ঘুটঘুটে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওর ছায়া দীর্ঘ হয়। বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসে একটা নেড়ে কুকুর। শরীরে দগদগে ঘা, লোমগুলো উঠে গেছে। মুখ দিয়ে লালা পরছে। কুকুরের ছায়াও দীর্ঘ হচ্ছে। কারফিউর মতো নির্জন রাস্তায় ওর চলার শব্দ কুকুরটির শব্দ ‘ঘেউ’ ছাড়া শব্দহীন সরণিতে এগোতে থাকে। ওর ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এখন অন্ধকার। বিকট শব্দে শম্ভূগঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ট্রেন ছুটে যায়। আজ আকাশে তারার মেলা বসেছে। কালপুরুষ বেশ বীরদর্পে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সপ্তর্ষীমণ্ডল সুখেই মিটমিট করছে। ওর কিছুই মনে পড়ে না। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ক্লান্ত হোমোসেপিয়েন। দূরে শম্ভূগঞ্জের গায়ে অন্ধকার। কোনো পিদিমের আলো জ্বলে না। হেঁসেলের ধোঁয়া নজরে আসে না। এত তাড়াতাড়ি সব ঘুমিয়ে গেল!
এত শান্ত গ্রাম! ধনচে গাছ আড়াল করে জল বরাবর চোখ বুলাতে থাকে ও। কতক্ষণ। কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের দিকে সিগনাল দিচ্ছে নীলাভ আলো। বলাশপুরের দিকে কনভয় ছুটে চলার বিকট শব্দ ভেসে আসে। প্রায় এক ঘণ্টা জেগে ওঠা চরের মধ্যে বসে আছে। সাহেব কোয়ার্টার, সার্কিট হাউসসহ নদীর পাড় ঘেঁষে সারি সারি বাঙ্কার। কামানসহ অন্যান্য ভারী অস্ত্র নাক বরাবর তাক করা।
একটা টুস শব্দের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার গুলি ছুটে আসবে। ও ঘড়ির দিকে তাকায়। আটটা সতের। হঠাৎ ওর মনে পড়ে, হাতে কাপড়ে পেঁচানো আগ্নেয়াস্ত্র অত্যন্ত মারাত্মক। এটা হাতে নিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হেঁটে আসা ঠিক হয়নি। এস কে হাসপাতালের কাছে একটা ট্রুপস অ্যামবুস করেছে। নদী পথে এসে যেন বটতলার এই বিপদসংকুল রাস্তায় সরাসরি ঢুকে গেরিলা আক্রমণ করতে না পারে। পেছন দিক থেকে কেউ ‘হল্ট’ বললেই ধরা পরে যেত। নইলে গোলাগুলির মধ্যে পরে বেঘোরে প্রাণ হারানো ছাড়া উপায় ছিল না। হঠাৎ করে ওর গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিড়দাঁড়ায় বয়ে গেল শৈত্যের হলকা। এই বোকামিটা করা ঠিক হয়নি। কমান্ডারকে বলা যাবে না। জাবেদকে বলা যাবে। কিন্তু এখনো আসেনি। আদৌ আসবে কি না! তারও ঠিক নেই। আসলে না হয় প্ল্যানমাফিক এগোনো যাবে। না এলে? আবার এতটা পথ মাড়িয়ে কমান্ডারের নাগাল পাওয়া দুস্কর। সকালের দিকে দুবলাকান্দা পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করার কথা। সিগারেটের তৃষ্ণায় কণ্ঠ কাঁপছে। জ্বালানোর উপায় নেই। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে হঠাৎ আলো ভয়ঙ্কর। সহজে টার্গেট করে। ছুটে আসে এক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি। ওরা প্রশিক্ষিত। মিস হয় কম। নান্দিয়া পাড়ার সৈয়দ আলী এভাবেই ঝাঁঝরা হয়েছিল। তারপর সবাই সতর্ক। অন্ধকারে মিশে থাকতে হবে। আলোতে নয়।
জুন মাসের গুমোট গরমে ঘামছে ও। আবার আকাশের দিকে তাকায়। তারার মেলা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে নক্ষত্রের মুখ জ্বলজ্বল করছে। তৃষ্ণা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখান থেকে দুইশ গজ দূরে ব্রহ্মপুত্র কলকল করে বয়ে যাচ্ছে। ভারী বর্ষণ হলে গাড়ো পাহাড়ের ঢলে ব্রহ্মপুত্রে জোয়ার বইবে। ও এখানে বসে জাবেদের জন্য অপেক্ষা করছে তাও তলিয়ে যাবে অথৈ জলে। স্রোতের কলকল ধ্বনি, বাঁকে বাঁকে ঘূর্ণনের গোত্তা মেরে দু কূলে ভাঙনের গান গেয়ে বয়ে যাবে। ট্রিগার ধরে অত্যন্ত সন্তর্পণে ও ব্রহ্মপুত্রের দিকে এগিয়ে যায়। জলের কিনারায় অস্ত্র রেখে আজলা ভরে পানি পান করে। শীতল পানি নাকে মুখে ছিটকা মারে। আবার সেই ধনচে গাছের ঢিবির কাছে এসে জাবেদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
ঘড়িতে এখন পৌনে নয়টা। জাবেদের পাত্তা নেই। জাবেদ না এলে ওর করণীয় কী? ইত্যাকার ভাবে। হ্যান্ড ব্যাগে দুটো গ্রেনেড আছে। যা বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য ওদের মিশন। জাবেদ এলেই কাজটা সম্পন্ন করার ভাবনা করা যেত। মশা, ডাঁশ, ওলা পোকার বিস্তর উৎপাত। নাকে মুখে হিচকা পরছে। তারপরও ও স্থির বসে থাকে। রাত পোকাদের গুঞ্জরণে পৃথিবীকে শব্দহীন করে দিয়েছে।
মাস তিনেক আগেও অন্ধকারকে ভয় ছিল। সাপের ভয়, ভূতের ভয়, মানুষের ভয় মিলিয়ে আঁধার আতঙ্কের মধ্যে যার পৃথিবী, সেই কিনা চার মাইল অন্ধকার মাড়িয়ে কেওয়াটখালী পাষাণবেদী বায়ে রেখে এখন ব্রহ্মপুত্রের চর ভেসে ওঠা ধনচে বনে আশ্রয় নিয়েছে একা। একাকী। ভয় শব্দটা এখন ওর মধ্যে বিরাজ করে না।
বরঞ্চ উন্মত্ত হিংস্রতা বসতি গেড়েছে। ওর হাতে স্টেনগানের মতো মারাত্মক মারণাস্ত্র। যার প্রতিটি কার্তুজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক একটি মানুষের প্রাণ। না, ও মানুষ হত্যা করতে চায় না। জীবনকে তুল্যমূল্য করে পশু হত্যা করতে চায়। যারা অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পরে সবুজ প্রান্তর জুড়ে রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠেছে, তাদের সঙ্গে ফয়সালা না করে ফিরে যাবার পথ নেই। মৃত্যু নইলে স্বাধীনতা। নিরীহ পিতা মাতা, থেকে অবোধ কিশোর হত্যা করে যারা, তাদের জন্য কোনো অনুকম্পা নয়। ওকে কোনো অনুকম্পা করেনি। হাজার হাজার পাকিস্তানী আর্মি এই চর পর্যন্ত ছুটে আসছে। হায়েনার মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই শ্যামল প্রান্তর জুড়ে।
হঠাৎ ওর মনে পড়ে, ‘এ দেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি।’ ও ইষৎ মুচকি হাসে। কবি, রমণীরা সব সম্ভ্রম রক্ষায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এসব খবর কি রাখেন? দরকার কী? এই সুন্দর তো তোমার। মহাকাব্যিক দার্শনিকতা। আহারে শ্যামল রমণী! মাতৃকূল। তোমার জন্য বিরল এই প্রান্তরে ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে অপেক্ষা করছি। একটি বুলেট নাক বরাবর ছুটে যাবে। আবার আরেকটি বুলেট আমার দিকে ফিরে আসবে। কী চমৎকার! তুমি ভাবতে পারো? রক্তের মহাজন সেজে বসে আছি।
ঠিক এসময় ক্ষীণ পদশব্দ। ও মাটির সঙ্গে দেহ মিশিয়ে অপেক্ষা করে। জাবেদ না অন্য কেউ? ঢিবিটার অতি কাছে হেঁটে যায় জাবেদ। জলের সঙ্গে ওর দেহের ছায়া মিলিয়ে ডাক দেয়, ‘পুটটুস।’ থমকে দাঁড়ায় জাবেদ। তড়িৎ উত্তর দেয়, ‘টুকু।’
কাছে এসে ধপাস করে ধনচে গাছে পিঠ রেখে শুয়ে পরে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, ‘জানে বেঁচে গেছি, প্রায় জীবনটা গেছিল।’ টুকু উত্তর দেয়, ‘আমারও। বোকামি করে ফেলেছিলাম। আমিও।’
টুকু ঘড়ির দিকে তাকায়। প্রায় দশটার কাছাকাছি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
‘আমার ক্ষুধা পেয়েছে।’
‘তোর জন্য রুটি এনেছি।’
‘দে।’
জাবেদ কার্তুজের ব্যাগ থেকে একখণ্ড বনরুটি বের করে দেয়।
কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করে টুকু রুটি খেতে খেতে জলের নিকট হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে। ক’ আজলা জল খেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে। যেন কতকাল ধরে ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রস্রাব শেষ হতে চায় না। জলের গায়ে দুয়েকটা নক্ষত্র। তার আলোয় মাছ কিলবিল করে।
জাবেদ ডাক দেয়, ‘টুকু।’
ডাকও যেন শব্দহীন। জাবেদের কণ্ঠ ভরাট সত্ত্বেও ওর কণ্ঠ রাতের পাখির ডাকের মতো শোনায়। টুকু বুঝতে পারে। এই বুঝতে পারার বয়স দুমাস হয়নি। টুকু আবার হামাগুড়ি দিয়ে জাবেদের কাছে ফিরে আসে।
‘এখন?’ টুকু প্রশ্ন করে।
‘অপেক্ষা।’
‘কার জন্য?’
‘মতি ভাই আসবে।’
‘কখন?’
‘জানি না।’
ধনচে গাছে গায়ের শার্টবিছিয়ে স্টেন জাপটে ধরে টুকু বলে, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’
‘তুই ঘুমা। আমি অপেক্ষা করি।’
‘শত্রু এলে তুই একা কী করবি?’
‘গুলি করতে করতে ব্রহ্মপুত্রের জলে হারিয়ে যাব।’
‘ওরা আসবে না। ভীতু। রাজাকাররাও আসবে না। ওরা ভয় পায়। ওরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধার নাগাল পায় না।’
‘তা ঠিক।’
ঠিক এক মিনিটের ভেতর টুকু ঘুমিয়ে যায়। ওলাপোকা একটানা ডেকে যাচ্ছে। দূরে কোথাও শেয়ালের হুক্কাহুয়া ভেসে আসছে। শম্ভূগঞ্জের ব্রিজের পাশেই পাষাণবেদি। এখন শেয়াল-কুকুরের মহোচ্ছব চলছে। গুলিবিদ্ধ বঙ্গসন্তানের নাড়িভুড়ি নিয়ে ওরা মহাসুখে আছে। তাই রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে ডেকে ওঠে। ওটুকুই। এ নিয়ে জাবেদ ভাবতে চায় না। প্ল্যান করে এগোতে হবে। কমান্ডার যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই। চুল পরিমাণ এদিক সেদিক হবার জো নেই। ভুলটা করেছিল ও। মণিকাকে খুঁজতে যাওয়া ঠিক হয়নি। দিনমজুরের কেমোফ্লেক্স ঠিক ছিল। কিন্তু কাপড়ের ব্যাগে রাখা স্টেনগান-কার্তুজ-ব্যাগ অত্যন্ত বিপজ্জনক। চ্যালেঞ্জ করলেই আটকে যেত। ধরা পরলেই নির্ঘাত মৃত্যু। সশস্ত্র শত্রুকে কেউ বাঁচিয়ে রাখে না। ও নিজেও রাখবে না।
বড় সড়ক ক্রস করে গলির মাথায় দাঁড়ায়। তখন এদিকটায় বিদ্যুৎ ছিল না। গতকাল কেওয়াটখালি পাওয়ার স্টেশনে হামলা হয়েছে। ভয়ঙ্কর রকেট ল্যান্সার দিয়ে হামলা। তিনটা ইউনিটের মধ্যে একটা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। শহরে লোডশেডিং চলছে।
গলি পেরিয়ে মণিকাদের বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে ছিল কতক্ষণ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতরে জনমনিষ্যির আঁচ পাওয়া যায়। অনেকটা বেদিশার মতো মণিকার বাবা এডভোকেট ত্রৈলঙ্গর গোস্বামী বাড়ির টপ-বারান্দায় উঠে আসে। সতর্ক পদক্ষেপ, নিশব্দ পদচারণা, সজাগ কান শুধুই অশুভ ইঙ্গিত করতে থাকে। তারপরও মণিকার পড়ার রুমের বদ্ধ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ইতিউতি ভাবতে থাকে। ভেতরের মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর অচেনা। গোস্বামী কাকা তো না! অন্য কেউ। নারীকণ্ঠ আছে। মণিকা বা মাসীমার নয়। অন্য কারো।
নানা রকম চিন্তা মাথায় কাজ করতে থাকে। হিসাব মতে মণিকাদের থাকার কথা নয়। পঁচিশ মার্চ ক্র্যাক ডাউনের পরপর ওরা এ বাসা থেকে সটকে পরেছে। শহরে দুবার বিমান হামলার পর গোস্বামী কাকা মণিকাদের আর এ শহরে রাখা নিরাপদ মনে করেনি। এখানে মনে হয়, তার সিদ্ধান্ত সঠিক। এ দেশে আর মানুষ বাস করতে পারে না। দখলদার দস্যু আর ফুঁসে ওঠা রাগী যুবকের মুক্তির ‘জয় বাংলা’র গেরিলা।
তারপরও কেন যে মণিকাকে খুঁজতে এলো, তা ও নিজেই জানে না। কেষ্টপুর দিয়ে পাস হওয়ার কথা ছিল। পুরবী’র দুলাল ভাইয়ের কাছ থেকে গ্রেনেড নিয়ে চর ধরে টুকুর কাছে পৌঁছানোর কথা।
‘এ বাড়ির মালিক ইন্ডিয়ায় গেছে গা। আমরার দহলে আছে। বাড়ি আমাগো। পাকিস্তান সরকার লেইক্কা দেব।’
ওর মনে হয় মণিকাদের বাড়ি বেদখল হয়ে গেছে। মণিকার সঙ্গে আর দেখা হবে না। ভাবতে ভাবতে নারকেল গাছের আড়ালে আবার চলে আসে। ঠিক এ সময় বিদ্যুৎ এলো। দুয়েকটা বাতি জ্বললেও ল্যাম্পপোস্ট প্রায় তিনশ গজ দূরে। এদিকে অন্ধকার ছেয়ে আছে। খুব সহজে বের হয়ে যাওয়া যাবে। ঠিক এ সময়ে জিপ ছুটে এলো গলির মুখ থেকে। ধামধাম করে ওপাশের আমগাছের গোড়ায় দুজন পাক আর্মি নেমে আসে। পেছন থেকে দুজন রাজাকার। মুখ বাঁধা প্রায় বিবস্ত্র এক নারী, রাজাকাররা ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। দ্রুততায় গোস্বামী কাকার টপ-বারান্দায় উঠে যায় ওরা। অনেকটা টেনে-হেঁচড়ে মেয়েটাকে জাপটে ধরে ডাক দেয়, ‘মানিক স্যার আইছে।’ খুঁট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। ওরা ঢোকার পরে আবার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ও নারকেল গাছ আড়াল করে স্টেনগান লোড করে, অপেক্ষায় থাকে। জিপ একলা আম গাছের গোড়া বরাবর। বের হওয়ার উপায় নেই। জিপে ফৌজি থাকতে পারে। ঘড়ির কাঁটা এক সেকেন্ড করে এগিয়ে যেতে থাকে। দুয়েকবার ঐ নারীর আর্তনাদ শুনেছে। তারপর থেকে অপেক্ষা করছে। ওর কিছুই শুনতে ইচ্ছে করে না।
ওই কাতর নারীর কথাও মনে হয় না। অপেক্ষা করে। অপেক্ষারত জিপটা নিথর। ড্রাইভারসহ হয়তো গোস্বামী কাকার বাসায়। ও অপেক্ষা করে। ওরা চারজন, অভাগী নারী, বাড়ির দখলদার। মোট ছয় জন। ও ভাবে লোডেড কার্তুজ আটাশটা। এক ম্যাগাজিন একস্ট্রা। তিনটা গ্রেনেড। দুঃখী নারীকে বাদ দেয়। ওর বেঁচে থাকবার দরকার নেই। ও এই পৃথিবীতে সব অধিকার খুইয়েছে। ব্রাশ ফায়ারে মরে গেলে ক্ষতি কী? বাকি পাঁচজনকে অন্ধকারের এত নিকট থেকে...। সাত-পাঁচ ভাবে। সাহস হারাতে থাকে। একটু এদিক-সেদিক হলেই বিপদ। মৌডালের ঝোঁপ পেছনে রেখে উঠে দাঁড়ায়। এদিক দিয়ে দ্রুত বেরোবার পথ আছে। মসজিদের পাশ ঘেঁষে ধানক্ষেত দিয়ে বড় রাস্তা ক্রস করে বেরিয়েই নদীর পাড়। ধনচের আড়ালে আড়ালে টুকুর কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। টুকু অপেক্ষা করছে। হঠাৎ করে ওর ভয়ানক সিগারেটের তৃষ্ণা পায়। মণিকাকে মনে পড়ে।
এম কলেজে মণিকা ওর সহপাঠী। কলেজ থেকে পূজাতে দল বেঁধে এ বাড়িতে এসেছে। হইচই করে বাড়ি মাতিয়েছে। গোস্বামী কাকা বেশ শিক্ষিত মানুষ। কন্যার বন্ধুদের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত দেখিয়েছে। মণিকা সাদামাাঁ তরুণী। বুদ্ধিদীপ্ত ক্লাসের সবাই মণিকাকে মনে রাখতে চায়। অথচ আজ মণিকা কি জানে, কি ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি ও। ওর বিছানায় ধর্ষিত হচ্ছে বঙ্গললনা। একজন অপেক্ষা করছে মৃত্যুর ওপারে। ওর মনে হয় ক্যাচ করে বেয়নেট ঢুকিয়ে দিল। দরজা খুলে টপ-বারান্দায় এসে দাঁড়ালো চারজন। একজনের হাতে সিগারেট। ‘আচ্ছা হ্যায়, মান্তা হ্যায়’ এই জাতীয় বাতচিতের মধ্যে ও স্পষ্ট দেখতে পায়। ও অপেক্ষা করে। ট্রিগারে আঙুল। আরো একজনের জন্য অপেক্ষা করে। সে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছে। ও অপেক্ষা করে। ঠিক এ সময় পঞ্চম লোকটি বের হয়।
‘পা-মুখ বাইন্ধা আইলাম।’
ঠিক এ মুহূর্তে আঙুলে চাপ পরে। ঠা-ঠা শব্দ চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। ধপাধপ পাঁচটি দাঁতাল গোস্বামী কাকার টপ-বারান্দায় লুটিয়ে পরে। ও দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করে। তারপর মৌডাল আড়াল করে অন্ধকারে মিশে যায়। বড় রাস্তায় কনভয় ছুটিয়ে পাকসেনারা এদিকে আসছে। ও তখন দড়াইখাল পেরিয়ে বলাশপুর পৌঁছে গেছে। এ সময় একবার মনে হয়েছিল স্টেশন কোয়ার্টারে শোয়েব সিদ্দিকীর বাসার কথা। ওর বাবা গার্ড সাহেব। স্টেশন সংলগ্ন কলোনিতে থাকে। বড় ছেলে শোয়েব সিদ্দিকী এপ্রিল থেকে লাপাত্তা। শোয়েব ওর বন্ধু। সবাই জানে। প্রয়োজনে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ আছে। পুত্র শোকার্ত ওর মায়ের মুখ মনে পরায় কষ্ট পায়, কি জবাব দেবে?
তারপর অনেক কাঠখড় পেরিয়ে টুকুকে আবিষ্কার করা। টুকু এখন ঘুমুচ্ছে। স্টেনের ম্যাগাজিন খুলে পরিষ্কার করে। এ ম্যাগজিনের চৌদ্দ কার্তুজ পাঁচ দানব খেয়ে ফেলেছে। মনে মনে হাসে। আহারে বেচারারা!
এখনো এক ম্যাগজিনসহ চৌদ্দটা কার্তুজ আছে। গ্রেনেড আছে তিনটা। ও এখন মতি ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবে। ঘড়ির দিকে তাকায় এগারটা সাতাশ। দূরে শম্ভূগঞ্জের চটকলে অসংখ্য বাতি জ্বলছে। জলের রেখায় বাতির ঝিলিক।
ওর মনে হয়, এতক্ষণের মধ্যে লাশগুলোসহ ওই নারীকে আরেক জিপে তুলে নিয়ে গেছে। অথবা সহযোগী হিসেবে বেয়নেটের খোঁচায় হৃদপিণ্ড এখন এফোঁড়-ওফোঁড়। তাহলে কেউ বাঁচতে পারেনি! পূর্বাপর ঘটনাটি ভাবতে থাকে জাবেদ। এক ইস্টু পাঁচ। মুচকি হাসে। পাঁচ ডেড বডি দেখে কী প্রতিক্রিয়া দাঁতালদের। পাগলা কুত্তা! ভাবনার মধ্যে মণিকাকে মনে পড়ে, পড়বেই তো। মণিকার জন্য। প্রিয় মণিকা, তোমার বিছানায় ধর্ষিত নারীর প্রতিশোধ নিয়েছি। তুমি কি খুশি হও নি? আমি এখন মাতৃভূমির সৈনিক। মাতৃভূমির কন্যা-জায়া-জননীর জন্য...।
মশা-ডাঁশ ছেঁকে ধরেছে। টুকু মাঝে মাঝে হাত নাড়ছে। শরীর ক্লান্ত। তারপরও তন্দ্রা আসছে না। জাবেদের মনের মাঝে তড়পাতে থাকে। হুট-হাট পাঁচটি গুলিবিদ্ধ মানুষ গোস্বামী কাকার টপ-বারান্দায় পড়ে গেছে। ওর জন্য এ এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এত কাছ থেকে শত্রু নিধনের আনন্দই আলাদা। ওর বুক ভরে উদ্বেলিত আনন্দ। প্রকাশ করতে পারে না। টুকুকে বলা যেত। টুকু ঘুমাচ্ছে। সড়সড় শব্দে দুয়েকটা শেয়াল শন খেতে ঢুকে পরে। হুক্কাহুয়া ডেকে ওঠে। জাবেদ শুধু কান খাড়া করে থাকে, কখন মতি ভাই আসবে? ওর হঠাৎ করে আজিজুল হক স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যার এম কলেজে বাংলা পড়ান। অসাধারণ বাগ্মী।
রবীন্দ্রনাথের শত শত কবিতা তার মুখস্ত। কী তার উচ্চারণ! সুমিষ্ট। এখনো কানে লেগে আছে। তার সঙ্গে শেষ ক্লাস ১৩ জানুয়ারি। এরপর আর দেখা হয়নি। উত্তাল বাংলাদেশ। হঠাৎ করে মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই মেয়ে, নাজিম হিকমতের নাম জানো?’
মণিকা অসহায়ের মতো মাথা নাড়ে।
‘তুরস্কের কবি। মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি মাটির প্রতি দায়বদ্ধ সচকিত কণ্ঠস্বর। কবিতা লেখার অপরাধে জেল-জুলুমসহ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত কবি। ভ্রাম্যমাণ জীবন নিয়ে শুধু মাতৃভূমিকেই মনে রেখেছে। নারীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি, চোখ তোমার মধুর মতো মিষ্টি।’ লিখেছে, ‘দড়ির একপ্রান্তে মৃত্যু, সে মৃত্যু আমার কাম্য নয়। তুমি জানো, জল্লাদের লোমশ হাত যদি আমার গলায় ফাঁসির দড়ি পড়ায় নাজিমের নীল চোখে ওরা ব্যথায় খুঁজে ফিরবে ভয়।’ তারপর স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নির্ধারিত সময়ের আগে।
মণিকা কি মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে? ও কি জানে ওর বন্ধুরা প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করছে। ওর শান্ত, নির্লিপ্ত স্বভাবের জন্য মণিকা ভাবতেই পারে ওর পক্ষে যুদ্ধফ্রন্টে হামাগুড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। আহা! মণিকা, তুমি জানবে না শত্রু নিধনের মধ্যে কী অসীম আনন্দ জড়িয়ে আছে। আসলে মণিকাকে কিছুই বলা হয়নি। সুযোগ কোথায়? আর বললেই বা কী হতো?
মণিকার মুখাবয়বে কে যেন একটি সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত পৌনে একটা। মতি ভাই আসেনি। অপেক্ষা করছে। শান্ত নির্জন রাতের পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে জাবেদের মনে হয়, এ পৃথিবীতে এত ক্রন্দন কেন? এ সময়ে ঘোর ভাঙে। তাকাতেই চোখের মণিতে নক্ষত্রের ঝিলিক খেলে যায়। আরমোড়া ভেঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে জলের দিকে এগিয়ে যায়। আজলা ভরে জল খায়। নাকে-মুখে জলের ছিটা দেয়। জাবেদের কাছে গিয়ে বলে, ‘মতি ভাইয়ের কী খবর?’
‘আসেনি। সংবাদহীন।’
‘তাহলে?’
‘অপেক্ষা।’
‘মাঝরাত।’
‘অপেক্ষা।’
‘কী ভাবছো?’
‘কিছুই না। ভাবতে চাই না।’
‘খুব শিগগির অপেরেশন শেষ করতে হবে।’
‘জানি।’
‘হাতে সময় আছে।’
‘এতক্ষণ অপেক্ষা করা বিপজ্জনক।’
সুনসান নীরবতা। ওলাপোকা ডাকছে। তারপর ওদের আর কিছুই মনে নেই। ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়।
জাবেদের ঘুম ভাঙে শেষ প্রহরের একটু আগে। আকাশের গায়ে তখনও নক্ষত্রের মুখ। তড়িঘরি করে টুকুকে ডাকে।
‘ওঠ। মতি ভাই আসেনি। একটু পরে সকাল হবে।’
টুকু আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে, ‘উপায়!’
‘মতি ভাই ছাড়াই প্ল্যান মাফিক আক্রমণ করতে হবে।’
‘সম্ভব!’
‘ভয় পাস?’
‘না।’
‘তাহলে আমার পিছে পিছে আয়।’
জাবেদ স্টেনগান হাতে পেছনে ধনচে গাছ রেখে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকারে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সামনে পা বাড়ায়।
টুকু জাবেদকে অনুস্মরণ করে। জাবেদ খুব পথ হাঁটে। অনেকটা তেলেসমাতির মতো জুবলিঘাট বরাবর ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে মন্দিরের ভিমের আড়ালে এসে দাঁড়ায়। টুকুর দিকে গ্রেনেডের ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘রুটি আছে। খেয়ে নে। গ্রেনেডগুলো দে। চার্জ করার পরে এক মিনিট অপেক্ষা করবি। ফিরে না এলে কিছুই ভাববি না। কমান্ডার তোর জন্য অপেক্ষা করবে। হিঙ্গানগর রাজাকার ক্যাম্প...।’
টুকু কিছু বুঝে ওঠার আগেই অন্ধকারে হেঁটে গেল জাবেদ। রুটি মুখে দিতেই বিকট শব্দে পরপর তিনটা গ্রেনেড ফাটার ভয়াবহ ভয় নিয়ে শেষ রাতে জেগে উঠল। সাইরেন বাজছে। পটাপট গুলির শব্দ ভেসে আসছে। এই আতঙ্কিত সময়ের মধ্যে ১-২ করে ৩ মিনিট অপেক্ষা করে। তারপর দুর্দান্ত গেরিলা কায়দায় ধনচে ক্ষেত পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে মিশে যায়। ঠিক এ সময় বড় মসজিদ থেকে ভেসে আসছে, ‘কল্যাণের জন্য এসো।’
পাদটীকা
পরদিন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আকতার মুকুল চরমপত্র পড়ে, ‘আমাদের ময়মনসিংয়ের বিচ্ছুরা কলেজ রোডে ব্রাশ ফায়ারে পাঁচ জন, জুবলী ঘাটে গ্রেনেড দিয়া পাকসেনারে খতম। হা হা হা। এর মধ্যে আবার দুজন জন্মের দুশমন, জন্মভূমির কুলাঙ্গার রাজাকার আছে। কে বা কারা এই সফল গেরিলা আক্রমণ করেছে, কেউ জানে না। শুধু গেরিলা টুকুর বরাত দিয়া মিয়া চাঁদ কমান্ডার জানায়, মাতৃভূমির যোগ্য সন্তান জাবেদ শহীদ হয়েছেন, ইন্না...রাজেউন।