থিওডর মমসেন : ইতিহাস রচনা করে পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার

বিশ্বসাহিত্য, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর | 2023-08-31 14:33:16

ইতিহাসচর্চায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। তবুও একজন ইতিহাস রচনা করেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি থিওডর মমসেন। প্রাচীন রোমান ইতিহাস রচনার জন্য ১৯০২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।

সে সময় তার আগে থেকে সাহিত্যে বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন এমিল জোলা, ডব্লিউ বি ইয়েটস, হার্বার্ট স্পেন্সারের মতো বিশ্ববিশ্রুত মানুষ। সবাইকে টেক্কা দিয়ে তাদের আগেই নোবেল পান মমসেন। কেন?

মমসেন রচনা করেছিলেন প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম লীলাক্ষেত্র রোমের আদ্যোপান্ত ইতিহাস। তিনি তাঁর ১৬ খণ্ডের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ‘করপাস ইনস্ক্রিপশন্স লাতিনেরাম’-এর জন্য বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন। এতে ইতিহাস রচনার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিজস্ব ঘরানার জন্ম দেন তিনি।

মমসেনকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সেরা ঐতিহাসিকের একজন রূপে, যা প্রতিফলিত হয়েছে তার আরেক গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব রোম’ রচনার সময়। এই রচনাগুলোই তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছিল। তিনি ইতিহাসকে উচ্চাঙ্গ সাহিত্যের আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন সৃজনশীল দক্ষতায়।

পাঁচ খণ্ডে হিস্টোরি অব রোম


 

তার পুরো নাম ক্রিস্তিয়ান ম্যাথিয়াস থিওডর মমসেন। নভেম্বর মাসটি তার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ১৮১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি ডেনমার্কের গার্ডিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯০৩ সালের ১ নভেম্বর ৮৫ বছর বয়সে জার্মানিতে পরলোকগমন করেন।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরের বছরই তিনি মারা যান। নোবেল কমিটি তাকে পুরস্কার দিতে বিলম্ব করলে তিনি এ পুরস্কার আর পেতেন না। কারণ নোবেল পুরস্কার মরণোত্তর দেওয়া হয় না। এ কারণে যথাসময়ে অর্থাৎ জীবিতকালে পুরস্কার না পাওয়ায় বিশ্বের বহু প্রতিভাবান ও যোগ্য মানুষ নোবেল বঞ্চিত হয়েছেন। মমসেনের সৌভাগ্য যে তিনি মৃত্যুর আগের বছর এ পুরস্কার পেয়ে নিজের অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হন।

মমসেনের কৈশোর ও ছাত্রজীবন কাটে হলস্টেইন শহরে। ইউরোপের নানা শহরে বসবাসের অভিজ্ঞতা তিনি পেয়েছিলেন। তার মা-বাবা দুজনই পণ্ডিত ছিলেন। তার জীবনের মূল শিক্ষা লাভ করেন তার বাবা জেমস মমসেনের কাছ থেকে। বাবার কাছ থেকেই তিনি গ্রিক, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি ইত্যাদি ইউরোপীয় ভাষা শিখেছিলেন।

মমসেনের বাবা সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। ফলে বাল্যকালেই মমসেন সাহিত্যের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তিনি শেক্সপিয়ার, বায়রন, ভিক্টর হুগো প্রমুখের সাহিত্যকর্ম পড়ে শেষ করে ফেলেন। এমনকি অল্প বয়সেই তিনি এইসব বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বেশ কিছু লেখা জার্মান ভাষায় অনুবাদও করে ফেলেন। এভাবে পিতার সাহচর্যে ও পারিবারিক পরিবেশে তিনি বিশ্ব এবং জার্মান সাহিত্য ও দর্শনের জগতে প্রবেশ করেন একেবারে অল্প বয়সেই।

১৮৩৮ সালে থিওডর মমসেন ডেনিস বিশ্ববিদ্যালয় কিইল-এ ভর্তি হন। আগে ইতিহাসে পড়লেও এখানে এসে ইতিহাসে তেমন আগ্রহ পাননি তিনি। পড়াশোনা শুরু করেন আইন বিষয়ে। পড়াশোনায় তিনি বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি রোমান আইন সম্পর্কে বিশেষ গবেষণা করেছিলেন। এই গবেষণা করাকালীন তিনি বুঝতে পারেন, রোমান আইনের ক্রমবিবর্তনের চিত্র প্রাচীন শিলালিপিতে পাওয়া যাওয়ার কথা। এই আগ্রহের বশেই একসময় প্রাচীন মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এসময় তার মনে শিলাবিদ বা এপিগ্রাফবিদ হওয়ার সাধ জেগেছিল, ঐতিহাসিক হওয়ার তেমন কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু রোমান আইনের মূল অনুসন্ধান করতে করতে ঐতিহাসিকে পরিণত হন তিনি। এ হিসেবে তিনি আইনের অধ্যাপক হয়েও রোমের সমৃদ্ধ ইতিহাস রচনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন।

ইতিহাস রচনার জন্য মমসেন ইতালিতে গিয়েছিলেন। মূলত আইন পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সরকারি বৃত্তি দিয়ে তিন বছরের জন্য ইতালিতে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে প্রাচীন রোমান শিলালিপি ও মুদ্রা সংশ্লিষ্ট প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে রচনা করেন ‘করপাস ইনস্ক্রিপশন্স লাতিনেরাম’ নামক ১৬ খণ্ডের একটি বইসিরিজ। এই বইয়ের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৩৩ সালে। আর ১৬তম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৩ সালে। গভীর ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়ের শক্তিতে সুদীর্ঘ ৩০ বছরের কঠোর পরিশ্রমে তিনি বইটির ১৬টি খণ্ডের প্রকাশনা শেষ করেন, যা ইতিহাসের ক্ল্যাসিক বা ধ্রুপদী বইয়ের মর্যাদা পেয়েছে।

১৮৪৮ সালে মমসেন জার্মানির লাইপেজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মনোনীত হন। এরপর ১৮৫২ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চলে যান তিনি। জুরিখে থাকার সময়ই তিনি সিদ্ধান্ত নেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে রোমের ইতিহাস আবার লিখবেন। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তার অবিরাম অধ্যবসায় শুরু হয়। অবিরাম লিখতে থাকেন পাতার পর পাতা। এসময় তিনি রাতে মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুমাতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “রাতে যা পড়ি, সকালেই তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।”

এই অবর্ণনীয় পরিশ্রমের মাধ্যমে মমসেন নতুন ইতিহাস গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব রোম’ রচনা করেন। ১৮৫৪ সালে বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটি পড়ে সমগ্র ইউরোপের সৃজনশীল লোকজন অভিভূত হয়ে পড়ে। মমসেনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশে। তার এই বইয়ের প্রথম তিনটি খণ্ডের বিষয়বস্তু ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দ থেকে শুরু করে দিগ্বিজয়ী বীর জুলিয়াস সিজার কর্তৃক উত্তর আফ্রিকার সেনেট সৈন্যদের পরাজয় পর্যন্ত সমগ্র রোমের ইতিহাস বৃত্তান্ত।

১৮৫৪ সালে মমসেন আবার জার্মানিতে ফিরে আসেন এবং প্রুশিয়ার ব্রাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এ সময়ই তিনি সেখানকার এক পুস্তক ব্যবসায়ীর কন্যা মেরি রেইমারকে বিয়ে করেন। পেশাগত কারণে তিনি পারিবারিক জীবনে খুবই কম সময় দিতে পেরেছিলেন এবং তার পরিবার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

মমসেন ১৮৫৮ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোমান ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন। কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জার্মানির প্রগতিশীল দলের সমর্থনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৬ এবং ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত প্রুশিয়ার সংসদের সদস্য পদে বহাল ছিলেন তিনি।

এ সময়কাল তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১৮৭০ সালে সেডানে প্রুশিয়া বা তখনকার জার্মানি ও ফ্রান্সের যুদ্ধে ফ্রান্স পরাজিত হয়। ১৮৭১ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে সম্পাদিত এক অপমানজনক চুক্তিতে ফ্রান্স স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এতে জার্মানির প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ঐক্যের নির্মাতা ছিলেন অটো ফন বিসমার্ক। এই ঐক্যের পর মমসেন জার্মান ইম্পেরিয়াল পার্লামান্টের (রাইখস্ট্যাগ) সদস্য হন। তখন তিনি বিসমার্কের অভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং এ কারণে তাকে কারাগারে অন্তরিন থাকতে হয়েছিল।

বিপুল কর্ম ও বিচিত্র জীবনধারার অধিকারী মেধাবী ঐতিহাসিক থিওডর মমসেন ১১৬ বছর আগে ১৯০৩ সালের ১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করলেও ইতিহাসচর্চার অঙ্গনে তিনি আছেন সমাসীন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর