সাহিত্যের প্রতি মানুষের টান সহজাত। কখনো গল্প কিংবা কখনো কবিতায় যুগে যুগে প্রকাশিত হয়ে আসছে মনের ভাব। পশ্চিমে হোমারের ইলিয়াড কিংবা পূর্বে ব্যাসদেবের মহাভারতের জন্মের পেছনে তাই প্রায় কাছাকাছি অনুঘটক কাজ করেছে। বিভিন্ন সময়ে ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছে ছন্দবদ্ধ শ্লোক। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সফোক্লিস কিংবা ইউরিপিডিসের ট্র্যাজেডি পড়ে সমানভাবেই অনুরিত হয় হাল জামানার পাঠক।
সাহিত্যের ইতিহাসে উপন্যাসের আগমন সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ধরতে গেলে অনেক পরে। সেই মেসোপটেমিয় সভ্যতার গিলগামেশ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সাহিত্যে চমকপ্রদ বহু ঘটনাই ঘটে গেছে। তারই কয়েকটি পাঠকের সামনে হাজির করতেই আজকের আয়োজন।
মিগেল ডি সারভান্টেস একজন স্পেনিশ সাহিত্যিক। ১৬০৫ সালে প্রথম খণ্ড এবং ১৬১৫ সালে দ্বিতীয় খণ্ড হিসাবে তিনি একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন নিজের ভাষায়। ডন কিহোতে নামের উপন্যাসটি পরবর্তী পশ্চিমা সাহিত্যের ইতিহাসে মাইলফলক বলে পরিগণিত। প্রকাশের পর বইটির ৫০০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত উপন্যাস হিসাবে পায় পাকা আসন।
উপন্যাসটি মূলত তৎকালীন শিভ্যালরি ব্যবস্থাকে ব্যাঙ্গ করেই রচিত। জনৈক ডন কিহোতে অব লা মানচা চিন্তার আতিশায্যে নিজেকে বীর নাইটের আসনে বসায়। তরবারি, ঘোড়া, নারী কিংবা মদের সাথে ঘটনা প্রবাহিত হয়েছে গভীরে। বর্ণনার সাবলীলতা এবং নাটকীয়তা পরবর্তী যুগে উপন্যাস লেখার পথকে সুগম করে দেয়।
খবরটা অবশ্যই থতমত খাইয়ে দেবার মতো। নেহায়েত শিশুসুলভ একটা গ্রন্থ লুইস ক্যারোলের এলিস’স এডভ্যাঞ্চার ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড। পাঠক মাত্রই জানে, ছোট্ট এলিসের বিস্ময়কর ভ্রমণকে কেন্দ্র করে পুরো গল্প আবর্তিত হয়েছে। কেউ কেউ শিশুতোষ গ্রন্থ বলেই ক্ষান্ত হলেও কারো কারো মতে বইটি আধ্যাত্মিক যাত্রার রূপক উপস্থাপন। তবে গোটা রচনায় রাজনৈতিক উত্তেজনা কিংবা উসকানি ছিল না—এটা সর্বসম্মতভাবে নিশ্চিত। তারপরেও বইটি নিষিদ্ধ তালিকায় স্থান করে নেয় চীনের হুনান প্রদেশে।
প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। বহুলভাবে বিভিন্ন জায়গায় সমাদৃত হলেও চীনের হুনান প্রদেশে বইটি অন্যান্য কিছু বইয়ের সাথে ব্যান করে দেওয়া হয়। সরকার মনে করে, বইটিতে পশুকে মানুষের ভাষায় কথা বলতে দেওয়া হয়েছে—যা অনুচিত। মানুষ আর পশু কখনোই সমান হতে পারে না।
A la recherche du temps perdu একটি ক্লাসিক উপন্যাসের নাম। লিখেছেন মারসেল প্রাউস্ট। সাত খণ্ডে লেখা সৃষ্টিকর্মটিকে মনে করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ উপন্যাসগুলোর একটি। ৯৬০৯০০০টি বর্ণ, ১২৬৭০৬৯টি শব্দ এবং ৩০৩১টি পৃষ্ঠা। ইংরেজিতে বইটি অনূদিত হয়েছে In Search of Lost Time নামে। ঘটনা এগিয়ে গেছে বক্তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা দিয়ে।
শুধু মাত্র বিস্তৃতির জন্য না, বিষয়বস্তু আর লেখকের স্বতন্ত্র রচনাশৈলির কারণে উপন্যাসটি অন্যতম বিখ্যাত হিসাবে বিবেচ্য।
ওয়ার এন্ড পিস কিংবা আন্না কারেনিনার মতো থান ইট সাইজের উপন্যাস লেখক লিও তলস্তয়। মহাকাব্যধর্মী বিস্তার আর রাশিয়ার জীবনব্যবস্থাকে তুলে ধরার মুনশিয়ানার জন্য তাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বি বলে মনে করা হয়। অথচ একটা চমকপ্রদ তথ্য খুব সম্ভবত তার বেশির ভাগ ভক্তেরই অজানা।
প্রকাশকের কাছে পাঠানোর আগে কয়েক দফায় পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়ার এন্ড পিস’-এর। সাতটি আলাদা সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি নিজের হাতে কপি করেন স্ত্রী সোফিয়া তলস্তয়। মনে রাখা দরকার, উপন্যাসের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৪০০।
ভিক্টর হুগোর ‘লে মিজারেবল’ বিশ্বসাহিত্যে ক্লাসিকের মর্যাদায় অভিষিক্ত। ঘটনার সাবলীলতা এবং প্রেক্ষাপট নির্মাণে নতুন জোয়ার আনে বইটি। অগুণতি গুণের পরেও চমৎকার একটা তথ্য পাওয়া যায় এখানে। ৮২৩ শব্দব্যাপী লম্বা এক বাক্য অনায়াসে ব্যবহার করেছেন হুগো। যদিও সবচেয়ে দীর্ঘ বাক্য ব্যবহারের নজির আছে।
জোনাথন কোয়ে’র লেখা দ্য রোটার’স ক্লাব গ্রন্থে ব্যবহৃত বাক্যে শব্দের সংখ্যা ১৩৯৫৫। তার পরেই রয়েছে জেমস্ জোয়েসের ‘ইউলিসিস’। সেখানে ব্যবহৃত বাক্যে শব্দের সংখ্যা ৪৩৯১। বাক্যগুলো আসলে গঠিত হয়েছে যতিহীন অনেক বাক্যকে যুক্ত করার মাধ্যমে। দুই বা ততোধিক বাক্যাংশ যুক্ত হয়েছে কোনো প্রকার উপযুক্ত বিরাম চিহ্ন ছাড়াই।
আর্থার কোনান ডয়েলের নাম কে না জানে? গোয়েন্দা ও রহস্য উপন্যাস লেখার পুরোধা হিসাবে তার জনপ্রিয়তা কতটা উচ্চতায় ছিল তা প্রমাণিত। বেকার স্ট্রিটে শার্লক হোমসের ঠিকানায় সত্যিকার অর্থেই মানুষের চিঠি পাঠানো ঘটনাও নতুন না। সেই শার্লক হোমস্ লেখার সময়েই লেখক অপরাধের নানা সূত্র বর্ণনা করেছেন; যা তখনও পুলিশ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে অজানা ছিল। যেমন, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ বা ছাই জমিয়ে রাখা তার মতে টাইপরাইটারের অন্যতম সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
কোনান ডয়েল তার লেখায় খুবই সাদামাটা উপাত্ত ব্যবহার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। জুতা, চুল, টাই, হাতের লেখা, আঙুলের ছাপ থেকে বের হয়ে আসত অপরাধীর সত্যিকার পরিচয় এমনকি পূর্ববর্তী না দেখা ঘটনার বিবরণ। সত্যিকার অর্থে তার লেখার সময়ে আঙুলের ছাপ নিরীক্ষা কিংবা হাতের লেখা পর্যবেক্ষণ সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। তার বিভিন্ন লেখা এবং নানা তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে পরে পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগ নানা জটিলতা সমাধানের পথ উন্মোচন করতে সক্ষম হন।
যদি কোনো মরুভূমিতে নির্বাসন দেওয়া হয়; সাথে করে কোন পাঁচটি বই সাথে নেবেন? জবাবে বার্নাড শ’র কথা ছিল বেশ চমকপ্রদ। নাহ, কোনো বই নয়; সাথে করে তিনি নিতে চেয়েছেন পাঁচটি লেখাহীন শূন্য বই।
১৯৭৪ সালে তার এই চিন্তার যথার্থ রূপ দেয় ‘হারমনি বুকস্’ নামক এক আমেরিকান প্রকাশনা সংস্থা। বইয়ের নাম দেয়া হয় দ্য বুক অব নাথিং। বইতে মোট ১৯২টি সাদা পাতা যুক্ত ছিল। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রকাশনা সংস্থা থেকে জানানো হয়, ‘দ্য বুক অব নাথিং আসলে একটা খালি বই। সম্ভাব্যতার তো আর কোন সীমারেখা টানা যায় না। নিজের মতো করে উপন্যাস প্রোথিত করুন। সংকলন করে রাখুন নিজের চিন্তাবলি। ছবি আঁকা, তালিকা তৈরি, হিসাব সংরক্ষণ, অটোগ্রাফ সংগ্রহ, কবিতা, ছুটি কাটানো, ডায়েরি, ধাঁধা, সেলাইয়ের ছক, গান, গুরুত্বপূর্ণ তারিখ, প্রিয় বাক্য কিংবা একান্ত নিজস্ব কোনো কল্পনাকে সাজিয়ে রাখুন নিজের মতো করে। তার মানে আপনি যা করতে চান, এটি তাই।