানে যার যার মতো একা পড়ে আছে। সুরকি-সিমেন্ট-বালির গাঁধুনিতে যত্ন করে বাঁধানো হয়েছিল বোঝা যায়, তবে ছত্রাকে খাওয়া, পুরনো, টোটাফাটা সেই নির্জন স্থাপনা দেখে কল্পনার আশ্রয় ছাড়া এখন আর পুরো ছবি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এপিটাফ বা নামফলকের বালাই মাত্র চোখে পড়বে না। মূল চত্বরের ঠিক মাঝখানে চারকোণা পোস্তাই করা ঘাসে ঢাকা যে কবর, তার চারদিকে পাথরের চাই ফেলে বহু আগে পোক্ত করা হয়েছিল, এমনটাই ধারণা করা যায়। হঠাৎ এসে যে-কেউ বুঝতে পারবে কাছাকাছি কালের মধ্যে কাঁচা লাশ কবরে নামানো হয় নাই। এমনকি নিকটকালে জমিনে বা প্রাচীরে কোথাও কোনো প্রকার সংস্কার হয়েছে তারও কোনো চিহ্ন মিলবে না। অজানা ভয় যেন রাজ্যপাট খুলে বসেছে রহস্যময় এই বনজ তল্লাটে। নীরবতা নয়, গাছের ডালে প্রতিধ্বনি করে ফিরে আসা বাতাসের সঙ্গে চেনা-অচেনা পাখিদের হাহাকার মিশে কান্নার মতো একটা জরুরি আবহ চারপাশে। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই হেলে পড়া বিকালের যে মুহূর্তে কফিল এখানে আসে নদীর ওপাড়ে ডুবুডুবু সূর্যের লালিমা তখন আধমাঝারি গাছপালা এবং ঘনবুনট ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে ঝুলন্ত ডালিম ফলটার সিঁদুরে চামড়ায় এসে ঠিকরে পড়েছে। কফিল তখন যা বোঝার বুঝে ফেলে, এবং একটা অনুমান তাকে সত্যের দিকে টেনে নিচ্ছে বলে অনুভব করে। একাগ্র ধ্যানের স্থিরতায় সে স্মরণ করে অরণ্যের একটা প্রতিধ্বনির স্বরে তাকে তো এমন একটা স্থানের কথাই বলা হয়েছিল সেই কতকাল আগে, ইশারাভাষায়। আবহমান প্রকৃতির আভাস থেকে তখনই সে প্রথম বুঝতে পেরেছিল, যে-মাটিতে জন্ম তার, সেই উর্বরতার আঞ্চলিক আকর্ষণে আটকে থাকলে কাঙ্ক্ষিতের ঠিকানা সে কোনোদিনও খুঁজে পাবে না।
রটনা-কুৎসা-গালমন্দ-গুজব-নিন্দা-নিগৃহ পেছনে ফেলে সন্ধ্যার আকাশের মতো মনে বেরিয়ে পড়ে কফিল সাধু। যে দোষে তাকে এই অবজ্ঞার ভার বইতে হচ্ছে তা কেবল তার এক সত্য অনুভূতি। নিজের একান্ত পরগনা ছেড়ে পরভূমির দিকে তার যাত্রা শুরু। কোথায়, কত দূরে তা-ও যে তার জানার আয়ত্তে নয়। বারান্দায় কুপি জ্বেলে সংখ্যালঘুর দেশত্যাগের মতো একটা করুণা ঘন হয়ে ওঠে সবখানে। কিন্তু অপমান ও অভিমানের হাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে এর যে বিকল্প নাই, এটুকু বুঝতে সময় লাগে না কফিল সাধুর। তাই সে চেনা জগতের চৌহদ্দি পেরিয়ে অজানার পথে পা বাড়ানোর আগে টলটলে চোখের পানিতে নিজেকে অটল রাখে। পাকা ফসলের ঘ্রাণ, শৈশবের দগদগে স্মৃতি, মায়ের কবরে ফোটা জংলি ফুলের সুবাস, দুধের বাটি, মধুর পেয়ালা, ঘিয়ের বোতল, কেরোসিন শিখা কিছুই তাকে আটকাতে পারে না। চেতনার ডানা জুড়ে অস্থিরতা। ফ্লাইট ছেড়ে দেবে এমন এক টানটান উত্তেজনা। কপালে আগুন লাগার সমস্ত সিকোয়েন্স মিলে একটা সেলুলয়েড। বোতাম চাপার ফুরসুৎ নাই, খুলির খোড়লে সবকিছু অটোমেটিক ঘোরে, ঘুরতে থাকে।
কফিল সাধু হাঁটে, যেমন মানুষ মাত্রই হাঁটে, সে রকম নয় তার হাঁটা। এক পা এগুলে যখন মাটির ওপরে তালু সুস্থিত, আরেক পা তখনই উঠে আসবে এমনটা নয়; হাঁটার সঙ্গে তাকে খুঁটিয়ে দেখতে হয় রাস্তার তিনপাশ। পেছনটায় না তাকালেও চলে। চলার মন্থরায় ভবের ভাবনা তাকে মাটির তলায় দাবিয়ে রাখতে চায়। পায়ের পাতায় চুম্বক কষা যেন। একবার উঠে তো আরেক বারের নাম নাই। কফিল সাধুর মন ভাবনার নিথর সরোবর; ভাবে জরায়ুর পথে কৃমির মতো পিছলে এসে একদিন সে কেঁদে উঠেছিল। চিকন গলার তীব্র স্বরে পৃথিবী জেনেছিল একজন এসে গেছে। কত কী করার ছিল তার! বর্তমানের ঘোরে সেসব আর প্রাসঙ্গিক নয় তার কাছে। পায়ের কাছ থেকে চোখ তুলে অনুভূমির দিকে যখন দৃষ্টি বোলায়, দেখে রাস্তা নয়, চুলের ফিতাই কেবল বিছানো রয়েছে দিগন্তের শেষ চিহ্ন অবধি।
সম্বিৎ ফিরে পেলে দেখে, রাস্তা রাস্তাই—সুরকি মাটির আলগা সরণি। মরিচার রঙে চনমনে, তবু হাহাকারের সকল বাজনা বেজে উঠছে মাটির কোরক ফেটে। দুই পাশে ঝোঁপঝাড়, আলুক্ষেত, আনারস বাগান, গণ্ডারের পাল, রশি ধরে কাতারে লাগানো ধানের চারা, দিগন্তের আধাবৃত্ত এবং ব্রহ্মাণ্ডের বিস্ময় বেছানো সারে সারে। যেতে যেতে অবচেতনায় বরফ জমে ঢের। যে হৃদয় মেলে পেছনের খুনখারাপি দেখে দেখে অবশ হয়েছে, কোথায় সেই তাজা মাংসের প্রকৃত ঠিকুজি। অন্তর কী জিনিস, মনের বসতি কোথায়, দেহের ঘরে কামের বাতিই কি জ্বলে ধিকধিক! আর কিছু কি নাই, এর চেয়ে মহত্তর, আর কিছু কি নাই চরাচরে! সে কেবল টের পায় মনের পরিধি জুড়ে অ্যান্টার্কটিকা, জীবনের অজস্র জারক একটা গোলার্ধে এসে একান্ত জমাট। তার পরে কালো বরফের সেই মহাদেশ চাঁদের আলোয় ছমছম করে করে ওঠে। কালোর কেন্দ্রে এক গোলাকার মুখ। চায়ের গুঁড়ায় জড়ানো। তারার কণায় ঢাকা চাঁদ। বরফের ফ্রেমে আটকানো। আরো এক বস্তু তার কোল ঘেঁষে—জমাট বাঁধা পানির কেলাসে একটা হিরের ছুরি, গোড়ার দিকটা দাবানো, চূড়ার ভাগটা মুহূর্তের দিকে তাক করা। ফলায় রক্ত ফিনিক। ঘটনার প্রতিটি স্বাক্ষর নীরব অক্ষরে ঝিলমিল। দুই চোয়ালের আভা ডালিমের রক্তিমতা নিয়ে অসহ্য আলোর ঘোরে উচ্চকিত।
আসল বিষয় কি নারী, কফিল সাধু ভাবে, হ্যাঁ, তাকেই তো আনাড়ী কৈশোরে তীব্র আলোয় দেখেছি, ঘন অন্ধকারের ঘাটলায় বসে জলের মতো সহজ আদরে ছুঁয়েছি। রাক্ষসের চোপা থেকে খসিয়ে এনে এই অজর কুসুম আমিই তো সাজিয়ে রেখেছি যত্নের অধিক যত্নে...। তার মনে হয় সেই নারী নক্ষত্রের ধাপ থেকে নেমেছিল আলোর ঘুঙুর পরা পায়ে, পৃথিবীর ক্লেদজ মাটিতে। আনাজ তরকারি কোটা মেয়ে। কৃষি জীবনের উর্বরতায় ফলবতী দেহ। জংলি গাবের মতো অগঠিত মনোহর স্তন। তার সেই কষটে কথার ঘায়ে কতবার ঘায়েল হয়েছে কফিল সাধু, কতবার তার ছলনার কাছে পরাভূত। কত পঙ্গপাল ছিল চারদিকে, কত দুধের মাছি, কত আঙুল ফোলা কলাগাছ। কিছু মুখ তার চোখে ভাসে—কালু গায়েনের ছেলে বখাটে হাবলু, মতি খরিফার খালাত ভাই কালা মগদুম। সবাই চেয়েছে অধিকার তাদের হাতেই ধরা থাকুক। যতই ময়লা থাকুক সেইসব হাতে, তবু তারা অধিকার পুরে নিতে চাইবে মুঠোয়, সেও তো স্বাভাবিক। কিন্তু মৃতের দেহ কেন লণ্ডভণ্ড হবে, কেন মাছির লালসার কাছে হেরে যাবে নির্দোষ মাংসপুঞ্জ! তার বুকে একটা বিষণ্ন বিজলি রেখা ছলকে ওঠে : হাবিল-কাবিলের এই চিরায়ত সংঘাতে কফিলই তো জিতেছিল। এমনকি একদিক থেকে সেই জয় তার হাতে এখনও তো ধরাই আছে। জয় করা মহাদেশ চায়ের পাতায়, বরফের চাইয়ে আটকা পড়ে গেছে এ-ই মাত্র দুঃখ তার।
চোখের আলোয় দৃশ্য নাইবা জাগুক, কল্পনার ধূসর বলয়ে তাকে তো দেখাই যাচ্ছে। সেখানে ঘাসে ঢাকা আয়তকার মাটি তাকে নিশ্চয়ই বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে। মনে ভাসে কাঠের খোলে শুয়েছিল সেই নিসর্গপ্রতিম নারী, আদুরে দেহের খোল ও কঙ্কাল। সেই নারী। আঙুর দানার মতো কান্না দুই চোখে, সূর্যোদয়ের মতো হাসি। মাছের আঁশটে ভরা শাড়ি। চারপাশে দুধকলায় পোষা সাপ। চিকন আলপথ বেয়ে আসা সেইসব সরীসৃপ অঙ্গের সুষমায় লোভাতুর। পশুর অবুঝ ক্ষুধা গনগনে। ক্ষুধার তাপে মাঠের সবুজ ছারখার। কতকাল ধরে কামের বিজলি ডাকা আকাশ ঢলাঢলি করে এসে ঝলসে দিতে চাইত লোকজ রূপের মাধুরী। জলার ঢেউ ভেঙে কেউ আসত পেঁচিয়ে ধরতে, ডাঙার ঘুপচি থেকে কেউ আসত ঘামের রেণুতে জবজববে। নাঙা লালসায় অকপট পশু। মেঘের বিদ্যুতে জ্বলে ওঠা কাম একদিন হারায় তার সমস্ত সীমা। ঠাটা পড়ে অচিন গ্রামদেশে। মগড়া গ্রাম। রক্তস্রোতা নদীর ধারায় ধোয়া লাল মাটির দেশ। রক্তবৃষ্টি থেকে তরতর বড়ে ওঠে গাছপালা, সারে সারে বিষবৃক্ষ। জনপদ ঘেঁষে ঘেঁষে অবারিত হেমলকের বন। সেই দেশের শ্যামলবরণ মেয়ে হঠাৎ চিরবিছানায় শুয়ে প্রমাণ করে দিল কতটা লাবণ্য ছিল তার, কতটা গুণের সৌরভ। শাড়ির বাঁধন উপচিয়ে গলে পড়ল পোড়া মাংসের স্রোত। গঞ্জের হাট থেকে কফিন এলো ঘরে। মার্কিনের শোভাও যে এত মনোহর হতে পারে কফিল ছাড়া কেউ বুঝবে না। সাধু কফিল। তার সেই আত্মপ্রতিমা নারীকে মাটির নিচে পুঁতে রাখার আগে বরফের সুরক্ষা চাই তার, চায়ের ভেষজ গুণে গন্ধনাশক সাময়িক সুরক্ষা নয়, পাথরে বাঁধানো ফ্রেমে কালের অব্যর্থ সূচক। অবশেষে বওড়া বাঁশের খোলে শুইয়ে দেওয়া হলো কাফনে মোড়ানো ছায়ামূর্তিটাকে। কফিল সাধুর আস্তানা মাটি ফাটা একটা গহ্বরে আস্ত ডুবে গেল!
কফিল সাধুর চোখ প্রত্ন সভ্যতার পাথরে বাঁধানো, পাথরে পানির ঝিলিক অপরূপ ঝরনা এক। এই তো বুঝি হপ্পার দিঘি থেকে বলাকার ঝাঁক উড়ে যায়। থেমে যাওয়া বৃষ্টির রেণু উড়ন্ত মেঘের গায়ে রঙের বিরহ চিত্র একেঁ আবার হারিয়ে যায়। আঁধারের হালকা ঘোলায় পরক্ষণে ডুবে যায় সেই পট। সারবাঁধা ডানার ঝংকার মেঘের বুকে আছড়ে পড়ে ক্রমাগত। বলাকার পায়ে আকাশের ঠিকানায় লেখা চিঠি। আধা চেতনার ঘুমে-অবসাদে সেই চিঠি পড়তে পড়তে কোথায় ছুটেছে কফিল সাধু। কবে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল মাঝেমাঝে তাও ভুলে যায় সে। খাঁচার পাখি উড়ে গেছে বলে পাখির মরদেহ চেনা মাটির গহ্বরে শেষ ঠাঁইটুকু থেকেও কেন বঞ্চিত হবে, কেন তার নিখোঁজ মাংসপুঞ্জ দূর অচেনা মুল্লুকে বেখবর হয়ে যাবে? কেমন কালের ধারা বইছে তবে এই চরাচরে, একটা মানুষের লাশ কেন তার প্রিয় প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ হতে পারবে না—এইসব ভেবে বেদনার অতল গর্তে সেঁধিয়ে যেতে থাকে কফিল সাধু।
তারপর বহু কাল কেটে গেছে, কফিল সাধুর ঘোর কাটে নাই। ঘটনার দীর্ঘ প্রবাহে একদিন সে জানতে পায় নিঝুমপুরের অচেনা অঞ্চলে সাঁওতাল পাড়া বলে একটা বসতি আছে। সেখানে প্রবেশের আগে এই নতুন তথ্যের চমক তাকে ফের কতকটা চাঙ্গা করে তুলেছিল। হলুদ পাতার বিষণ্ন গাছ থেকে একটা প্রণয়পক্ষী আর্তস্বরে তাকে ডেকেছিল, ঠোকরে ঠোকরে হলদে পাতায় লেখা কথামালা তার চোখের সামনে এলে কেঁপে উঠেছিল তার প্রাণ। তাতেই কি ছিল না সব বৃত্তান্ত লেখা, সেই প্রকৃতিপত্রে আত্মার বিধিলিপি একান্ত আভাসিত? একটা ডালিম ফল তেরো বসন্ত ধরে পেকে থাকে কবরস্থানের গাছে, অস্তগামী সূর্যের বিপরীতে বিপুল রঙের খেলায় কেন এত রহস্য তার? কার কূটাভাস, কিসের সংকেত চিত্রিত সেই ফলের গোলকে!
ডালিম পাকার পরে কীটপতঙ্গ, ব্যাকটেরিয়া, ধূলিময়লা, ক্লেদ-রিরংসা, পচনশীলতা, বিভৎস ভঙ্গুরতা কেন তাকে স্পর্শ করবে না? কেন পাখি ছোঁয় না সেই অপরূপ গোলকের খোসা, রক্তটসটস দানা, কেন মানুষের মোহ ফলের স্বাদের কাছে পরাজিত নয়, কেন একটা মাত্র ফল ঝুলে থাকে গহন জংগলে? উদাসীন কফিল সাধুর স্তরে উঠে গেছে, যতই বলুক লোকে, সে আসলে মাটির গড়নে এক সহজ মানুষ। কেরামতি নয়, বুজরুকি নয়, ইচ্ছার একান্ত বলে সে কেবল রহস্য খুঁজেছে দিনরাত, তেরোটি মৌসুম একটানা। অলৌকিকের কণাদানা কোনোদিন তার মধ্যে দেখে নাই কেউ; যতদিন নিজের ভূমিতে ছিল, একমাত্র ভরসা ছিল চাচা। গ্রামসম্পর্কীয়, রক্তের কেউ নয়। বাবা নিঁখোঁজ, যুদ্ধের দিনে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ তা বলতে পারে না। মানুষ পশু পাখি সবার দৃষ্টি ও লোলুপতা এড়িয়ে সে কেবল নির্হেতু ভক্তির দিকে হেঁটে গেছে রাতদিন, নারীর দিকে হেঁটে গেছে।
অচিন গাছের অচিন পক্ষীর পাতায় লেখা বাণী কফিলের মনে আকস্মিক ঝড় তোলে। মরুতুফান। এই কি তবে জ্ঞানের পুলকে উতরে ওঠা কফিল সাধু? গাছের পাতায় লেখা জ্ঞানে প্রকৃতির মতো সমৃদ্ধ এখন, বাতাসের মতো স্বচ্ছল? সে কি বেদনার মতো নিঃসঙ্গ, বিরহের মতো একা নয়? সেই সাধু, কোনোদিনও যে সাধুর তকমা পেয়ে চাউর হতে চায় নাই খেয়ালে বা সচেতনে। তবে সে খুঁজত তো বটে, নিজের জীবন খুঁজত, ফেলে আসা পথের ধূলি খুঁজত, কাটা নখের স্মৃতি খুঁজত, নিজেকেও খুঁজত একা একা। ভোগের আকাঙ্ক্ষা ছাপিয়ে আভোগে উচ্চারিত হতে হয়তো তারও ছিল কিছু একান্ত বাসনা। অথবা ছিল না, কে জানে, কে জানে! ডানায় ঝাপটা মেরে অচিন পক্ষী উড়ে যায় চোখের পলকে, গাছের হলুদ পাতায় শেকড়ে শান্তির আবহ আসে। কাসিন্দা নদীর পাড়ে, সাঁওতাল পাড়ায় ছুটে যায় কফিলের অন্তরাত্মা, প্রথম থাপে, তার পরে যায় তার দেহ, দুই পায়ে যতটা কুলায় হাঁটার শেষে সেই জংগলে, সেই অচেনা কবরস্থানে।
রাত নেমে গেছে, আকাশে তখন গর্ভপাতের মতো একখানা অপ্রস্তুত চাঁদ। তবু মনে হয় বিচ্ছিন্ন জোছনার ডানা আঁধারের বিরুদ্ধে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যায়। কী লেখা সেই পত্রফলকে, কে বলবে এসে এই ঘন রাতে! কফিল সাধুর মন চনমন করে ওঠে, ব্যান্ডেজ খোলা চোখের রোগীর মতো পিটপিট করে অনেকটা সময়। নিচে আলো-অন্ধকার মিলন-বিচ্ছেদ পরস্পর একাকার হতে চায়। বিবর্ণতার বিপরীতে কাসিন্দা নদীর জলে একপ্রকার আনন্দ উচ্ছলিত হয়ে ওঠে, তবে তা গভীর নয়, আবার তুচ্ছও নয় বস্তুত। বনের গভীর কোণা থেকে হঠাৎ একটা আওয়াজ উঠে আসে। কফিল সাধু শোনে সেই একান্ত আওয়াজ, যা তার জীবনে শোনা অন্য যে কোনো ধ্বনির চেয়ে পৃথক, যে কোনো ভাষা ও অর্থময়তা থেকে ভিন্নতর। সে তখন ঝুলন্ত ডালিম ফলের দিকে চেয়ে প্রচণ্ড চিৎকারে ফেটে পড়ে। এই চিৎকার ভয় থেকে উচ্চারিত নয়, আশা থেকেও উৎসারিত নয়। দূরে যেখানে জংগল আরো ঘন হয়ে গেছে সেই স্থান বরাবর আকাশের একটা উঁচু স্তর থেকে এক ঝলক আলো এসে পড়ে ডালিম ফলের দুইটি চোয়ালে। চোখে পলক পড়ারও আগে কফিল সাধু হঠাৎ লক্ষ করে ডালিম ফলটা তার বুকের কাছে, পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে।