“কবিতা নতুন কিছু না, যেহেতু গদ্যেই কবিতা ছিল”

সাক্ষাৎকার, শিল্প-সাহিত্য

রোজেন হাসান, অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিচার এডিটর | 2023-12-31 17:57:30

নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালের ৫ মার্চ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখালেখি শুরু আশির দশকে। নাসরীন জাহানের গদ্য ঝরঝরে, ঋজু, মেদহীন। তার পর্যবেক্ষণশক্তিও গভীরতাশ্রয়ী, তিনি যে কোনো ক্ষুদ্র বিষয়কেও মেলাতে পারেন সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যার মূল বিন্দুতে। এ কারণে দুই বাংলাতেই সমঝদার পাঠকরা তাকে সমান আগ্রহে গ্রহণ করেছেন।

দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছেন। এরমধ্যে সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, প্রথম উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’র জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে পাওয়া আলাওল সাহিত্য পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

সম্প্রতি বার্তা২৪-এর বিশেষ আয়োজন বইপ্রহরে কবি ও সাংবাদিক শিমুল সালাহ্উদ্দিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন নাসরীন জাহান। বইমেলায় বেরিয়েছে তাঁর নতুন দুটি বই—এর মধ্যে একটি কবিতার এবং অন্যটি উপন্যাস। এ বই দুটি নিয়েই মূলত কথা বলেছেন তিনি। আলাপকালে অনেক বিষয়ের সাথে এসেছে—কেন অতি সাম্প্রতিক সময়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন, তাঁর সাহিত্যজীবন এবং স্বামী আশরাফ আহমদের সাথে দাম্পত্য জীবন।

দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক তখন কবি আহসান হাবিব। নাসরীন জাহান এবং তাঁর স্বামী আশরাফ আহমদ দুজনেরই যথাক্রমে গল্প-কবিতা প্রকাশিত হতো। তারা পরস্পরকে না দেখেই মুগ্ধ হন লেখায়, কালক্রমে একজন আরেকজনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিনের সাথে আলাপকালে এ প্রসঙ্গে তিনি, “আশরাফের কবিতা ওখানে ছাপা হতো, আমার গল্পও সেখানে ছাপা হতো। এভাবেই আমাদের দুজনের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আমার গল্প সে পছন্দ করত আর তার কবিতা আমি পছন্দ করতাম।”

আরো পড়ুনঃ সাক্ষাৎকারে আন্দালিব রাশদী “দুই নাম্বারি মুক্তিযোদ্ধা সচিবরা আমারই বন্ধু”

শিল্পমূল্যায়নের প্রশ্নে নিজের আপোসহীন অবস্থানকে তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে—“... শিল্পের ব্যাপারে, আমার বাবাও যদি খারাপ লিখতেন, আমি জীবনেও বলতে পারতাম না যে তিনি ভালো লেখেন।”

এবার মেলায় কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘মদের গেলাসে নাচে বরফের ওম’ বইটি নিয়ে কথায় কথায় উঠে এসেছে কিভাবে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন সেই গল্প। জানান সেটি ছিল ফেসবুক কেন্দ্রিক—“...তখন আমি ওখানে স্ট্যাটাস দিতাম, আমি যে স্ট্যাটাসই দিতাম সবাই বলত আপনি কবিতা লিখছেন, মুশকিল হয়ে গেল আমার সব স্ট্যাটাসেই সবাই বলত আহা কী সুন্দর কবিতা। কাব্যিকও না, বলত কী সুন্দর কবিতা।”

তিনি বলেন, “আমরা যারা সিরিয়াস লেখক, ফেসবুককে খুব ফালতু মনে করতাম। তো মাঝখানে প্রচণ্ড একটা অসুখ হয়ে গিয়েছিল আমার, তখন আমার ছোট বোন ঝর্ণা ইয়াসমিন এসে আমাকে ফেসবুক ধরিয়ে দিল সময় কাটানোর জন্য। ফেসবুকে আমি অনেক পুরনো মানুষকে খুঁজে পেলাম, এইভাবে একটা নেশা তৈরি হয়ে গেল, বিশ বছর তিরিশ বছর আগে একজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, ফেসবুকে তাকে খুঁজে পেলাম।”

গত শতকের আশির দশকে বাংলা কথাসাহিত্যে নাসরীন জাহানের জমকালো আবির্ভাব। একের পর এক সফল উপন্যাস তাঁকে উভয় বাংলায় বোদ্ধা পাঠকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’র জন্য পান ফিলিপস পুরস্কার। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের জন্য। তাঁর উপন্যাস নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আলোচনা করেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কথাসাহিত্যে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেই ক্ষ্যান্ত নন। সম্প্রতি লিখছেন কবিতা। এবার বইমেলায় অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মদের গেলাসে নাচে বরফের ওম’ এবং একই প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য তাঁর নতুন উপন্যাস ‘সূর্যাস্তের শেষ রঙ’। কথা বলেছেন বইমেলা উপলক্ষে বার্তার বিশেষ আয়োজন ‘বইপ্রহর’-এ।

মেলায় অন্যপ্রকাশ থেকে বেরিয়েছে নাসরীন জাহানের নতুন উপন্যাস ‘সূর্য়াস্তের শেষ রঙ’। উপন্যাসটি নাসরিন জাহানের জাহাঙ্গীরনগরে দেখা জীবনের অন্য এক অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। জানালেন, পুরো উপন্যাসে জাহাঙ্গীর নগরের এক বিশদ ছাপ ফেলেছেন তিনি। উপন্যাসটির প্লট পেয়েছিলেন একদিন ঘুম না আসা রাতে। বললেন, “ঘুম আসছিল না, তখন এই থিমটা পেলাম—খুবই সুন্দরী এক নারীকে কুত্সিত এক পুরুষ অপহরণ করে, পরবর্তীতে তাকে বিয়ে করে, মারধোর করে, পরে সেই মেয়ের গর্ভে যে বাচ্চা হয় সেই মেয়ে তাকিয়ে দেখে বাচ্চাটা হুবহু বাবার মতো হয়েছে, এটা দেখে সে অজ্ঞান হয়ে যায়।”

অপহরণকারী যখন মেয়েটির সন্তানের পিতা হয়ে গেল, আর সেই সন্তান যখন হুবহু পিতার আদল পেলে, তখন সেই নারীটির সাথে তার মেয়ের দ্বন্দ্বই উপন্যাসে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। মা আর মেয়ের এই দ্বন্দ্বের একটি দার্শনতাড়িত পরিসমাপ্তির বা পরিণতির কথা তিনি বলেছেন এভাবে—“শেষ দিকে দেখা গেল যে, মা দাঁড়ায় না, ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যায়।”

নাসরীন জাহানের গদ্যের স্বীকৃত গুণ হলো তা কাব্যতাড়িত, কবিতার অনেক চোরাগুপ্তা ইঙ্গিত এবং অনেক সময় কবিতার আবেশ জড়িয়ে থাকে তাঁর লেখায়। বইপ্রহরে কবিতার বই প্রকাশের অনুভূতি অন্যরকম কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, “অন্যরকম তবে খুব বেশি অন্যরকম না, অনেক অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল, যদি আমার গদ্যের মধ্যে কবিতা না থাকত।”

জানালেন, তিনি ছড়া লিখতেন একসময়, বাংলা কবিতার তিনটি ছন্দই তাঁর জানা আছে। তবে কবিতায় ছন্দের দিকে যাননি। ‘মদের গেলাসে নাচে বরফের ওম’ বইয়ে বেশির ভাগই গদ্যকবিতা—সেখান থেকে বইপ্রহরে পড়ে শোনালেন মাত্রাবৃত্তে লেখা প্রকৃতি গান নামে একটি কবিতাঃ

আঁধারের পাতাগুলো গান দিয়ে বোনা
বাতাসের কান্নায় সুর যায় শোনা
জলের কান্না ভারি মিষ্টি ও মিহি
শীত কাঁদে তার সাথে রাত্তিরে হি হি
এর মাঝে তুমি খাও প্রেমময় চুমো


আকুল পরাণে বলো ঘুমো সোনা ঘুমো
হি হি রব শুষে নেয় জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ
বনভূমি তন্ময় কী আকুল প্রাণ
এরপর রোদ্দুর তার গান গাই
ডানাবোঝা রাত্তির বলে আমি যাই।

নাসরীন জাহানের কথাসাহিত্যিক সত্তার অন্তরালে লুকোনো কবিসত্তা এবার স্বরূপে তার পথ করে নিয়েছে। বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ও কবিতা পড়তে তাঁর পাঠকরাও উন্মুখ থাকবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর