এক বেঞ্চিতে ঠাসাঠাসি করে বসতেই হবে। কুমকুম, কাজরী, সুবর্ণা, ক্যামেলিয়া, রীমা, নিশু আর এনি। প্রায় সময়ই মাঝের ধাক্কাধাক্কিতে কোনার দুইজনের বসে থাকাই দায় হয়। ফিসফিস শব্দের ধমকাধমকি, হাসাহাসি, খোঁচাখুঁচি করে সময় যায় সারা বেলা। পেছনের বেঞ্চিতেই বসে অনিতা আর মমতা। ক্লাসের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারী। দুইজনের মাঝে তীব্র প্রতিযোগিতা। পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছুতেই তাই মন দেয় না। সামনের বেঞ্চে বসা সাতজনের দিকে কটমট করে তাকায় একটু পর পর। এদের ফিসফিসানিতে জরুরি এক পড়া বুঝতে বেশ ঝামেলা হচ্ছে এই দুইজনের। মোটা মতো খুশি আপার ক্লাস। মোটা মানুষদের রাগ থাকে কম, তা ভুল প্রমাণ করতেই যেন খুশি আপার জন্ম। রাগী এই আপার ক্লাসেও ফার্স্ট বেঞ্চে বসা সাতজনের গুঞ্জন আজ থামছেই না। বিষয়টি গুরুতর। ক্যামেলিয়ার প্রেমে পড়েছে সুবর্ণার প্রতিবেশি ছেলে মুক্ত। এ নিয়ে কিছুক্ষণ পরে পরেই চলছে তর্ক বিতর্ক। এনি লজিক্যালি আর সুবর্ণা ইমোশনালি বিষয়টি দেখছে। স্কুল জীবনে প্রেম করা উচিত কী উচিত না, তা নিয়ে দুই পাশের লড়াইয়ের শব্দগুলো ক্যামেলিয়া মন দিয়ে শুনছে। এর মাঝেই বজ্র কণ্ঠের ধমকে আপাতত ইস্তফা দিতে হয়। বিষয়টি ফয়সালা হবে ছুটির পর।
স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন এনি, রীমা, নিশু আর ক্যামেলিয়া হেঁটে বাড়ি ফিরে। কাজরী থাকে বেশ দূরে। যাত্রাবাড়ি। হাটখোলা থেকে অনেকটা পথ ফিরতে হয় বাসে করে। ফলে স্কুল ছুটির পর আর সময় করতে পারে না। স্কুল শেষে বেরুতে বেরুতে ক্যামেলিয়া মনস্থির করতে পারে না। তাঁকায় রীমার দিকে। রীমা সুবর্ণার দিকে তাঁকিয়ে বলে, রাজি হতে আবার এনির হরিণী চোখের ইশারায় বলে, “না না, রাজি হইস না। ছেলেরা খুব খারাপ হয়। এই ছেলে সিগারেট খায়, আমি শিওর। প্যান্টের পকেটের মাথা দিয়ে লাইটার বের হতে দেখেছি।”
সুবর্ণা দাঁত কিড়মিড় করে। রীমা চুপ হয়ে যায়। বহু তর্ক বিতর্কের পর এনিরে নিরাশ করে গেটের শেষ মাথায় গিয়ে ক্যামেলিয়ার হ্যাঁ সূচক শব্দধ্বনিতে বিজয়ী হয়ে সুবর্ণা ধরে বাড়ির পথ।
প্রপোজালের পর প্রথমদিনের প্রেম। একা ছাড়া যাবে না। ছেলেরা খুব খারাপ হয়, একা পেয়ে হাত যদি ধরে ফেলে। ফলে মনস্থির হয় প্রত্যেকেই যাবে দেখা করতে। সবার যাবার যুক্তিসঙ্গত কারণ লাগে, কারণ তৈরি হয় নিশুর ফেইক জন্মদিন। আর উল্লেখযোগ্য কারণ না দেখাতে পারলে বাড়ি থেকে সেজেগুজে বেরিয়ে আসাও তো মঙ্গলে পাড়ি দেবার মতোন দুঃসাধ্য!
ক্যামেলিয়ার বাড়িতে এনির বিশ্বাসযোগ্যতা অন্যদের চেয়ে বেশি। ফলে এনির ওপর দায়িত্ব থাকে ক্যামেলিয়াকে বের করবার। আজীবন সততার সাথে চলা এনির মন সায় দেয় না, এমন অন্যায় করতে। কিন্তু বিধিবাম। প্রত্যেকেই চেপে ধরেছে ওকে। সুবর্ণার ব্যবহার সবচেয়ে হৃদয় বিদারক। রীতিমতো ভিলেন বানিয়ে ফেলছে। অবশেষে এনি রাজি হয়। বহুকষ্টে ক্যামেলিয়াকে বের করতে পারে নিশুর জন্মদিনের কথা বলে। রীমার বাড়ি ওয়ারী। বিশাল বাগানবাড়ি। প্রতি শীতে বন্ধুদের পিকনিক ওদের বাড়িতেই তাই হয়। রীমার বাড়ি থেকে সামান্য ঝামেলা পেরিয়ে বের করে সোজা নিশুর বাড়ির সামনে। “শোন, আমায় কিন্তু বাসা থেকে দুইশ টাকার বেশি দেয়নি”, নিশু জানায়।
প্রত্যেকেই সম্মত হয় সবাই মিলেই প্রথম প্রেমের দিন যার বাহ্যিক নাম নিশুর জন্মদিনের খাবারের বিল দেবার ব্যাপারে। শেষ যাত্রা সুবর্ণার বাসা। ওকে কোনো রকমে বের করতে পারলে আজকের এডভেঞ্চারের ষোলোকলা। সুবর্ণার বড় বোন টিংকুদি ভীষণ ভালো, গেলেই শরবত, এটা সেটা খাওয়ায়। আজই কেন যেন সুবর্ণাকে বেরুতে দিতে চাইছে না। কোনো রকমেই যখন রাজি করানো যাচ্ছে না, এবার বেশ উচ্চকিত স্বরে শুরু হয় সুবর্ণার আথালি পাথালি কান্না। বাকি ছয়জন অর্ধমৃত চেহারা নিয়ে বসা। নেত্রী ছাড়া আজকের পুরো প্ল্যান বাতিল। আহারে! প্রথম প্রেমের প্রথম দিনের সম্ভাব্য অপমৃত্যু! শেষমেষ টিংকুদির মন গলে। বেরিয়ে আসে সুবর্ণা।
মুক্ত ভাইয়ার বন্ধু মিতু ভাইয়ার গাড়িতে যাবে সবাই। আরেক বন্ধু পিয়াল ভাইয়াও যোগ দিয়েছে। মিতু ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে, সামনে পিয়াল আর মুক্ত ভাইয়া। পেছনে সাতজন। চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের গেটে নামে। মেঘলা দিনেও নিশু আজ সানগ্লাস পরেছে। ব্যতিক্রমী দেখাতে। গোলগাল, নাক খাড়া, ফর্সা চেহারার নিশুকে সানগ্লাসে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। এনির বিশাল চোখের সামনে গেলে কবিতা আসে গড়গড়িয়ে। সাজতেও পারে সুন্দর। আবেদনময়ী মুখ নিয়েও গম্ভীর হয়ে রাস্তায় চোখ দেওয়া। কিছুটা থমথমেও। মনের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অপরাধের সাথী হতে হচ্ছে। কোঁকড়া লম্বা চুল, কোঁকড়ানো আইল্যাসের বাদামি চোখ আর ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙে রীমাকে দেখায় গ্রিক দেবীর মতোন। আজ সেও সাজার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ঠোঁটের লিপস্টিক আসতে আসতেই শেষ। আবরণটুকু সরায় ওর ফর্সা ধবধবে গোলাপী ঠোঁটগুলো আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। সুবর্ণা সবচেয়ে লম্বা, একাহারা, দেবীর মতোন ভীষণ সুন্দর চেহারা নিয়ে সাজগোজ না করেও লাবণ্যময়ী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাজরী সাজে না কখনোই। কথাও বলে কম, সবার কথা মন দিয়েই কেবল শোনে। কুমকুমকে আদর করে ঝাকড়ি বলে সবাই। কোঁকড়া দীঘল চুলগুলো কোমর ছড়ানো। কম উচ্চতার ক্যামেলিয়ার চেহারা ক্যাবলাকান্ত হতো পুরোই যদি গালে টোল না পড়ত। সবার মাঝে অসুন্দর হওয়ার মনোবেদনা দূর করতে বন্ধুরা তার শরীর খুঁটিয়ে দেখে এই একটা উপাদান বের করে এতই প্রশংসায় ভাসিয়েছে যে, যে কোনো কথায় গালের টোল দেখাবার চেষ্টায় হেসে হেসে কথা বলা তার রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
রেস্টুরেন্টের ভেতরেও নিশু চোখ থেকে সানগ্লাস খোলে না। কারণ আজ তার জন্মদিন। হোক না ফেইক। তবু ডিফরেন্ট এক লুক থাকা উচিত। খেতে খেতে চলে গল্প। প্রথম প্রেমের চোখাচোখি। দুরুদুরু বুক আর মুক্ত ভাইয়ার চাহনিতে ক্যামেলিয়া দিশেহারা মুখ থেকে থেকে গোলাপি হচ্ছে। হঠাৎই মনে হয়, সব নাই হয়ে যেত! মুখোমুখি বসত কেবল মুক্ত ভাইয়া। তা আর হবার না। প্রেম করা খুব খারাপ কাজ আর একা প্রেম করা তো খারাপের খারাপ। খারাপ কাজের ইচ্ছে এত বেশি কেন থাকে জীবনে? দীর্ঘশ্বাস চাপা দেয় ক্যামেলিয়া।
বিল আসলে এবার বিপদে পড়ে নিশু। গল্পে গল্পে নিশুকে সবাই টাকা দিতেই ভুলে গেছে। এদিকে সামনে তিনজন ছেলের সামনে প্রকাশ্যে টাকা চাওয়াও যাচ্ছে না। ওর কটমটে চোখেও প্রথমটায় বোঝে না কেউ। হঠাৎ মনে পড়লে সব তড়িঘড়ি করে টেবিলের নিচ দিয়ে হাতে হাতে টাকা পৌঁছায় নিশুর কাছে। হাসিমুখে নিশুর হাত এবার টেবিলের উপর ওঠে, “আর কিছু খাবা কেউ?”
আজীবন সুখ থাকে না। বিষাদের দিন ঘনিয়ে আসে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। আড্ডা, গল্পগুজব আর প্রেম পড়ার চাপে পুরোই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার পথে। এর মাঝে ইংরেজির দুর্বলতা টের পেল ওরা। সুবর্ণা আর রীমা ছাড়া বাকিরা পড়তে এলো মহিউদ্দিন স্যারের কাছে। মেয়েদের দলের সাথে একদল ছেলেও পড়বে। ছেলে আর কেউ না। মমতার ভাই ফারুক আর ওর তিন বন্ধু। টেস্টের পর স্কুল বন্ধ। মুক্ত ভাইয়ার সাথে যোগাযোগের নাই কোনো উপায়। স্যারের বাসায় এসে হঠাৎ নতুন সুযোগ পেয়ে যায় ক্যামেলিয়া। রাগী মমতার ভাই ফারুক খুব ফ্রেন্ডলি। দ্রুত বন্ধু হয়ে যায় ক্যামেলিয়ার। এর মাঝে ফারুক চমৎকার এক নীল ডায়েরি উপহার দেয় ক্যামেলিয়াকে, ভেতরের পাতায় কত কথা লেখা। ক্যামেলিয়া বোঝে, ওকেই কাজে লাগানো যাবে প্রেমে। এদিকে মমতার জন্য ফারুকের সাথে একলা কথা বলার জোও নাই। একদিন হুট করেই আসে সুযোগ। মমতা অসুস্থ। আসেনি। ফারুক বন্ধু হিসেবে উপকার করতে রাজি কিনা, আগেই প্রশ্ন করে জেনে নেয়। উপকারটা কী, জানার আগেই ফারুক কথাই কেবল দেয় না, ইংরেজি খাতা মাথায় নিয়ে বিদ্যা বলে প্রতিজ্ঞাও করে। ফলে লেখা হয় প্রথম প্রেমের চিঠি। গোটা অক্ষরের চিঠিটি ফারুকের হাতে যখন দিয়ে অনুরোধ জানায় মুক্ত ভাইয়ার কাছে পৌছে দিতে, ফারুক নিজ কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারে না, ক্যামেলিয়া এত খারাপ! কিন্তু কিছুই করার নাই। প্রতীজ্ঞা তো করে ফেলেছে, তাও আবার এসএসসি পরীক্ষার আগে পড়ার খাতা ছুঁয়ে। আরেক কারণও ছিল, ফারুক বেশ কিছুদিন হিমু হবার চেষ্টা করছে। গোলাপ ফুল চিবিয়ে খেয়ে বন্ধুদের কাছে হিমুর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরিও করেছে। হিমুদের কাজ প্রেম ভালোবাসাকে সমর্থন দেওয়া। ফলে বাজে মনে হলেও চরিত্রহীন ক্যামেলিয়ার প্রেমের চিঠি নিয়ে একটা পান কিনে খেতে খেতে ঝলসে যাওয়া দুপুরে ফারুক হাজির হয় মুক্ত ভাইয়ার বাড়ি। বাড়ির সামনে গিয়েই পিচিক করে পানের রস ফেলে খুঁজতে থাকে ভেতরে ঢোকার পথ।
পরীক্ষা শেষে রেজাল্টের দিনটি যেন এলো হরিণ বেগে। ছুটতে থাকা জীবনের প্রথম আঁচ আসে কিশোরীর জীবনগুলোয়। ভালো কলেজে ভর্তির ধাক্কা। নামকরা কলেজগুলোতে ভর্তি হবার প্রতিযোগিতায় আবারও বিষণ্ণ পড়ার জীবন। হঠাৎ করেই গল্প, আড্ডা আর বন্ধুতার হুল্লোড়ের ছেদ। অনিতা আর ক্যামেলিয়ার লড়াই হলিক্রস কলেজের জন্য। প্রবল লড়াই শেষে রেজাল্টের দিন সাদা বোর্ডের কালো সংখ্যাগুলোয় অনিতার রোল পাওয়া গেলেও, ক্যামেলিয়ার ক্রমশ কুয়াশা হয়ে আসা চোখ নিজের রোল খুঁজে বের করতে পারে না। ফেরার মুখে ক্যামেলিয়ার অধোবনত চোখের কান্নায় অনিতার মা পুরো রিক্সাজুড়ে বুকের মধ্যিখানে তাকে রাখে, জড়িয়ে বাসায় ফেরে। দুই তিনদিন পর পরের মেয়েটির জন্য পাগলের মতো ছুটে যায় হলিক্রসের প্রিন্সিপ্যালের রুমে। নাহ, হবে না। জ্ঞানের ব্রাহ্মণ্য রাজ্যে নমশূদ্রের জায়গা কোনো কালেই হয় না।
ভীষণ ভালো কলেজ না পেলেও সরকারি কলেজে ভর্তি হয় বন্ধুরা প্রায় সবাই। স্কুল জীবনের কড়াকড়ি সময়সীমা নেই। দারোয়ানকে অনুরোধ করে কলেজ ফাঁকি দেওয়া যায়, বুকের ওপরের নেমপ্লেট খুলে মার্কেটে মার্কেটে টাকা ছাড়াই নেইল পলিশ টেস্ট করার নামে দুই হাত রঙিন করে ফেরত আসা যায়, প্রবল ভিড়ে খাবার দোকানগুলোয় দাম না দিয়েই চলে আসা যায়।
মুক্ত ভাইয়ার সাথে ক্যামেলিয়ার সাময়িক বিচ্ছেদে প্রেমেও কেমন এক ভাটা চলে আসে। দেখা নাই, সাক্ষাত নাই, একটু একটু করে উবে যেতে থাকে চোখাচোখির প্রেম। এর মাঝেই খবর আসে, মুক্ত ভাইয়া এইচএসসিতে খারাপ করেছে। ক্যামেলিয়ারও দোটানা অবস্থা। মেয়েরা বরাবরই ক্লাসের ফার্স্ট বয়কেই বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত। এদিকে আবার এই পরিস্থিতিতে ছেড়ে আসার কথা বলাও অমানবিক, রীতিমতো অপরাধের। বিষয়টি ইতোমধ্যে বন্ধু মহলের সবাই জানে। রাগী মমতার কানে যেদিন প্রথম যায়, দুই চোখের আগুনে সেদিন ভয়াবহ চিতায় জ্বলে বাসায় ফিরতে হয় ক্যামেলিয়ার।
কলেজ দূরে। ফলে মমতা আর ক্যামেলিয়া কলেজ-জীবনের যাত্রাসঙ্গী। যাত্রায় অনেক কথার সাথে ক্যামেলিয়ার মনোবৈকল্যের কথাও শোনে। ধীর স্থির হয়ে সেদিনই ক্যামেলিয়াকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফেরে। ফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে, “এখনই ‘না’ বল!”
এইচএসসির পরই সব পুরোদস্তুর বিচ্ছিন্ন হয় পাকাপোক্তভাবে। ফারুকের সাথে ক্যামেলিয়ার কয়েক দফা ঝগড়ার সূচনা হয়েছিল এইচএসসির কিছুকাল আগে। কথা ছিল বন্ধ। হঠাৎ ক্যামেলিয়া একদিন খবর পায়, ফারুক চলে যাচ্ছে বিদেশ। পাগলের মতো ছুটে আসে, হাতে হুমায়ূন আহমেদের বই, হিমুকে নিয়ে গল্প। বহুদিন পরে দুই বন্ধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে বাকশক্তিহীন হয়ে। দুজনের চোখেই নিঃশব্দ জল।
বাকিরা ঢাকায় থাকলেও ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন জীবনে নতুন বন্ধুদের পদচারণায় পুরনো ফিকে হতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মেই। মানুষের চলার জীবনে এত শত গলিপথ, তবু পুরনো পথে বারেবারেই তার ফিরে আসা হয় কী এক অদ্ভুত সুতোর টানে! গল্পটা এখানেই শেষ তবু আরো কিছু কথা।
মমতা জার্মানি এখন। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ আর নাই তেমন। নিশু আমেরিকার এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। বাংলাদেশে আসার সময় ব্যাগভর্তি জিনিস নিয়ে আসে বন্ধুদের জন্য প্রতিদিনের কষ্টের টাকা জমিয়ে। কাজরী থাকে কানাডায়, আগের মতোনই নীরব, ফেইসবুকের নানান মন্তব্যে শান্তভাবে হাজিরা দেয় মাঝেমাঝে। কুমকুমের দশাও তা। থাকে ঢাকার বাইরে। বন্ধুদের সাথে দেখা আর হয় না। ভাইরাল যোগাযোগ ছাড়া। রীমা, এনি, সুবর্ণা থাকে ঢাকায় প্রাসাদোপম বাড়িতে, সংসার আর সন্তান নিয়ে ভীষণ কর্মব্যস্ততার মাঝে। বিদেশ থেকে ফিরে ফারুক এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আগের মতোই ঝগড়াটে, কেবল ক্যামেলিয়ার সাথেই। কলেজের কর্মব্যস্ততায় ডুবে ক্যামেলিয়া পার করে জীবন। মধ্যবয়সের জীবন-সায়াহ্নের মানসিক ক্লান্তিতে রিক্সায় ফিরতে ফিরতে চোখ হঠাৎ ঝাপসা হতে থাকে, দেখতে পায়, পাশের রিক্সায় এনি আর সুবর্ণা চলছে। শাড়ি পরার অনভ্যস্ততায় এনির শাড়ি কখন হাতের কাছে লুটানো টেরও পায়নি ১৬ বছরের কিশোরী। এক চিলতে হাসি সারা মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, সেই কিরণ মাখানো মুখ ঝিকমিক করে ওঠে বালুর মতোন। চারপাশের সাদা বরফে ঢাকা বাগান শার্সির এপাশ থেকে দেখতে দেখতে অনিতার ঘোর জাগে। নীরব তুষারপাত হয়ে যায় ঝিমঝিমে বৃষ্টি ভেজা দিন, চোখের সামনে আসতে থাকে একের পর এক মুখ, গলির শেষ মাথায় থাকে সামনের বেঞ্চের নচ্ছারগুলো যাদের জ্বালায় পড়া যদি একটু শুনতে পারা যায়!