উর্দুসাহিত্যের আহমেদ ইলিয়াস বাংলাদেশের একজন বড় কবি

সাক্ষাৎকার, শিল্প-সাহিত্য

মিলু হাসান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 18:02:53

জাভেদ হুসেন একজন স্বনামধন্য অনুবাদক ও গবেষক। জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬। কুমিল্লায়। সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্ক্সীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন। এছাড়াও তিনি একজন গালিব-গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। সাদত হাসান মান্টোর কালো সীমানা ছাড়াও মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি কবিতার বইয়ের অনুবাদ করেছেন তিনি। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ প্রথমা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর দুটি অনুবাদ গ্রন্থ—মির্জা গালিবের কবিতা, ও আরেকটি আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা। বার্তা২৪-এর পক্ষ থেকে অনুবাদক ও গবেষক জাভেদ হুসেনের সাথে আলাপ করতে গিয়েছিলেন কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট মিলু হাসান—তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসায়।


বার্তা২৪: এবারের মেলায় আপনার নতুন কী কী বই আসছে?
জাভেদ হুসেন: মেলায় এসে পড়েছে এর মধ্যে প্রথমা থেকে—মির্জা গালিবের গজল। উনার সাড়ে পাঁচশোর মতো, প্রধানত উর্দু গজল থেকে, কিছু ফার্সি থেকে অনুবাদ করা আছে। ফার্সি গজলের সংকলন আসলে এ প্রথম। গোটা ষাটেক শের বা পঙ্ক্তি আছে মির্জা গালিবের ফার্সি গজল থেকে। এটা এসে পড়েছে। আরেকটা আসবে, ওই বইটা নিয়ে আমি একটু কৌতূহল অনুভব করছি। ওটা হচ্ছে বাংলাদেশের একজন উর্দু কবি, নাম আহমেদ ইলিয়াস। উনি বড় একজন কবি। তাঁকে আমি বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব কবিরা যারা জীবিত আছেন—তারা যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, সবার মধ্যে অন্যতম কবি বলে মনে করি, যৌক্তিক কারণও আছে। যেটা হচ্ছে আমাদের এখানে বাঙলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার কবিতা নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। সেই জায়গা থেকে তাঁর পরিচয় বা পরিচিতি নেই আমাদের এখানে। তাঁর ছয়টা কাব্যগ্রন্থ আছে। সবগুলো বাঙলাদেশ থেকে ছেপে বেরিয়েছে—উর্দু কাব্য। লাহোর, করাচি, হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ থেকে যেসব উর্দু সাহিত্য পত্রিকাগুলি বের হয় ওখানে তাঁর লেখা বেশ সমাদর করে ছাপে। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৬, বয়স্ক মানুষ। তাঁর একটা কাব্যের সংকলন প্রথমা থেকে বেরুচ্ছে—‘আহমেদ ইলিয়াসের কবিতা’। অবশ্য বইয়ের নামটা পরিবর্তনও হতে পারে।

বার্তা২৪: মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙলাদেশি উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াসের কী ভূমিকা ছিল?
জাভেদ হুসেন: মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা যেটা হতে পারত, উনি যদিও প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তাকে পালিয়েই বেড়াতে হয়েছে। দুপক্ষ থেকেই আসলে তাদের মুখের ভাষা, তাদের অবস্থান এ জায়গা থেকে একটা সন্দেহের কারণ সৃষ্টি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগের পর্যায়গুলোতে বাঙলাদেশের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার যেসব পর্যায় যেমন ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির পরপরই যেসব কবিতা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে লেখা ও ছাপা হয় এম আর ইলিয়াসের বয়োজ্যোষ্ঠ উর্দু কবি, উনার বন্ধু নওশাদ নূরির।

কবি শামসুর রাহমানের সাথে উর্দু কবি নওশাদ নূরী

যেমন ছয় দফা, তখন তাঁরা মানে উনার বন্ধু আরেক উর্দু কবি নওশাদ নূরীসহ ছয় দফার উর্দু অনুবাদ করে ছাপিয়ে সেটার প্রচার করতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এরকম ভূমিকা ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকৃত অর্থেই তাদের কোনোরূপ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারা বরাবরই প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। যেহেতু তারা অন্য কোনো জায়গা থেকে মানুষকে বিচার করতেন না। মানুষ হওয়ার জায়গা থেকে তার অধিকার পাওয়া, অধিকার নিজে রক্ষা করবার যে লড়াই তা করতেন। ফলে বাঙালি জাতি হিসেবে, রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষমতা, নিজের অধিকার নিজে গড়ার তোলার যে লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে তারা বরাবরই ছিলেন, সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। যেহেতু তারা তৎকালীন সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন, এর ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।

বার্তা২৪: কবিতা অনুবাদের জন্য কবি হওয়ার দরকার আছে কিনা বা কবি হলেই সে কবিতার অনুবাদ ভালো করতে পারে এমন কোনো কথা আছে কিনা—আপনি কী মনে করেন?
জাভেদ হুসেন: এটা অবশম্ভাবী না। কবিতা অনুবাদের জন্য কবি হওয়াটা একেবারেই অনিবার্য না। কবির অনেক ছাড় আছে, তার রেফারেন্সের প্রয়োজন নাই এবং কবি হিসেবে ভালো কবিতা লেখার যে দায় সেটা কবি অবশ্যই বহন করেন। একজন অনুবাদকের আসলে এর বাইরেও আরো বহুকিছুর প্রয়োজন আছে। যেহেতু তিনি এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার মাঝখানে একটা যোগসূত্র গড়ে তোলেন ফলে অনুবাদকের প্রথম যেটা হওয়া উচিত সেটা হচ্ছে দুই ভাষা শুধুমাত্র জানা নয়, দুই সংস্কৃতির সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা তার দরকার। এটা অনিবার্য। কারণ অনুবাদ তো শুধুমাত্র কবিতার হয় না, আপনি যখন এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার অনুবাদ করেন তখন অনুবাদ সংস্কৃতিরও হয় এবং পৃথিবীকে দেখার দুটো চোখ, দুটো দৃষ্টিকে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রত্যেকটা ভাষা পৃথিবীকে যেভাবে দেখে থাকে, অনুবাদক ওই অনুবাদ ভাষার মাঝখানে সম্মিলন ঘটান। এ সম্মিলন ঘটানোর জন্য অনুবাদককে দুই ভাষার দৃষ্টি থেকে দেখবার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তবে কবি হওয়াটা কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে যদি সে অনুবাদকের যোগ্যতা পূরণ করে তারপরে, তা হচ্ছে কবির নিজের স্বরে একটা কাব্যিক রস প্রতিস্থাপন করতে পারেন। একটা টেক্সট বহুভাবে অনুবাদ হওয়া উচিত। একভাবে অনুবাদ একটা টেক্সটকে তুলে ধরতে যথেষ্ট না।

বার্তা২৪: আপনি উর্দু ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। তো, ভাষা হিসেবে উর্দু বেছে নেওয়ার করার কারণ কী? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উর্দু ভাষার প্রতি এক ধরনের নেগলেটেট দৃষ্টিভঙ্গি আছে কি?
জাভেদ হুসেন: আমি ইংরেজি থেকেও করি। ঘটনাচক্রে উর্দু ভাষা নয় কবিতা থেকে একটা স্বাদ পেয়ে গেছি—যে কোনো কারণেই হোক। ঠিক যে কারণে কেউ রবীন্দ্র সংগীত গায়, নজরুল না গেয়ে, ঠিক যে কারণে কেউ সেতার বাজায়, বাঁশি না বাজিয়ে। ঠিক এরকম কোনো একটা কারণে উর্দু থেকে কবিতা করা শুরু।

উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস

হ্যাঁ, ঐতিহাসিকভাবে উর্দু ভাষা সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা আমাদের এখানে আছে—ওটা নির্দিষ্ট একটা রাষ্ট্রের ভাষা। লক্ষণীয় বিষয় যে, ওই রাষ্ট্রে এ ভাষায় যতজন কথা বলেন তার চাইতে অনেক বেশি মানুষ কথা বলেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। বিশেষ করে ভারতে এ-ভাষী জনগোষ্ঠী সব চাইতে বেশি। এ ভাষাটা আসলে কোনো রাষ্ট্রের ভাষা হওয়ার কথা ছিল না। সাধারণত প্রত্যেকটা ভাষার সাথে একটা জাতি জড়িত। বাঙালি জাতি বাঙলা ভাষার সাথে।

বার্তা২৪: এবারের বইমেলায় আপনে তো একজন বাঙলাদেশি বিহারী উর্দু ভাষার কবির কবিতার বই আপনার অনুবাদে বের হচ্ছে। তো, প্রকাশকদের কাছ থেকে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছে কিনা?
জাভেদ হুসেন: আমার কথা হচ্ছে কি, এ বিষয়টাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। গুরুত্ব দেওয়া উচিত তার গ্রহণের ক্ষেত্রে। বর্জন করবার জন্য কোনো ছুতোর দরকার হয় না। আপনি চাইলেই বর্জন করতে পারেন। গ্রহণের জন্য সক্ষমতা দরকার। না খাওয়ার জন্য আপনার ভালো পেটের দরকার নেই, স্বাস্থ্যবান মানুষ হয়ে টিকে থাকার জন্য আপনার ভালো হজমশক্তির দরকার আছে। ফলে, আলোচনাটা হওয়া উচিত আমরা কত গ্রহণ করতে পারব। কত বেশি গ্রহণ করতে পারব, কতটা হজম করতে পারব। সেই দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। ওই জায়গা থেকে আমার মনে হয় যে, আমাদের গ্রহণ করার সক্ষমতা বাড়ছে। কোনো ভাষার সঙ্গে, কোনো সংস্কৃতির সঙ্গে বৈরিতার সুযোগ নেই। কারণ ভাষাগুলো তো সাধারণজনের, খেটে খাওয়া মানুষের। যারা না থাকলে কোনো ভাষা টেকে না। যে কোনো ভাষা মরে যায়। ফলে মৈত্রিতাটা, সংযোগটা হওয়া দরকার মানুষের সঙ্গে মানুষের। ভাষা তো আসলে মানুষহীন অবস্থায় মৃত। তার তো কোনো অস্তিত্ব নেই মানুষ না থাকলে। ফলে সংযোগটা মানুষের সঙ্গে মানুষের। কোন মানুষের? যারা আসলে চিরকাল বেঁচে থাকার লড়াই করতেই জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে, ফলে ভাষার মুক্তি, গল্পের মুক্তি, সাহিত্যের মুক্তি আসলে হচ্ছে ওই মানুষগুলোর মুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত, ভাষাকে টিকিয়ে রাখে যারা। ফলে আপনি যতভাবে সম্পৃক্ত হতে চাইবেন বিভিন্ন ভাষার সম্পদ আপনার ভাষায় নিয়ে এসে নিজের ভাষাকে, সংস্কৃতিকে আরো সম্পদশালী, ধনী করতে, সমৃদ্ধ করতে চাইবেন যখন তখন প্রকৃত অর্থে আসলে এটা মানুষের মুক্তির সম্ভবনার অনিবার্যতা এটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে আমি বরাবরই ঠিক ওই বৈরিতা যে প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলেন যে জায়গাটা আমি গুরুত্ব দিই না। কারণ বৈরিতাকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে বৈরিতা কাটানোর সুযোগ নেই। আপনাকে দেখতে হবে সম্ভবনার জায়গায়। আপনাকে দেখতে হবে ভাষার মধ্যে মানুষের মুক্তি, মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হবে।

বার্তা২৪: আপনে তো মার্ক্সকে নিয়ে, মার্ক্সের মতদর্শন নিয়ে সম্পর্কিত বইয়ের অনুবাদ করছেন প্রচুর। আবার সুফী কবির কবিতার অনুবাদও করছেন। দুইটা জায়গা তো কনফিক্ট মানে একটা বস্তুবাদী আরেকটা ভাববাদী। তো এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
জাভেদ হুসেন: দেখার যে কাঠামো এ জায়গা থেকে এ প্রশ্নটা বিবেচনা করা যায়। দেখবার তো অনেক দৃষ্টি আছে, সম্ভবনা আছে, সুযোগও আছে। আপনি যখন লিখতে যাবেন, যা বলার হয়ে গেছে তার থেকে নতুন কিছু বলার না থাকে, তখন লেখালেখি করবার কষ্টটা পোহানোর কোনো দরকার নেই। প্রকৃত অর্থে অনেকের কাছে এটা অস্তস্তিকর বলি, বা যেভাবে তারা ভাবতে অভ্যস্ত সে জায়গা থেকে আমি একই সঙ্গে মাক্স অনুবাদ করছি একই সঙ্গে আমি মনসুর হাল্লাজের কবিতা অনুবাদ করছি বা সুফী কবিদের কবিতা অনুবাদ করছি। এ জায়গা থেকে দুটো প্রসঙ্গ মনে রাখা উচিত যে আপনি যেভাবে শব্দটা ব্যবহার করলেন যে ‘ভাববাদী’, তার বিপরীতে যে ‘বস্তুবাদী’ শব্দটা এসেই পড়ে, ঠিক যে অর্থে আপনি ভাববাদী শব্দটা ব্যবহার করলেন, তার বিপরীতে যে বস্তুবাদ দাঁড়াবে—মার্ক্স সেরকম বস্তুবাদী নন। সেরকম বস্তুবাদীদের ইউরোপে একটা ধারা ছিল, মার্ক্সের আগের পর্যন্ত, যাদেরকে মার্ক্স বলতেন স্থূল বস্তুবাদী। খুব স্থূল অর্থে বস্তু আর ভাবকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে দেখার প্রচলন আছে আমাদের মধ্যে। মার্ক্স সেরকম বস্তুবাদী নন। যেহেতু তিনি সেরকম বস্তুবাদী নন ফলে যাদেরকে আমরা ভাববাদী বলি ওই প্রচলিত কাঠামোর জায়গা থেকে ভাববাদী বস্তুবাদী বলি সেরকমভাবেও মার্ক্স ভাববাদীদের দেখতেন না। ফলে মার্ক্সের যখন আমি অনুবাদ করি আবার একই সঙ্গে মনসুর হাল্লাজ বা আপনে যাদেরকে বললেন ভাববাদী তাদেরকে অনুবাদ করি তখন আসলে একটা কথা মনে রাখি মার্ক্সের মূল শিক্ষা—মানুষ কিভাবে আসলে চিন্তা করবে সেটা সে একা সিদ্ধান্ত নেয় না। সে সিদ্ধান্তটা নেয় তার সমাজ, তার পরিপার্শ্ব, তার সংস্কৃতি যেভাবে যে অবস্থায় তার মধ্যে ক্রিয়া করেছে সে জায়গা থেকেই আসলে সে একটা দার্শনিক অবস্থানে পৌঁছায়। তবে সে দার্শনিক অবস্থানে পৌঁছানোটা তাকে পৃথিবীকে দেখতে একভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সে জায়গা থেকে সে পৃথিবীকে দেখেও বটে। কিন্তু সে দেখার জায়গাটা সে যে দেখছে সেটা তো একটা বাস্তব পৃথিবী। সে বাস্তব পৃথিবীকে আমি যেভাবে মোকাবেলা করি তিনি ভাববাদী হয়ে গেছেন বলে তো শূন্যে হাঁটেন না তাকে এ রাস্তার উপরে হাঁটতে হয় এবং যে পাথরে হাঁটতে গেলে আমি ঠোকর খেলে পায়ে ব্যথা পাব সে পাথরে ঠোকর লেগে তিনিও ব্যথা পাবেন। ফলে যে পৃথিবীটাকে তিনি দেখছেন সে পৃথিবীটা তো বাস্তব।

প্রথমা থেকে প্রকাশিতব্য জাভেদ হুসেনের অনুবাদে ‘মির্জা গালিবের গজল’

বাস্তব পৃথিবীটাকে তিনি কেমন করে দেখছেন সেক্ষেত্রে আমাদের কারোই দ্বিধার অবকাশ নেই যে তিনি একটা বাস্তব পৃথিবীতেই বেঁচে ছিলেন। উনাদের একটা বড় সুযোগ আছে আমরা যখন প্রতিদিনকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসগুলাতে আটকা পড়ে যাই, সেগুলাকে উনারা অস্বীকার করতে গিয়ে বহু বিস্তৃত একটা সম্ভবনার কথা বলেন। সুফী কবিরা বলেন যে পরম সত্যের সঙ্গে মিলনের কথা। বাঙলার যে বিশাল ভাব সম্পদ সেখানে অনেক জায়গাটা বলা হচ্ছে একটা পরম সত্যের সঙ্গে মিলনের কথা। এটা প্রকৃত অর্থে মানুষের সামনে একটা বিশাল দ্বার উন্মোচন করে দেয়। মার্ক্সও এমন পৃথিবী চাইতেন যেখানে প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইতে নিজেকে আটক করে ফেলবার দরকার হবে না। যখন সে পুরাপুরিভাবে এ পুরা মহাবিশ্বের সঙ্গে নিজেকে অনুধাবন করবার সুযোগ পাবে, যাদেরকে আমরা ভাববাদী বলছি তারা আসলে বাস্তবিক লড়াইয়ের যে পর্বটা, সেই জায়গাটা মানসিকভাবে পার হয়ে যেতে চান। কিন্তু এটা মোকাবেলা করতে হয়ই বটে। ফলে যখন আমি মার্ক্স পাঠ করি এবং এ জগতটাকে বদলানোর জায়গা থেকে মার্ক্সকে যখন আমি অনিবার্য বলে মনে করি তখন মনসুর হাল্লাজের মতন সুফী কবিরা আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক থাকেন না। কারণ মার্ক্স প্রকৃত অর্থে যে জায়গায় মানুষকে দেখতে চান—প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেকে আটকে ফেলবার দরকার পড়বে না, নিজেকে পুরো মহাবিশ্বের সাপেক্ষে নিজের অস্তিত্বকে যাচাই করে দেখবার সুযোগ পাবে। আমি যখন মার্ক্সের এ পরিচয় খুঁজে পাই তখন প্রকৃত অর্থে মনসুর হাল্লাজ বা গালিবের কবিতা অনুবাদ বা দুটোকে এক সঙ্গে চর্চার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তো আমার হয়ই না বরং দুটোকে আমার একে অপরের পরিপূরক বলে মনে হয়।

বার্তা২৪: মেলায় তো প্রচুর অনুবাদের বই বের হয়। দেখা যাচ্ছে সেখানে ভালো অনুবাদের বই পাওয়া যাচ্ছে না। তো ভালো অনুবাদ করার জন্য আপনি উঠতি অনুবাদকদের কী পরামর্শ দেবেন?
জাভেদ হুসেন: শুধু ভালো অনুবাদ না, ভালো চা বানানোর ক্ষেত্রেও একই পরামর্শ দেব। আপনি যা করতে চাচ্ছেন ভালোভাবে করার জন্য সৎ হওয়া। চায়ের পানি চাপানোর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ চুলো জ্বালিয়ে জ্বাল দেওয়া দরকার, ভালো চা পাতা দরকার, যেহেতু দুধ চা খাই তার জন্য ভালো দুধ দরকার, চিনি দরকার, তার জন্য চুলোও দরকার, তার জন্য ম্যাচের কাঠিও দরকার, চুলো জ্বালানোর জন্য জ্বালানিও দরকার, এসব জোগাড়ের পর কোনো একটা জায়গায় একটু ফাঁকি দেবেন, চা পাতা একটু কম দেবেন, দুধ একটু কম দেবেন এবং আপনে একটু জ্বালানি বাঁচাবেন—এ ফাঁকিবাজি দিয়ে এককাপ ভালো দুধচা সম্ভব নয়। ঠিক যখন আপনি অনুবাদ করছেন সেখানেও আপনার যা দরকার প্রধানত আপনি যে পাঠকের কাছে আপনি আপনার অনুবাদকর্ম তুলে ধরবেন, ধরে নিচ্ছি—আপনি যা যা জানেন তিনি তা জানেন না বলে আপনার অনুবাদ করা বই পড়বেন, ফলে আপনি যদি ভাবেন যে পাঠককে কেমন করে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে আপনার ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ আছে। ফলে আপনি ফাঁকি দিবেন, প্রথমত যাকে সন্তুষ্ট করা উচিত সেটা আপনি নিজে। এখানে আমি যেটা বলছিলাম দুটো ভাষার সংস্কৃতিকে জানার জন্য যে নিবিড় প্রয়াস দরকার, শ্রম দরকার, ক্লেশ দরকার, লেগে পড়ে থাকা দরকার সে জায়গায় বিন্দুমাত্র অবহেলা করেন, এ বিন্দুমাত্র অবহেলা শতগুণ ত্রুটি হয়ে ঘাটতি হয়ে দুর্বলতা হয়ে একটু খানি হেলা, একটু খানি ফাঁকি শতগুণ হয়ে প্রকাশিত হবে আপনার অনুবাদের কাজে। ফলে আমার অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে একটা পরামর্শই দিই সেটা নতুন কিছু না। পৃথিবীর যে কোনো কাজ একদম ভালো করে করতে হলে যা করা উচিত সে জায়গা থেকে অনুবাদের ক্ষেত্রেও লেগে পড়ে থাকা, লক্ষ্য আপনার পাঠক পরে, প্রথমে আপনি নিজে কারণ নিজেকেই সন্তুষ্ট করা সবচেয়ে কঠিন। প্রথমত অনুবাদ কাজের মধ্যে আপনি নিজে সন্তুষ্ট হওয়া দরকার। নিজে সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজন সৎ হওয়া ফাঁকি দেওয়ার একদমই রাস্তা নেই। লেগে থাকা ও সৎ হওয়া।

বার্তা২৪: এই যে একজন অনুবাদক লেগে থাকবেন, সৎ হবেন, শ্রম দেবেন তার জন্য তো তিনি তেমন আর্থিক মজুরি পাচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে তিনি অনুবাদ করার জন্য কিভাবে সাহস পাবেন, যদি তাদের অন্য কোনো পেশা না থাকে?
জাভেদ হুসেন: লিখে টিকে থাকা এ মুহূর্তে সাধারণভাবে বাংলাদেশে সম্ভব নয়। লিখে যারা টিকে আছে তারা যা বলতে চায় সেটা বলার সুযোগ কম। সবাই যা শুনতে চায় সেটাই আপনাকে বলতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর