ছেলেটা এক মনে তারাবতি, মরিচাবাতি পুড়িয়ে যাচ্ছে। চোখেমুখে কী নিদারুণ আনন্দ। আমি মুগ্ধ হয়ে একজন সুখী মানুষ দেখছি। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যাবেলায় পার্কের এই চুপচাপ কোনাটায় কেন এত আনন্দ নিয়ে একটা ছেলে তারাবাতি পোড়াবে এই ঘটনার কোনো সুরাহা করতে না পেরে বেঞ্চিতে গা এলিয়ে আপনমনে দেখছি।
ছেলেটা লেকের দিকে মুখ করে বাতি পোড়াচ্ছে। আমি এক সাইড থেকে ওর মুখ দেখলাম আবারও। ঝলমল করছে আনন্দে। আমাকে এখনো দেখতে পায়নি। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমি এসে বসি। দুয়েকঘণ্টা বসে থেকে চলে যাই। এই একলা সময়টুকু আমি প্রতিদিন আত্মহত্যার পরিকল্পনা করি। কিন্তু খুব বেশি সাহস নেই বলে গত আট বছরে আত্মহত্যার মতো কোনো কাজ আমি করে উঠতে পারলাম না। বিষয়টা আসলেই খুব খুব কঠিন। জগতের মোহ ছাড়তে পারি না। আসলে আমি আত্মহত্যা কোনোদিনই করব না। আমি না থাকলে আমার পরিবারের কার কেমন লাগবে। কে কেমন করে কাঁদবে এটুকু ভেবেই আমি সুখ নেই নিজে নিজে। অজান্তে যে কতবার নিজের চোখে জল এসেছে তার ইয়ত্তা নেই আমার লাশের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে আমার মা কাঁদছেন। আমার স্ত্রী বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন, আমার চার বছরের ছেলে টুবলু ‘বাবা না এলে ভাত খাব না’ বলে জেদ করছে। এইসব ভাবনা প্রতিদিন আমাকে এই জগতের জন্য অপরিহার্য করে তোলে। তাই মরে যাওয়ার সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি খুব সন্তর্পণে রাস্তা পার হই, ইলেক্ট্রিকের তারের দিকে নজর দিই। চোর, ছিনতাইকারী পিছু নিল কিনা সারক্ষণ খেয়াল করতে থাকি। আমি মরলে নিজে মরে যেতে চাই। এইসব অপঘাতে নই। অপঘাতে মরব না বলে যেসব খুঁতখুঁতানি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমার স্ত্রী শীলা ভীষণ বিরক্ত। শীলাকে কে বোঝায় আমি চাইলেই মরে যেতে পারি। শুধু টুবলুর জলভরা চোখ গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে। মরে গেলে তো ঐপারে মায়ের শাড়ির গন্ধ পাব না।
এই অসুখে-বিসুখে মরে যেতেও ইচ্ছুক নই আমি। তাই বাড়িতে আমার কঠোর ডায়েট। কোলেস্টেরল হাই হওয়া যাবে না, বিপি বাড়তে দেব না, এমনকি চাষের কই-মাগুর খেয়ে শেষ বয়সে ক্যান্সারও হতে দেব না বলে ধণু ভাঙা পণ করেছি আমি। ফলাফল সংসারে অশান্তি। প্রথম প্রথম শুধু শীলা খুব বিরক্ত হতো। মাঝে একবার বাজার-ঘাট নিয়ে অশান্তি করায় বাপের বাড়ি চলেও গেছিল। ইদানীং মা আর টুবলুও আমার ওপর বেশ চোটপাট করে।
আমার বিধবা মা সারাজীবন খুব অভাব-অনটনে পার করেছেন। পছন্দের খেতে পাননি, পরতে পাননি। ছেলেকে মস্ত ইঞ্জিনিয়ার করে এখন একটু আয়েশ শুরু করেছেন মাত্র। মাঝে মাঝেই টুবলুর সঙ্গে ইন্টারনেট দেখে এটা-সেটা বাইরে থেকে আনিয়ে খান দুজনে। শীলার এতে মহা উৎসাহ। বাইরের ফুচকা, গ্রিল, স্যান্ডউইচ, পিজ্জা পেলে ওরা আমাকে ভুলে যায়। অথচ ওদের ভালো রাখতেই তো এসব খাবার খেতে দিতে চাই না। সব খাবারে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট আছে। স্বাদের লোভ দেখিয়ে কারিনার জায়গায় মর্জিনা গছিয়ে দেয় এ ওদের কে বোঝাবে।
নিজেকে প্রবোধ দিতেই আমি অফিসের পর কিংবা অফিসের ফাঁকে লেকের এই নির্জন জায়গাটায় এসে বসি। এখানে বসে বসেই ছক করি কিভাবে একদিন কোনো ঝুট ঝামেলা ছাড়া এই পানিতে ডুবে যাব। সচরাচর এখানে কেউ এসে বসে না। আসলেও এই ভর সন্ধ্যায় পাঞ্জাবি পরে বাবু সেজে হাতে তারাবাতি, মরিচাবাতি নিয়ে কেউ আসেই না। তাহলে এ কে? মরিচাবাতিতে আগুন দিতে দিতে ছেলেটা বেশ দরাজগলায় গান ধরল—“আমার মুক্তি আলোয় আলোয়”…
কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে ডাক দিলাম, এই যে ভাই, শুনছেন?
ছেলেটার মুখটা এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এমন সুপুরুষ অনেকদিন দেখিনি। আমি হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছি। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেটা নিজেই বসা থেকে উঠে হেঁটে পাশে এলো। আমার দাদী বলতেন, রূপের মাইয়া ছিনাল, রূপের বেডা মাইগ্যা। এমন সুপুরুষের খুঁত খোঁজার চেষ্টা করলাম। পাশে বসতেই আগরবাতির গন্ধ টের পেলাম। খুব হালকা কিন্তু স্পষ্ট গন্ধ। আগরবাতি তো কেউ গায়ে মাখে না। তার মানে দীর্ঘক্ষণ আগরবাতির পাশ থেকে উঠে এসেছে। মসজিদে গিয়েছিলেন? জিজ্ঞেস করেই জিভ কাটলাম। মসজিদে কেন আগরবাতি জ্বালাবে। তিনি মিষ্টি করে হেসে জবাব দিলেন, না কবরস্থান থেকে এলাম।
এবার আমার চমকাবার পালা। দুটো কারণে চমকেছি। প্রথমত এই সুপুরুষের কণ্ঠও তার চেহারার মতো বিস্ময়কর সুন্দর। আর কবরস্থান থেকে কেউ ফিরে এত আনন্দিত কাউকে হতে দেখিনি। দীর্ঘদিনের শত্রুর কবর জিয়ারত করে থ্রিলার বইয়ের প্রতিশোধকামী নায়কের মতো হাসি দেখলাম তার মুখে।
আমি জানতে চাইলাম, কে মারা গেছেন?
তিনি বললেন, আমার স্ত্রী
: ওহ, স্যরি।
: আরে আপনি স্যরি বলবেন কেন?
: আসলে আপনজনের মৃত্যুতে কী বলতে হয় আমি জানি না।
: সবকিছু কি জানতে হয়? আর যাই হোক স্যরি হয়তো বলতে হয় না।
: কবে মারা গেছেন? প্রায়ই তার কবরে যান?
তার উত্তরে এবার আমার চমকাবার পালা—
সে জবাব দিল, আজ ভোরে মারা গেছেন। তার মৃত্যু উদযাপন করতেই এই জায়গাটা বেছে নিয়েছি। এই জায়গাটায় কেউ থাকবে না মনে হচ্ছিল। কিন্তু আপনি এসে গেছেন। আমি শরীফ, আপনি?
আমি একটা কাষ্ঠের হাসি দিলাম। এতটাই শুষ্ক হাসি যে তেষ্টা পাচ্ছে। পানি না খেলে যেন মরেই যাব। আমি এখানে প্রতিদিনই আসি, সেটা বললাম তাকে। দিনের একটা সময় আমার কিছু ভালো লাগে না, কাউকে ভালো লাগে না, হয়তো বিষণ্নতার কারণে। তাই কিছুটা সময় একা কাটাতে আমি এখানে আসি।
ছেলেটা এবার হো হো করে হেসে উঠল। তার হাসিতে তাচ্ছিল্যের সুর খুব প্রকট। আমায় পালটা প্রশ্ন করল, এত বিষণ্নতা কেন? বউ মরে গেছে? সংসারে কেউ নেই? কাউকে পাননি? কেউ ঠকিয়েছে? দীর্ঘদিন একটা ভালো সেক্স করা হয় না? টাকা-পয়সার অভাব? কারো জন্য এমন বাজি ধরেছেন যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন?
হড়বড় করে এত প্রশ্ন আমাকে কোনো ইন্টারভিউতেও কেউ করেছে কিনা মনে পড়ছে না।
আমি সবেগে মাথা নাড়লাম। এসব কিছুই আমার সঙ্গে ঘটেনি। আমার শুধু মরে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সেটা এই অচেনা ভীষণ সুখী তরুণকে বলতে ইচ্ছা করতেছে না। ছেলেটাকে খুব সেলফিশ মনে হলো। তার সঙ্গে আলাপ না করাটাই সমীচীন মনে করেও জানতে চাইলাম, আপনার সঙ্গে ঘটেছে এই ঘটনাগুলো?
ছেলেটা মোবাইল আনলক করে সময় দেখে নিয়ে জানতে চাইল, শুনতে চান কী ঘটেছে? সময় আছে?
আমি মাথা নাড়লাম। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবান একজন পুরুষের জীবনের গল্প মুগ্ধ হয়ে শোনার চেষ্টা করছি। ছেলেটা বলতে শুরু করেছে—
আমার স্ত্রী তৃষাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। প্রেম করলে যা হয়, মেয়ের বা ছেলের সকল যোগ্যতা থাকার পরেও সে পরিবারে নানা কারণে অচ্ছুত হয়ে ওঠে। তৃষারও তেমনটাই ঘটেছিল। তৃষার তিনকূলে কেউ ছিল না। সে খুব প্রেমিকা মেয়ে ছিল। মফস্বলের একটা সাধারণ অনার্স মেয়ের এত স্মার্টনেস আর এত প্রেম কোথা থেকে এসেছিল জানি না। আমি তখন বিসিএস পাস করেছি মাত্র। নওগাঁয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ হয়েছে আমার। মুক্তির মোড়ে আমার অফিস স্টাফরাই আমার জন্য বাসা ঠিক করল। সে কী দুর্বিষহ জীবন। সারাজীবন ঢাকা শহরে মায়ের কোলে বড় হওয়া ছেলে আমি। এমনকি বিসিএসের রিটেন পরীক্ষার সময়গুলোতেও আমার মা আমার হলের সামনে বসে থেকেছেন। আমার বন্ধু-বান্ধব বেশ হাসাহাসি করলেও আমি মায়ের এই কাজগুলোকে কখনোই বাধা দিতাম না। আমার মেঝখালা শুধু বলতেন বড় আপা তুমি তো বুঝবা না এই ছেলেই তোমাকে এমন আঘাত দেবে, এত মা ন্যাওটা ছেলেরাই বড় বড় অন্যায় করে। তুমি মিলিয়ে নিও।
আমিও তাই করেছিলাম তৃষাকে বিয়ে করে। তৃষার আগমণ খালার ভবিষ্যত বাণীকে সত্য করল। আমি তৃষাদের পাশের বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম, চাচা-চাচীদের সংসারে আশ্রিত। আমার রান্না-খাবারটা ওদের বাড়ি থেকেই আসত। তৃষার তখন ২১ বছর বয়স। আমার দুর্বিষহ মফস্বল শহরে স্বপ্নের মতো হয়ে এলো সে।
শরীফের মফস্বলের দুর্বিষহ জীবনের কথা শুনে আমার ঢাকা শহরের দুঃসহ প্রতিদিন চাগাড় দিয়ে উঠল। এই শহরে মানুষ থাকে? শীতকালে শীত নেই, কিন্তু ধুলায় ধূসর চারিপাশ। অনেকক্ষণ ধরে মশা পিন পিন করছে কানের কাছে। শরীফের সেসব দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে একমনে বলে চলেছে—
সকাল আর রাতের খাবার গুছিয়ে আনত সে। যতক্ষণ না খেয়ে শেষ করতাম ততক্ষণ আমার ঘরে থাকত। আমার বিছানা গোছানো, কাপড় গুছিয়ে রাখার কাজ করত। আমি তখন খেয়ে নিতাম। এই সময়টায় ও অনেক গল্প করত। স্থানীয় একটা ডিগ্রি কলেজে অনার্স পড়ত। রাত-দিন এত কাজ করত, কিন্তু তার চেহারায় কোনো ক্লান্তি দেখিনি আমি, সৌন্দর্যের খামতি নেই। আমার ঘরে যখন ঘুর্ণি তুলে ঘুরে বেড়াত। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, তোমার ভয় লাগে না? ও বিস্ময়ে জানতে চাইল, কিসের ভয়?
একা একটা পুরুষ মানুষের ঘরে তুমি এভাবে আসো সেই ভয় নেই তোমার? ওর উত্তর আমাকে বিস্মিত নয় অভিভূত করেছিল, বলা যায় তখনই প্রেমে পড়েছিলাম ওর।
তৃষা বলেছিল, বড়জোর আমার গায়ে হাত দেবেন, আমাকে ভোগ করবেন। আমার এই দেহ নশ্বর, তেমনটা কেউ করলে আমি গায়ে আগুন লাগিয়ে এই রূপ জ্বালিয়ে দেব। আগুন ছিল মেয়েটির চোখে।
কী ডাকসাইটে মেয়েরে বাবা। বলেই ফেললাম। শরীফ হেসে ফেলল। আমিও হাসতে হাসতে একটা মশা মেরে ফেললাম। এখানে বেশ মশা। কিন্তু এই মশাও এই ছেলেকে থামাতে পারছে না। কথা বলার নেশায় পেয়েছে তাকে—
…ছুটিতে ঢাকায় এসে আমি মাকে তৃষার কথা বললাম। মা কখনো কল্পনাও করতে পারেননি তার কুচুমুচু বেইবি তার অবাধ্য হয়ে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়তে পারে। তৃষার ছবি দেখে অনেক খুঁত ধরার চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হলেন। শেষমেষ বের করতে পারলেন—তৃষা এতিম। বাবা-মা কেউ নেই। আমি শ্বশুড়বাড়ির কোনো আদর পাব না। আমার ছেলে-মেয়ে ভবিষ্যতে নানা-নানীর আদর পাবে না। আর কোনো মানুষের বাবা-মা ছোটবেলায় মারা যায়, যারা অভাগা। আমার মা তো জেনে শুনে তার সৌভাগ্যের বরপুত্র ছেলের জন্য এমন অভাগা মেয়ে আনতে পারেন না। কোনো মানুষের এতিম হওয়াটা যে দোষের হতে পারে সেটা সেদিনই জানলাম। আমি আগেই আপনাকে বললাম আমি ভীষণ মা ন্যাওটা। বাবার কোনো ভূমিকাই নেই আমার জীবনে। আজকের আমি এই মায়ের জন্যই। জেদ চেপে গেল। নিজের অজান্তেই আমার সামনে মা আর তৃষা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। মা আমার সঙ্গে নওগাঁ যাওয়ার জেদ করলেন। আমি মাকে ফেলে একাই ফিরে এলাম। ফিরে এসে তৃষার পরিবারকে জানালাম বিয়ে করতে চাই তাদের মেয়েকে। তৃষার চাচা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কেবল উচ্ছল তৃষাকেই দেখলাম কেমন একটা মিইয়ে যেতে। মুচমুচে মুড়িতে যেমন দুধ ঢেলে দিলে নেতিয়ে পড়ে, ঠিক তেমন বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল তৃষা। আমি ভাবলাম বাবা-মায়ের কথা মনে পড়েছে। তৃষার সেই বিষণ্নতার রহস্য উদ্ধার করি আমাদের বিয়ে তিন বছর পর।
এক সপ্তাহের মধ্যে খুব অনাড়ম্বর আয়োজনে আমার আর তৃষার বিয়েটা হয়ে গেল। বাবা এসেছিলেন আমাদের দোয়া করতে। বিয়ের খবরে আমার মা শয্যা নিলেন। আমি তৃষাকে নিয়ে মাকে দেখতে গেলে মা তাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন না। আমার স্ত্রীকে অপমান মানে আমাকে অপমান করা। আমি সে রাতেই ফিরে আসি। সেদিনও মা খুব কাঁদছিলেন। বারবার বলছিলেন অলক্ষ্মী মেয়ে এনেছি এই বাড়িতে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। মায়েদের অভিশাপ বোধ হয় লেগে যায়।
আমি তখন সুখের সমুদ্রে। জীবনে পরিবর্তন বলতে তৃষা আমার ঘরে খাবার নিয়ে এসে রাতে চলে যায় না, আমার চারপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে। দাম্পত্য সম্পর্কে সুখী হতে যা যা লাগে সব কিছু দিয়েই সে আমাকে সুখী করেছিল। উই হ্যাড গুড সেক্স, অ্যাক্সিলেন্ট মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট। এত সুখের মধ্যেও ওর চোখের তীব্র বিষণ্নতা আমার চোখে পড়ত। ওকে জিজ্ঞাসা করলেই বলত মায়ের অভিশাপ ও নিতে পারেনি। ভয় লাগে ওর।
আমার জীবনের আর সব সত্য ঘটনার মতো ভয় সত্য হয়ে এলো। আমরা সেদিন রাতে সিনেমা দেখে ফিরছিলাম। আমাদের বাড়িতে আসার আগে একটা অন্ধকার গলি আছে, সেদিন সন্ধ্যায় কারেন্ট ছিল না। তিনজন লোক আমাদের ওপর হামলা করে। অন্ধকারে একদম বুঝতে পারিনি ওরা কারা। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। সারাদিন নানান মামলা মোকদ্দমা হ্যান্ডেল করি। তারাই কেউ আক্রমণ করেছে। মফস্বলের লোকেরা ভীষণ প্রতিশোধপরায়ণ বলেই জেনে বড় হয়েছি আমি। ওদের কেউ একজন আমাকে আঘাত করতে চাপাতি নিয়ে আসছিল। সে সময় তৃষা আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলাফল তৃষার মাথায় তীব্র আঘাত। তৃষা লুটিয়ে পড়তেই ওকে মারলি কেন, ওকে মারলি কেন বলতে বলতে তিনজনের সেই দলটা ছুটে পালিয়ে গেল। তৃষাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে সদর হাসপাতালে ছুটলাম। সেখান থেকে ঢাকায়। অ্যাম্বুলেন্সে করে তৃষাকে নিয়ে ছুটছি। আমার সারা গায়ে রক্ত। কী বিচ্ছিরি হয় রক্তের গন্ধ। জানি না ওকে বাঁচাতে পারবো কিনা। ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে প্রথম মনে হলো মাকে ফোন দিতে হবে। হাসপাতালে ডাক্তারদের জিম্মায় তৃষাকে দিয়ে আমার সঙ্গে আসা সহকর্মীর ফোন থেকে মাকে ফোন দিলাম। আমার বা তৃষার ফোন কোথায় পড়েছে জানা নেই। মা এলেন। খুব শান্ত হয়ে সব ঘটনা শুনলেন। তৃষা তখন আইসিইউতে। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে আমার সঙ্গে আইসিউতে ঢুকলেন মা। অচেতন তৃষার গায়ে হাত রেখে বললেন, তুমি আমার খোকাকে বাঁচিয়েছো। আমিও তোমায় বাঁচাব।
এটুকু বলেই থামল শরীফ। তার চোখ চিকচিক করছে। চোখে পানি।
আমি কাঁধে হাত রেখে বললাম, প্রকৃতি কী অদ্ভুত মিলিয়ে দেয়, তাই না?
: হ্যাঁ দেয়। তবে জীবিতের সঙ্গে মৃতকে মিলিয়ে দিয়ে কী লাভ হয় আমার জানা নেই।
: আপনার স্ত্রী সেদিন মরে গিয়েছিল? তবে আজ কে মারা গেলেন?
: আজ তৃষা আনুষ্ঠানিকভাবে মারা গেছে, যে মৃত মানুষকে আমি কবরে নামিয়ে দিয়ে আসতে পেরেছি। সেই আঘাতে তৃষার ব্রেন ডেড হয়ে যায়। বেঁচে থাকা মানুষ কিচ্ছু করতে পারবে না, কিচ্ছু শুনবে না, বলবে না, হাত পা নাড়াতে পারবে না। পারার মধ্যে শুধু যদি আমরা খেতে দিই তবে খেতে পারবে, কখনো ভোকাল কাজ করলে শব্দ বের হবে কিছু, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখা ছাড়া তার কোনো কাজ রইল না। সাড়ে তিনমাস তৃষাকে এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছি। ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, এভাবেই বেঁচে থাকবে তৃষা।
একটা সময় ভীষণ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। তৃষাকে আমি হাসপাতালে রাখব নাকি বাসায়। মা সিদ্ধান্ত নিলেন তৃষাকে নিয়ে বাসায় ফিরবেন তিনি। তার সন্তানকে রক্ষাকারী এই তরুণীকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে বাঁচাবেন। আমার জীবন ঋণ শোধ করতে মা তৃষাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ফেরার আগে সব ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। পঙ্গু হাসপাতালের সামনে থেকে হাসপাতালের বিছানা, হুইল চেয়ার কিনলেন তিনি। আমার ঘর একটা হাসপাতাল হয়ে গেল। স্যালাইন স্ট্যান্ড, ক্লিনিক্যাল প্ল্যাম্পার্স, ক্যাথেটার, অষুধের তীব্র গন্ধের সঙ্গে যোগ হলো অ্যান্টিবেডসোর ক্রিম। আমাদের একটু অযত্নে পচে যেতে পারে তৃষার শরীর। মাত্র দেড়মাস সংসার করেছিলাম ওর সঙ্গে। কী নরম মাখনের মতো শরীর, কী আদর কাঙাল একটা মেয়ে ছিল। ওর শরীরের প্রতিটি রোমকূপ চিনে নিয়েছিলাম আমি। আজ আমার সামনে সে একতাল কাদা হয়ে পড়ে আছে। একটা প্রায় মৃতদেহ। কিন্তু কী অদ্ভুত সুন্দর সেই শরীর।
তৃষার দেখাশোনার জন্য মা একজন নার্স ঠিক করেন। নার্স আর মায়ের জিম্মায় তৃষাকে দিয়ে আমি দীর্ঘ চারমাস পর কাজে জয়েন করি। নওগাঁ থেকে আমাকে স্ট্যান্ড রিলিজ দেওয়া হয় নিরাপত্তার খাতিরে। আনুষ্ঠানিকতার খাতিরেই আমার সহকর্মীরা একটা হত্যাচেষ্টা মামলা করে। সেটায় সাক্ষ্য দিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে আসি। সন্দেহভাজন কাউকেই পাওয়া যায় না।
সারাদিন কাজ করি, রাতে তৃষার পাশে, বসে শুয়ে গল্প করি। অনেক গল্প। শুধু সে জবাব দেয় না। মাঝে মাঝে অক্সিজেন আর রাইস টিউবের নল খুলে আমি চুমু খাই। কেউ আমায় পালটা চুমু দেয় না। তৃষার নরম পেলব বুকে নাক ডুবিয়ে আমি শুধু বেডসোর ক্রিমের গন্ধ পাই, অষুধের গন্ধ পাই। কখনো কখনো ভীষণ ঘেন্না লাগত। কখনো পাগলের মতো তাকে চাইতাম। মানুষ তো আমি পুরুষ মানুষ।
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শরীফের কথা শুনছি। কোনো পুরুষের এত সরল স্বীকারোক্তি আমি শুনিনি। একটু করে বাতাস বইছে, বেশ ঠান্ডা লাগতে শুরু করছে। সব উপেক্ষা করে আমি এই ছেলেটার গল্প শুনছি।
তৃষার সঙ্গে সারাদিন কী হলো তার গল্প করা আমার একটা নেশার মতো হয়ে গেল। রাতে ওর সঙ্গে আমিই থাকা শুরু করলাম। নার্সের কাছ থেকে শিখে নিলাম ওকে খাইয়ে দেওয়া, পোশাক পালটে দেওয়া। ওকে পরিচ্ছন্ন করে দেওয়া।
একদিন এক বন্ধু এলো বাসায়। তৃষার কথা একটু আধটু শুনেছে। সামনাসামনি আমার সেবা করা দেখে সেটি ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। ব্যাস আর যায় কই। আকাশে-বাতাসে আমার আর মায়ের স্তুতি। মৃতপ্রায় একজন মানুষকে আমরা কী অসীম ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি। বড় বড় টিভি চ্যানেল, পত্রিকা থেকে লোক আসতে লাগল আমাদের বাড়িতে। আমার ভালোবাসার গুণকীর্তন হতে লাগলো পত্র-পত্রিকায়। একজন লেখক আমাদের গল্প নিয়ে বই লিখলেন, উৎসর্গ করলেন আমাদেরকে। উৎসর্গপত্রে লিখলেন, ভালোবাসার অমর জুটি তৃষা-শরীফকে।
এভাবে কেটে গেল তিনটা বছর। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার মা আমাদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। আমি এখন ফেসবুক সেলেব। তৃষার মাথার কাছে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে থাকি। ইনবক্সে আসা নানা প্রশ্নের উত্তর দিই। কতজন ভালোবাসার কথা জানতে চায়। সরকারি কেরানি আমি ভালোবাসার বাণী বিলিয়ে যাই। অজানা-অচেনা মানুষের কৌতূহল মেটাতেই নিত্য ইনবক্স, আউটবক্স সব চেক করি।
একদিন আউটবক্সে একটা ম্যাসেজ এলো। ফেইক একটা আইডি থেকে। কোনো পরামর্শ চেয়ে বা ভালোবাসার স্তুতি গেয়ে নয়। চরম সত্য ভালোবাসার গল্পটা জানাতে। সেই ম্যাসেজে লেখা ছিল—“আপনি তৃষাকে এতটা ভালোবাসবেন আমার কল্পনাতেও ছিল না, আমি ক্ষমা চাইতে লিখছি আপনাকে। তৃষা আসলে আমায় ভালোবাসত। আমাদের পালিয়ে বিয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু আপনি ম্যাজিট্রেট হওয়ায় সেই সাহস করিনি, একবার তৃষা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। সেটি তাকে করতে দিইনি। আপনার সঙ্গে বিয়ের পরও আমাদের দেখা হয়েছে, ভালোবাসা হয়েছে। আমরা দুজনে মিলেই ঠিক করি, আপনাকে খুন করে আমরা পালিয়ে যাব। গোপনে সব গুছিয়ে রেখেছিলাম। তৃষা যদি সামনে এসে আপনাকে না বাঁচাত তাহলে সেদিন আপনি মরে যেতেন, তৃষা কেন আপনাকে বাঁচাল জানি না, হয়তো আপনাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিল।”
আইপি ট্রেস করে কিছুই ধরতে পারলাম না। পুলিশে বলব নাকি না, সেটি নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম।
সেদিন রাতে কেন জানি খুব বমি হলো। ঘেন্নায় বমি বুঝলাম, কিন্তু কাকে ঘৃণা করব বুঝতে পারলাম না। ঘরে দরজা আটকে মুখে কাপড় দিয়ে চিৎকার করে কাঁদলাম। আমার এক মন তৃষাকে তীব্র ঘৃণা করতে শুরু করে সেসময়, আরেক মন আমাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পড়ে। এই প্রথম আমি মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে গেলাম আমার জীবনের আরো একটি চরম সত্য। যাকে এত এত ভালোবেসেছি, তার এই দ্বিচারণ মা নিতে পারবে না। হয়তো মেরেই ফেলবে তৃষাকে। যত যা-ই হোক শেষ পর্যন্ত সেই তো আমায় বাঁচিয়েছিল।
তবে আমি আর লোক দেখানো বা মন থেকে কোনোভাবেই ভালোবাসতে পারছিলাম না তৃষাকে। কেমন অসহায় লাগতে শুরু করে আমার। সেসময় থেকে তৃষার শরীরও খুব খারাপ হতে শুরু করে। ভালোবাসার অভাবে চারাগাছ মরে যায়, আর সে তো জলজ্যান্ত মানুষ। সারাদিন আগলে রাখা সেই সুন্দর শরীরে ঘা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আজ সকালে সে মারা যায়। সে মারা যাওয়ার পর আমি এতটা নির্ভার হয়েছি, এতটা স্বাধীন হয়েছি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না
শরীফ ছেলেটা কাঁদছে। এত সুপুরুষ মানুষের কান্না খুব কদর্য হয়। খুব বিশ্রি লাগে সে অনুভূতি। তবু আমার প্রশ্ন থেকেই যায়, আপনাকে বাঁচাতেই তো তৃষার এই পরিণতি, তবু এত খুশি হতে পারলেন আপনি?
শরীফ এবার হো হো করে হেসে ওঠে, পালটা প্রশ্ন করে, প্রাপ্তবয়স্ক একটা মানুষের পায়খানার গন্ধ সহ্য করেছেন কখনো? প্রস্রাবের কাপড় বদলে দিয়েছেন, বেড সোর হয়ে যাওয়া পিঠে মলম মালিশ করেছেন কখনো? নাকে দেওয়া রাইস টিউব থেকে ইনফেকশন হয়ে বিচ্ছিরি গন্ধের পুঁজ পরিষ্কার করেছেন কখনো? গলায় ফুটো করে খাদ্য নালীতে নল ঢোকানো সুন্দরী রমণীকে সহ্য করার গল্প শুনেছেন আগে কখনো?
আমার গা গুলিয়ে উঠল!
প্রতিদিন দুই থেকে তিন বা চার বেলা সেই পায়খানা পরিষ্কার করতাম আমি আর আমার মা, মানবসেবা আর ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মোহে। কতদিন ভাতের থালা হাতে নিয়ে ফেলে রেখে উঠে পড়েছি। ভোকাল চলে যাওয়া একজন মানুষের জান্ত্যব গোঙানি শুনেছেন রাতের পর রাত? তখন আল্লারাখার সেতার বাজলেও অসহ্য লাগত। পুরুষ হয়ে শুধু সততার বিমূর্ত প্রতীক হতে আমি কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি। আমার কামনা-বাসনাকে বিসর্জন দিয়েছি। আজ আমি সব থেকে মুক্ত। অষুধের গন্ধ থেকে, আমার নকল ভালোবাসার বেড়াজাল থেকে। আজ আমার স্বাধীনতা দিবস।
প্রায় নটা বেজে গেছে। ইদানীং আমার দেরি হলে টুবলুটা ভীষণ কাঁদে। ওর কথা মনে পড়তেই আমার চোখ জ্বালা শুরু হলো, যেন ছেলের শোকে আমি কেঁদেই ফেলব। শরীফ উঠে দাঁড়িয়েছে। তার ফোন বাজছে। রিসিভ করে খুব শান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ মা আমি আসছি।
বিদায় নিয়ে একটু এগিয়ে এসে শরীফকে আবার ডাক দিলাম। ‘হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ বলে একটা হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম, ফের তাকালাম না, মুক্তি পাওয়া পুরুষের হাসি দেখতে আমার ভীষণ হিংসা হবে।