তাণ্ডবের বৃষ্টি ঝরছে। নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা আকাশ। নীলার মনটাও উচাটন সেই তালে। কারণহীন কারণে হু হু করছে বুকের মধ্যিখান। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলীয় দেশগুলোর সমস্যাই এই। হাওয়ার রঙে রাঙে মানুষের মন। সামনে ‘জবা ফুলের দুনিয়া’ বইয়ের খোলা পাতা, গল্পের নায়িকার খাদে পড়বার সাথে সাথে নীলা কল্পনায় দেখতে থাকে বিশ্বাসের অবাক চোখে অবিশ্বাসের মৃত্যু।
গুমোট মনটা হালকা করতে মোবাইল টেনে নেয় হাতে। ফেইসবুকের নোটিফিকেশনে চোখ যায়, একই ধারার মন্তব্য, শত শত লাইক। পেইজে গিয়ে একের পর এক ছবি, চটুল, গভীর পোস্ট... নাহ, কিছুই মন টানে না। এমন সময় মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশন, “আমি বারেবারে আপনার প্রেমেই কেবল পড়ি।”
কপালে ভাঁজ পড়ে নীলার। প্রোফাইল খোলে। বাচ্চা এক ছেলে। নীলা বোঝে যে, ওর বয়স না বুঝেই এমন এক মেসেজ। আর এ যুগে প্রেমে পড়ুক না পড়ুক প্রগলভ মেসেজ পাঠাতে দ্বিধা থাকে না কারো।
“কথার উত্তর না দিয়ে কই গেলেন?”
আবারও নোটিফিকেশন। নীলার হাসি পায়।
“আপনি কী পড়েন?”
“অনার্স ফোরথ ইয়ার।”
“কোন সাবজেক্ট?”
“অর্থনীতি।”
“কলেজ?”
“জগন্নাথ।”
“ও আচ্ছা। আমি আপনার মাতৃসম। আমার বয়স চল্লিশোর্ধ। আমার ছেলে দুইদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।”
“আমায় তুমি করে বলেন তবে।”
“ওকে। বলব।”
“কোথায় থাকেন আপনি?”
“তুমি থাকো কোথায়?”
“মোহাম্মদপুর।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে আমি অনেক ফিল করি! জানি না কেন, আপনাকে প্রায় এক বছর ধরে ফলো করছি।”
হাসতে থাকে নীলা। মাঝবয়সী জীবনে এই কথা বলবার মতন কেউ থাকে না কারো জীবনে। মাঝবয়সী মনও থাকে সন্দেহে ভরা। কেন, কে, কী উদ্দেশ্যে কথার আগ্রহ বোঝার চেষ্টাই থাকে বেশি। চেনা মানুষের ছল থাকে অনেক রকম, দেখা বহুবার। মেসেজ অপশন বাদ দিয়ে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে গান ছেড়ে মোবাইল রেখে আবারও জানালায় দৃষ্টি।
হায়রে, জীবন! হায়রে, কিউরিয়াস মন! ভাবতে থাকে নীলা।
“আপনি বৃষ্টিতে ভেজেন?”
আবারও আসে মেসেজ। ভ্রু কুঁচকে মোবাইল হাতে নিয়ে তাকায় স্ক্রিনে। জানালার বাইরের বৃষ্টিতে আবারও মুখ ঘুরায়। ছোট ঘরের চিলেকোঠার পাশের ছাদটায় দুই বোনের হুল্লোড়, রিক্সার হুড ফেলে ঝুম বৃষ্টিতে নাইতে নাইতে বাড়ি ফেরাগুলো স্বপ্নের মতোন আসতে থাকে চোখ জুড়ে।
“আপনি বৃষ্টিতে ভেজেন না?”
“নাহ, আগে ভিজতাম, তোমাদের বয়সে।”
এবার মোবাইল ভালো ভাবেই হাতে তুলে নেয় নীলা।
হাসির ইমো দিয়ে ছেলেটা লেখে, “আপনার তো আকাশচুম্বী বয়স। জানেন, আজ শাহবাগ থেকে বাসায় ফিরেছি ভিজতে ভিজতে। কী যে ভালো লাগছিল! আপনি ভিজবেন আমার সাথে একদিন?”
“নাহ। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
শাহেদ ডাকতে থাকে নীলাকে। অফিস থেকে ঘণ্টাখানেক আগে ফিরেই ফ্ল্যাটের কমন ক্লাবে আড্ডা দিচ্ছিল এতক্ষণ রোজকার মতোন। সারাদিনের কাজ শেষের অবসর!
“বাই।”
“কেন কেন?”
দেখবার আগেই নেট অফ করে নীলা কিচেনে গিয়ে ঢোকে।
খাবার শেষে শুয়ে আছে। তখনও ঝুম বৃষ্টি। ইদানীং এমন হয়েছে যে, বৃষ্টিতে ঘুমই আসতে চায় না। এপাশ-ওপাশ করতে থাকে নীলা। কিছুক্ষণ পরে শাহেদও পাশ ফেরে।
“ঘুমাও নি?”
কপালের ওপর হাত শাহেদের।
“না, ঘুম আসছে না।”
“আমারও, চলো গল্প করি।”
“নাহ, সকালে অফিস। তোমার মতো শুয়ে বসে তো আর থাকি না ঘরে।”
অভিমান আর বেদনার দলা নামে বুক চিড়ে। সংসার সংসার করেই তো কাজ বাদ দিয়েছে। মাস্টার্স তো নীলাও করেছিল। বাচ্চাকে কারো কাছে রাখতে না পেরেই তো চাকরিতে যাবার সিদ্ধান্ত বাদ দিতে হলো। আজ বাচ্চাও বড়, শাহেদের অফিস, রাত অবধি আড্ডার জীবনে নীলা এক অলক্ষ্য সত্তা। সারাদিন ঘর গুছিয়ে, হরেক রান্না করে, গান শুনে, সিনেমা দেখে, বই পড়ে, মেহমানদারি যত্ন নিয়ে করেও শূন্যতায় ভরা লাগা মনের নীল দেখতে পায় না শাহেদ!
“আজ মনে হলো, বয়স আমার অনেকই হলো।” গলাখাকারি দিয়ে বলে ওঠে শাহেদ। শাহেদের কথা শুনে পাশ না ফিরেই নীলা অভিমানে শুয়ে থাকে।
“নীলা, শুনছো?”
নীলা চুপ হয়ে থাকে।
“আমি সরি। আসলে অফিস থেকে এত টায়ার্ড হয়ে ফিরি। ভালো লাগে না তখন আর...”
এক তিক্ততার জল যেন ছড়িয়ে যায় সারা বুক জুড়ে নীলার। কিছুই বলে না। শাহেদ আবার কথা শুরু করে, “আজ বাসের এক ছেলে আংকেল বলে ডাকল। আসলে বয়স হয়ে গেছে আমার। রাস্তাঘাটে প্রায়ই আংকেল ডাকতে শুনি ইদানীং। বাসে আজ শাহবাগ থেকে ছোটখাটো এক ছেলে উঠল। আমার পাশে এসে বসল। হঠাৎ বলে, আংকেল, বৃষ্টিটা কী চমৎকার! তাই না?”
নীলা কৌতূহলী হয়ে ওঠে। এপাশ ঘুরে বলে, “ছেলেটা কোত্থেকে উঠেছে বললে?”
“শাহবাগ।”
“কোথায় যাচ্ছিল, জানো কিছু, বলেছে?”
“হুম, বলল, মোহাম্মদপুর।”
“আর কোনো কথা হয়েছে?”
“হ্যা, বলল, জগন্নাথে পড়ে, অর্থনীতিতে, অনার্স ফোরথ ইয়ারে...”
অন্ধকারে নীলার চোখ মুখ চাপা হাসিতে ভাসতে থাকে। একসময় উচ্চকিত হাসির শব্দে নিস্তব্ধ রাত ঝনঝন করে ওঠে। শাহেদ অবাক হয়।
“হাসো কেন? কী হয়েছে?”
“কিছুই না। লাইফ ইজ ফুললি মিস্টেরিয়াস!”