জুতোর বাক্সে ভালোবাসা

ভ্রমণ, শিল্প-সাহিত্য

সঞ্জয় দে | 2023-08-30 06:32:39

‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা সত্যি’-র মতো সান ডিয়েগো শহরে একটা পেটে-ভাতে চাকরি জুগিয়ে ফেলেছি কয়েক মাস হলো; তবে এখন পর্যন্ত একটা চার চাকার যান কেনবার মতো পয়সা জুগিয়ে উঠতে পারিনি। ওদিকে এ-শহরে গাড়ি না থাকার মানে হচ্ছে হাত-পা গুটিয়ে বস্তাবন্দি হয়ে থাকা। ট্রাম-ট্রেন দূরে থাক, বাস টেম্পোরও কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আমার কিন্তু সে-অর্থে তেমন কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। হাউসমেট মিস্টার ব্রুস ওয়াং প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে আমাকে অফিস নেওয়া আর সপ্তাহান্তে কাছের এক ভিয়েতনামিজ দোকান ভিন হুং-এ নেবার কাজটি করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী আর তিন কন্যা থাকে টরেন্টোতে। আকালের বাজারে আমাকে শেষ মুহূর্তে পেয়ে বাড়িতে এনে তুলেছেন ভাড়া শেয়ার করার জন্যে। সাথে কথা দিয়েছেন, আমার যাতায়াতের ব্যাপারটি দেখবেন বলে। ভদ্রলোক যুবাকালে বেইজিং-এর কলেজ থেকে পাশ করার পর পরই দীর্ঘদিনের প্রণয়িনীর গলায় মালা পরান; আর তার পরের বছরই ওয়াং পত্নীর কোল জুড়ে আসে প্রথম কন্যাসন্তান। চীনে তখন চলছে ‘এক সন্তান, সুখী পরিবার’ নীতি। এই নীতি কিন্তু মিসেস ওয়াংকে সুখী করতে পারেনি। পরের বছরই তার সাধ হয় আরেকটি সন্তানের। কিন্তু চীনে বাস করে তেমন ইচ্ছে ফলালে জেল জরিমানার সম্ভাবনা প্রবল। অগত্যা ওয়াং শুধুমাত্র স্ত্রীর ইচ্ছে চরিতার্থের জন্যে পাড়ি জমালেন কানাডায়। সেখানে একটি নয়, আরো দু দুটি সন্তানের জন্ম হলো। এরপর তাঁদের মাথায় এলো ভিন্ন এক খায়েশ। তিন তিনটে সন্তান তো হলো, এবারে একটি সামনে-পেছনে উঠোনওয়ালা বিশাল বাড়ি চাই। টরেন্টোতে ওয়াং যে টাকা কামান, ও দিয়ে ওই আক্রার বাজারে বিশাল বাড়ি কেনা সম্ভব নয়। এবারে ওয়াংপত্নী তার পশ্চাৎদেশে খেজুরের কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘তুমি না হয় এবারে আমেরিকায় একটা চাকরির চেষ্টা করো। শুনেছি, আমেরিকায় নাকি মেলা টাকা; আমেরিকা মানেই বিশাল গাড়ি, বিশাল বাড়ি।’ বৌয়ের এই অভিলাষে ত্যাক্ত হয়ে ওয়াং একদিন সত্যি সত্যি চাকরি নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান। তবে যে বৌয়ের ধাক্কায় তার এই আমেরিকা অবধি ছুটে আসা, সেই বৌকেই এখন পর্যন্ত এখানে আনতে পারেননি কী এক ভিসাপত্রের ঝামেলায়। মি. ওয়াং এখন খেয়ে না-খেয়ে টাকা জমাচ্ছেন; শুনছি, সামনের বসন্তে ওয়াংপত্নী বালবাচ্চা আর লোটা কম্বলসহ একেবারে ক্যানাডার পাট চুকিয়ে এখানে আসবেন। ততদিন পর্যন্ত এই ভাড়া ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত গুমটিঘরটি নিশ্চিতভাবেই আমার নিবাস।

ওয়াংয়ের বাড়ির খুব কাছেই একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি। সেখানে হেঁটেই যাওয়া যায়। আমি শনিবারের বিকেলগুলোতে সেখানে মাঝেসাঝে যাই। ঠিক বই পড়তে যাই, তেমন নয়। ওখানে বেশ কিছু ভালো ডিভিডির কালেকশন আছে। এইতো কিছুদিন আগে নিয়ে এলাম দ্যা সোভিয়েত স্টোরি আর দ্যা কোল্ড ওয়ার নামক দুটো ডকুমেন্টারির ডিভিডি। তো সেই লাইব্রেরিতেই একদিন একটি পোস্টার আমার নজরে আসে। করিডরের বাঁ-দিকের একটি দরজায় সাঁটা। সেখানে লেখা রয়েছে, নামমাত্র দক্ষিণার বিনিময়ে লাইব্রেরির একটি ঘরে নাচ শেখানো হবে। আগ্রহীরা সত্তর যোগাযোগ করুন। ভেবে দেখলাম, হাতে যেহেতু বেশ খানিকটা সময় আছে আর এটা যেহেতু হাঁটা পথের মাঝেই—নাচের ক্লাসে কয়েকদিন ঢুঁ মারলে মন্দ হয় না। ঢাকায় ধানমন্ডি লেকের ধারে রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে একসময় সালসা শিখেছিলাম। আমি হয়তো তাই পুরোপুরি আনাড়ি ছাত্র নই, হাতেখড়ি আছে আমার। তো সাহস করে একদিন পৌঁছে গেলাম নাচের ক্লাসে। শুরুতেই কিছুটা হতোদ্যম হতে হলো। ক্লাসের যারা ছাত্র ছাত্রী, তাঁদের প্রায় সকলেরই বয়স সত্তরের কোঠায়। অবসর জীবনের নিঃসঙ্গতা ঘোঁচাতে নাচের ক্লাসে মজেছেন। বুড়োরা ঝকমকে বাটিকের শার্ট আর বুড়িরা চড়া মেকআপ লাগিয়ে বাহুলগ্না হয়ে তুমুল ছন্দে নাচছেন। এতসব মানুষের মাঝে কেবল মাত্র দুজন রমণীর বয়স হয়তো ত্রিশের কোঠায়। চেহারা সুরতে মনে হলো দুজনেই হিস্পানিক। এঁদের একজনের গা দিয়ে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে পেঁয়াজের গন্ধ। সে গন্ধ এতটাই প্রবল যে, তিনি আমাকে নাচের জন্যে জাপটে ধরলেও আমাকে পাশ কাটাতে হয়। সুতরাং রইল বাকি এক। এই যে একজন, ওর নাম ভেনেসা। আশপাশেই নাকি থাকে, আর কাজ করে একটি কোম্পানির কেরানি পদে। এ শহরে ভেনাসাও আমার মতোই নবাগত।  এতকাল ও ছিল ভেনচুরা কাউন্টি নামক শহরে। সেখানেই ওর পরিবার।


নাচের ক্লাসে একই জনের সাথে বহুক্ষণ নাচা যায় না। কারণ, কিছুক্ষণ পর পরই নাচের মাস্টারের রব ভেসে ওঠে—‘জেন্টলম্যান রোটেট, রোটেট প্লিজ।’ মানে হলো, সঙ্গী বদল করে আর কাউকে ধরুন। একজনের সাথেই আঠার মতো লেগে থাকলে মন হয়তো নাচের ছন্দ থেকে পথ খুঁজে নেবে সঙ্গীর কোমরসন্ধিতে। যদিও এই রোটেশনের ব্যাপারটাতে আমার চরম অনীহা। আমি চেষ্টা করি, ঘুরে ফিরে ওই ভেনেসাতেই আটকে থাকতে। ওভাবেই ‘স্লো, স্লো, কুইক কুইক, স্লো’—এই রিদমের মাঝে সেরে নিই টুকটাক আলাপ। তৈরি হয় কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠতা।

ভেনেসা একটি ছাই রঙের মাজদা গাড়ি চালায়। গাড়ির ছাদের ওপর মেছতা রোগীর মতো কালশিটে দাগ। আর সিটবেল্টের যে ধরন, ও থেকে অনুমান করা যায় গাড়িটি কম করে হলেও বিশ বছরের পুরনো। প্যাসেঞ্জার সিটের পায়ের কাছটায় কিছু দুমড়ানো মুচড়ানো কাগজের টুকরো। তা থেকে দু একটা উঁকি দেওয়া কাগজ জানান দেয়, তারা টেলিফোন কিংবা বিদ্যুতের বিল। মোটামুটি ভাগাড়ের মতো এই গাড়িটির সওয়ারি আজ আমি। গত সপ্তাহেই ভেনেসা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ওর এই বাহনে চড়ে সান ডিয়েগোর হারবার এলাকায় যাবার। ঠিক বেড়াতে নয়। ওখানে ওর এক গাতক বন্ধুদল আসবে নানা বাদ্যযন্ত্রসহ। ভেনেসা ওখানে যাবে তাঁদেরকে কিছুটা সঙ্গ দিতে। আমাকে সে-কথা জানিয়ে সহযাত্রী হবার প্রস্তাব দিলে আমি এক কথায় লুফে নিই। ছুটির দিনে আমার তো আর করার মতো তেমন কিছু নেই! মি ওয়াং এই সময়টায় গম্ভীর মুখে চীনে সওদার দোকান থেকে আনা ফ্রি পত্রিকায় চীনে ভাষার পাজল মেলান। ও সময়ে তাঁর সাথে খেজুরে আলাপ করা যায় না। বাড়িতে বসে তাই অলস হাওয়া না খেয়ে যদি হারবারের  নোনা বাতাস খাওয়া যায়, তবে হয়তো মন্দ হয় না।

ভেনেসার পরনে আজ ফ্রি-কাট সাদা ধবধবে প্যান্ট, আর ঊর্ধ্বাঙ্গে সিল্কের টপস। হারবারে ঠিক এমনতর রক্ষণশীল পোশাকে খুব কম লোকেই যায়। এর পেছনে অবশ্য একটা ব্যাখ্যা আছে। কিছুদিন আগে কথায় কথায় জানিয়েছিল, ওর পরিবার কট্টর ক্যাথলিক। বড় ভাইটি স্থানীয় গির্জার প্যাস্টর। ক্যাথলিক মতে জন্মনিয়ন্ত্রণকে ‘না’ বলায় এখন পর্যন্ত পাঁচ পাঁচটি সন্তান তাঁর। তবে আর্থিক সঙ্গতি নাকি তেমন নয়। এ কথাগুলো ভেনেসার কাছ থেকে জেনেছি একদিন নাচের ক্লাসে ঢোকার আগে। সেদিন নিজের মায়ের সাথে করিডরে দাঁড়িয়ে বেশ চড়া গলায় বাৎচিত করছিল। টেলিফোন রাখার পর আমি কাছে গিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এনিথিং রং?’ তাতে করে ও হড়বড়িয়ে মায়ের ওপর ঝাল ঝরিয়ে যা বলল তার সারাংশ হলো এই—ভেনেসার মা-বাবা ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা চালাত। সেই ব্যবসা লাটে ওঠায় ভেনেসা প্রতি মাসে মা-বাবাকে কিছু পয়সা পাঠায়। কিন্তু বুড়োবুড়ি সেগুলো নিজেদের পেছনে খরচ না করে সব ঢালে এই বড় ভাইয়ের পাঁচ সন্তানকে এটা-সেটা কিনে দেবার কাজে। ক্রোধে রাঙামুখী হয়ে ভেনেসা বলে, ‘দে আর জাস্ট এক্সপ্লয়েটিং মাই প্যারেন্ট’স ইমোশন। সঙ্গতি না থাকার পরও একের পর এক বাচ্চা নেওয়ায় ওদের সংসারে অভাব লেগেই আছে। সেসব জানিয়ে আমার মা-বাপের কাছে এসে যখন ঘ্যান-ঘ্যান করে, তখন তাঁরাও নাতি পুতির মুখের দিকে তাকিয়ে সব টাকা খরচ করে ফেলে। ওদিকে সেই টাকাটা কিন্তু আমার পাঠানো টাকা। বোঝো অবস্থাটা।’ তো সেইসব আলাপের মাঝেই উঠে আসে ওর পরিবারের কিছু গোঁড়ামির কথা। ওর মায়ের নাকি ফতোয়া আছে, নন-ক্যাথলিকদের সাথে বন্ধুত্ব করাটাও এক ধরনের পাপ। যদিও পরিহাসের ব্যাপার হলো, ভেনেসার ছোট বোন, যে কিনা এই মুহূর্তে থাকে সান ফ্রানসিস্কোতে, সে কিন্তু চুটিয়ে এক সৌদি যুবকের সাথে লিভ টুগেদার করছে। সে কথা জানলে হয়তো ওর মায়ের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার সম্ভাবনা আছে।


হারবারে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করা নিয়ে বিরাট এক ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়। আজ তো শনিবার। রাজ্যের লোক যেন ভেঙে পড়েছে এখানে। পথের পাশের মিটার পার্কিংগুলো সব দখল। বেশ কয়েকবার ঘুরপাক খাবার পর নিতান্তই ভাগ্যবশে একটি জায়গা আমাদের মেলে। সেখানে স্যাত করে গাড়িটি পার্কিং করে ভেনেসা মিটারে পয়সা ভরতে যায়। আমি সেই ফাঁকে নেমে আশেপাশে নজর বুলাই। উল্টোদিকের ফুটপাথে দেখি, এক ভবঘুরে শপিং মলের কার্টে নিজেদের যাবতীয় সংসারটিকে ঠেলেঠুলে বসিয়ে পাশে বসে ঝিমুচ্ছেন। সামনে শিপিংবক্স থেকে কেটে নেওয়া এক টুকরো কাগজে লেখা, ‘মিথ্যে কেন বলব? বিয়ার খাবার জন্যেই কিছু পয়সা চাইছি।’ এর সামনে দিয়ে সে মুহূর্তে পাঁচ-দশটি ছোট কুকুরের দল নিয়ে হেঁটে যায় বাঁ-হাতে ফুল লতাপাতার উল্কি আঁকা এক যুবতী। দলের একেবারে শেষ কুকুরটির পেছনের পায়ে বাঁধা একটি হুইল। বাকিগুলো হাঁটছে কিছুটা খুঁড়িয়ে। মেয়েটি খুব সম্ভবত কোনো পঙ্গু কুকুর সেবা কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক। সবগুলো কুকুরের গলায় বাঁধা চেনের প্রান্তকে নিজের মুঠিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মেয়েটি ফুরফুরে মেজাজে সামনে এগিয়ে যায়।

মিটারে পয়সা ভরে ভেনেসা ফিরে আসে। আমরা হাঁটতে থাকি কংক্রিটে বাঁধানো পথ ধরে। খুব কাছেই এসে একটি রিকশা হার্ড ব্রেক করে। এ সেই বঙ্গদেশের রিকশা নয়। বরং ও ধরনের কিছু একটা। এঁদের অনুমতি আছে কেবল এই হারবারের আশপাশে লোকেদের নিয়ে ঘুরবার। রিক্সার পাদানির জায়গাটি থাকা টেপরেকর্ডার থেকে ভেসে আসছে আরবি গান। যানটি চালাচ্ছে ফ্যাশন দুরস্ত এক যুবা। জেল দিয়ে পেছনে ব্যাকব্রাশ করা চুল। হাতের কবজিতে বেঁধে রাখা কয়েকটি মালা। আমরা তো আর এখানে প্রমোদ ভ্রমণে আসিনি, তাই গাঁটের টাকা খরচ করে রিকশায় চড়বার মানে হয় না; আর ও জিনিসে তো এ জীবনে কম চড়িনি!

হারবারের ডান দিকে বিশাল এক যুদ্ধজাহাজ। নানা যুদ্ধ শেষ করে অবসর নিয়ে এটি এখন ডেরা বেঁধেছে এই হারবারের কোণে। কম পয়সায় খাটবার মতো লোক নিয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প এদেশে গড়ে ওঠেনি, ওদিকে দৈত্যের মতো এমন এক জাহাজকে ডুবিয়েও দেওয়া যায় না। তাই একসময় ঠিক হলো, জাহাজটিকে যদি এই হারবারে বেঁধে রেখে একটা জাদুঘর মতন করা যায়, তবে হয়তো জাহাজটি মরে গিয়েও বেঁচে যায়। সেটাই হলো পরে। লোকে এখন পয়সা খরচ করে ভেতরে গিয়ে দেখে আসে নাবিকদের থাকার স্থল আর যুদ্ধ বিমানের কংকালগুলো। এই জাহাজের পাশ দিয়ে হাঁটার সময়ে নিজেকে হস্তীর সম্মুখে পিপীলিকাসম মনে হয়। হয়তো সেসব নিয়েই ভাবছিলাম কয়েক মুহূর্ত। কোন সময়ে যে একজন চৈনিক ভদ্রলোক হাতে একখানা লিফলেট গুঁজে দিয়ে গেছে টের পাইনি। এখন সম্বিত ফিরে পেয়ে তাতে নজর বুলিয়ে যা বুঝলাম—এঁরা ফালুন গং নামক চীন দেশের এক সাধক সম্প্রদায়। তা চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট সরকার এঁদের ওপর ব্যাপক নাখোশ। সুযোগ পেলেই পাইকারি হারে ঢুকিয়ে দেয় জেলে। সেটুকুও হয়তো মেনে নেয়া যেত। কিন্তু ফালুন গং গ্রুপ জেল থেকে পলাতক কয়েক সদস্যের মাধ্যমে জেনেছে—জেলে অন্তরিন বাকি সদস্যদের শরীর থেকে অনেক সময়েই সরিয়ে ফেলা হয় কিডনির মতো মূল্যবান প্রত্যঙ্গ। আর সেজন্যেই এই দল চাচ্ছে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘটনাটিকে বিশ্ববাসীর নজরে আনতে।


ভেনেসা ততক্ষণে সরে গেছে কিছুটা ডান দিকের কোণে। সেখানে চার জনে মিলে বসিয়ে ফেলেছে গানের জমজমাট আসর। তাঁদের হাতে বেহালা, গিটার, একর্ডিয়ান আর চেলো। যিনি লিড গায়ক তার গায়ে একটি ছাই রঙের টি শার্ট। মাথায় প্রথাগত মেক্সিকান খড়ের টুপি। বিশাল সেই টুপির চাতালে ঢাকা পড়েছে মুখের একাংশ। পাশেই রাখা সাউন্ডবক্স থেকে ঝুলে থাকা মাইক্রোফোনটি আঁকড়ে ধরে ভদ্রলোক দুলে দুলে গান করেন; আর গানের মাঝে সকল দর্শকের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভেনেসার দিকে তাকিয়ে হাসেন। সেই অর্থপূর্ণ হাসি দেখে আন্দাজ করি, এ-ই হয়তো ওর সেই গাতক বন্ধুদল।  দলের সামনে পেতে রাখা গিটারের শূন্য বাক্স। লোকে দু চার মিনিট গান শুনে সেখানে রেখে যাচ্ছে কয়েকটি কয়েন।

আমি স্প্যানিশ বুঝি না। ভেনেসা তাই তর্জমা করে গানের কয়েকটি লাইন আমাকে শোনায়—‘আই ডু নট নো হোয়াট টু ডু, আই ফেল ইন লাভ উইথ ইউ ইন এ ডে, এন্ড ডু নট নো হোয়াই, ইউ মেইড মাই লাইফ রিবর্ন।’ সে তো বুঝলাম, কিন্তু একদিনের মাঝেই হাবুডুবু প্রেমে পড়া কি আদৌ সম্ভব?—মুচকি হেসে ভেনেসাকে জিজ্ঞেস করি। আমার কথার জবাব দেবার মতো কোনো ব্যাগ্রতা ওর মাঝে ক্রিয়া করে না, বরং ওর দৃষ্টি ব্যস্ত থাকে লিড গায়কের সাথে অদৃশ্য তরঙ্গ স্থাপনে। আমি তাই ওকে কিছুটা স্পেস ছেড়ে দিয়ে বাঁ-পাশে আরো কিছুটা দূরে এক ভাস্কর্যের দিকে হেঁটে যাই। এটির সামনে প্রচুর মানুষের জটলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর জাহাজে করে নৌ সেনারা যখন নিউ ইয়র্কে ফিরে এলো, তখন তাঁরা যুদ্ধ জয়ের আনন্দে উদ্বেলিত, প্রজ্জ্বল; তাঁদেরকে এক নজর দেখতে আর ফুল ছুঁড়ে দিতে বন্দরে সমবেত হলো হাজারও নারী। সেই নৌ সেনাদের মাঝে একজন তেমনই এক যুবতীকে ঠেসে ধরে ওষ্ঠাধরে প্রগাঢ় চুম্বনের প্রলেপ এঁকে দিলো। সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় বন্দি করে নিল টাইমস ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক। পরে যুদ্ধ পরিসমাপ্তির যে আনন্দ, তার সমার্থক হয়ে গেল টাইমের কভার পেইজে ছাপা সেই ছবিটি। আরো পরে সেই ছবিটিকে সম্বল করেই গড়া হলো বিশাল ভাস্কর্য। নিয়ম হয়ে গেল, ভাস্কর্যটি কয়েক বছর করে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে থাকবে। সেই ঘূর্ণনের সাথী হয়ে ভাস্কর্যটি এ-মুহূর্তে এ শহরের হারবারে। লোকে তাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এর সামনে ছবি তোলার জন্যে। অনেকে আবার প্রেয়সীকে জাপটে ধরে সেই ভাস্কর্যের নাবিকের ভঙ্গিমাতেই ছবি তুলছে। পত্রবিহীন কোরাল গাছের তলে দাঁড়িয়ে যখন এসব তামাশা দেখছি, তখন হঠাৎ পেছন থেকে ভেনেসার কণ্ঠ শুনতে পাই—‘ইসনট ইট এ লাভলি স্ট্যাচু?’ আমি মাথা দোলাই। তারপর দূরের গানের দলের দিকে ইঙ্গিত করে বলি, ‘তুমি চাইলে ওদিকটায় আরো কিছু সময় কাটাতে পারো। আমি আছি এখানে।’ ‘দ্যাটস ওকে, চলো আমরা এই ট্রেইলে কিছুটা দূর হাঁটি। ওরা ওখানে বহুক্ষণ গান করবে। ফিরে আসার পথে না হয় আবার থামা যাবে।’

ডান পাশের এক ফিশ রেস্তোরাঁ থেকে তাজা মাছ ভাজার চনমনে গন্ধ ভেসে আসছে। তার সামনে খদ্দেরদের লাইন। আমরা সেটিকে পেরিয়ে আরো কিছুটা দূর হেঁটে গেলে এক কাকাতুয়া পাখিওয়ালা আমাকে হাত নেড়ে ডাকেন। তার আদরের পাখিটি নাকি আমার হাতে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম নিতে চায়। অগত্যা সেই পাখিটিকে ডান কবজিতে আশ্রয় দিতে হলো। সেটি দেবার বিনিময়ে আমাকে খোয়াতে হলো জামার সবচেয়ে উপরের বোতামটি। সেয়ানা কাকাতুয়া কোন সময়ে যে ঠোকর দিয়ে বোতামখানি খেয়ে ফেলেছে টেরই পাইনি। দেখি, ভেনেসা খিক খিক করে হাসছে আমার দশা দেখে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পাখিটিকে মূল মালিকের হাওলায় ছেড়ে এসে পাশের এক দূর্বা ঘাসের জমিনে ধপ করে বসে পড়ি।


অনতিদূরে খাড়ির মাঝে বেঁধে রাখা কয়েকটি নৌকো। ঢেউয়ের আঘাতে তারা প্রবলভাবে দুলছে। আর তীরের কাছটায় নোটিশ টানিয়ে লেখা, ‘এখানে সাঁতার কাটা কিংবা মাছ ধরা নিষিদ্ধ।’ আমার থেকে একটু দূরে ঘাসের মাঝেই হঠাৎ মাথা ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে গেছে বিশাল আরবান ট্রি। তার তলে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে সুতো টেনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে দু যুবক-যুবতী। যেন আকাশের দিকে তুলি টেনে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা। ভেনেসার নাকের অগ্রভাগে বিন্দু বিন্দু স্বেদ। সাগরের নীল জলের প্রতিফলন সেই বিন্দুতে সমাপতিত হয়ে সৃষ্টি করে উজ্জ্বল আলোকস্ফটিক। আমি ঘাসের ওপর শুয়ে ভেনেসার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘সো দিস সিঙ্গার গাই, ইজ হি জাস্ট এ ফ্রেন্ড অফ ইওরস?’ কামরাঙার কোয়ার মতো ঠোঁটটিকে উলটে কৌতুকপূর্ণ স্বরে ও জবাব দেয়, ‘কেন তুমি কি ভেবেছিলে ও আমার নাগর?’ এ বলে ভেনেসা খলখলিয়ে হেসে ওঠে। তারপর বহু দূরের অস্পষ্ট করোনাড দ্বীপের সেতুর দিকে তাকিয়ে সেই লিড গায়ক আর ওর জীবনের কিছু যোগবিন্দুকে আমার সামনে তুলে ধরে।

ভেনেসার পরিবার ওর খুব ছোটবেলায় মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় চলে এলেও ও রয়ে গিয়েছিল দিদার কাছে গুয়াদেলরাহা শহরে। সেই শহরের হাইস্কুলে ওর সহপাঠী ছিল এই লিড গায়ক, আলবার্তো। বলা চলে, ও ছিল আলবার্তোর হাইস্কুল সুইটহার্ট। তবে এর মাঝেই জীবন অন্য দিকে মোড় নেয়। আলবার্তোর মায়ের তখন এক অদ্ভুত মানসিক রোগ ছিল। ছেলেকে সে সহ্য করতে পারত না। কারণে-অকারণে বেধড়ক পেটাত। মায়ের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরুবার আগেই একদিন আলবার্তো ঘর ছেড়ে ফেরারি হয়। ওদিকে ভেনেসা এর কয়েক বছর পর মা-বাপের কাছে আমেরিকায় চলে আসে। আলবার্তো ওর জীবন থেকে বেমালুম হারিয়ে যায়। ভেনেসার জীবনও নানা চোরাগলিতে ঘুরপাক খায় এতটা বছর। তারপর এই দু বছর আগে মেক্সিকোতে নিজ শহরে বেড়াতে গিয়ে ভেনেসা যায় গির্জার রবিবাসরীয় প্রার্থনায়। সেখানে গিয়ে দেখে, যুবা বয়েসী যাজকদের একজনকে বড্ড যেন চেনা চেনা লাগে।

আলবার্তোর মায়ের পরে পাকস্থলীর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। কী করে যেন আলবার্তোর কানে ঠিকই পৌঁছে যায় মায়ের এই অন্তিম দশার কথা। যেই মায়ের কারণে তাঁকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, সেই মাকেই শেষ সময়টায় আলবার্তো প্রাণ সঁপে দিলো। কিন্তু ভদ্রমহিলা শেষতক বাঁচলেন না। জীবনের এই লুকোচুরি খেলায় শ্রান্ত হয়ে আলবার্তো শরণ নিল যীশুর। গুয়াদেলরাহার সেই সমুদ্রমুখী গির্জাতে সেভাবেই ভেনেসার সাথে আলবার্তোর পুনর্মিলন।

শৈশবের সেই কুসুম কুসুম রোমান্টিকতা এখন আর নেই। তার বদলে এখন দু জনের মাঝে যা আছে, সেটি নিখাদ বন্ধুত্বপূর্ণ মমতা। আর সেই মমতা এক সময় খুঁজে পায় সমধারা। আলবার্তো গির্জার অধীনে কাজ করছিল স্থানীয় দরিদ্র শিশুদের নিয়ে। ওদিকে প্রথম যৌবনে ঘটানো একটি গর্ভপাতের পর ভেনেসার আর কোনোদিন মা হয়ে ওঠা হয়নি। তাই পথশিশুদের নিয়ে কিছু একটা করার উদগ্র বাসনা তার মাঝেও ছিল। ভেনেসা আলবার্তোকে প্রস্তাব দেয়, এই শিশুদের জন্যে আমেরিকা থেকে কিছু অর্থ সাহায্য উত্তোলন করলে কেমন হয়? আলবার্তো তো এমনিতেই ওর সেই ভবঘুরে জীবনে গিটার বাজিয়ে পয়সা তুলত। এবারেও না হয় তেমন কিছু করুক ক’টা দিন আমেরিকায় এসে। তারপর যে টাকা পাওয়া যাবে তা নিয়ে ভেনেসা আলবার্তোর দলের সাথে পৌঁছে যাবে গুয়াদেলরাহায়। ওখানে বাচ্চাদের জন্যে খেলনা কেনা হবে। স্থানীয় এক জুতোর দোকানদার বলেছেন, বিনা মূল্যে তিনি কিছু জুতোর বাক্স দেবেন। তারপর সেই বাক্সে খেলনা ভরে বিলানো হবে শহরের প্রায় কয়েকশো দরিদ্র শিশুর মাঝে।


ভেনেসার বয়ানটি শেষ হলে আমি আকাশে উড়তে থাকা বাহারি ঘুড়িগুলোর দিকে তাকাই। সেই মুহূর্তে একটি ঘুড়ি আরেকটির হাতে ধরাশায়ী হয়ে সুতো ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে দূর সমুদ্রের দিকে। তবে সেটিকে কেউ তাড়া করছে না। বরং ঘাসের চাদরে শুয়ে থাকা ঘুড়ির মালিক বেশ আমোদ নিয়ে দৃশ্যটি দেখছেন। পাশেই রোদ চশমা পরে পা ভাঁজ করে বসে থাকা প্রেয়সী কিছুটা যেন সরে আসে তার দিকে। তারপর ভালোবাসা অনিবার্য পথ খুঁজে নেয় তাঁদের দ্বৈত ওষ্ঠাধরে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর