স্বপ্ন ভেঙে ঘুম থেকে উঠলাম। এখনও শরীর-মন-বিছানায় সেই স্বপ্নের আবেশ। কতদিন স্বপ্ন দেখি না, যতদিন তোমাকে দেখি না ঠিক ততদিন বাদে আজ স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে তোমাকেই দেখেছি, কিম্ভূত এক স্বপ্ন— দুজন একই পথে একই গন্তব্যে যাচ্ছি, তবে বাহন ভিন্ন।
তুমি যাচ্ছ জানতামই না, আচমকা জানলাম। ফোনে নাকি মেসেঞ্জারে নাকি কোন কাকতালে, মনে নেই। স্বপ্নের ডিটেইল তো কখনো মনে থাকে না। এতদিন বাদে যে তোমার সাথে কথা হচ্ছে সেটাও ভাবনায় এলো না। নিত্যদিনের কথা চালাচালির মতোই অনায়াস আলাপ। কথার ফাঁকে জানলাম একই গন্তব্যে যাচ্ছি আমরা, খানিক বাদেই। আনন্দে আমার আটখানা হবার দশা, নেহায়েত সেটা চেপে গেলাম।
কথা হচ্ছিল। তুমি বললা, যাচ্ছ। স্বভাবতই জানালাম আমিও যাচ্ছি। আশ্চর্য, তোমার কাছে টিকিট দুইটা অথচ যাচ্ছ তুমি একাই। আশা জাগলো— একসাথে যাই, গা ঘেঁষে বসব, ঘ্রাণ নিতে নিতে অনেক কাল আগে যেমন গিয়েছিলাম। দীর্ঘ বিরতিতে তোমার বসার ঢং, হাসির আওয়াজ, কথা বলার ভঙ্গিমা আমি তো কবেই ভুলে গেছি। সেইসব স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে আমাদের কথা হচ্ছিল।
অসময়ে পাশের ঘর থেকে ডাক এলো—বাজারসদাই আরও কিছু আপদকালীন কাজ সেরে যেতে হবে যে জাহান্নামে যাই না কেন। তোমাকে ফোনে ঝুলিয়ে রেখে দেওয়াল পেরুলাম-ফর্দ বুঝে নিলাম-স্বল্পবিস্তর বাকবিতণ্ডা সেরে আমি ফিরতে চাই, ফিরবার ভীষণ তাড়া তোমার কাছে। হোল্ড করে রাখা ফোনকলে ফেরত আসতে মিনিট কয়েকেরই তো মামলা, অথচ সেই ক্ষণকাল— আমাদের সাক্ষাৎহীনতার দীর্ঘকাল, অনন্ত অনালাপের চেয়েও দীর্ঘতর অনভূত হতে থাকলো স্বপ্নের ভেতরেই।
ফিরে আসতে তুমি আবারও বললা, তোমার দুই টিকিট-তুমি একলা যাচ্ছ-বাক্সপ্যাটরা গোছানো। দরকারি কোনকিছু নিতে কখনো ভুল হয় না তোমার, আমি জানি। আর সব দরকারি-অদরকারি কথা তুমি বলেই যাচ্ছ। গন্তব্যে গিয়ে তোমার স্যান্ডেল বদলাতে হবে, খুঁটিনাটি কী কী সব। তোমার কণ্ঠ আমার কানে অসীম তৃপ্তি দিচ্ছিল, তবুও আমি আদতে তোমার কোন কথাই ঠিকঠাক শুনছিলাম না। হয়তোবা শুনছি অথবা স্বপ্নে এমন হয় আমরা কেউ কারো কথা শুনি না কিংবা শুনলেও ঘুম ভাঙার পর তা ভুলে যাই।
আমি কেবলই ভাবছিলাম আমরা একই গন্তব্যে যাচ্ছি অনেককাল বাদে আবার একই সঙ্গে। এই ভাবনায় আমি এতটাই মগ্ন ছিলাম যে, তোমার কথা অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টি হয়ে আমার কানের পর্দায় বাড়ি খেয়ে ফিরে যাচ্ছিল। আমি ভুলে যাচ্ছিলাম আমার যাওয়ার উপায়ান্তর তখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তবে তুমি যাচ্ছ-দুই টিকিট-বাড়তি টিকিটের সঙ্গী নেই তোমার, আমার আর চিন্তার কী? তোমার পাশের সিটে আমি বসব, বলাইবাহুল্য। আমরা একই গন্তব্যে যাচ্ছি একসাথে মেঘ তাড়াব গ্রামের বাজার থেকে কিনব লাল টিপ-চুড়ি তোমার জন্য আরামদায়ক চপ্পল আর ঘ্রাণ নিতে নিতে হাঁটব মেঠোপথে।
আমি তৈরি হলাম, তুমিও তৈরি হচ্ছো, বরাবরই তোমার অনেক সময় লাগে। ছোট্ট টিপটাও তুমি এত সময় নিয়ে এত যত্ন করে এমন আলতো করে কপালে ছোঁয়াও। সেই টিপ তুলে নিলে তুমি ভীষণ রাগ করো— এ সবই আমি জানি। পুরনো জানা বিষয়, তোমার চেনা বৈশিষ্ট্য আমি কল্পনা করছি। তুমি বদলাচ্ছ, এতদিনে কতদূর বদলেছ আমি জানি না, তবে এই মুহূর্তে পোশাক বদলাচ্ছ। আবার ঘ্রাণ নিতে নিতে তোমার পাশের সিটে বসে বহু দূরে ভেসে যাচ্ছি, ভেবে যাচ্ছি, দূর থেকে আমি ভেসে যাচ্ছি। অথচ গন্তব্যে গিয়ে দেখা যাবে আমি আবারও টুথ ব্রাশ নিতে ভুলে গেছি।
তখনও ভাঙেনি স্বপ্ন, যেহেতু গন্তব্য এক তাই টার্মিনালও অভিন্ন। যাবার পথে নিদারুণ এক নির্জনতা কেমন খা খা করা শূন্যতা আমার পথরোধ করে। বরাবরই আমাদের মিলিত হবার দিনগুলাতে শহরজোড়া জনসমাগম আর বিরাট ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকতো, গাড়িগুলো পাথর অবশ হয়ে বসে পড়তো রাস্তায়। এই বস্তির শহর, এই রাত বারোটায় যানজটের শহর, এই নোংরা কানাগলির শহর ছেড়ে আমরা দূর নির্জনে চলে যাব, এই জঘন্য ভিড়ভাট্টার শহরে আর কোনদিন ফিরব না; কতবার ভেবেছি। আমরা ফেরত এসেছি বারবার, পরস্পরের থেকে ক্রমশই দূরে চলে গেছি, অনন্ত দূরে। কেবলই এই শহরের অলিগলি, মানুষের ঘামের গন্ধ তোমার না থাকাকালে সঙ্গী হয়ে থেকেছে আমার।
ঘনঘোর স্বপ্নে আমি যাচ্ছিলাম অভিন্ন বাস টার্মিনালে, যেখানে আমার জন্য টিকিট নিয়ে অপেক্ষা করছ তুমি অথবা আমিই আগে গিয়ে তোমার পাশের সিটে বসবার অপেক্ষায়। যেখানে যাই না কেন এই মড়ার শহরে সবদিন সবসময় আমার যাবার পথে লেপটে পড়ে থাকে পাড়ার কাঁচাবাজার, ময়লা আবর্জনার স্তূপ আর মানুষের ঠাসাঠাসি আমি এড়িয়ে যেতে পারি না।
অথচ আজ কড়া নজরদারিতে পথের পাশের সবজির দোকানটিও। টুকটুকে টমেটোর গা ঘেঁষে নেই কচি গাজর, ভয়ার্ত লতিগুলো এলিয়ে পড়ছে না বেগুনের গায়। ভালো শসা-মন্দ শসা যে যার দূরত্বে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। আপেল-পেয়ারা যার যার আভিজাত্যে প্যাকেট মোড়ানো। সবজির নাম-দাম আর ঘ্রাণে মুখ ঢেকেছে দোকানি। মানুষেরা এমন সন্তর্পণে বাজারে এসেছে যেনবা গোপন অভিসার।
দিনের আলোয় নিশিপাওয়া শহরের দৃশ্য পেরিয়ে আমি চলতে থাকি। ভাবনাজুড়ে তুমি, বলছিলে— একলা হওয়াই মানুষের নিয়তি… তোমার গায়ের ঘ্রাণ… কেউ নেই… মনে পড়ে না। স্বপ্নেও আমার স্মৃতিভ্রম হয়, কিছুক্ষণ আগের কথাও ভুলে যাই। শর্টটার্ম মেমরি লসের সিনড্রম দেখা দিচ্ছে আমার— তোমাকে বলা হয়নি কত কথা, আবার সাক্ষাৎ হলে… সেই আশায় আমি ছুটে চলি নিশিগ্রস্ত শহর পাড়ি দিয়ে।
তুমি বলছিলে—মানুষের গায়ের ঘ্রাণ… অসুখ… তোমার সুবাস, তোমার ভাঁজের কথা ভেবে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি স্বপ্নের ভেতরে। আচ্ছন্ন আবিল হয়ে পথ চলতে থাকি। সারাটা পথজুড়ে, পুরোটা শহরজুড়ে একই দৃশ্য বিরামহীন পড়ে রয়। ইতস্তত দুই-একটা জটলা, সেখানে সমবেত তিনজনের হাতে নয় দু-গুণে আঠারোজন মিলে তুলে দেয় আহার। হাসি মুখ— নয় নয় একাশি, রাশি রাশি ছবি তুলে যায় ছবির ফ্রেমে ঢুকে পড়ে অভুক্ত পাঁচটি কুকুর।
এইসব অযাচিত অকিঞ্চিৎকর দৃশ্য পিছনে ফেলে আমি পৌঁছে যাই স্বপ্নের চূড়ায় অথচ তোমার কাছে ভিড়তে পারি না। চোখ ঢেকে তুমি উঠে যাও বাসে, সামনে কেউ নেই, পেছনে কেউ নেই, পাশেও কেউ নেই—তুমি একা। সাঁই সাঁই করে ছুটে চলে বাস, ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দ, চাকার ঘর্ষণে স্বপ্ন ভাঙে।