অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ কবিতাভবন প্রকাশ করেছে মাসুদ খানের নতুন কবিতার বই ‘ঊর্মিকুমার ঘাটে’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বাতিঘরের ৪৪৩-৪৪৫ নং স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
মাসুদ খানের প্রথম বই ‘পাখিতীর্থ দিনে’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর ২০০১ সালে ‘নদীকূলে করি বাস’, ২০০৬ সালে ‘সরাইখানা ও হারানো মানুষ’, ২০১১ সালে আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি, ২০১২ সালে ‘হাওয়াকল’, ২০১৪ সালে ‘এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায়’, পরের বছর ‘দেহ-অতিরিক্ত জ্বর’, ২০১৬ সালে ‘প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান’, ২০১৮ সালে ‘প্রসন্ন দ্বীপদেশ’, এবং গত বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পাখপাখালির গান পাগলাঝোরার তান’। এছাড়া তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ও ‘গদ্যগুচ্ছ’ সংকলিত হয় ২০১৮ সালে।
নতুন প্রকাশিত তাঁর কবিতার বইটি, নিজস্ব লেখালেখির জগৎসহ বর্তমান সাহিত্যাঙ্গন ও আরো নানাবিধ বিষয়ে সম্প্রতি বার্তা২৪-এর সাথে কথা বলেছেন মাসুদ খান
বার্তা২৪: ঊর্মিকুমার ঘাটে বইটা সম্পর্কে জানতে চাইব।
মাসুদ খান: ২০১৮-তে ‘প্রসন্ন দ্বীপদেশ’ কবিতার বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকে গত দুই বছরে যে কবিতাগুলি লিখেছি সেগুলি নিয়েই এবারকার বই ঊর্মিকুমার ঘাটে। বরাবরের মতোই এ বইয়েরও উপজীব্য প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, জীবন, সমাজ-সংসার, বিশ্ব-মহাবিশ্ব আর এদের রহস্য, এদের নৈঃশব্দ্য ও কলরব, যা জলছাপের ইশারার মতো লিপ্ত হয়ে আছে কবিতার শরীরে। শব্দে-নৈঃশব্দ্যে, ছন্দে-দুন্দে, রূপনিধি রজকিনী আর যোগিনী ব্যঞ্জনায়, পিশাচীস্পর্শে, লাল-কালো কোলাহলে জেগে-ওঠা এক ভোরের ঊর্মিকুমার ঘাট।
বইটির অনেক কবিতাই ছাপা হয়েছে বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্ট পত্রিকায়। নানা সময়ে নানাভাবে সাড়া পেয়েছিলাম কবিতাগুলির ব্যাপারে। বইটার বেশ কিছু কবিতা ছিল অপ্রকাশিত। এখন সব মিলিয়ে বইটি প্রকাশের পর বেশ সাড়া পাচ্ছি সংবেদী সমঝদার পাঠকদের।
বার্তা২৪: আপনার পূর্ববর্তী কবিতার বইগুলোর সাথে এই বইয়ের পার্থক্য আছে কি, কবিতাগুলোতে কি নতুন কোনো দিকে যেতে চেয়েছেন?
মাসুদ খান: প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বইয়েই একটু একটু করে বদলে গেছি, ভাব ও ভাষা উভয়ত। এ বইটাতেও। তবে ব্যাপক কোনো বদল নয়। আমার প্রতিটা কবিতার বইয়ে থাকে এক বা একাধিক দীর্ঘ কবিতা। এবারকার বইটিতে নেই। এবারে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটি গীতিকবিতা। রয়েছে বেশ কিছু ছোট ছোট কবিতা। আর আছে সব অনুচ্চ স্বরের হর্ষবিষাদ পদাবলি।
বার্তা২৪: আপনার প্রথম কবতিার বই ‘পাখিতীর্থ দিনে’ প্রকাশতি হয়ছেলি ১৯৯৩ সালে এরপর ২০০১-এ ‘নদীকূলে করি বাস’। প্রথম বইয়রে পর দ্বিতীয় বই করতে এত দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন কেন?
মাসুদ খান: এক তাড়াবিহীন ধীরগতি সময় কেটেছে সেই বছরগুলিতে। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি করে কবিতা লেখা হতো। বেশি হতো আড্ডা আর পঠনপাঠন। তারপরও ৭/৮ বছরে লেখা হয়েছিল অনেকগুলি কবিতা। পরে সেগুলি একত্র করে ৫ ফর্মার ‘নদীকূলে করি বাস’।
বার্তা২৪: আপনার কবিতায় বিজ্ঞান এবং এর নানা অনুষঙ্গের বড় ভূমিকা পাওয়া যায়। সেখানে ব্যক্তি, বস্তু, সমাজ, সভ্যতা, মহাবিশ্ব সবকিছুর সাথেই বিজ্ঞানের একটা সংযোগ থাকে। আপনি কি তিরিশ এবং তিরিশ পরবর্তী কবিদের সাথে নিজের কবিতার পার্থক্য তৈরি করার জন্য বিজ্ঞানকে বেছে নিয়েছিলেন?
মাসুদ খান: তাই কি? বিজ্ঞানকে কি খুব বড় ভূমিকায় পাওয়া যায় আমার কবিতায়? পুরাণ নৃতত্ত্ব অধিবিদ্যা ইতিহাস ভূগোল সমাজ-রাজনীতি... মানববিদ্যার সব বিষয়ই তো অনুষঙ্গ আকারে থাকে আমার কবিতায়, সেইসঙ্গে প্রকৃতিবিজ্ঞানও। বিজ্ঞানের বিষয়টা আগেও কবিতায় ছিল—বিশ্বকবিতায়, বাংলাকবিতাতেও। নতুন কিছু না। তবে বলতে পারেন, একটা কসমিক ভিউ, একটা ক্ল্যাসিক এপিক লক্ষণা বা ব্যঞ্জনা প্রায়শই থাকে আমার কবিতায়, দীর্ঘ কবিতায় তো বটেই, এমনকি থাকে হ্রস্ব কবিতাতেও। পার্থক্য তৈরি করার জন্য ঠিক কোনো কিছুকে বেছে নিইনি আসলে।
বার্তা২৪: আপনার কিছু কবিতায় সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির নানা বিরোধিতা আছে। সেখানে ঔপনিবেশিক বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার একটা পাল্টা ভাষ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সত্তরের দশক-পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? এই সময়ে রাজনৈতিক কবিতা আদৌ লেখা হচ্ছে কি বা কবিতায় গণমানুষের উপস্থিতি পান?
মাসুদ খান: কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হয় সবার আগে। তারপর বিবেচনায় আসে তার উপজীব্য বিষয় ও অনুষঙ্গরাশি। কবিতায় সমাজ-রাজনীতি বা যে কোনো বিষয়ই থাকতে পারে, কিন্তু তাকে থাকতে হয় জলছাপের মতো, আবছা ইশারা আকারে। সমস্ত বিষয়, প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গকে ছাপিয়ে কবিতাকে ফুটে উঠতে হয় ফুল ফোটার মতো করে। কবিতা বা যে কোনো নন্দনশিল্প মানেই রূপ রচনা, সৌন্দর্য সৃজন। যে কোনো বিষয়খণ্ড কিংবা অনুষঙ্গপুঞ্জকে ঘিরে এমনকি বিষয়হীনতা ঘিরেও সৃজিত হতে পারে সেই সৌন্দর্য। সমাজ-রাজনীতিসহ বিচিত্র বিষয় নিয়েই কবিতা হচ্ছে এ সময়ে, হচ্ছে ‘নির্বিষয়’ কবিতাও।
বার্তা২৪: কবিতার পাশাপাশি আপনি গদ্য লিখছেন, কয়েক বছরে ধরেই গদ্যের বই প্রকাশিত হচ্ছে আপনার। হঠাৎ গদ্য লিখতে শুরু করলেন কেন?
মাসুদ খান: হঠাৎ না তো, আগে থেকেই লিখতাম। তবে খুব কম-কম। একটি প্রবন্ধ/নিবন্ধের বই (গদ্যগুচ্ছ) আর একটি কথাসাহিত্যের বই (প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান) বের হয়েছে এ যাবৎ। অবশ্য আরেকটি মুক্তগদ্যের (আমি বলি গদ্য-আলেখ্য) বই আছে আমার—‘দেহ-অতিরিক্ত জ্বর’। অনেকে এ বইয়ের লেখাগুলিকে কবিতা বলেই বিবেচনা করে। তুলনামূলকভাবে কবিতাতেই আমি স্বচ্ছন্দ বেশি।
বার্তা২৪: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মাসুদ খান: ভালো, বৈচিত্র্যপূর্ণ। বইছে বহু বাতাস, ফুটছে নানা ফুল, প্রবাহিত হচ্ছে বহু ঝরনা।