কুকুর ও পটাশিয়াম সায়ানাইড

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

সৈয়দ নূরুল আলম | 2023-08-31 03:51:19

জাস্টিস সোবহান সাহেব টেবিলে তিনবার হাতুড়ি পেটালেন। এখনই রায় ঘোষণা হবে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। গভীর নিঃশব্দে ডুবে আছে এজলাস। সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে সোবহান সাহেবের দিকে। তিনি কী রায় দেবেন! সাত বছর কারাদণ্ড? বারো বছর? না মৃত্যুদণ্ড।

আজকের রায় শোনার জন্য সারা কোর্ট লোকে-লোকারণ্য। কোথাও এতটুকু তিলঠাঁই নেই। সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, রিক্সাওয়ালা, কুলি-মজুর সবাই এসেছে। কিছু আগে ছোট ছোট কথা, কথার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বিবেক নামক কোর্টে উপস্থিত সবাই আজ বিচারক। কেউ বলছিল বারো বছর, কেউ বলছিল যাবজ্জীবন, কেউবা বলছিল মৃত্যুদণ্ডই এর উপযুক্ত শাস্তি। গণরায়ের ওপর আর কি রায় থাকতে পারে?

সোবহান সাহেব রায় ঘোষণার আগে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। কথা শোনা না গেলেও, সোবহান সাহেবের ঠোঁট নড়তে দেখা গেল। সোবহান সাহেব এবার তের পৃষ্ঠাব্যাপী রায় পড়ে শোনালেন। রায় শোনার পর কোর্টে উপস্থিত প্রায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। এ কী শুনছি!

আসামি পক্ষের যে দু চারজন লোক কোর্টে এসেছিল, এতক্ষণ তারা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তাদের ঘাড়েও কিছু উত্তম-মধ্যম পড়তে পারে। পাবলিক তো পাবলিকই একবার গণধোলাই শুরু হলে আর রক্ষে নেই।

কিন্তু রায় শোনার পর সবাই একত্র হয়ে হৈ হৈ করে ওঠে। কেউ আবার ফুলের তোড়া আনতে ছোটে। নেতাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে হবে। আসামি পক্ষের উকিল হারুন দুপা এগিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে দেয় বাদী পক্ষের উকিল আবুলের দিকে। আবুল ইতস্তত করে। ওর সঙ্গে কেন হাত মেলাব?

‘কোর্টে দাঁড়িয়ে আমরা একে অন্যের শত্রু হয়ে আসামিকে জেরা করতে পারি। রায় ঘোষণার পর কোর্টের বাইরে একে অন্যের বন্ধু।’ কথাগুলো বলে, হারুন জোর করে আবুলের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ঝাঁকাতে থাকে।
‘তুই এমন একজনের পক্ষ নিয়ে উকালতি করলি, যে কিনা...’
‘শোন এটা আমার পেশা। শুধু পেশার কারণে আমি এ কেসটা হাতে নিয়েছি।’
‘জানি এ কেসে অনেক টাকা পাবি। টাকার জন্য অন্য কেউ করতে পারে। তুই কেন এ কেস নিলি।’
‘আমি এ কেস না করলে অন্য একজন ঠিকই করত।’
‘তুই কেন অন্য পাঁচজনের সাথে নিজেকে তুলনা করবি।’
‘তোর রাগের কারণ আমি বুঝি। তুই যেমন লোকটিকে ঘৃণা করিস, আমি তার থেকে কোনো অংশে কম করি না। আমি চাইনি লোকটি বেকসুর খালাস পেয়ে যাক। কিন্তু আইনের কাছে আমরা বাঁধা। সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া আইন বোবা। এ ক্ষেত্রে তোরও কিছু করার নেই। আমারও কিছু করার নেই। দুঃখ করে লাভ নেই। চল চা খাই।’
হারুন প্রায় জোর করে আবুলকে নিয়ে যায়।

ইতোমধ্যে নেতাকে ঘিরে আরো কিছু লোক জমা হয়েছে। নেতার গলায় কাঁচা ফুলের মালা। নেতা সামনের সারিতে হাঁটছে। পেছন থেকে অন্য সবাই স্লোগান দিচ্ছে, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা।’

ত্রিশাল থেকে কালা আর রবি এই মামলার রায় শুনতে এসেছে। ওরা ভেবেছিল, রায় শুনে গ্রামে গিয়ে অন্য সবার কাছে গল্প করে মজা পাবে। ওদের গ্রামে আক্কাস মিয়ার ফাঁসি না হয়ে আর যায় কোথায়। আক্কাস মিয়া এখন মওলানা আক্কাস উদ্দিন হলেও, ওদের কাছে আক্কাস মিয়া, আক্কাস মিয়াই। বেটা এবার দেখবে, কত ধানে কত ঘুঘু।

কিন্তু রায় শুনে কালা আর রবি দুজনই দুঃখ পেয়েছে বেশি। ওদের মনটা কাচ ভাঙার মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মনের দুঃখে ওরা দুজন কোর্টের সামনে শিমুলগাছটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ‘আমার নেতা-তোমার নেতা’— স্লোগান শুনেই কালা আর রবির শরীর গরম হয়ে ওঠে। পারলে এখনই ওদের পাছায় এক লাথি মারে। কালা আবার বেশি রাগ হলে ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। কথার সাথে থুথু ছোটে। ও থুথু ছিটিয়ে বলে, ‘হালাদের কী দোষ। দোষ যত জজ সাহেবের। জজ সাহেব মাল খাইছে। মাল খাইয়ে এই রায় দেছে।’

রবি আবার কালার থেকে মাথায় বুদ্ধি একটু বেশি রাখে। ও কালাকে বলে, ‘বোকার মতো কথা কইস না। জজ সাহেব বলল, শুনলি না। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হলো। সাক্ষী-সাবুদ না পেলে আসামি ধরবে কেমনে।’

একথা শুনে কালা আরো রেগে যায়, বলে ‘সাক্ষী তো আমরা। আমরা জানি না, ও বেটা খচ্চর কত মানুষ মারছে। কত মাইয়া ওর বাপদের হাতে তুইলে দেছে। এ কথা কে না জানে।’ কথাগুলো একটানে বলতে বলতে কালা হাঁফায়।

রবি বলে, ‘শোন আইনের অনেক ফুটো আছে। সেই ফুটো দিয়ে এরা বের হয়ে যায়। তয় আল্লাহর কাছে এরা ধরা খাবেই খাবে।’

ওরা হঠাৎ দেখে জজ সাহেবের শাদা গাড়িটা ওদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। সামনে ড্রাইভার পিছনে জজ সাহেব। কালা হাত উঁচু করে জজ সাহেবকে সালাম দেয়। জজ সাহেব সেটা লক্ষ করেন না। গাড়িটা শাঁ করে গেট দিয়ে বের হয়ে যায়। কালা আর রবি একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকে।

শেষ বোশেখে আকাশ তাঁতিয়ে রোদ উঠেছে। কয়েক দিন থেকেই ভ্যাপসা গরম পড়ছে। সোবহান সাহেবের কাছে গরমটা আজ আরো বেশি মনে হচ্ছে। গাড়িটা জনসন রোডের মোড়ের কাছে এসে জ্যামে আটকে যায়।

ড্রাইভার লতিফ এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। একমনে গাড়ি চালাচ্ছে। ওর মুখটা আজ বড় বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। অন্যদিন হলে সোবহান সাহেবকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করত—স্যার বিচারের রায় এমন হলো কেন, আমি ভাবছিলাম এমন হবে।

লতিফ প্রতিদিন এজলাসের এককোণে দাঁড়িয়ে বিচারকার্য দেখে। রায় শোনে। কখনো কখনো রায় শুনে খুশি হয়। আবার অনেক সময় দুঃখ পায়। নীরবে টপটপ করে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। লতিফের ভেতরে একটি নরম মন আছে। সে মন একটুতেই গলে যায়।

বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে বসে বিচারকার্য নিয়েই সোবহান সাহেবের সঙ্গে লতিফের কথা হয়। সোবহান সাহেব এতে কিছু মনে করেন না। বরং লতিফের সঙ্গে কথা বলে সোবহান সাহেব নিজেও বেশ হালকা বোধ করেন। বিচাকের আসনে বসে সোবহান সাহেব যে কথা বলতে পারেন না সেকথা লতিফের কাছে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। লতিফকে কেন এত ভালো লাগে তা সোবহান সাহেব নিজেও জানেন না। সেই আসার পর থেকে এত বছর গেল, কোনোদিন কাজের কোনো গাফিলতি হয়নি। এমনকি মাসের বেতনটা পর্যন্ত লতিফ নেয় না। সোবহান সাহেবের কাছে জমা রাখে। সোবহান সাহেবের মেয়ে মিমিকে তো মামণি, মামণি বলেই পাগল।

আজ লতিফ কোনো কথা বলছে না দেখে সোবহান সাহেব একটু অবাক হন। অথচ, সোবহান সাহেব ভেবেছিলেন আজকের রায়ের জন্য লতিফের কাঠগড়ায় নিজেকে দাঁড়াতে হবে। লতিফ কিছুই বলছে না, সেটা বুঝতে পেরে সোবহান সাহেব নিজেই প্রসঙ্গটা তোলেন।
‘আজকের রায় শুনেছো?’
এবারও লতিফ কোনো কথা বলে না। ওর মুখটা থমথমে হয়ে আছে।
সোবহান সাহেব চশমার গ্লাস রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে নিজেই বলতে থাকেন, ‘সব জানি। জেনেও কিছু করতে পারলাম না। এখানে আমার কষ্ট।’
কিছু সময় থেমে আবার বলেন, ‘আইন আমাদের হাতপা বেঁধে রেখেছে। আইনের বাইরে আমরা যেতে পারি না। যেমন ধরো, একট মেয়ের ওপর জোর খাটানো হলো, আর এ জন্য তাকেই প্রমাণ করতে হবে। এই হচ্ছে আমাদের আইন।’
‘এ কেমন আইন?’
লতিফের মুখ দিয়ে বোমার মতো ফেঁটে বেরোয় কথাগুলো।
‘তুমি জানো না, প্রমাণের অভাবে অনেক সত্য ঘটনা অসত্য হয়ে যায়। প্রকৃত দোষী আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন খুব খারাপ লাগে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।’

সোবহান সাহেবের শেষের কথাগুলোা কেমন যেন ভিজে ওঠে। সেটা বুঝতে পেরে লতিফ মনিবের মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে চেষ্টা করে। বলে, রায় ঘোষণার আগে আপনি বিড়বিড় করে কী বলেছিলেন, আমি জানি। বলব?
সোবহান সাহেব কিছু বলার আগেই লতিফ বলে, আক্কাস আলীকে কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিয়েছিলেন।
‘ঠিক বলছি না?’
‘কী করে বুঝলে?’
‘আপনি মনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। তাই লোকটির ওপর ক্ষেপে এই কথা বলেছিলেন।’
‘তুমি জানো না। আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এমন একটা রায় দিতে হলো আমাকেই । এটা ভেবেই আমার ভেতরে আগুন ধরে গিয়েছিল।’
আর কেউ না জানলেও আমি জানি, আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুজিববাহিনীর কমান্ডার হিসেবে যশোর লক্ষ্মীপাশায় যুদ্ধ করেছেন। আপানার বাঁ পায়ে একটা গুলির দাগও আছে।
‘তুমি এসব কী করে জানলে?’
‘আমিও আপনার বাহিনীতে ছিলাম।’
‘তুমি ছিলে?’
‘আমি আপনার দলের কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলাম। সবাই আমাকে লতি বলে ডাকত।’
সোবহান সাহেব বিস্ময় মুখে চেয়ে থাকে লতিফের মুখের দিকে।
‘আপনার কাছে আজ কিছুই লুকাব না। আপনার দারোয়ানকে ধরে, আপনার ড্রাইভারের চাকরিটা নিয়েছি। আসলে দারোয়ান চাচা আমার কোনো আত্মীয় হয় না। সেদিন মিথ্যা কথা বলেছিলাম। পাঁচশ টাকা দিয়ে আমি দারোয়ান চাচার ভাইয়ের ছেলে সেজে আপনার ড্রাইভারের চাকরিটা নিয়েছি।
‘কেন তুমি এটা করলে?’
‘আমি শুধু একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছে থেকে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে চেয়েছি।’
‘তুমি তো প্রথমেই পরিচয় দিতে পারতে।’
‘আমার আর আপনার দূরত্ব অনেক। তাই পরিচয় দিইনি।’
‘এটা তুমি মস্ত বড় ভুল করেছো। এখন আমাদের সামাজিক অবস্থা যাই হোক। আমরা দুজন মুক্তিযোদ্ধা এটাই আমাদের বড় পরিচয়।’
‘আপনার কাছে এ সম্মানটুকু পাব ভেবেই এখানে কাজ করতে এসেছি বা করছি। কিন্তু আজকের ঘটনায় আমি খুব ব্যাথা পেয়েছি। আমি এর প্রতিবাদ করতে চাই।’
‘কিভাবে করবে?’
‘আমি চাকরি ছেড়ে দিতে চাই।’
‘এ কী বলছো তুমি? এ জন্য তুমি কি আমাকে দায়ী করছো?’
‘আপনাকে দায়ী করছি এ কারণে, আপনারা আইনের লোক। আইন তৈরি করেন। এখনো কেন সেই আইন তৈরি করছেন না যে আইনে সব অপরাধীরা সাজা পাবে। যে আইনে ছিদ্র থাকবে না।’
‘তুমি দেখো, আজ না হলেও, একদিন সেই আইন তৈরি হবে এবং সব অপরাধীর সাজাও হবে।’
‘স্যার, গাড়ি কি ঘোরাব? যে জ্যাম সহজে ছুটবে না। গাড়ি ব্যাক করে হেয়ার রোড হয়ে যাই।’
‘ঠিক আছে যাও। তবে আজ থেকে আর স্যার না। বলবে সবুর ভাই। তোমাদের সেই সকলের সবুর ভাই।’
যুদ্ধের সময় সোবহানকে সবাই সবুর ভাই বলেই ডাকত।

পরের দিন লতিফকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই রাতেই গ্যারেজে গাড়ি রেখে লতিফ কোথায় চলে যায় কেউ তা বলতে পারে না।

২.

লাল মিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যে মওলানা আক্কাস উদ্দিনের খুব আপন হয়ে ওঠে। লাল মিয়া ছাড়া মওলানা সাহেব যেন অচল। কখন কী খেতে হবে, কখন কী করতে হবে, সব লাল মিয়ার মুখস্থ। মাঝে মাঝে মওলানা সাহেব ভাবেন, এত বিশ্বস্ত, এত নির্লোভ মানুষ হতে পারে?

মওলানা সাহেব ব্যস্ত মানুষ। প্রতিদিনই একটা না একটা মিটিং লেগেই থাকে। তাছাড়া, যখন তখন পার্টির লোকজন আসে। পার্টির ভালোমন্দ নানা কৌশল নিয়ে কথা হয়। সব কাজেই লাল মিয়া মওলানা সাহেবের কাছে কাছে ছায়ার মতো থাকে। এত ব্যস্ত থাকার পরও মওলানা সাহেব সময় পেলেই লাল মিয়ার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন।
‘কোথায় বাড়ি?’
‘আমডাঙ্গা’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘কেউ নেই। আমি একা।’
‘বিয়ে করোনি?’
‘না।’
‘এখন করবে?’
মুচকি হাসে লাল মিয়া। নিজের দিকে তাকায়। বয়স পাঁচচল্লিশ পেরিয়ে ছেচল্লিশে পড়েছে। মওলানা সাহেব বুঝে নেন। লাল মিয়া রাজি। চাঁদের মতো একটা মেয়ে ধরে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে, ভেবে রাখেন মওলানা সাহেব।

এভাবেই চলতে থাকে দিন। যতই দিন যায় ততই লাল মিয়া মওলানা সাহেবের আরো আপন লোক হয়ে যায়। অসুবিধার মধ্যে লাল মিয়া নামাজ পড়ে না। আল্লাখোদার নাম নেয় না। এতে মওলানা সাহেব মাঝেমধ্যে লাল মিয়াকে মৃদু ভর্ৎসনা করে। আখেরাতের কথা বলে। ওসব শুনে লাল মিয়া মুচকি হাসে। লাল মিয়াকে রাগ করলে হাসে, আবার ভালো বললেও হাসে। এতে করে মওলানা সাহেব লাল মিয়ার হাসাকে এক ধরনের রোগ বলে ধরে নিয়েছেন। লাল মিয়া শুধু মওলানা সাহেবের কথায়ই হাসে না। ওর একটা কুকুর আছে। কুকুরের সাথেও হেসে হেসে কথা বলে।

মওলানা সাহেব নিয়মের মধ্যে জীবনযাপন করেন। সকালে প্রতিদিন এক মাইল হাঁটেন। নাস্তায় ডিম মাখনের পরিবর্তে ছোলা, কলা খান। দুপুরেও খাদ্য তালিকায় মাছ মাংসের পরিবর্তে শাকসবজি বেশি স্থান পায়। আর রাতে এক গ্লাস দুধ খান এবং যেটা নিয়মিত খান, সেটা সরবতে এলাহি।

এটা মওলানা সাহেবের দেওয়া নাম। আসল নাম কী, লাল মিয়াও তা জানে না।
খাদ্য খাবার তৈরি করা থেকে শুরু করে পরিবেশেন করা, সবটাই লাল মিয়ার তদারকিতে হয়ে থাকে। এতে মওলানা সাহেব যেমন তৃপ্তি পান, লাল মিয়া নিজ হাতে মনিবকে পরিবেশন করে, সে আরো বেশি তৃপ্তি পায়।

৩.

মওলানা সাহেবের মৃত্যুতে সবই শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এভাবে হঠাৎ মওলানা সাহেব চলে যাবেন, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। কেউ কেউ এ মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যু মনে করছে। ভালো লোক রাতে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়েছে আর সেই লোকটা ফজরের আজানের আগেই নাই হয়ে গেল, এ কেমন কথা?

মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে পার্টির লোকজন ছুটে এলো। পুলিশ ছুটে এলো। মৃত্যুর আলামত খুঁজল, কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। তবু কেস দিতে হয়, সেটা মনে করে পার্টির পক্ষ থেকে কেস দেওয়া হলো। সন্দেহভাজন বাবুর্চি, গাড়ির ড্রাইভার, ছায়াসঙ্গী লাল মিয়া সবাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল।

আসামিদের পক্ষে জামিন চাওয়া হলো। জামিন নামঞ্জুর হয়ে কেস কোর্টে গেল।
লাল মিয়া ছিল মওলানা সাহেবের সবচেয়ে কাছের লোক। সব সন্দেহ লাল মিয়ার ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে অন্য সবাই কেস থেকে মুক্তি পেয়ে যায়।

দিন যায়, কেস গড়াতে থাকে। বাদী পক্ষের উকিল জেরা করে। লাল মিয়া হেসে হেসে উত্তর দেয়। সেই হাসি রোগ এখনো আছে। তারিখ পড়ে, লাল মিয়া কোর্টে হাজিরা দেয়। দু পক্ষের উকিলের জেরা চলে। এভাবে চলতে চলতে ফাইনাল তারিখ পড়ে। যেদিন রায় ঘোষণা হবে।

৪.

আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে লাল মিয়ার আজ থেকে দশ বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। আজ লাল মিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে আছে দশ বছর আগে সেখানেই দাঁড়িয়েছিল আক্কাস মিয়া। আজও বিচারক সোবহান সাহেব, সেদিনও বিচারকের আসনে এই সোবহান সাহেবই বসেছিলেন।

বয়সের ছাপ সোবহান সাহেবের চোখেমুখে স্পষ্ট। লাল মিয়া সোবহান সাহেবকে ঠিকই চিনেছে কিন্তু সোবহান সাহেব বোধহয় লাল মিয়াকে চিনতে পারেননি। মুখে চাপদাড়ি। চোখে পাওয়ারওয়ালা মোটা চশমা। গায়ে পায়জামা-পানজাবি, এ অবস্থায় লাল মিয়াকে সোবহান সাহেবের পক্ষে চেনার কথা না।

আজও কোর্টে অনেক লোক এসেছে। সবাই রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। সোবহান সাহেব টেবিলের ওপর রাখা চশমা চোখে পরে, রায় ঘোষণা করলেন। সংক্ষিপ্ত রায়, লাল মিয়াই যে মওলানা আক্কাস উদ্দিনকে হত্যা করেছে তার যথার্থ সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় তাকে...

৫.

এ সময় লাল মিয়া ধারালো গলায় বলে, ‘স্যার, আমার একটা কথা আছে।’
লাল মিয়ার এ কথা শুনে সোবহান সাহেবসহ এজলাসের সবাই অবাক বিস্ময়ে লাল মিয়ার দিকে তাকায়। লাল মিয়া একনাগাড়ে বলতে থাাকে, আমার নাম লতিফ। এক সময় অনেকে আমাকে লতি বলে ডাকত। এখন আমি লাল মিয়া। আমার একটি কুকুর ছিল। কয়েক দিন আগে কুকুরটি মারা যায়। ওকে একটু একটু করে পটাশিয়াম সায়ানাইড প্রয়োগ করে হত্যা করেছি। যে বিষ প্রয়োগে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নাই।

কিছু সময় থেমে লাল মিয়া আবার বলে, কুকুরের মতো একইভাবে ত্রিশালের আক্কাস মিয়া, আজকের মওলানা আক্কাস উদ্দিন তাকেও আমি হত্যা করেছি। প্রতিদিন রাতে তার খাবারের দুধে একটু একটু করে পটাশিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে তাকে মেরেছি। যার কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। পোস্টমর্টেমেও বিষ প্রয়োগ ধরা পড়েনি। তবু আমি অপরাধী।

চশমা খুলে, চোখ মুছতে মুছতে লাল মিয়া বলে, মহামান্য আদালতের কাছে আমার প্রার্থনা, বিচারের রায় অন্য রকম হোক।

সোবহান সাহেব লাল মিয়ার কথায় কর্ণপাত না করে, খস্ খস্ করে রায়ে সই করে দ্রুত এজলাস থেকে নেমে যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর