এমন টিপটিপ বৃষ্টির মাঝে ঘর থেকে বের হওয়া মোটামুটি সাইজের পাপ। কিন্তু কিছু করার নেই, বের হতেই হবে। আজ টাকাটা না আনতে গেলে রাতে খাওয়া হবে না। এই পত্রিকা অফিসে টাকাটা অনেক দিন আটকে আছে। এডিটরকে এর আগে বেশ কিছুদিন তাগাদাও দেওয়া হয়েছিল। আজ নিজ থেকেই বাড়িওয়ালার ল্যান্ডফোনে কল করে যেতে বললেন।
আমি ফ্রিল্যান্স কন্ট্রিবিউটর। তিনটা কবিতার বই, একটা উপন্যাস বের হয়েছে কিন্তু কোনো বিক্রি নেই। পকেট রেসকোর্সের ময়দান হয়ে থাকে বছরের অর্ধেক সময়। ফুলটাইম লেখালেখি করলে যা হয় আরকি।
সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে রাস্তার সামনের চায়ের দোকানের কাছাকাছি আসতেই মনে পড়লো ছাতাটা নেওয়া হয়নি আর ঘরে তালাও দেওয়া হয়নি সম্ভবত।
আমার ভাঙা চিলেকোঠা থেকে চুরি যাওয়ার মতো কিছু না থাকলেও ছাতার জন্য হলেও উপরে যাওয়া দরকার। আবার উপরে উঠব কিনা ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল, অগ্যতা আমিও চায়ের দোকানে ঢুকলাম। ভাবলাম এক কাপ চা খেতে খেতে বৃষ্টিটা ধরে এলেই ছাতাটা নিতে উপরে উঠব।
পরপর দু কাপ চা খাওয়ার পরও বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ তো নেই-ই বরং বেড়েই যাচ্ছে। চায়ের দোকানেও তেমন লোকজন নেই। কোনার দিকে যেখানে বৃষ্টির ছাঁট পৌঁছাচ্ছে না সেদিকে সরে যেতেই লক্ষ করলাম আধো অন্ধকারে সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। দেখেই নিকোটিনের তৃষ্ণাটা চেপে বসল। পকেটে হাত বুলিয়ে ন্যাতনেতে ২০ টাকার নোটের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে নিলাম। মনে মনে হিসেব করছি একটা গোল্ডলিফ কেনার পর বাস ভাড়া হবে কিনা।
মনে পড়ল দু কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে, সিগারেট কিনলে পত্রিকা অফিসে যাওয়া হবে না। এইদিকে বৃষ্টিও কমবার নামগন্ধ নেই। বেঞ্চের কাছাকাছি সরে বসলাম। সেকেন্ড হ্যান্ড ধোঁয়াতে যদি নেশা কিছুটা কমে।
লোকটা মনে হয় আমার উশখুশ ভাব দেখে ব্যপারটা আঁচ করতে পারল। অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এলো। বেনসনের প্যাকেট এগিয়ে ধরে বলল—নিন।
অচেনা একজন পরিচয়হীন লোকের থেকে সিগারেট নিব কিনা ভাবতে ভাবতে একটা শলাকা তুলে নিলাম। নিকোটিনের এমনই নেশা! মনে মনে ভাবছি লোকটাকে আগে তো এই এলাকাতে দেখিনি।
অন্ধকারে চেহারাটাও বোঝা যাচ্ছে না, ধন্যবাদ বলতেই লাইটার জ্বালিয়ে এগিয়ে ধরলেন, এবার হালকা আলোয় চেহারায় বসন্তের দাগগুলো এক ঝলকের জন্য ভেসে উঠল। বললাম, আপনাকে আগে এই এলাকায় দেখিনি, নতুন এসেছেন নাকি?
‘আমি এই এলাকার না’—গলার স্বরে কর্তৃত্বভাব স্পষ্ট। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় থাকেন? কী করেন?
‘আমি কিছু করি না, শুধু করাই, আপনি কী করেন?’—পাল্টা প্রশ্নে বিব্রত আমি।
বললাম, কিছু করি না তেমন, লেখালিখি করি টুকটাক।
‘ওহ লেখক আপনি?’ এবার তার কণ্ঠে কিছুটা আগ্রহ টের পেলাম। আমি বললাম নাম ডাক আছে তেমন কেউ না।
উনি বললেন, তাতেও চলবে। আমার একটা গল্প লিখে দিতে পারবেন? ভালো পারিশ্রমিক দেব।
শুনে বেশ মজা পেলাম। মজার তো লোকটা! গল্পও বলবেন আবার পারিশ্রমিকও দেবেন। বাইরে বৃষ্টিও কমবার নামগন্ধ নেই।
আমি বললাম আমি তো গল্প তেমন একটা লিখি না, তবু শুনি আপনার গল্প।
আসলে এইটা কোনো গল্প নাকি সত্যি ঘটনা তা বিবেচনা করার দায়িত্ব আপনার। বলেই তিনি শুরু করলেনঃ
আমার গ্রামের নাম নিশ্চিন্তপুর। আমি যখন খুব ছোট আমার মা মারা যায়। আমার বাপ ছিল নিষ্কর্মা। কাম কাইজ কিছু করত না। মানুষের থেকে চেয়েচিন্তে চলত। আমার বয়স যখন পাঁচ তখন আমার বাপ আমারে পালক দিয়া দেয় ছয় গ্রাম পর ভাওয়ালপুরে। আমার পালক পিতা-মাতা ছিল জোতদার। অনেক বিষয় সম্পত্তির মালিক কিন্তু নিঃসন্তান। আমি ছিলাম তাদের চোখের মণি। তবে তারা আমারে আমার বাপের কাছে যাইতে দিত না। হয়তো ভয় ছিল গেলে আর ফিরে আসব না। এইভাবেই দিন যাইতেছিল।
তার চার বছর পর আমার বয়স যখন নয়, তখন একদিন আমার পালক বাপ আমারে ডাইকা বলল তোমার আসল পিতা গত পরশু ইন্তেকাল করেছেন, আমি তোমারে জানাই নাই কারণ সে মারা গেছে গণপিটুনিতে।
আমি নিঃশব্দে অন্য ঘরে চলে গেলাম।
তার ১৬ বছর পর আমি জানলাম কী কারণে আমার বাপ গণপিটুনিতে মারা গেছিল।
এই ঘটনার দশ বছরের মধ্যে আমার পালক পিতা মাতা দুইজনই মারা গেলেন। আগেই বলেছি আমার পালক পিতামাতা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। আমি সেইসব সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসি। প্রথমে পুরান ঢাকায় বাতিল মালের দোকান কিনি একটা। এখন পুরান ঢাকায় আমার সাতটা দোকান। তার মধ্যে ২টা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি।
আমি অবিবাহিত। যৌবনে টাকা বানানো আমার নেশা হয়ে গেছিল, সেই নেশায় পড়ে বিয়েশাদি করা হয় নাই। আমার আরো একটা নেশা আছে। সেই গল্পটাই আপনারে বলব।
আমার নিষ্কর্মা বাপ মারা যায় গণপিটুনিতে চোর সন্দেহে। আমার বাপ ভিক্ষুক ছিল, শেষে হয়তো ভিক্ষা তেমন না পাইয়া চুরি করা শুরু করে। গ্রামের মানুষ ভিক্ষা দিবে কী নিজেরাই খাইতে পায় না। জানেন, যখন এই ঘটনা জানলাম তখন ভিক্ষুকদের ওপর আমার একটা মায়া কাজ করা শুরু করল।
তারপর প্রথম আমি এই কাজটা করা শুরু করি আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে পঙ্গু, অন্ধ, শারীরিকভাবে অক্ষম ভিক্ষুক ধরে আনা শুরু করলাম। তাদের পুনর্বাসন করব এই ছিল আমার ইচ্ছা। ব্যপারটা সহজ ছিল না আর সবাই যে স্ব-ইচ্ছায় আসছে তাও না। তবে তার চেয়েও ভয়াবহ এমন এক চক্রের সন্ধান পাই আমি।
এই চক্র ভিক্ষুক বানানোর চক্র। তাদের সাথেই আমার ফাইটটা দিতে হইছে বেশি। কারণ আমি তাদের ব্যবসায় হাত দিছি। কিন্তু আমি এত সতর্কতার সাথে আমার খেলা খেলছি সেই চক্র জানেই না তাদের সোনার ডিম পাড়া হাঁসেরা আজ কোথায় কে। হাহাহাহা।
যেসব ভিক্ষুক স্ব-ইচ্ছায় আসে নাই তাদের লোভ দেখায়ে, যারা লোভে পড়ে নাই তাদের উঠায়ে নিয়ে আসছি। তাদেরকে ধরে আমার কেমিকেল ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসতাম। আমার একটা ফ্যাক্টরি আন্ডারগ্রাউন্ড। উপরে দোকান নিচে কারখানা। আমার সেই দোকানের আন্ডারগ্রাউন্ড হইল ভিক্ষুক পুনর্বাসন কারখানা।
তারপর তাদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করলাম। এইটাও সহজ ছিল না, কিন্তু টাকা থাকলে কী না হয় বলেন? তাদের সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট ব্যবসা, চায়ের দোকান, মুদি দোকান করে দিলাম। সারাদেশেই এদের ছড়ায়ে দিলাম যাতে সেই চক্রের লোকজন তাদের আর খুঁজে না পায়। এইভাবে আমি এই পর্যন্ত মোট ৬৮৩ জন ভিক্ষুক পুনর্বাসন করছি।
আরেকটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন, “বলেন আমার মতো সমাজ সংস্কারক আরেকটা দেখছেন জীবনে?”
আমি তখন লাইটারের আলোয় এই আজব লোকটাকে দেখে বিস্মিত না হবার চেষ্টা করছি। তারপর লোকটা পকেট থেকে দশটা এক হাজার টাকার নোট বের করে টেবিলে রেখে বলল, “গল্পটা আপনার না লিখলেও চলবে।”
প্রত্যেক বছর এই দিনে আমি এই গল্পটা একজন মানুষকে বলি। গল্প বলার মতো আমার কেউ নাই। কথাটা শেষ করেই লোকটা অন্ধকার বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে গেল। যাওয়ার আগে দোকানদাররে বলে গেল, হানিফ, ইনার চায়ের বিল আমার।
এক চোখ নষ্ট হানিফ আমার দিকে নির্লিপ্ত তাকিয়ে আছে আর আমি পেছন থেকে তাকিয়ে দেখছি একজন না-মানুষ কী করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।