গভীর রাতে রতনের বাবাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেল পাকিস্তানি সেনারা। বাবাকে জড়িয়ে ধরে রতন খুব কাঁদছিল। বাবা ওকে আদর করে বললেন, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি তো কালই চলে আসব।
রতনের বয়স দশ। রতনের ভাই রুতুল তার থেকে পাঁচ বছরের বড়। সে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেও অশ্রু টলমল করছে। বাবা তাকেও আদর করলেন। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের মা চোখের পানি মুছছেন। রুতুল লক্ষ করল বাবা চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু তার চেহারায় স্পষ্ট ভয় ও আতংকের ছাপ। যাওয়ার আগে বললেন, তোমরা কান্নাকাটি করছো কেন? আমি তো কালই ফিরে আসব।
মা এবার নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্না শুনে মেজর বলল, বাহেন রোনা মাত। চিন্তা করিও না। হাম কাল শামকো ভেজ দেঙ্গে। চলিয়ে হোসেইন সাব।
জলপাই রঙের জিপটা হোসেন আলীকে নিয়ে চলে গেল। বাইরে তখন ঘোর অন্ধকার। অমাবস্যার রাত। সন্ধ্যা থেকেই আকাশটা কেমন ভার হয়ে ছিল। গুমোট আবহাওয়া। এখন হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে মেঘের গর্জন ও ঘনঘন বিদ্যুৎচমক। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। আর্মির গাড়িটা চলে গেলে রতনের বড়ভাই ও দুই বোন ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। পাকসেনারা যুবক ছেলেদের দেখলে মুক্তিবাহিনীর সদস্য মনে করে ধরে নিয়ে হত্যা করছে। যুবতী মেয়েদের চোখে পড়লে ওদের মাথা ঠিক থাকে না। তাই রতনের বাবা তাদের পাক আর্মিদের সামনে আসতে নিষেধ করেছিলেন। রতন ও রুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবাকে তুলে নেওয়া জিপটার চলে যাওয়া দেখছিল।
দুই বোন রেহানা ও শাহানা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেছে। রতনের বড়ভাই আসিফ বিরক্ত হয়ে বলল, তোরা সবাই যদি কান্নাকাটি করিস তাহলে আম্মাকে সান্ত্বনা দেবে কে? কান্নাকাটি বন্ধ করে এখন ঘুমাতে যা।
রেহানা ও শাহানা চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর চলে গেল। আসিফ মাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে একপর্যায়ে নিজেই শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করল। তার কান্নার শব্দে রুতুলসহ অন্য ভাইবোনরা এসে বড়ভাইকে জড়িয়ে ধরল। সবাই একসঙ্গে কাঁদছে। মনে হলো যেন কান্নার মিছিল শুরু হয়েছে। অথচ যার সবচেয়ে বেশি কাঁদবার কথা, রতনের মা রহিমা খাতুন, তিনি পাথরের মূর্তির মতো বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। কান্না ও বৃষ্টির শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। রতনের মা সবাইকে কান্না থামিয়ে তাদের বাবার জন্য দোয়া করতে বলে নিজে ঘরে গিয়ে জায়নামাজে দাঁড়ালেন।
সারদা পুলিশ একাডেমিতে হোসেন আলী প্রধান হিসাবরক্ষক। ট্রেজারির একটা চাবি তাঁর কাছে, আরেকটা চাবি থাকে একাডেমির অধ্যক্ষের কাছে। অধ্যক্ষ পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারত চলে গেছেন। পুলিশ একাডেমি এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে। ট্রেজারির তালা ভেঙে নগদ অর্থ লুটপাট হয়েছে। সে বিষয়ে তদন্ত করার জন্য গভীর রাতে হোসেন আলীকে ধরে নিয়ে গেছে পাক সেনারা।
পুলিশ একাডেমিতে পাক আর্মিরা আক্রমণ করে ১৩ এপ্রিল। তার আগের রাতে পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে পাবনা জেলার কাছাকাছি মুলাডুলিতে নিজ বড়ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন হোসেন আলী। এরমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগদানের ঘোষণা এলে তিনি রাজশাহী পুলিশ লাইনে এসে যোগদান করেন। হোসেন আলী ভীতু প্রকৃতির মানুষ। পরিবার-পরিজন ছেড়ে তার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষ। লুকিয়ে প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকেন।
রাজশাহীতে কাজে যোগদানের পর তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী আব্দুর রহমানের অনুরোধে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। বাড়িটা খালি পড়ে আছে। বাড়ির লোকজন সবাই গোদাগাড়ি বর্ডার দিয়ে ভারতে চলে গেছে। মুলাডুলি থেকে প্রতিদিন রাজশাহী আসা-যাওয়াটা কষ্টসাধ্য বিষয়। অল্প কিছু বাস চলাচল করে। সেগুলোতে প্রায়ই বসার জায়গা পাওয়া যায় না। রাস্তায় দুই-তিন জায়গায় চেকপোস্ট। ডান্ডি কার্ড বের করে বসে থাকতে হয়। সবকিছু মিলে রহমান সাহেবের অনুরোধ মেনে নিয়ে এখানে আসেন হোসেন আলী। অবশ্য বড়ভাই তাঁকে চাকরিতে যোগ দিতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, দেখিস, দেশ একদিন স্বাধীন হবে। মানুষ জেগে উঠেছে। পাকিস্তানিরা এ যুদ্ধে হারবে নিশ্চয়ই। হয়তো সময় লাগবে আমাদের স্বাধীন হতে। তুই চাকরিতে আর ফিরে যাস না। ওদের কোনো বিশ্বাস নেই—কখন কী করে ফেলে। হোসেন আলী কোনো কথা বলেন না। চুপ করে থাকেন। তিনি জানেন বড়ভাইয়ের কথায় দ্বিমত করার কিছু নেই। তবু শেষ পর্যন্ত হোসেন আলী চাকরিতে যোগ দেন।
নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে রহিমা খাতুন কথাগুলো ভাবছিলেন। ভাসুরের কথা শুনে কাজে যোগ না দিলে আজ হোসেন আলীকে এ অবস্থায় পড়তে হতো না।
২
পরদিন সকাল থেকে রুতুল ও তার ভাইবোনরা বারান্দায় বসে আছে জলপাই রঙের গাড়িটার অপেক্ষায়। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে গেল। গাড়ি এলো না। রুতুল জানে না তার বাবাকে আর্মিরা কেন ধরে নিয়ে গেছে। মাকে জিজ্ঞেস করে একবার বকা খেয়েছে। মা বলেছেন, ছোটদের সবকিছু জানতে নেই। একথা শোনার পর রুতুল মন খারাপ করে মার দিকে তাকিয়ে থাকে। রহিমা খাতুন মুহূর্তের মধ্যে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, অফিসের কাজের জন্য নিয়ে গেছে বাবা। আজকালের মধ্যেই চলে আসবে। তুমি বাবার জন্য দোয়া করো, বাবা যেন তাড়াতাড়ি চলে আসেন।
রুতুল নির্বাক হয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছে। মা ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। নিঃশব্দে কাঁদছেন রহিমা খাতুন। মায়ের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ওর মাথায় এসে পড়ল।
রহিমা খাতুন আজ রোজা রেখেছেন। সন্ধ্যায় এক গ্লাস পানি আর একমুঠ মুড়ি দিয়ে রোজা ভাঙলেন তিনি। ছেলেমেয়েরা অনেক চেষ্টা করেও ভাত খাওয়াতে পারেনি। হোসেন আলী ফিরে এলে একসঙ্গে ভাত খাবেন তিনি। গভীর রাত পর্যন্ত সবাই হোসেন আলীর অপেক্ষায় বসে থাকলেন।
মেজর তার কথা রাখেনি। কথা রাখবে না সেটাই স্বাভাবিক। সারা দেশে তারা নিরীহ মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলছে। ওরা মানুষ না, ওরা পশুর চেয়েও অধম।
৩
দ্বিতীয় দিনও পার হয়ে গেল। হোসেন আলী ফিরে এলেন না। রহিমা খাতুন সারা রাত জেগে থাকেন ফিরে আসার অপেক্ষায়। তাঁর সঙ্গে দুই কন্যা রেহানা ও শাহানা জেগে থাকে। গতকাল থেকেই বাড়িতে চুলা বন্ধ। আশপাশের বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে যায়। রহিমা খাতুন পানি ছাড়া কোনো কিছু মুখে দেন না। সারা দেশে যুদ্ধ চলছে। প্রতিদিনই নানা ধরনের খবর আসছে।
আসিফের মনটা আজ খুব খারাপ। নিজের বাবার কোনো খোঁজ নাই, এরমধ্যে খবর এলো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা শিবলি নিহত হয়েছে। শিবলি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। পাক সেনারা জীবিত অবস্থায় তার চোখ উপড়ে ফেলে। শরীরের চামড়া ছিলে লবণ ছিটিয়ে দেয়। তারপরেও শিবলির মুখ থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে কোনো রকম তথ্য বের করতে পারেনি। অবশেষে ৯ জুন পাক সেনারা তাকে বড়াল নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
৪
তৃতীয় দিন দুপুরে সারদা থেকে ইয়াসিন মিস্ত্রি এলো রহিমা খাতুনের সঙ্গে দেখা করতে। সে পুলিশ একাডেমিতে মিস্ত্রির কাজ করে। কাঠ, লোহা-লক্কর সব ধরনের কাজেই পারদর্শী। হোসেন আলীর সঠিক কোনো খবর সে দিতে পারল না। তবে লোকমুখে শুনেছে হোসেন আলীর মতো আরো কয়েকজনকে একাডেমির গেস্টহাউজের একটা কক্ষে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রহিমা খাতুনকে ইয়াসিন মিস্ত্রি বলল, স্যারের মতো ভালো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা। স্যারের কিছু হলে আমি সব ফাঁস করে দেব। ইয়াসিন মিস্ত্রি রহিমা খাতুনকে আম্মা বলে ডাকে।
রহিমা খাতুন অবাক হয়ে বললেন, তুমি কী ফাঁস করবে?
আমি নিজে লকারের তালা ভেঙে দিয়েছি। আমার সামনে চারজন পাক সেনা লুটপাট করেছে সব। রাত দশটায় আমাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে এই কাজ করিয়েছে।
কী বলছো?
জ্বি আম্মা, নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজটা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি রাজি না হলে ওই রাতেই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলত।
রহিমা খাতুনের বুকটা কেঁপে উঠল। কী সাংঘাতিক! নিজেরা লুটপাট করে নিরীহ মানুষটাকে রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে গেল। ঘরের খাবার ছাড়া মানুষটা একবেলাও ঠিকমতো খেতে পারে না। অথচ আজ তিন দিন পার হয়ে গেছে। না জানি কী অবস্থায় আছে। নিজের অজান্তেই তাঁর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
শাড়ির আঁচলটা টেনে চোখ মুছতে মুছতে রহিমা খাতুন বললেন, তোমার এসব কথা কাউকে বলার দরকার নাই। ওরা জানলে তোমাকে মেরে ফেলবে।
স্যারের জন্য আমি জীবন দিতেও রাজি আছি আম্মা। স্যারের কিছু হলে আমি অবশ্যই সবকিছু ফাঁস করে দেব।
ইয়াসিন মিস্ত্রির চলে যাওয়ার সময় তাকে রহিমা খাতুন বললেন, তোমার স্যারের কোনো খবর পেলে আমাদের জানাবে।
আপনি চিন্তা করবেন না আম্মা। আমি নিজে এসে খবর দিয়ে যাব।
ওইদিন গভীর রাতে পাক আর্মিরা ইয়াসিন মিস্ত্রিকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পদ্মা নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তার লাশ পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। খবরটা শুনে রহিমা খাতুন খুব কান্নাকাটি করলেন।
৫
চতুর্থ দিন পার হয়ে গেল। হোসেন আলীর কোনো খবর পাওয়া গেল না। নানা গুজব কানে আসতে লাগল। দুপুরে বাড়ির কাছের মুদি দোকানদার ইদ্রিস আলী রুতুলকে জানাল, গতকাল রাতে নাকি পুলিশ একাডেমিতে অনেক গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। তার এক আত্মীয় একাডেমি সংলগ্ন কুঠিপাড়া গ্রামে থাকে। আজ রাজশাহী এসেছিল। সে নিজের কানে গুলির শব্দ শুনেছে। অনেক মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পদ্মায় ভাসিয়ে দিয়েছে। খবরটা শুনে রুতুল আঁতকে উঠল। তার আব্বা তো পুলিশ একাডেমিতেই আছে। রুতুল দোকানে এসেছিল দুই/একটা দরকারি জিনিস কিনতে। কোনো কিছু না নিয়েই সে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
সারা দেশের অবস্থা যে ভালো না সেটা বিবিসির খবর শুনলেই বোঝা যায়। সন্ধ্যায় মোড়ের চায়ের দোকানে অনেকেই রেডিওতে বিবিসির খবর শুনতে আসে। রহিম মিয়া সে সময় সবাইকে বিনা পয়সায় আদা চা খাওয়ায়। রুতুল মাঝে মাঝে সেখানে যায়। আজ তার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। খবর শুনে ফেরার সময় রহিম চাচা বলল, তোমার আব্বার কোন খবর পাইছো?
না চাচা।
শোনো, আর্মিদের হাতে ধরা পড়লে কেউ কি আর কখনো ফেরত আসে? তোমার বড়ভাইকে বলো খোঁজখবর নিয়া লাশ উদ্ধার করতে পারে কি না।
আপনি না জেনে এভাবে যা খুশি বলবেন না। তাছাড়া আব্বা ধরা পড়েনি। বাসা থেকে অফিসের কাজের জন্য নিয়ে গেছে।
সেটা তো আরো ভয়ংকর।
রহিম চাচার ওপর অসম্ভব রাগ হলো রুতুলের। সে ঠিক করল আর কখনো এখানে আসবে না।
এরমধ্যে সেখানে বসা আরেকজন বলল, শুনেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত মানুষকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটিচাপা দিচ্ছে...।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই রুতুল হনহন করে হেঁটে বাসার দিকে রওনা হলো। রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে মনে বলছে, কোথায় এরা আমাকে সান্ত্বনা দিবে, দুইটা ভালো কথা বলবে। তা না, উল্টো নিষ্ঠুরের মতো না জেনে শুনে আব্বাকে নিয়ে কী সব কথা বলল! এদের মনে কি কোনো দয়ামায়া নাই?
অসম্ভব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল রুতুল। কারো সঙ্গে কথা না বলে সোজা ছাদে উঠে গেল। অমাবস্যা এখনো কাটেনি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেইসঙ্গে আকাশ মেঘলা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। ছাদের বাতি নিভানো। এক কোনায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুতুল। রহিম চাচার কথাগুলো রুতুলের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি কি কোনো খবর পেয়েছেন আব্বার? তা নাহলে এভাবে কথাগুলো বললেন কেন? প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। তাহলে কি আমার আব্বাও...? একবার মনে হলো দৌড়ে চাচাকে জিজ্ঞেস করে আসে তিনি কি সত্যি কোনো খবর পেয়েছেন?
কিন্তু সাহস পেল না রুতুল। কারণ যদি রহিম চাচা বলেন, অনুমান করে না গো, আমি জেনেই বলছি। তোমার আব্বারে...। রুতুল একথা শুনতে চায় না। প্রয়োজনে সারা জীবন আব্বার জন্য অপেক্ষা করবে। সে বিশ্বাস করতে চায় না যে এরকম কিছু ঘটতে পারে। কী সব উলটাপালটা ভাবছে সে! একা থাকলে মাথার মধ্যে আজেবাজে চিন্তা আরো বেশি কাজ করে। তাই এক দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে মার কাছে ছুটে গেল। রুতুলের ইচ্ছা ছিল মাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকবে। সেটা হলো না, কারণ মা বড়ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন।
পাশের বাড়ির একজন মুরব্বি রুতুলের বড়ভাই আসিফকে ডেকে পরামর্শ দিয়েছেন মসজিদে একটা দোয়ার ব্যবস্থা করতে। কথাটা শুনে রহিমা খাতুন বললেন, বিপদ-আপদে আল্লাহ-খোদার নাম নেওয়া ছাড়া তো কোনো গতি নাই। ফজরের নামাজের সময় তুমি ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে কালই দোয়ার ব্যবস্থা করো।
৬
পরদিন আসরের নামাজের পর হেতেম খা মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হলো। সকাল থেকে কোরআন খতম দেওয়া হয়েছে। মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা কম। শহর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। যারা আছেন ভয়ে ঘর থেকে বের হতে চায় না। রুতুলরা তিন ভাই, আত্মীয়স্বজন ও এলাকার মানুষ মিলে বিশজনের বেশি হবে না। আসরের নামাজ শেষে হুজুর দোয়া শুরু করলেন। এরপর শুরু হলো মোনাজাত। মোনাজাত শুরুর আগে হুজুর বললেন, হোসেন আলী সাহেবের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে আমরা এখন রাব্বুল আলামিনের কাছে হাত তুলে দোয়া করব...। আপনারা সবাই একবার সূরা ফাতেহা, তিনবার সূরা এখলাস ও একবার দরুদ শরিফ পড়েন। হুজুরের কথা শুনে রুতুল হতবাক। বড়ভাইকে সে বলল, হুজুর এসব কী বলছেন? আব্বাকে সত্যি সত্যি ওরা মেরে ফেলেছে? আর যদি মেরেই ফেলে সে খবর আমরা জানার আগে হুজুর জানলেন কিভাবে?
বড়ভাই ইশারা দিলেন মোনাজাতের মধ্যে কথা না বলার জন্য।
চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে রুতুলের। গতকাল সন্ধ্যায় রহিম চাচাও একই ধরনের কথা বলছিলেন। তাহলে কি বড়ভাই কোনোকিছু গোপন করছেন তাদের কাছে? নাকি হুজুর অনুমান করে বলছে? কোনটা আসলে সত্যি? রুতুলের ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে হুজুরের মুখ চেপে ধরে। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছেন, ‘আমাদের বিপদগামী মুসলিম ভাই...।’ রাগে রুতুলের শরীর কাঁপছে। হঠাৎ মসজিদের আশপাশের দোকানগুলোর ঝাঁপ নামানোর শব্দ কানে এলো। মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে। কেউ কেউ চিৎকার করছে ‘আর্মি আসছে’ ‘আর্মি আসছে’ বলে। পাক আর্মির গাড়ি দেখলেই মানুষ ভয়ে দোকানপাট বন্ধ করে পালায়।
রুতুল মোনাজাত ফেলে রাস্তার ওপর গিয়ে দেখে, সেদিন রাতের সেই জলপাই রঙের জিপটা তাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রাস্তায় একটা কাকপক্ষীও নেই। সবাই ভয়ে পালিয়েছে। রুতুল জিপের পেছনে পেছনে দৌড়াতে শুরু করল। জিপটা ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে থামল। রুতুল যেন উড়ে এসে দাঁড়াল জিপের কাছে। রুতুলের আব্বা জিপ থেকে নামলেন। যে কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন তা-ই পরনে। পাঁচ দিনে এ কী হাল হয়েছে তাঁর! চোখ-মুখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্তির ছাপ। কালি পড়েছে চোখের নিচে। মুখটা শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। রুতুলের মনে হলো দাঁড়াতে বা হাঁটতে আব্বার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রথমে রুতুলকে দেখেননি তিনি। যখনই ওকে দেখলেন, তাঁর চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠল। জড়িয়ে ধরলেন ওকে। এর মধ্যে রুতুলের অন্য ভাইবোনেরা এসে দাঁড়িয়েছে বাবাকে ঘিরে।
একটু দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রহিমা খাতুন তখন আঁচলে অশ্রু আড়াল করতে চাইছেন।
পাদটীকা
পাঁচ দিন হোসেন আলীকে আটকে রাখার পর তদন্তে বেরিয়ে এসেছিল—কয়েকজন পাক সেনা মিলে লকার ভেঙে টাকা লুটপাট করেছে। লকার ভাঙার কাজটি করিয়েছে তারা ইয়াসিন মিস্ত্রিকে দিয়ে। সেকারণে ইয়াসিন মিস্ত্রিকে হত্যা করা হয়। এই সত্য প্রকাশ করা যাবে না দেখে পুলিশ একাডেমির চারজন সিপাইকে দোষী করে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়। রিপোর্টে লেখা হয়, এই সিপাইরা লকার ভেঙে টাকা লুট করে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে গেছে।