সুলতান মাহমুদ: যোদ্ধা ও শিল্পবোদ্ধা

আত্মজীবনী, শিল্প-সাহিত্য

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 16:58:20

গজনির সুলতান মাহমুদ (জন্ম ২ নভেম্বর ৯৭১, মৃত্যু ৩০ এপ্রিল ১০৩০) কখনো ভারত শাসন করেননি। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে তিনি একজন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক চরিত্র। কারণ ১৭ বার তিনি ভারত আক্রমণ করেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ভারতে শাসন বিস্তার না করে প্রতিবারই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কেন?

কারণ সুলতান মাহমুদ ভারতে আসতেন সম্পদ আহরণ করতে। তার লক্ষ্য ছিল বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির। সে আমলে ব্যাংক ছিল না। টাকা,পয়সা নিরাপদে রাখা হতো মন্দিরের প্রতিমার নিচের গোপন ঘরে। আর মানুষ শ্রদ্ধা ও আবেগে সেসব পাহারা দিত।

সুলতান মাহমুদ কয়েক বছর পর পর আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে মন্দিরে জমাকৃত সোনা, দানা, সম্পদ নিয়ে যেতেন। মন্দির ধ্বংস করার উদ্দেশ্য তার ছিলনা। থাকার ইচ্ছা থাকলে তিনি ১৭ বার আক্রমণ করতেন না। প্রথম আক্রমনেই নিজের অধিকার ও শাসন প্রতিষ্ঠা করতেন।

যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যসহ সুলতান মাহমুদ, ছবি: সংগৃহীত

 

আফগানিস্তানের ইরান সংলগ্ন গজনির শাসক সুলতান মাহমুদ বার বার ভারত আক্রমণ করে ফিরে গেলেও তিনিই ছিলেন মুসলিম শাসনের পথ প্রদর্শক। মাহমুদের পথ ধরেই কিছুদিন পর গজনির পার্শ্ববর্তী ঘোর নামক রাজ্যের শাসক মুইজউদ্দিন শিহাবউদ্দিন ঘোরি (১১৪৯–১২০৬) ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন।

ঘোরি ১১৯২ সালে রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। ১১৯৩ সালে ঘোরি দিল্লি নগর প্রতিষ্ঠা করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন এবং তার সেনাপতি কুতুবউদ্দিন আইবেককে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে স্বদেশে ফিরে যান। ঘোরি তার অন্যান্য সেনাপতিদের ভারতের বিভিন্ন দিকে অভিযানের নির্দেশ দেন এবং তার সেনাপতিদের একজন ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০৩ সালে বঙ্গ বিজয় করে সেখানে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

সমগ্র ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের পথ ও সুযোগ সৃষ্টি করার নেপথ্যে সুলতান মাহমুদের পূর্ববর্তী আক্রমণগুলো অনুপ্রেরণা ও পথনির্দেশনার কাজ করেছিল। সুলতান মাহমুদ একজন সাহসী যোদ্ধা ও দক্ষ বিজেতার পাশাপাশি ছিলেন সাহিত্যের সমঝদার ও শিল্পবোদ্ধা। ইতিহাসে তিনি বীর যোদ্ধা ছাড়াও অমর হয়ে আছেন মহাকবি ফেরদৌসি ও মহাপন্ডিত আল বিরুনির পৃষ্ঠপোষক রূপে।

সাহিত্য, কবিতা, শিল্পের প্রতি তার অনুরাগ ছিলো ইতিহাসখ্যাত। মহাকবি ফেরদৌসি এবং মহাপন্ডিত আল বিরুনীর মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা তার নৈকট্য ও সহযোগিতা লাভ করেন। মহাকবি ফেরদৌসি তার জগদ্বিখ্যাত মহাকাব্য 'শাহনামা' সুলতান মাহমুদকে উৎসর্গ করেন।

সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত হয়ে বিশ্বখ্যাত পন্ডিত আল বিরুনিও গুরুত্বপূর্ণ রচনা সম্পন্ন করেন। আল বিরুনি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'কিতাবুল হিন্দ' বা 'ভারততত্ত্ব' রচনা করেন সুলতান মাহমুদের সৈন্যদলের সঙ্গে ভারতে আসার সুবাদে। আল বিরুনির এই গ্রন্থের মাধ্যমেই বিশ্ব প্রথমবারের মতো ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণ, প্রথা, ভূগোল ইত্যাদি সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে জানতে সক্ষম হয়।

সুলতান মাহমুদ ৯৭১ সালের ২ নভেম্বরে বর্তমান আফগানিস্তানের (সাবেক জাবালিস্তান) গজনি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সবুক্তগিন ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস এবং সেনাপতি, যিনি ৯৭৭ সালে গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন খোরাসান এবং ট্রান্সঅক্সিয়ানার সামানি রাজবংশের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকাজ পরিচালনা করেন।

মাহমুদের শৈশব সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি। মাহমুদের মাতা একজন সম্ভ্রান্ত ইরানি পরিবারের কন্যা ছিলেন। এই সূত্রে ফারসি সংস্কৃতির অনুরক্ত ছিলেন তিনি। কাওসারি জাহান নামে এক আমিরজাদিকে বিয়ে করেন তিনি এবং মোহাম্মদ ও মাসুদ নামে তার দুই পুত্র সন্তান ছিলো। এরা পর্যায়ক্রমে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে শাসন পরিচালনা করেন। পরে মাসুদের পুত্র মওদূদ গজনভি সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। গজনির শাসন মধ্য এশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ও চীনের কিয়দাংশ এবং ভারতবর্ষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

সুলতান মাহমুদের সার্বক্ষনিক সঙ্গী হিসেবে মালিক আইয়াজ নামে এক জর্জিয়ান দাসের বর্ননা পাওয়া যায়, যিনি ছিলেন তার বন্ধু, সহযোগী ও পরামর্শদাতা। ৯৯৪ সালে পিতা সবুক্তগিনের খোরাসান অভিযানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মাহমুদ রাজকার্যে অংশগ্রহণ শুরু করেন। সামানি শাসক দ্বিতীয় নূহের সহায়তায় তিনি খোরাসান অধিকার করতে সমর্থ হন। বিভিন্ন অভ্যন্তরীন দ্বন্দে এসময় সামানি রাজবংশ খুব অস্থির সময় পার করছিলো। ফলে গজনি ক্রমে ক্রমে প্রভাবশালী ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে।

৯৯৭ সালে সবুক্তগিন মারা যান এবং তার ছেলে ইসমাইল গজনভির সুলতান হিসাবে মসনদে বসেন। তবে মাহমুদ তার ক্ষমতাসীন ভাই ইসমাইলের চেয়ে বড় এবং অভিজ্ঞ হলেও বৈমাত্রেয় মায়ের প্রভাবে তিনি প্রাথমিকভাবে ক্ষমতার লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েন। মাহমুদের বৈমাত্রেয় মাতা ছিলেন সবুক্তগিনের পৃষ্ঠপোষক আলাপ্তগিনের কন্যা এবং প্রভাবশালী রাজমাতা, যার সুবাদেই ভাই ইসমাইল ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান।

কিন্তু সুলতান মাহমুদ অচিরেই রাজ্য ও শাসনের পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন। খুব দ্রুতই মাহমুদ বিদ্রোহ করেন এবং তার আরেক ভাই আবুল মুজাফ্ফারের সহায়তায় ইসমাইলকে পরাজিত করে গজনভি সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন। তিনি তার আরেক সহযোগী আবুল হাসান ইসফারাইনিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গজনি থেকে পশ্চিমে কান্দাহারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন। তার পরবর্তী লক্ষ ছিলো বোস্ট শহর, যেটিকে তিনি একটি সামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

সুলতান মাহমুদ জীবৎকালে দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদল গড়ে নিজের শক্তি ও প্রাধান্য চারদিকে সম্প্রসারিত করতে থাকেন। একজন বীর সেনাপতি ও অনন্য বিজেতার পরিচয়ে তিনি ভূষিত হন। ১০৩০ সালের ৩০ এপ্রিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পূর্ব ইরানিয় ভূমি এবং ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ (বর্তমান'আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) জয় করেন এবং ভারতে বার বার আক্রমণের কৃতিত্ব দেখান।

সুলতান মাহমুদ একসময়ের প্রাদেশিক রাজধানী গজনিকে মধ্য এশিয়ার ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে পরিণত করেন। তিনি গজনিকে সে সময়ের এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে উন্নীত করে নিজেকে সুলতান (কর্তৃপক্ষ) উপাধিধারী প্রথম শাসকরূপে অভিষিক্ত করেন এবং মুসলিম জাহানের মূলকেন্দ্র আব্বাসিয় খিলাফতের সমর্থন নিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের শাসন চালু রাখেন।

আফগানিস্তানের ডাকটিকেটে সুলতান মাহমুদ, ছবি: সংগৃহীত

 

ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শাসনের রূপকার ছাড়াও আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জাতীয় বীররূপে স্বীকৃত হন সুলতান মাহমুদ। আফগানিস্তানে বহু প্রতিষ্ঠান তার নামাঙ্কিত এবং সেদেশের ডাকটিকেটে তার ছবি ব্যবহার করত।

মধ্যযুগের রাজনৈতিক ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ এশিয়ার অন্যতম প্রধান নৃপতি। তিনি যুদ্ধ ও বিজয়ের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, দর্শনের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নিজের নাম ও কীর্তিকে স্মরণীয় করেছেন এবং ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসন পেয়েছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর