প্রতিবারের মতো এবারের বইমেলা সম্পর্কেও একটি পর্যালোচনা সংযোজিত হলো। এই লিস্টে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, সীমাবদ্ধতা, রুচি ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। সব বই আমার একার পক্ষে নিরীক্ষা করা কিংবা স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তবু ঘুরেফিরে যা চোখে পড়ল, অন্যের রিভিউ থেকে চেখে দেখে যা মনে এলো, বিচারবুদ্ধি কী বলল সেই অনুযায়ী একটা লিস্ট তো করাই যায়। এখানে কোনো বিষয়ের ‘উল্লেখযোগ্য’ একাধিক বই থেকে ‘নির্বাচিত’ বই সিলেক্ট করা হয়েছে। ‘উল্লেখযোগ্য’ হলো উল্লেখের যোগ্য, অর্থাৎ নানাকারণে ভালো বই, কিন্তু ‘নির্বাচিত’ বই হলো তাদের মধ্য থেকে বিবিধ কারণে রীতিমত উল্লেখ করার মতো বই।
যেহেতু বইমেলা বিশাল, শত শত স্টল, গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৪৯১৯ (মোট বিক্রি হয়েছে ৮২ কোটি টাকা), এর মধ্য থেকে রিভিউ ছাড়া বই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এবারের বইমেলা আগের যে কোনো মেলার তুলনায় অনেক অনেক সুন্দর হয়েছে। পরিসর বেড়েছে। হাঁটাচলায় স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। একইসাথে, দুঃখের বিষয়, প্রচুর বেনোজলও প্রবেশ করেছে।
অধিকাংশ ভালো বই এসেছে মেলার মাসের অর্ধেকেরও পরে। তাহলে আর ১-বা-২ ফেব্রুয়ারি থেকে মেলা শুরুর অর্থই বা কি; কিংবা সাড়া মাস জুড়ে মেলা জারি রাখার অর্থই বা কী? একইভাবে, মেলা বাড়ানোর অর্থই বা কী, কেননা যতই বাড়ানো হোক, শেষদিনের আগে মেলায় বই প্রকাশের অর্থই বা কী?
গ্রন্থমেলায় পাঠকের চেয়ে লেখক বেশি, কাগজের আগাছা বেশি। আমি বলেছি, লেখক তুমি পালিয়ে যাও, সময় এখন পক্ষে নয়। একজন লেখক মন্তব্য করেছেন, বন্যার জল বেরিয়ে যাবে, পড়ে রইবে মননশীল পলি। হয়তো তা-ই। মনে রাখা দরকার, একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ একটি পরিশীলিত, সম্পাদিত, মননশীল শিল্পরূপ। এটা ঝাল-মুড়ির ঠোঙ্গা নয়, রাতারাতি ছাপিয়ে ফেললাম। মেলাটির নামই গ্রন্থমেলা, বইমেলা নয়। সব বই-ই গ্রন্থ হয় না। এবারে খাবারের দোকানগুলো ভালো ছিল। বেঙ্গলের দুধ-চা ছিল সবচেয়ে উপাদেয়। দেখা গেছে, বই কিনুক না-কিনুক, মাংস-লুচি-ফুচকার দেদার উদরং চলেছে।
এবারের বইমেলার একটি বিশেষ ব্যাপার হলো প্রচুর অনুবাদগ্রন্থ এসেছে। প্রচুর। ফিকশনের, অনুবাদ, নন-ফিকশনের অনুবাদ। বিজ্ঞানের অনুবাদ। ব্যাপক অনুবাদ। ফলে অনুবাদ ক্যাটিগরিতে ‘নির্বাচিত’ গ্রন্থের নাম আগেই পেশ করি—
নির্বাচিত অনুবাদ
ক) অনুবাদ-ফিকশন—১. গোলাপের নাম, উমবের্তো একো, অনুবাদ: জি এইচ হাবীব, বাতিঘর।
খ) অনুবাদ-নন-ফিকশন—১. নীরদ সি চৌধুরীর মন, ইয়ান অ্যালমন্ড, হাসান আল জায়েদ এবং রায়হান রহমান, ইউপিএল।
২. নাইন-ইলেভেন, নোম চমস্কি, অনুবাদ: মুহম্মদ গোলাম সারোয়ার, চৈতন্য।
গ) অনুবাদ-বিজ্ঞান—১. সিক্স ইজি পিসেস, রিচার্ড ফাইনম্যান, অনুবাদ: উচ্ছ্বাস তৌসিফ, প্রথমা।
২. ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল, মিচিও কাকু, অনুবাদ: আবুল বাসার, প্রথমা।
ঘ) অনুবাদ-সাহিত্য—১. তরজমাগুচ্ছ, আলম খোরশেদ, পাঠক সমাবেশ।
ঙ) ব্যতিক্রমী অনুবাদ—১. বিবর্তনবাদী জ্ঞানতত্ত্ব, কার্ল পপার, অনুবাদ: আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া, পাঠক সমাবেশ।
নির্বাচিত ভূমিকা
১. সেলিম রেজা নিউটনের ভূমিকা, তদীয় অনুবাদে নোম চমস্কির ভবিষ্যতের সরকার, পেন্ডুলাম।
নির্বাচিত কবিতাগ্রন্থ
১. এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না, আল মাহমুদ, সরলরেখা।
২. দশ মহাবিদ্যা, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, বৈভব।
৩. পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়, মাসরুর আরেফিন, পাঠক সমাবেশ।
উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ
১. সামান্য দেখার অন্ধকারে, আলতাফ শাহনেওয়াজ, প্রথমা।
২. আমাকে এবার পিছমোড়া করো, কামরুজ্জামান কামু, প্রথমা।
নির্বাচিত কবিতা-সংকলন
১. নির্বাচিত কবিতা, আলফ্রেড খোকন, কবিতাভবন (বাতিঘর)।
২. নির্বাচিত কবিতা, মারুফ রায়হান, ধ্রুবপদ।
নির্বাচিত কবিতা
১. “নুর নুর বলে চমকায় পাখি” কবিতাটি সারাজাত সৌম’র একইনামের (নুর নুর বলে চমকায় পাখি) কবিতা গ্রন্থের নাম-কবিতা, বেহুলা বাংলা।
নির্বাচিত বিজ্ঞান
১. আমাদের মহাজাগতিক পরিচয়, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রথমা।
২. রোগ জীবাণুর গল্প, সঞ্জয় মুখার্জী, আদর্শ।
পড়ে-রাখা-ভালো বিজ্ঞান
১. শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল, আবদুল গাফফার, অণ্বেষা।
নির্বাচিত শিশুপাঠ
১. মধু শিকারি, অনুবাদ: শামিম আজাদ, ইউপিএল।
২. আজব দেশে অ্যালিস, শিশু-নাট্যরূপ অনুবাদ: আবদুস সেলিম, প্রকৃতি-পরিচয়।
ব্যতিক্রমী কিশোর-বিজ্ঞান
১. অ-পদার্থবিজ্ঞান, রাতুল খান, আদর্শ।
নির্বাচিত কিশোর-ইতিহাস
১. বাংলা ও বাঙালিঃ মুক্তি সংগ্রামের কিশোর-ইতিহাস, ড. মোহাম্মদ হাননান, ময়ূরপঙ্খি।
২. শেখ মুজিব: কিশোর জীবনী, আহমাদ মাযহার, সময়।
নির্বাচিত নন-ফিকশন
১. কবিতাকলা ভবন, মৃদুল মাহবুব, বৈভব।
২. দূরের জানালা, মাসুদুজ্জামান, পরান-কথা।
৩. ভাষার প্রতিভা, রাজু আলাউদ্দিন, পেন্ডুলাম।
ব্যতিক্রমী নন-ফিকশন
১. চর্যাপদ: কালে কালান্তরে, রাজু আলাউদ্দিন, জার্নিম্যান।
২. বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে, ফাহাম আবদুস সালাম, একাদেমিয়া।
নির্বাচিত প্রবন্ধ
১. চেতনার উত্তরাধিকার, সম্পাদরা: পুলক দেবনাথ ও সাদিয়া মাহজাবিন ইমাম, অন্যপ্রকাশ।
নির্বাচিত গবেষণাগ্রন্থ
১. দারিদ্র্যের অর্থনীতি, আকবর আলি খান, প্রথমা।
২. দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য, মোজাফ্ফর হোসেন, পাঞ্জেরী।
নির্বাচিত গল্পগ্রন্থ
১. এখানে জাদু শেখানো হয়, মুরাদুল ইসলাম, বৈভব।
২. মনোজবাবুদের বাড়ি, হরিশংকর জলদাস, প্রথমা।
৩. বৈদিক পাখির গান, সাদিয়া মাহজাবিন ইমাম, চৈতন্য।
৪. দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশ, সাগুফতা শারমীন তানিয়া, প্রথমা।
ব্যতিক্রমী ফিকশন
১. হলদে ফুলের বিকেল, পাপড়ি রহমান, পরানকথা।
২. রোদ্দুর খুঁজে ফিরি, ফাহমিদা বারী, চৈতন্য।
নির্বাচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস
১. কাসিদ, জয়দীপ দে, দেশ পাবলিকেশন।
নির্বাচিত জর্নাল
১. কবিতালেখকের জার্নাল, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, চন্দ্রবিন্দু।
২. মা-বেলার ডায়েরি, আনন্দময়ী মজুমদার, বিপিএল।
নির্বাচিত জীবনী
১. বিজ্ঞানসাধক দুই বন্ধু, আলী নাঈম, বিপিএল।
২. অগ্রনায়কেরা, স্বকৃত নোমান, রোদেলা।
৩. ক্লাইভ, আদনান আরিফ সালিম, অন্বেষা।
৪. নভেরা, আনা ইসলাম, জার্নিম্যান ও অন্যপ্রকাশ।
নির্বাচিত সায়েন্স ফিকশন
১. তৃতীয় নারী, মাসউদুল হক, নাগরী।
নির্বাচিত সাক্ষাৎকার
১. গবেষণার দশানন, (গোলাম মুরশিদের সাথে আলাপ) রাজু আলাউদ্দিন, বিপিএল।
২. শিল্পী হওয়ার সব গুণাবলি নিজেকে অর্জন করতে হয়, শিল্পী রনবীর সাথে আলাপ, রাজু আলাউদ্দিন, পাঞ্জেরী।
নির্বাচিত প্রকৌশল গ্রন্থ
১. পদ্মা সেতু, এনায়েত চৌধুরী, প্রকৃতি-পরিচয়।
বিশেষ নির্বাচিতগ্রন্থ
১. বিনয় মজুমদার নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর প্রবন্ধসমগ্র-১, বৈভব।
এবারের বইমেলায় গল্পগ্রন্থের বেশ জয়ধ্বনি লক্ষ করেছি। সেই তুলনায় উপন্যাস মনে হলো, কিছুটা দাপট হারিয়েছে। তবু কয়েকটি উপন্যাস নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। পাঠ শেষ করতে পারিনি বিধায়, ক্যাটিগরিভুক্ত করতে পারছি না।
বিচারাধীন উপন্যাস
১. আলথুসার, মাসরুর আরেফিন, প্রথমা।
২. দ্যা নর্থ এন্ড, বর্ণালী সাহা, পাঠক সমাবেশ।
৩. জাদুকরী ভ্রম, হামিম কামাল, চন্দ্রবিন্দু।
৪. তিমিরযাত্রা, মোজাফ্ফর হোসেন, পাঞ্জেরী।
এবারের মেলার সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রকাশনা হলো বৈভব এবং পেন্ডুলাম। উভয়েই তাদের পরিবেশনা ব্যতিক্রমী রেখেছেন, আচরণ বন্ধুত্বসুলভ রেখেছেন। প্রথমা প্রকাশন সবসময়েই ভালো বই আনে, এবারও কয়েকটিই এনেছে, তবে এবারে তাদের সংগ্রহ আগের মেলার মতো মনোলোভা নেই, বইয়ের প্রোডাকশনও দুর্বল, বিশেষত কবিতার বইগুলো আলাদা মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। এবারে কম হলেও অনেকগুলো নজরকাড়া এবং ব্যতিক্রমী গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন বাতিঘর এবং চৈতন্য। প্রকৃতি-পরিচয় সবসময়েই খুব ভালো বই আনেন, সুলভও, কিন্তু প্রচার পায় নাই। এবারও নাই। তাঁরা প্রচার-বিমুখ শুধু নয়, প্রচার-বিরোধীও।
সৌভাগ্যক্রমে ২০২০ এর মেলায় ঘুরতে ঘুরতে পুরনো তিনটি ভালো বই নজরে এলো। জীবনানন্দ জীবনের ভালো কিছুকেই ‘শালিখ’ বলেছেন, কাজেই এই পুরাতন তিনটি শালিখ হলো—১. গ্রিক উইট, মুরাদুল ইসলাম, স্বরে-অ। ২. আমার গদ্য, ফরিদ কবির, অ্যাডর্ন। ৩. কোয়ান্টাম রাজ্যে ডালিমকুমার, খন্দকার রেজাউল করিম, সূচয়নী পাবলিশার্স। এই দারুণতম গ্রন্থত্রয়ী, পাঠক না পড়লে মিস করবেন।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ পুরোটা অন্ধকার হয়ে যায় যদি দুটি বই না-আসত। প্রথমটি বঙ্গবন্ধুর লেখা আমার দেখা নয়াচীন, প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। আর দ্বিতীয়টি গোলাম হোসেন হাবীবের অনুবাদগ্রন্থ গোলাপের নাম। আমি প্রিয় হাবীব ভাইয়ের হাতে এবং বঙ্গবন্ধুর পরিজনদের হাতে তুলে দিতে চাই মদীয় ‘অদৃশ্য পুরস্কার’। এর কোনো অর্থমূল্য নাই, কোনো মিডিয়া কভারেজ নাই, কোনো আলাদা দাবি নাই। আছে স্বেদস্নিগ্ধ ভালোবাসা। নিজে মেলায় গিয়ে, নিজে খুঁজে, নিজে কিনে, নিজের বিচারবুদ্ধিতে যাচাইকৃত বই বিশ্লেষণ করে এই পুরস্কার আমি প্রদান করছি। লেখক তুমি ধন্য হও।
এবারের মেলায় আমার দুটি বই একটাই পৃথিবী, প্রকৃতি-পরিচয় এবং অনুবাদ ও সম্পাদিত পরমাণু বিদ্যুতের দিগ্বিজয়, চৈতন্য। প্রথমটি কিশোর-পাঠ্য বিজ্ঞান-গ্রন্থ, দ্বিতীয়টি প্রকৌশল শাখার বই।
এই বইমেলার সবচেয়ে আলোচিত মিম প্রকৃত লেখকের কয়টা মুদ্রণ হয়! লেখক কে—মোটিভেশনাল বক্তা নাকি বাংলা গদ্যের সাথে পরিচয় আছে এমন কেউ? আপনি কী বলেন?
অতএব সাইন আউট বইমেলা ২০২০। তামাম শুদ।