ইতিহাসে ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়া কয়েকটি উপন্যাস

বিশ্বসাহিত্য, শিল্প-সাহিত্য

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 20:03:30

সাহিত্যিক, সমালোচক, ঐতিহাসিক অথবা ছোট-বড় পাঠকের মাঝে প্রায়ই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিতর্ক ওঠে। সাহিত্য আড্ডাগুলো বেশ জমিয়ে তোলে এই প্রসঙ্গটি। বাস্তবিক অর্থে পাঠকের রুচিভেদে তার দেওয়া মতামত ভিন্ন হতে পারে। কোন উপন্যাসের শব্দচয়ন সুন্দর, কোনো বই বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছে সার্থকভাবে, কোনো বইয়ের সামাজিক প্রভাব ছিল চূড়ান্ত আবার কোনো বই পৃথিবীর চিন্তার ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে। সুতরাং শ্রেষ্ঠ বই কোনটা—প্রশ্নের উত্তরে সবার আগে আমাদের মানদণ্ডের প্রসঙ্গে একমত হতে হবে।

তারপরেও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠেকে থাকে না। বেশ কিছু কারণেই বিভিন্ন সময়ে কিছু উপন্যাস পেয়েছে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে খেতাব। অনবদ্য সেইসব কীর্তিগড়া কয়েকটি বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজনেই আমাদের আজকের আয়োজন।

আন্না কারেনিনা

বিয়ে, বহুগামিতা, জুয়া, প্রেম এবং রাশিয়ার সামন্ততন্ত্রকে পটভূমি ধরে বিস্তৃত পরিসরে অনবদ্য উপন্যাস আন্না কারেনিনা। লিও তলস্তয়ের হাতে রচিত এই মহাকাব্যিক ধাঁচের সৃষ্টিকর্ম পাঠকদের কাছে সবচেয়ে সমাদৃত। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হবার পর তার নির্মাণ আর চমৎকারিত্বের জন্য বিখ্যাত ম্যাগাজিন “Time” তাকে Greatest Novels-এর লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করেন। আট পর্বে বিভক্ত আখ্যানের কেন্দ্রিয় চরিত্র মূলত দুটি—আন্না নামের গৃহিনী এবং তার প্রেমিক এবং ভূস্বামী কনস্টানটাইন লেভিন।

◤ বিশ্বাস, দর্শন আর রুশ সমাজব্যবস্থা উঠে এসেছে তলস্তয়ের হাতে ◢


লেভিনের বসবাস বিশ্বাস আর দর্শনের টানাপোড়েনে। বস্তুত তলস্তয় এখানে ভালোবাসা, ব্যথা, বিরহ, জীবন, রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা এবং পরিবারকে সুচিন্তিত আলোচনার মাধ্যমে মুঠোবদ্ধ করেছেন। নারীর চরিত্র এবং তার সামাজিক চিন্তার প্রতিকায়নে বইটি একটি বিপ্লবের মতো কাজ করেছে। পরবর্তী রুশ সাহিত্যে কেবল নয়, অন্যান্য ভাষাতেও আন্না কারেনিনার প্রভাব ছিল স্পষ্ট।

টু কিল এ মকিংবার্ড

হারপার লি-কে মনে করা হয় সবচেয়ে প্রভাবশালী আর প্রতিভাধর লেখকদের একজন। মাত্র একটি বই দিয়ে এভাবে খ্যাতির চূড়ায় উঠে যাবার নজির সাহিত্যের আকাশে বিরল। ‘টু কিল এ মকিংবার্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। আর সাথে সাথেই পরিচিতি পায় ক্লাসিক হিসাবে। তারপর ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত তিনি আর কিছু প্রকাশ করেননি।

◤ উপন্যাস থেকে নির্মিত সিনেমা পায় একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ◢


উপন্যাসটিতে এক তরুণী জ্যাঁ লুইস ফিন্সের মধ্য দিয়ে আমেরিকায় বর্ণবাদকে বেশ মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। বইটি পুলিৎজার পুরস্কার পায় ১৯৬১ সালে। এর গল্প থেকে ১৯৬২ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র পায় একাডেমি অ্যাওয়ার্ড।

দ্য গ্রেট গেটসবি

ফ্রান্সিস স্কট ফিটজেরাল্ড লিখিত ‘দ্য গ্রেট গেটসবি’ নামটা সফল আর সার্থক উপন্যাসের কাতারে উপরের দিকেই থাকবে। নিক ক্যারাওয়ে নামের তরুণটির নিউ ইয়র্ক শহরে থিতু হওয়া নিয়ে কাহিনী এগিয়ে গেছে; যে দ্রুতই পরিচিত হয় প্রতিবেশি রহস্যময় ব্যক্তি জয় গেটসবির সাথে। বইটি গত শতাব্দীর বিশের দশকে আমেরিকার অবস্থা ও ইতিহাসকে ফ্রেমবন্দী করে লিখিত। নিখুঁত বর্ণনাভঙ্গির কথা বাদ দিলেও লেখকের শিল্পবোধের প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিটি স্থানে।

◤ রহস্যময় বর্ণনাভঙ্গিতে আমেরিকার অবস্থা তুলে ধরেছে বইটি ◢


ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড

বছর কয়েক আগেই মারা গেলেন কলম্বিয়ান সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। জাদু-বাস্তবতাকে সাহিত্যে উপজীব্য করে নতুন পৃথিবীর সন্ধান দেবার জন্য তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড’ তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। উপন্যাসটিতে বুয়েন্দিয়া বংশের উত্থান এবং মাকোন্দো নামক গ্রামে তাদের প্রতিষ্ঠা, বিবর্তন ও পতনকে চিত্রিত করা হয়েছে। গার্ডিয়ান পত্রিকায় বইটির রিভিউয়ে বলা হয়েছিল, যদি ল্যাটিন আমেরিকার অস্তিত্ব নাও থাকত, তবে এই উপন্যাস থেকেই তা সৃষ্টি করা সম্ভব হতো।

◤ মার্কেজের হাতে ধরে পৃথিবী পরিচিত হয় জাদুবাস্তবতা নামের নতুন স্টাইলের সাথে ◢


গোটা উপন্যাসে মিথ, উপকথা, লোকগল্প এবং ঐতিহাসিক সত্যকে মিলিয়ে-মিশিয়ে একাকার করে তুলেছেন। একারণে বাস্তব আর অবাস্তব জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠে জন্ম নিয়েছে নতুন জগত। ১৯৮২ সালের নোবেল ছাড়াও আরো অজস্র পুরস্কার ও খেতাব এনে দিয়েছে মার্কেজকে উপন্যাসটি।

এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া

ই, এম, ফস্টারের অনবদ্য উপন্যাস এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া লেখা হয় ভারতে বেশ কয়েকটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতার পর। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। এক ভারতীয় মুসলিম ডাক্তার আজিজ এবং ইংরেজ অধ্যাপক সিরিল ফিল্ডিং-এর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে রচিত হয়েছে পটভূমি। গল্পের ভাঁজে প্রোথিত আছে ব্রিটিশ উপনিবেশে ভারতীয় জীবনের নানা চিত্র। প্রকৃতির রঙিন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বর্ণনা, লেখকের নির্মাণশৈলি এবং ভারতকে তুলে ধরার ভিন্নরকম যোগ্যতা দেখিয়েছেন লেখক। প্রকাশের পরপরই এইজন্য মাস্টারপিস তকমা পেয়ে যায় বইটি।

◤ এর পেছনে কাজ করেছে তার ভারত-জীবনের অভিজ্ঞতা ◢


ইনভিজিবল ম্যান

রালফ্ এলিসনের ইনভিজিবল ম্যান উপন্যাসটি সাহিত্যের আকাশে এক মাইলফলক হয়ে দেদীপ্যমান। উপন্যাসের বর্ণনাকারীর কোনো নাম দেওয়া হয়নি; বরং তার বিশ্বাস মতে, তিনি অন্যদের কাছে সামাজিকভাবে অদৃশ্য। বস্তুত এখানে আফ্রো-আমেরিকান এক তরুণের প্রসঙ্গ এসেছে তীব্রভাবে। প্রতিটি জায়গায় কিভাবে সে বৈষম্য আর প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। উপন্যাসটি পরাবাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি আফ্রিকান আমেরিকান সংস্কৃতিকে চিত্রিত করার জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। প্রতীক এবং রূপকের ব্যবহারও ছিল বিস্ময়কর। ১৯৫৩ সালে ইনভিজিবল ম্যান উপন্যাসটি আমেরিকার জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।

◤ বর্ণবৈষম্যকে তুলে ধরা হয়েছে পরাবাস্তব সাহিত্যিক স্টাইলে ◢


ডন কিহোতে

১৬১৫ সালে স্পেনিশ সাহিত্যের রত্ন হিসাবে প্রকাশিত হয় ডন কিহোতে। লেখক মিগেল ডি সার্ভেন্তেস নিজেও হয়তো ভাবতে পারেননি, তার লেখাটা পরবর্তী কয়েক শতক ধরে অন্যান্য বহু সংস্কৃতিতে উপন্যাস লেখার প্রেরণা যোগাবে। নাইট হতে বিভোর এক ব্যক্তির ডন কিহোতে ডি লা মানচা নাম ধারণ এবং তার রোমান্টিক কার্যাবলি উপন্যাসের মূল উপজীব্য হিসাবে স্থান পেয়েছে।

◤ উপন্যাসটি স্পেনিশ হলেও পরবর্তী বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রেরণা যোগায় ◢


আর্ট, সংগীত এবং সাহিত্যে এই ডন কিহোতে শীঘ্রই এক আলোচিত আদর্শ হিসাবে পরিণত হলেন। আধুনিক জমানা পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এমনকি আমাদের ব্যবহার্য বেশ কিছু ইংরেজি শব্দের উৎসস্থান এই বইটি।

থিংস ফল এপার্ট

এতক্ষণ পশ্চিমা সাহিত্যিক আর সাহিত্যের নাম শুনে অনেকের মনে হতে পারে, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কি কেবল তারাই রচনা করেছে? তাদের প্রশ্নের জবাবে সবার আগে আসবে থিংস ফল এপার্ট উপন্যাসের নাম। চিনুয়া আচেবের এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালের দিকে। আফ্রিকার সাহিত্যের অমূল্য রত্ন হয়ে যুক্ত বইটি একপাক্ষিকতাকে সরিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে তুলে এনেছেন এক নতুন আবহ। ওকোনকুয়ো নামক জনৈক নাইজেরিয়ান ইগবো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে উপন্যাসের যাত্রা। ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে স্থানীয়দের ওপর কেমন প্রতিক্রিয়া পড়েছিল, কত দ্রুত বদলে যাচ্ছিল মানুষের স্বভাব ও সংস্কৃতি—তাকে টেনে আনা হয়েছে নিখুঁতভাবে।

◤ ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রভাব আর আফ্রিকার পরিবর্তনের অন্যতম দলিল বইটি ◢


উপনিবেশ পরবর্তী আফ্রিকান সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম এই বই। আলোচিত হয়েছে সেই গল্পগুলোই, যা আগে বাইরের কেউ শোনেনি। সেইসব চিৎকার, যা উপনিবেশবাদীরা উপলব্ধি করতে পারেনি। শুধু আফ্রিকায় না, তৃতীয় বিশ্বের পরিস্থিতিতে লেখাটি একটি আদর্শ প্রতিবাদ।

দ্য কালার পার্পল

ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই পত্র-উপন্যাস বেশ জনপ্রিয়। তবে, এলিস ওয়াকার এই ঘরানায় সবচেয়ে বেশি মুন্সিয়ানা দেখাতে সক্ষম হন। ১৯৮২ সালে তাকে পুলিৎজার পুরস্কার এবং জাতীয় পুরস্কার এনে দেয় উপন্যাস ‘দ্য কালার পার্পল’। গৃহযুদ্ধের পরে আমেরিকার দক্ষিণে এক আফ্রিকান আমেরিকান তরুণী সেলি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে।

◤ দ্য কালার পার্পল থেকে নির্মিত সিনেমা একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পায় ◢


ঈশ্বর এবং বোন নেটিকে উদ্দেশ্য করে তার লেখা চিঠিতে উঠে আসে তার ওপর ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতন, জীবনযাপনে ভোগান্তি, বন্ধু এবং পরিবারের অবস্থা। উন্মোচিত হয় যৌনতা, বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, বিকৃত কাম এবং অন্যান্য নানা মুখোশ। উপন্যাসটি ১৯৮৫ সালে সিনেমাতে রূপান্তরিত করা হয় এবং তা একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়। আলোচিত হয় বিশ্বব্যাপী।

এ সম্পর্কিত আরও খবর