ভুল ভ্রুণ

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

গাজী তানজিয়া | 2023-08-31 13:22:26

পৃথিবীতে কোনো আত্মহত্যাই মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয় না। তবে লুবনারটা নিল কেন? নাকি লুবনা আসলে আত্মহত্যা করে নাই! তাহলে তাকে কি তুমি হত্যা করেছো? সে তো আরো মারাত্মক। চোখের সামনে সবাই জ্বলজ্যান্ত একটা খুনিকে ঘুরতে-ফিরতে দেখেও কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না! রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, ঘৃণা, জিঘাংসা সব পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে গেল! ব্যাপারটা তোমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। কেউ তোমার দিকে আঙ্গুল তুলছে না, আবার লুবনার দিকেও না। যেন আটাশ বছরের একটা মেয়ের এভাবে বিয়ের দুবছরের মাথায় মরে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক! কারো মনে কোনো প্রশ্ন নাই।

কী হয়েছিল লুবনার? কেন সে গত প্রায় এক বছর ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছিল। যারা এসেছে তারা সবাই যে লুবনার জন্য খুব শোকগ্রস্ত তাও না। কিছুক্ষণ পরপর যে যার সেলফোন বের করে ফেসবুকটা চেক করে নিচ্ছে। আচ্ছা ফেসবুকে এখন ঠিক কী নিয়ে ঝড় উঠেছে? কোন ইস্যুটা ভাইরাল? নাকি লুবনার চলে যাওয়ার খবরটা দিয়ে এরা লাইক, লাভ ইমো, স্যাড ইমোর গোনাগুনতিতে ব্যস্ত! একমাত্র ব্যতিক্রম লুবনার মা। তিনি তোমাদের ঘরে লুবনার বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছেন। এই শুয়ে থাকার ভঙ্গি আর হাতে গননাহীন এলিয়ে পড়ে থাকা তসবিহ্ জানান দিচ্ছে তার ভেতরের সব হাহাকার।
কিন্তু লুবনাকে যে তুমি হত্যা করেছো এটা কেউ বুঝতে পারছে না কেন? নাকি তোমার এই ধারণাটা ভুল। তুমি হয়তো ভাবছো আধুনিক মানুষ খুব বেশি যান্ত্রিক এখন। তাদের কিছু ভাবার সময় নাই। স্যোশাল মিডিয়ায় কেউ একটা ইস্যু তুলে দিলে পরে, মানুষ সেদিকে মনোযোগ দেয়। নয়তো তারা পুঁজিবাদী সমাজের ঠেলা সামলাতেই ব্যস্ত। কর্পোরেট স্লেভরা যেন মাথা তোলারই সময় পায় না। ব্যসায়ীরা ধান্ধায় বুঁদ! নাকি সবাই সব বুঝতে পারছে, তুমি শুধু ভুলের সঙ্গে বসবাস করে যাচ্ছো।

ছোটবেলা থেকে তুমি যেসব ভুলগুলা করো আপাতদৃষ্টিতে তা ছোট মনে হলেও ধীরে ধীরে তা বড় হয়ে ওঠে। এই যেমন তোমার শরীরের কোনো জায়গায় ভীষণ জোরে ঠোকর লাগল। এই ধরো পায়ে বা গোড়ালিতে। মনে হলো, ও কিছু না। একটু পানি বা বরফ লাগিয়ে দিলা জায়গাটাতে। কিন্তু অনেক্ষণ পর দেখলা জায়গাটা ফুলে উঠেছে বা অসম্ভব ব্যথা হয়েছে। কালচে হয়ে গেছে। কিছুদিন পর হয়তো টিউমার হয়ে গেল। এমনই হয়েছিল একবার ছোটবেলায় তোমরা যখন বরিশাল বেড়াতে গেছিলা তখন। তুমি আর তোমার ভাই ডাকবাংলোয় খেলতে খেলতে হঠাৎ শ্যম্পুর বোতল থেকে কিছুটা শ্যম্পু ঢেলে ফেললা। ওটা ওভাবে থাকলেই পারত কিন্তু না, তুমি ওগুলো নিয়ে মাথায় লাগায়ে ফেললা। তারপর মাকে বললা, গোসল করায়ে দাও। তখন ঘোর সন্ধ্যা। মফস্বল শহরের ডাকবাংলোয় এ সময় ট্যাঙ্কিতে পানি থাকে না। অগত্যা বেয়ারাকে দিয়ে সেই নদী থেকে পানি আনায়ে তোমার মাথায় ঢালতে হলো। কম ঝক্কির ব্যাপার ছিল না সেটা।

আর একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রথম বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। তুমি নিশ্চিত ছিলা অনার্স ফাইনালেও ফর্স্টক্লাস থাকবে। কিন্তু সাবসিডিয়ারি সাবজেক্টগুলোতে খুবই উদাসীন থাকতা। লেখাপড়া-ক্লাস একদমই করা হতো না। পরীক্ষার দুদিন আগে পড়তে বসে দেখো লেজে গোবরে অবস্থা। ফাইনাল পরীক্ষায় মার্কস না যোগ হলেও পাশ করা তো আবশ্যক। তাই তুমি ও তোমার কয়েকজন বন্ধু পরীক্ষার হলে নকল করতে গিয়ে ধরা পড়লা! ফলে তোমার পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। তুমি নেক্সট ইয়ারে উত্তীর্ণ হতে পারলা না। তোমাকে আবার জুনিয়রদের সাথে পড়তে হইল। তোমার সব বন্ধু যখন সেকেন্ড ইয়ারে, তখন তুমি ফার্স্ট ইয়ার।

এরকম ছোটখাটো বা বড়-বড় ভুলে ঠাসা তোমার জীবন। কিন্তু সেবার তুমি যে ভুলটা করলা, তার খেসারত যে এমন মারাত্মক হয়ে উঠবে কে জানত!

তুমি যখন বিয়ে করলা তখন তোমার স্ত্রী মাস্টার্সের ছাত্রী। তুমি এমনিতে খুব একটা প্র্যাকটিকাল না হলেও তুমি চাইছিলা একটা পরিকল্পিত জীবন। তুমি ভাবছিলা, তোমার স্ত্রী লুবনার লেখাপড়া শেষ হলে ও একটা চাকরি নিয়ে কিছুটা থিতু হয়ে তোমরা একটা সন্তান নেবে। কিন্তু লুবনার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই সে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ল। কিন্তু এরকম হওয়ার কোনো সম্ভবনা ছিল না। তোমাদের সব রকম প্রিকোশন ছিল। প্রিকোশনেও যে ভেজাল থাকতে পারে তার নমুনা দেখে তুমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেও, লুবনাকে বললে ভ্রুণটা অ্যাবট করিয়ে নিতে। কারণ তখন তোমার সাংবাদিকতার চাকরিতে দুই মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে এবং আদৌ সামনের মাসে বেতন হবে কিনা, বা তোমার চাকরিটা আদৌ থাকবে কিনা এ নিয়ে তুমি সংশয়ে ভুগতেছিলা।

লুবনা সব মায়েদের মতো তার প্রথম সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চাইছিল। কিন্তু তুমি তাকে বুঝাইলা, ‘দেখো, আমাদের এটাই তো শেষ না, সামনে আরো অনেক চান্স আছে। আর এটা তো এখন একটা স্পেসিস মাত্র! এখনো মানুষ হয়ে ওঠে নাই।’

লুবনা কী বুঝল কে জানে! সে তখন কোনো প্রতিবাদ না করে, এক কল্পিত আগামীর কল্পগল্পে মত্ত মানুষের মতো তোমার হাত ধরে নার্সিং হোমের ওটিতে পৌঁছে গেল।

কিন্তু ঝামেলাটা হলো মাসখানেক পর। একদিন রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তুমি দেখো লুবনা উঠে বসে আছে। কেমন মূর্তির মতো ভাবলেশহীন সেই বসে থাকা। শুধু চোখদুটো যেন হিংস্র প্রাণীর মতো জ্বলজ্বল করছে। সত্যিই জ্বলজ্বল করত নাকি তোমার ওরকম মনে হতো কে জানে!

দিনের বেলায় তখন পর্যন্ত সে স্বাভাবিক আচরণ করত। অন্তত তুমি যতটা সময় দেখতা তোমার স্বাভাবিকই মনে হতো।

একদিন ভোরবেলা শেভ করার পর তুমি দেখলা, তোমার আফটার শেভ লোশনটা নাই। লুবনাকে জিজ্ঞেস করার পর সে নির্লিপ্ত গলায় বলল, ফেলে দিছি।

তোমার স্বভাবের একটা দুর্বল দিক হলো, হঠাৎই তোমার মেজাজ তিরিক্ষী হয়ে ওঠে এবং সেই স্বভাববশত তুমি কিছুক্ষণ চেঁচাও তারপর আবার মনে মনে অনুশোচনাও করো। সেদিনও তুমি চেঁচিয়ে দুয়েক বাক্য ছুড়ে দেওয়ার পর যখনই লুবনার চোখে তোমার চোখ পড়ল, তুমি ঘা খাওয়া কুকুরের মতো মিইয়ে গেলা।

লুবনা ওভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল কেন! সেই দৃষ্টির বর্ণনা তোমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। তবে তুমি দমে গেলে, ভেতরে ভেতরে একেবারেই দমে গেলে তুমি।

তবে লুবনার এধরনের কর্মকাণ্ড আরো বাড়তে লাগল। একে এক শ্যাম্পু, শাবান, পাউডার, ক্রিম সবকিছু ফেলে দিতে লাগল সে।

লুবনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে সাপের মতো হিস হিস করে বলত, তুমি গন্ধ পাও না, গন্ধ?

কিসের গন্ধ? হ্যাঁ, এক একটা আলাদা আলাদা স্মেল আছে তো! কত ধরনের ফ্রাগ্রান্স...।

আমাদের বাচ্চাটার শরীরের ঘ্রাণ পাও না তুমি ওই সব প্রসাধন সামগ্রীর মধ্যে?

কী বলো এসব!

এই যে এত এত বাচ্চা অ্যাবরশন হয়, এইসব কচি কচি মুখ, খণ্ড-বিখণ্ড শরীর যায় কোথায়?

কোথায় যায়?

আনবর্ন শিশুর ভ্রুণের সেল ব্যবহার করা হয় সব আর্টিফিশিয়াল ফ্লেভারিং এজেন্ট তৈরিতে। কোনো না কোনো কসমেটিকস ফ্লেভার তো এগুলো নিশ্চয়ই! তুমি পাও না গন্ধ?

শিশুর চর্বি, বোনম্যারো এগুলো না-না ফিটাল ট্রিটমেন্টে ব্যবহৃত হয়-জানো তুমি?

তোমরা কিচ্ছু জানো না। তোমরা নারীকে মা হতে উৎসাহিত করো নিজ স্বার্থে। আবার নিবৃত্ত করো নিজ স্বর্থে। তোমারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বলো সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মুত্যু হলে সে নারী স্বর্গবাসী হবে, আবার তোমরাই কন্যা সন্তান হলে, তাকে গলাটিপে মারতেও কসুর করো না।

লুবনাকে তুমি কখনো এভাবে কথা বলতে শোনো নাই। সে কেমন একটু ইমোশোনাল, একটু আদুরে, হাসিখুশি টাইপ একটা মেয়ে। সে কখনো কোনো যুক্তিতর্কের ধার ধারে নাই। তুমি তোমার দৈন্যদশায় তাকে জড়ায়ে একি করলা! তুমি সেই তাবৎ বিস্ময় গলায় ঢেলে দিয়ে জানতে চাইলা, কে বলল তোমাকে এসব?

কীসব?

ওই কসমেটিক্স ফ্লেভারের কথা?

আমি নেটে দেখেছি।

তুমি এবার জোর দিয়ে বললা, নেটে তো এরকম উদ্ভট কত কিছুই লেখে, সব কি সত্যি নাকি!

লুবনার চোখগুলো এবার জ্বলে ওঠে, সে বলে, তাহলে ওই শরীরগুলো যায় কোথায় বলো? প্রমাণ করো আমাকে যে এসব হয় না!

তোমার হাতে সে মুহূর্তে কোনা প্রমাণ নাই, আবার ওই শরীরগুলো ডাস্টবিনে যায় সে কথা বলার সাহসও তোমার নাই। কারণ লুবনার যে মানসিক অবস্থা তাতে সে এটাও মেনে নিতে পারবে না।

তুমি তখন মনে মনে প্রমাদ গুনতে থাকো। তুমি লুবনাকে একের পর এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে লাগলা।

আর লুবনা ক্রমাগত আরো অসুস্থ হয়ে যেতে লাগল। সে কিভাবে যেন সিডেটিভ নিয়েও না ঘুমানোর কায়দাটা রপ্ত করে ফেলছিল। খেত খুব কম বা ইচ্ছে করেই হয়তো খেত না। তার মানসিক বিকার দিনকে দিন এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে, শেষের দিকে তার মুখ থেকে হিংস্র প্রাণীর মতো লালা গড়াত। ঘুম না হওয়ার কারণে চোখগুলো ফোলা আর লাল হয়ে থাকত।

তুমি জানো, একটা সময় মানুষের জীবনে প্রেম, বিয়ে, দাম্পত্য সম্পর্ক সব কিছু ছাপিয়ে সন্তানের মা-বাবার ভূমিকায় নিজেকে পরিচালিত করাটাই মানুষের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যে সম্পর্কে প্রেম থাকে না, সেখানেও সন্তানের বাবা-মা সম্পর্কটা কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় কিভাবে যেন দাঁড়িয়ে থাকে।

যখন ভ্রুণটার জন্ম হয়েছিল, তখনও তোমাদের দুজনের মধ্যে প্রেমটা ছিল। ভীষণভাবে ছিল যা বেশিরভাগ সন্তানের জন্মের সময় থাকে না। অথচ সেই সন্তানটাকে তুমি হত্যা করলা! লুবনার প্রভাবে এমন কিছু ভাবনাও যে তোমাকে উত্ত্যক্ত করে যায় নাই সেকথা তুমি নিশ্চিত করে বলতে পারো না।

কিন্তু তুমি এজন্য কাকে দায়ী করবা? তোমার আর্থিক দৈন্যতা বা সিদ্ধন্তহীনতা বা কন্ট্রাসেপটিভের অকার্যকারিতা কাকে দায়ী করবা ঠিক বুঝে উঠতে পারছো! তবে এটা বুঝতে পারছো যে লুবনার মৃত্যুতে হত্যার অভিযোগের আঙুলটা অন্তত তোমার দিকে উঠছে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর