চোখ এমনি এক অঙ্গ যে রহস্যে, প্রকাশে সর্বত্র ব্যতিক্রমী। গুরুত্ব প্রকাশে সে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। তাকে ঢেকে রাখার প্রশ্ন বোধ করি সভ্যতার আচ্ছাদনে বিশ্বাসী মানুষেরও নেই। কিন্তু তার প্রকাশকে আরো রহস্যময় করে তুলতে তাকে ঢাকা হলো। না এ ঢাকা পর্তুগীজ জলদস্যুর মতো এক কাপড়ে ঢাকা চোখের কথা নয়। এ ঢাকা আরো রসসিক্ত যথা চোখের রূপ উদ্ভাসিত থাকবে অথচ চোখের আগে যেন এক স্বচ্ছ পাহারাদার। সেই হলো গিয়ে চশমা। কিন্তু চশমাও কি কেবল প্রারম্ভিক দেখাতে বা চোখের পাহারাদারিতে আটকে থাকল?
না, মানুষ তাকে আকর্ষণের উপাদান বানিয়ে ফেলল বৈচিত্র্যের ঘনঘটায়। রোদ চশমার ব্যবহারে মানুষের অভিব্যক্তি বদলে যাওয়ার রূপ সবাই জানেন। বাজারে গান আসলো “গোরে গোরে মুখরে পে কালা কালা চশমা”। চশমার ব্যাপারটা নিছক প্রত্যক্ষভাবে চশমা হয়ে আসেনি। এর প্রথম আবিষ্কারের জায়গা হিসেবে ইতালিকে ভাবা হয়। আসলে শিক্ষিত ব্যাক্তিরা আতশ কাচের মাধ্যমে বস্তুকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। ফলে এই ভাবনা আসতে সময় লাগল না যে দুটি আতশ কাচ নাকের আগার শক্ত অংশে রাখলে একাগ্র মনে বস্তুটি নিরীক্ষণ করা যায়। ফলে এর থেকে আদর্শ চশমা তৈরির ভাবনা আসতে খুব বেশি সময় লাগল না।
অবস্থানের অর্থ ধরেই ফরাসি শব্দ চশমাহ থেকে “চশমা” শব্দের আগমন বলে ধরে নেওয়া হয়। আসলে চশমার প্রাথমিক আবিষ্কর্তা হিসেবে জিওনার্দো দ্য পিসা নামে এক ব্যাক্তিকে মনে করা হয়। তিনি অবশ্য চোখের অসুখ বা প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার জন্যই চশমার আগমনের কথা ভেবেছিলেন। ১৪০০ সাল নাগাদ অনেক হাতে আঁকা প্রাচীন ছবিতে চশমার ছবি দেখা যায়—তার থেকে ধারণা করা হয় সেই সময়ে এর ব্যবহার ছিল। রোমান সম্রাট নিরো এমেরাল্ডের টুকরোকে দূরের জিনিস দেখার জন্য ব্যবহার করতেন, অবশ্য তখনও চশমা আসেনি। তার বন্ধু দার্শনিক তাকে দূর থেকে গ্ল্যাডিয়েটারদের লড়াই দেখার জন্য এটি ব্যবহারের পরামর্শ দেন। রোমান সম্রাটরা তাদের সৈন্যবাহিনীকে মর্যাদাসম্পন্ন ও শক্তিশালী দেখানোর জন্য চশমার কাছাকাছি ধরনের জিনিস ব্যবহার করতেন।
তবে যতই ইতালির নাম থাকুক মিশরীয় সভ্যতার চিত্র থেকে মিশর থেকেই এর আগমন—সেই ধারণাও করা হয়। চোখের কমদৃষ্টিকে সঠিক করার জন্য এক বিশিষ্ট পোপ প্রথম অবতল কাচের চশমা ব্যবহারের পদ্ধতি আনেন। সবচেয়ে ঐতিহাসিক ব্যাপার ১৭৮০ সালে বেঞ্জামিন ফ্যাঙ্কলিন বাইফোকাল চশমা বানান, এই উদ্ভাবন এক বিশাল ইতিহাস। তারপর ১৮৭৩ সালে সেলুলয়েড এলে তার ব্যবহারে চশমার কাঠামো উন্নত হতে শুরু করে। এর আগে অবশ্য স্প্যানিশ লেন্স প্রস্তুতকারী দল চশমার জাগ্রত হাতলে ফিতে লাগিয়ে তাকে পরিধানের উপযোগী করে তোলে।
জর্জ এইরি বিষমদৃষ্টির সমাধানের কথা ভেবে ১৮২৫-এ যে বিশেষ চশমা নেন তাই একসময় আমেরিকায় চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয়। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট এই জাতীয় চশমা ব্যবহার করতে শুরু করেন। তারপর তো চশমা ধীরে ধীরে অসাধারণ প্রভাবে প্রাধান্যে স্টাইলে মানুষের আধুনিকীকরণে সঙ্গী হয়ে উঠল। যেখানে পঞ্চাশের দশকে চোখে লাগানো ফ্রেমের চশমা ছিল স্বপ্ন। সেখানে ষাটের দশকে তা অভিনব হতে শুরু করল। যদিও চশমার আগমনে সাধারণের কাছে তা কিছুতেই ব্যবহারযোগ্য হয়নি। লেন্সের ওপর নির্ভর করে পলিকার্বনেট, পোলারাইজড, অ্যাস্ফেরিখ। এছাড়া ফ্রেমের ওপর নির্ভর করে মুখমণ্ডলের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে বৈচিত্রের ঘনঘটা দেখে থম মেরে যেতে হয়।
সত্যজিৎ রায়ের “নায়ক” ছবিতে উত্তমকুমারের মুখে যে কালো ফ্রেমের চশমা ছিল সেই সাযুজ্যকে অস্বীকার করা যায়। এক একটা উপাদান তার অভিনবত্বে একটা ভাষা তৈরি করে। আগেকার দিনের পণ্ডিতমশাই গল্পের এই চরিত্র ঢুকলেই আমাদের মনে ভেসে আসে দড়িবাঁধা গোল গোল চশমা। কোনো রাশভারী পদস্থ ব্যক্তি মনে আসলেই কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। কোনো সুদর্শন যুবক ভাবলেই রিমলেস চশমা একটা বেশ ফুরফুরে হালকা ব্যাপার। এসব ভেরিয়েশন অবশ্য সেইসব লেখকদের খুব আয়ত্তে থাকে যাঁরা চরিত্রকে সাজিয়ে পাঠকের মনে নিমিষে ঢুকিয়ে দিতে পারেন।
এখন ছদ্ম চশমার দিন মানুষ লেন্স পড়তে শিখেছে কিন্তু চশমা কোথাও হারেনি। রোদ চশমার তো ফ্যাশনই আলাদা। শোনা যায় এই চশমার রঙ আর কাঠামো এতই প্রভাবশালী যে সাধারণ দেখতে মানুষও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন। অতএব প্রকৃতি থেকে বিজ্ঞান হয়ে আমরা সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ি এইসব উপকরণের সাধু প্রয়োগে...