উত্তর ভারত ঘুরে: তাজমহল থেকে বের হয়ে অলিগলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে রাতের আগ্রার মুখোমুখি হলাম। পুরনো আগ্রার ঘিঞ্জি এলাকার ভিড়, রিকসার টুংটাং, মিনা বাজারের হৈচৈ ফেলে চলে এসেছি নগরীর আলো-শোভিত এভিনিউ-এ।
মোবাইল অ্যাপে হোটেল বুক করা আছে, ড্রাইভার সুরজিৎ সেখানে ব্যাগ রেখে বিশ্রাম নিতে চলে গেলো। আমরা কাল সারাদিন ঘুরে রাতের মধ্যে জয়পুর ফিরে যাবো, এমন চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে। কাজটি ভুল হয়েছে। যে টাকায় আগ্রা-জয়পুর আপ-ডাউন করছি, তাতে জয়পুর-আগ্রা হয়ে দিল্লি চলে যাওয়া যেতো। রাস্তায় যেতে কষ্ট হবে ভেবে আমরা জয়পুর থেকে দিল্লির প্লেনের টিকেট কেটে রেখেছি। ফলে আমাদের জয়পুরই ফিরতে হচ্ছে। এতে সময় ও টাকা খরচ হলো বেশি। একই পথ দুবার ঘুরতে হলো। যদিও চমৎকার সুপার হাইওয়েতে ভ্রমণের কষ্ট টেরই পাওয়া গেলো না।
আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হতো, জয়পুর থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লি চলে যাওয়া। জয়পুর-আগ্রা-জয়পুরের খরচে জয়পুর-আগ্রা-দিল্লি যাতায়াত হয়ে যেতো। সময় যেমন বাঁচতো, তেমনি হোটেল আর জয়পুর-দিল্লির বিমান ভাড়াও লাগতো না। অভিজ্ঞতা না থাকার ভুলে সময় ও টাকার গচ্চা দিতেই হলো।
উত্তর ভারতে হোটেল বেশ সুলভ, কলকাতার চেয়েও কম টাকায় ভালো হোটেল পাওয়া যায় অ্যাপে। গাড়িও অ্যাপে নেওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে, টু ওয়ে, ঘণ্টা ধরে গাড়ি পাওয়া যায়। সুরজিৎ সার্বক্ষণিক থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ। সে থাকতে চেয়েছিলও। কাল আবার জার্নি করবে আর আমি হেঁটে শহরের জীবনকে স্পর্শ করতে চাই বলে ওকে বিদায় দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরতে শুরু করি। অবশ্য প্রয়োজন হলে ফোনে ডাকলেই সে ছুটে আসবে। আর আমাদের হোটেলের পাশেই কম দামের একটি হোটেলে সে উঠেছে। অতএব চিন্তার কিছু নেই।
ঘুরাঘুরির সময় খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটাও আমি ঝামেলাহীন রাখি। যেখানে সুবিধা হয় খেয়ে নিই। প্রধানত পাউরুটি, কলা, আপেল, ডিম সেদ্ধ, দুধ খেয়ে দিব্যি চলছে। রাতের দিকে ভারি ডিনার করবো ভেবে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম আগ্রার মূলকেন্দ্রে।
এতো বছরের পুরনো হলেও আগ্রার শহরে মুঘলাই রোশনাই ঝলঝল করছে। চারিদিকে বাগান, উদ্যানের ছড়াছড়ি। আগ্রা ফোর্টের সামনে শাহজাহান গার্ডেন তো এলাহী ব্যাপার। আর আছে মোড়ে মোড়ে সড়কদ্বীপে নেতৃবৃন্দের ভাস্কর্য। নেতাজি সুভাস বসুর মূর্তি পেলাম। পেলাম উত্তর ভারতের পুরনো হিন্দু শাসক পৃথ্বিরাজ চৌহানের মূর্তি। উত্তর প্রদেশ হিন্দু সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন বিজেপি’র শাসনে থাকায় হিন্দুত্ব পুনরুত্থানের বিশেষ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় এসেই প্রাচীন নগর এলাহাবাদের নাম বদলে রেখেছে প্রয়াগ। বিখ্যাত মুঘলসরাই রেলজংশন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নামও বদল করা হয়েছে।
শুনতে পেলাম, আগ্রার নামও বদলে অগ্রবন রাখা হবে। কিন্তু ইতিহাসবিদ ও সুশীল সমাজ তা হতে দিচ্ছেন না। তারা অগ্রবন নামের অস্তিত্ব পাচ্ছেন না। বরং আগ্রা নামের মজবুত ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে। মুঘলদের আগে লোদি বংশও আগ্রায় অনেক স্থাপনা করেছে। আগ্রা সম্পূর্ণভাবে মুঘল ও মুঘল-পূর্ব মুসলিম শাসকদের শহর। ফলে যোগীকে খানিক পিছিয়ে গেছেন।
আলোশোভিত, উদ্যানময় এভিনিউ ফেলে চলে এলাম আগ্রার বিখ্যাত জামে মসজিদে। বিরাট চত্বর, মিনার, গম্বুজ, ক্যালিগ্রাফিতে সমৃদ্ধ মসজিদটি চট দেখলে মধ্য এশীয় কোনও স্থাপনা বলে ভ্রম হবেই। পাথুরে কাঠামোতে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে। দেশি-বিদেশি পর্যটক-দর্শনার্থীদের ভিড় এখানেও দেখতে পাওয়া গেলো।
মসজিদের পাশে আগ্রার বিখ্যাত পাইকারি বাজারগুলো অবস্থিত। চামড়ার জুতা, পোশাক, ধাতব তৈষজপত্র ইত্যাদিতে ঠাসা ছোট ছোট অসংখ্য দোকান। পুরনো ঢাকার চকবাজার বা লালবাগের মুঘল নগর বিন্যাসের আদল এখানেও লক্ষণীয়। দোকানের মালামাল আর হরেক রকম ক্রেতায় ঠাসাঠাসি ভিড়। দামও আধুনিক মলের চেয়ে অনেক কম। সস্তায় মজাদার খাবারের অনেক হোটেলও পাওয়া গেলো। মাংসের প্রাধান্যে মুঘলাই রান্নার প্রাচুর্য হোটেলগুলোতে।
অনেকেই আমাদের ইতিমুদ্দৌলাহ নামের একটি সমাধিস্থলে যেতে পরামর্শ দিলেন, যাকে 'শিশু তাজমহল' বলা হয়। এটা দিল্লির হুমায়ূন মাকবারা আর সেকেন্দ্রার আকবর মাকবার অনুরূপ। মাকবারা মানে সমাধিস্থল। মুঘলরা মধ্য এশীয় রীতিতে সমাধি সৌধ নির্মাণ করতেন, যার অনেকগুলো এখনো ভারতের নানা স্থানে অটুট।
ইতিমুদ্দৌলা যমুনা নদীর পূর্ব পাশে অবস্থিত সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ও মাতা আসমৎ বেগমের কবরগাহ। নূরজাহান নিজের অর্থে এই সুরম্য সৌধ নির্মাণ করেন।
আরেকটি জায়গায় যাওয়ার জন্যও পরামর্শ ছিল। সেটার নাম মাহতাব বাগ, যার বাংলা হলো ‘চন্দ্রালোকিত বাগান’ (মুনলাইট গার্ডেন)। সম্রাট বাবর এটি নির্মাণ করেন যমুনার অপর তীরে, যেখান থেকে ভিন্ন কৌণিক অ্যাঙ্গেলে তাজমহল ও আগ্রা দুর্গকে দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষত রাতে এবং জোছনায় মাহতাব বাগ থেকে তাজের অসামান্য সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। নদীর জোছনা প্লাবিত স্তোতের পাশে শ্বেত মর্মর তাজের অনিন্দ্য অবয়ব দেখার জন্য মাহতাব বাগ শ্রেষ্ঠ স্থান।
সময় স্বল্পতার কারণে এসব এবং আরও কিছু ছোট-খাট স্থাপনা, ঐতিহাসিক, দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব হলো না এবারে ভ্রমণে। মনে মনে ঠিক করলাম, এটা কেবল প্রাথমিক দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়।
না দেখার আফসোস আর যতটুকু দেখেছি, তার তৃপ্তি নিয়ে নগর পরিভ্রমণ শেষে হোটেলে ফিরে এলাম। আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেটি তিনতলায়। একতলায় দেখতে পেলাম কোচিং সেন্টার চলছে। বাইকে চেপে জিন্স আর টি-শার্ট চাপিয়ে অসংখ্য ছেলেমেয়ে ক্লাসে আসছে, যাচ্ছে। সম্ভবত দিনে কোনও চাকরি করে প্রাইভেটে তারা পড়াশোনা করছে। ক্যারিয়ার আগে বাড়াতে এসব প্রতিযোগিতামূলক শহরে ডিগ্রি, ট্রেনিং নিয়েই চলতে হয়। আগ্রাতেও তেমন ধারা চলছে।
দিল্লি বা বেঙ্গালুরুর মতো নারীর নিরাপত্তাহীনতা আগ্রায় ততটা প্রকট মনে হলো না। রাত ১১/১২টা পর্যন্ত অনায়াসে তরুণ-তরুণীরা নিজস্ব বাইকে চড়ে চলাফেরা করছে। দীপক রাঠোর নামে একটি ১৯/২০ বছরের ছেলে হোটেলে দেখা করতে এলো। আমাদের জয়পুরের বন্ধুর পরিচিত ছেলেটি কলেজে পড়ে এবং স্থানীয় ক্লাবে ক্রিকেটে খেলে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক খোঁজ-খবরই সে রাখে। সুস্বাস্থ্যবান দীপক ছাড়াও প্রতিটি ছেলেমেয়েকেই স্বাস্থ্য সচেতন মনে হলো। দীপকের বাইকে আশেপাশের এলাকায় এক চক্কর দিতে দিয়ে পথে পথে জিম দেখেছি অনেকগুলো। জীবনকে উপভোগ করতে হলে অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে নিজের কাজ অন্য কারো ভরসা ছাড়া নিজেকেই যে করতে হবে, এই কাণ্ডজ্ঞানটি আগ্রায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রকট। পথে পথে অলস আড্ডা, চা খেয়ে, সিগারেট ফুঁকে ফুটপাত দখল করতে বিশেষ কাউকে দেখিনি। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত এবং সেটা অবশ্যই উদ্দেশ্যভিত্তিক, লাভজনক ও প্রয়োজনীয়।
শুধু স্বাস্থ্য নয়, আগ্রায় বসবাস করতে আরেকটি জিনিস লাগবে, তা হলো মুঘল বাদশাহ হয়ে জন্মানোর ভাগ্য। বিরাট বিরাট বিশ্বঐতিহ্যের স্বীকৃতি ও তকমাধারী স্থাপনা ছাড়াও আগ্রায় ছড়িয়ে আসে অসংখ্য রাজকীয় ঢঙের প্রাসাদ, বাড়ি-ঘর, মুঘল গম্বুজওয়ালা প্রহরী ছাউনি। ইংরেজ আমলে তৈরি রাজসিক ভবনও কম নয়। সম্ভবত এসব দেখেই কথাটি বলেছিলেন কবি ও অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু। যাদবপুরের অধ্যাপক বুদ্ধদেব এক চিঠিতে দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে কথাটি জানিয়ে ছিলেন। সেই ভাষ্যটিই তুলে দিচ্ছি:
“আমি এখন আগ্রায়। এসব শহরে বসবাস করতে হলে মুঘল বাদশাহ হয়েই জন্মাতে হয়। আগ্রা ফোর্টে জাহান আরার ঘরগুলো ভারি ভালো, ও-রকম বাড়িতে থাকতে পারলে তবেই এ-অঞ্চলে বসবাস সম্ভব। কিংবা তাজমহলের ভিতরটাও মন্দ নয়। এছাড়া আর ঠাণ্ডা জায়গা এখানে আছে বলে মনে হয় না। যে যুগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না, সে যুগে ও-ধরনের বিরাট কেল্লা গড়তেই হতো শাহানশাহদের, নয়তো প্রাণ কি বাঁচতো? স্নানের কী বিলাসিতা! শ্বেতপাথরের কী উদার মসৃণ শীতলতা! ইলেকট্রিসিটি থাকলে অত দরকার হতো না, এয়ার কন্ডিশন করে দিলেই হতো। তবু ওঁরা ওগুলো করেছিলেন বলেই আজ সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা একটু বুঝতে পারি যে ভারতবর্ষ এককালে সত্যিই ইংরেজ বর্জিত ছিলো এবং ইংরেজ-বর্জিত সে ভারত তখনকার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের চাইতে কোনো অংশে ছোটোও ছিল না। নবাবী আমলের সূর্যাস্তের সোনা এ অঞ্চলে চেখে বেড়াচ্ছি-পচে গেছে, কিন্তু একটা রূপ আছে।”
১৯৪১ সালেল ১০ অক্টোবর দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে বুদ্ধদেব বসু চিঠিতে কথাগুলো বলেছিলেন। আগ্রায় শত শত বছরের প্রাচীন মুঘল ঐতিহ্যের অপসৃয়মান সেইসব দ্যুতিময় স্থাপনার রশ্মি এখনো চমকাচ্ছে।
আরও পড়ুন: প্রেম ও বেদনার মহাকাব্য তাজমহলে