সিনেমাহলে রহস্যময় বন্ধুতা ও প্রেমের মাঝখানে যারা সশব্দে ধরা পড়ে, যারা হতাশার মাঝখানে ভরা প্যাকেটের গা ফেটে বেরিয়ে পড়ে, যারা দুধে শিশুর দিকে প্রলোভনের ভঙ্গিতে বড়দের হাতে ঘুরে বেড়ায় আর সময়ে অসময়ে ফন্দি করে সব খাবারের মধ্যে হালকা শরীরে ঢুকে পড়ে তাদের মহান নাম চিপস। আলুর মাহাত্ম্য যে কত নান্দনিক তা কি এই চিপসের কাছে না গেলে কখনো বোঝা যেত! চিটোস, কুল র্যাঞ্চ ডরিটোস, লে’জ, অরিজিনাল প্রিঙ্গলস—বর্তমানে এরাই প্রথম সারির বিখ্যাত চিপস। আমেরিকায় আলুর চিপস চূড়ান্ত রকমের জনপ্রিয়। প্রায় ১.২ বিলিয়ন বাৎসরিক হারে এটি বিক্রয় হয়। মার্চের ১৪ তারিখ জাতীয় চিপস দিবস হিসেবেও এখানে প্রতিপালন হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী চিপসের জনপ্রিয়তার ওপরে নির্ভর করে এর একটি নির্দিষ্ট অনুপাত পাওয়া গেছে তা হলো আমেরিকা ৮৬%, ফ্রান্স ৮৬%, ইজিপ্ট ৭২%, ব্রাজিল ৫১%, সাউথ আফ্রিকা ৪৩%, চীনে ২৮% হারে জনতারা এটি ক্রয় করেন।
চিপসের আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি স্বাস্থ্যসচেতন সেলেব্রিটিরাও। মুখের ভেতরে গিয়ে তার যা সুমধুর নাচের শব্দ—সেই শব্দের মোহজাল, যা ভাঙা সহজসাধ্য নয় তা প্রমাণিত। আর স্বাদ সে তো যতবার মুখে আসে ততবার নতুনরূপে প্রভাবিত করতে থাকে। এই চিপসের রূপ খুব তীক্ষ্ণ অথচ নির্মেদ, সে তিনি নিজে যতই মেদ বাড়াতে সক্ষম হোক না কেন! চিপসের আগমন কিভাবে হলো তা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য নেই। একটি রয়েছে প্রচলিত গল্পের ভিত্তিতে আরেকটি তথ্য ও বইয়ের সূত্র ধরে। যে বইয়ের সূত্র ধরে তথ্যটি সামনে আসে—“দ্য কুক’স অরাকল” নামক সে বইটি লিখেছিলেন উইলিয়াম কিচিনার, ১৮১৭ সালে।
স্বাস্থ্যসচেতন অথচ মুখরোচক খাদ্য হিসেবে চিপসের রন্ধনপ্রণালী লেখা ছিল সেইসময় এই বইতে। গোল গোল করে পাতলা করে আলু কেটে তার ওপর লেবু ও নুন দিয়ে পরে সেটাকে কাপড়ে শুকিয়ে ভাজা করার পদ্ধতি লেখা ছিল বইতে। পরবর্তী সময়ে ১৮২৫ সালে একটি ব্রিটিশ বইতে এটিকে ফ্রেঞ্চ খাদ্য হিসেবে পাওয়া যায় “সেকেন্ড রিসাইপ” নামে। চিপস বেশিরভাগ দেশেই চিপস এবং ক্রিস্প নামেই পরিচিত। এবার আসা যাক সেই গল্পটিতে যেটি প্রচলিত অর্থে বেশি ব্যবহৃত।
ঊনিশ শতকে নিউ ইয়র্কের সারাটোগা স্প্রিংস শহরে আফ্রিকান-আমেরিকান-ইন্ডিয়ান হেরিটেজ মুন’স লেক হাউজের শেফ জর্জ ক্রাম তার এক ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে চিপসের উদ্ভাবন করেন বলে শোনা যায়। যেই ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে এই উদ্ভাবন, তিনি ছিলেন সেই সময়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী করনেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট। তাঁকে পরিবেশিত খাদ্য তথা ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের আকারে ও স্বাদে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে সেটিকে পরিবর্তিত রূপে আনতে বললে ক্রাম তাকে জব্দ করার জন্য আলুকে খুব পাতলা করে তাতে স্বল্প নুন ছিটিয়ে সেটি পরিবেশন করেন। উল্টো সেটি তার এমন ভালো লেগে যায় তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ক্রাম এই সুযোগেই এরপর এই খাদ্যের প্রচলন করেন, যার নাম হয় “সারাটোগা চিপস”। সময়টা ১৮৫৩ সাল ফলত এই বিতর্ক আসে যে, কে এই বিষয়টি উদ্ভাবন করেন কিন্তু এই ভাবনাকে ছাপিয়ে ক্রামের গল্প ও চিপসের জনপ্রিয়তা তীব্র হয়ে ওঠে।
চিপসকে বহুদিন সংরক্ষণ করার জন্য প্রথম লরা স্কুডা চিপসের প্যাকেট বাজারে আনেন। সালটা ১৯২৬। তারপর আরো উন্নত ভিন্ন স্বাদের চিপস বাজারে আসতে শুরু করে। জো মারফি এই ফ্লেভারড চিপসকে মানুষের কাছে নিয়ে আসেন ফলে শুধু নুন নয় নানা মশলা, নানা গন্ধ ও স্বাদের রূপ নিয়ে এটি হাজির হতে থাকে রেস্তোরাঁ থেকে ঘরে, রাস্তায় সর্বত্র । এইভাবে ক্রমে ক্রমে চিপসের জনপ্রিয়তা তীব্র হয়ে ওঠে। হারমান লের লে’জ ব্র্যান্ড সফল বাণিজ্যিক চিপসের ব্র্যান্ড হিসেবে বৃহত্তর জায়গা করে নেয় ১৯২০ সাল নাগাদ। এইভাবেই ঘরের ডাল ভাত থেকে শুরু করে পাঁচতারার স্টার্টার থেকে মেন কোর্স অবধি সর্বঘাটের কাঁঠালী কলা রূপ নিতে পারেন তিনি চিপস মহাশয়। ফলে জিহ্বার রসনা থেকে শুরু করে চোখের নজর পেরিয়ে মস্তিষ্ক ফুরফুরে করার এক আনমনা হালকা মেজাজী খাবার হলো চিপস। আসুন আমরা নোনতা মায়ার মুচমুচে ঘোরে প্রবেশ করি...