গদ্যের নাম শুনে ভাবছেন এটির বিষয় জটিল কূটনৈতিক আলোচনা। না তা একেবারেই নয়। হ্যাঁ আক্ষরিক অর্থে না শুনে ভাব নিলে কেউ কাউকে টুপি পরাচ্ছে শুনলে আমরা ভাবি বেশ বোকা বানিয়েছে। অথচ ঘটনাটা কিন্তু উলটো মাথা যেহেতু সবচেয়ে গুরুত্বের অঙ্গ তাই তার আচ্ছাদনকারী টুপি কিন্তু অস্তিত্ব ও শক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহন করে। সামগ্রিকভাবে মানা হতো যেহেতু টুপি এই চিন্তার আধারকে আচ্ছাদন করে অতএব এর পরিবর্তন মতের পরিবর্তনের সামিল। তবে এই টুপি কোথা থেকে আসলো। কেনই বা এর প্রয়োজন হলো সেই বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
ধারণা করা হয় ইজিপ্টে আনুমানিক ৩২০০ খ্রিঃপূর্ব সময় কোনো টোম্ব পেন্টিংয়ে প্রথম টুপির ছবি ধরা পড়ে। মাথায় প্রথম টুপি পরিধানের কারণ সৌন্দর্য নয় আশা করা যায়। মাথাকে ঠান্ডা, রোদ ইত্যাদি থেকে সুরক্ষায় রাখার কারণেই টুপি সদৃশ বস্তুর আগমন। পরে অন্তস্থ পরিবেশে আমোদ-প্রসাধনের জন্য নারী-পুরুষ উভয়েই টুপি ব্যবহার করত। সৈন্যদলের কাছে একই সংকেত সূচক টুপি তাদের একক ভাবকে দৃঢ় করত। পায়ের মোজা থেকে মাথার টুপি অবধি সুসজ্জিত হলেই যেন একটি আদর্শ পোশাক পূর্ণতা পাবে এই ভাবনাও ছিল বোধ করি। ইজিপ্টেই প্রথম এর বিশেষ ব্যবহার শুরু হয়।
প্রধানত পুরুষেরাই টুপি ব্যবহার করত। তবে ১৯ শতক থেকে মেয়েরা সুসজ্জিত পালক, কিম্বা ছবি দেওয়া টুপি ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্তমানে টুপির বৈচিত্র দেখলে স্তম্ভিত হতে হয় যে এত তার প্রকারভেদ। ডার্বি, চুল্লো, টারবান বা পাগড়ি, ফেডোরা, কেফিয়াহ, কুফি, পানামা, হেলমেট, উষাঙ্কা এমন অজস্র। পৃথিবীর বিশিষ্ট টুপি সৃষ্টিকারী দোকান হলো “জেমস লক অ্যান্ড কোং (লন্ডনের জেমস স্ট্রিটে)। যা নাকি প্রাচীনতম টুপির দোকান বলে ইতিহাসে থাকার দাবি রাখে।
টুপি অর্থাৎ ইংরেজিতে HAT—এই তিনটি অক্ষরের সাযুজ্যে বিভিন্ন অর্থ ধরা হয় বিভিন্ন দেশে। যেমন উদাহরণ দিই হ্যাটকে টেক্সাস শহরে বিস্তারিত অর্থে মানা হয় “হসপিটালিটি অ্যাকুমডেশেনস অফ টেক্সাস।” অষ্টাদশ শতকে যখন চার্চ বলতে শুরু করল মেয়েদের চুল দেখানো যাবে না তখন থেকে টুপি ব্যবহারের গুঞ্জন শুরু হলো। প্যানকেক আকৃতির টুপি মেয়েদের জন্য বাজারে আসতে থাকলে। যাতে টুপি তাদের মুখের রঙ রক্ষা করে সেইহেতু রোদের কথা মাথায় রেখে তা বানানো হয়েছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন স্টাইলে অজস্র প্রকারভেদে টুপির আগমন হতে থাকল। পূর্বোক্ত যেসব টুপির নাম করেছি তারা কেউ মাথা সম্পূর্ণ ঢাকে। কেউ কেবল মাথার পেছনের তালুটি ঢাকে, কিছু টুপি যেমন চুল্লো মাথা থেকে কান অবধি পূর্ণ ঢাকা। কিছু টুপি কেবলই সৈান্দর্যকে মাথায় রেখে। মাথা আর মুখ যেহেতু সহাবস্থানে তাই এটি সুন্দর হলে স্বাভাবিক প্রকাশ আরো উচ্চকিত হয়। আবার পাগড়ী যা পাঞ্জাবিদের বিশেষ ব্যবহারে মর্যাদা পায় এবং তা ধর্মীয়ভাবেই। সেই পাগড়ী নাকি ফার্সি শব্দ দস্তার থেকে এসেছে। এই পাগড়ীর ব্যবহার ইসলাম সংস্কৃতিতেও বিশেষ গুরুত্ব পায়। আরব, ইরান এসকল অঞ্চলে এর বিশেষ ব্যবহার দেখা যায়, এখানে বলা হতো “পাগড়ী আরব জাতির মুকুট।” আসলে শিরস্ত্রাণ বা টুপি বা পাগড়ী যাই হোক একটা কথা খুব স্পষ্ট রাজরাজরা থেকে যে মুকুট পরিধান এর মাধ্যমে নবাবী বা রাজকীয় ঐতিহ্য পরিবেশিত হতো তা মাথার মুকুটকে ধরেই অতএব এই ভাবনাই প্রমাণ করে এর আকৃতি, ব্যবহার ব্যক্তির কাজ ও সমাজে তার স্থান নির্ভর করায়।
লন্ডনে যখন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল খুনি “জ্যাক দ্য রিপার”কে ঘিরে। তাকে চিহ্নিতকরণের সবচেয়ে রহস্যময় উপাদান থাকত তার এই ঘের দেওয়া কালো টুপি। যা তাকে শনাক্ত করার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় বাঁধা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ইসলাম ধর্মে ধর্মীয় শর্তানুসারে টুপির বহুল প্রচলন আছে ফলে এই ধর্মের প্রভাব যখন আফ্রিকায় পড়তে থাকল তখন আফ্রিকার উষ্ণীষ ব্যবহারকারী মানুষ টুপি ও পাগড়ীর দিকে ভিড়ে গেল। পোপ ও পাদরিদের মাথার তালু বেষ্টিত বিশেষ টুপি ব্যবহার করতে দেখা যায়। আর খ্রিস্ট ধর্মের মেয়েদের গাউনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন বৈচিত্র্যময় টুপি প্রে।
ইহুদি ধর্মে ধর্মগুরুদের আকারে ছোট টুপি পরতে দেখা যায়। মিশরে ফ্যারাওরা টুপি ব্যবহার করতেন। ১২০০ খ্রিঃপূর্ব নাগাদ চীনে টুপির ব্যবহার শুরু হয়। চাষীরা একধরনের টোকা নামক টুপি ব্যবহার করেন। বাংলায় ও চীনের এর বহুল প্রচলন দেখা যায় গ্রামে। গ্রীক মিনোয়ান সমাজে বড় চুলের মানুষেরা ধাতুর মুকুট পরত। বলা হয় আফগানের টুপি “পাকল” আর গ্রিকদের “কাউসিয়া” সাদৃশ্যযুক্ত টুপি। যদিও ইজিপ্টের কথা টুপির প্রারম্ভিকতার সঙ্গে যুক্ত তবু পারস্য সাম্রাজ্যকেও এ ব্যাপারে ছাড়া যায় না। বলা হয় প্রায় ছয় হাজার বছর আগে এখানে এর যাত্রা শুরু। প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে পারস্যের একটি পাঁচ হাজার বয়স্ক দেবী মূর্তির মাথায় টুপি দেখা যায়...। টুপি দিয়ে রূপের ঘনঘটা, টুপির মধ্যে ছুরি, টুপির মধ্যে লুক্কায়িত রাজ্যের চিঠি দূত বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, টুপি দিয়ে আড়াল হয়ে যাচ্ছে রহস্যমাখা মুখ। আসলে সভ্য মানুষের উপকরণে যেখানে উন্নতজীবনের বীজ লুকিয়ে থাকে সেখানে ফাঁকে ঢুকে পড়ে অন্যসব গল্প। তবু সংস্কৃতি তার উপমা এই তো আমাদের ঐতিহ্য জাগিয়ে রাখে...