“ভাষা, বোঝাপড়া ও জ্ঞান—সবই অতল গহ্বরের ওপর পেতে দেওয়া পাতলা এক জাল।”—তিনি আমাদের অনুভব করিয়েছিলেন, তিনি ল্যুডভিগ হ্বিটগেনস্টাইন। জন্ম ও মৃত্যু দুটোই এই মাসে। জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৮৮৯ এবং মৃত্যু ২৯ এপ্রিল ১৯৫১। ভাষা মানুষের শরীর কি মানুষের নানান যন্ত্রপ্রকৌশলের চেয়ে কম জটিল বিষয় নয়। ভাষা দিয়েই এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া যেতে পারে পরাতত্ত্ব, নৈতিকতা, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি। মানুষ লুকিয়ে থাকে ভাষার পেছনে, এমনকি ঈশ্বর বা স্রষ্টাকেও খুঁজে পাওয়া যায় ভাষায়ই। ফলে ভাষা বিষয়টা মোটেও নিরীহ কোনো বিষয় নয়। এর রাজনীতি অর্থনীতিও ভয়ংকর, গূঢ় ও গভীর। ‘ট্র্যাকটেটাস’ ও ‘ফিলোসফিকাল ইনভেস্টিগেশনস’ তার মহান দুইটি কীর্তি হলেও তিনি আরো অনেক দুর্ধর্ষ বইপত্র লিখেছেন। ল্যুডভিগ হ্বিটগেনস্টাইনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার জন্ম এবং মৃত্যুদিন স্মরণে রেখে এই লেখা।
হ্বিটগেনস্টাইনকে এককথায় বলা যায় ‘ফ্রি স্পিরিট’—এক অন্তহীন স্বাধীনচেতনাসম্পন্ন মানবসত্তা—অন্তত আমি যতটুকু তাঁকে পাঠ করে ও তাঁর লেখা পড়ে বুঝতে পারি। বিচিত্র জীবনযাপন করেছেন। এক পরিস্থিতি থেকে আরেক পরিস্থিতিতে অনায়াসে যেন যেতে পারতেন। অস্ট্রিয়া থেকে ইংল্যান্ড, কখনো আমেরিকা, রাশিয়াতেও আরেকটু হলে ডেরা বেঁধে ফেলেছিলেন, নিজে কুটির বানিয়ে নির্জনে চলে গেছেন নরওয়েতে। বিচিত্র জীবন—বিচিত্র জীবিকার বহর—অধ্যাপনা থেকে বাগানের মালি, হাসপাতালের আরদালি থেকে ফের অধ্যাপক, আরো কত কী। পিতার সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন। হয়ে গেছেন কখনো পথের মানুষ, কখনো প্রাসাদের। তিনি যেন হারমেন হেসের আরেক সিদ্ধার্থ। জীবন যেন ঠিক খেলা নয়, লীলার মতো এসেছে ধরা দিয়েছে ছুটে গেছে। ভিয়েনা সার্কেলের সঙ্গে মিশে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটক পড়ে মুগ্ধ। পরে হয়ে গেছেন রবীন্দ্রভক্ত। আবার কোনো বৃত্তে থাকতে চাননি। মনে করতেন, দার্শনিক কোনো গোষ্ঠীর ভেতরে বেড়ে উঠতে পারে না। দার্শনিকতা কোনো দলবদ্ধ বিষয় নয়। আর তিনি তো দার্শনিক না হয়ে হতে যাচ্ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু সেদিকে যাওয়ার আগে রাসেলের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, “উইল ইয়ু প্লিজ টেল মি হোয়েদার আই অ্যাম এ কমপ্লিট ইডিয়ট অর নট?” রাসেল যদি বলতেন হ্বিটগেনস্টাইন একজন মাথামোটা নির্বোধ কেউ, তাহলে তিনি সোজা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় ফিরে যাবেন, আর যদি তা না হন তো দর্শনচর্চায় রত হবেন। বাঙালির মধ্যবিত্তের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সেকালে কি একালেও একথা কজন ভাবতে পারে যে, ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বাদ দিয়ে কেউ দর্শন পড়তে চাইবে?
তিনি অস্ট্রিয়ার মানুষ, গুরুত্বপূর্ণ লেখাপত্র অনেকটাই মূলত জার্মান ভাষায়। দিয়েছেন ভাষণ, বলেছেন নানান কথাবার্তা। সেসব নিয়েও আলাদা আলাদা বই আছে। তবে তাঁকে যে তকমাটি দেওয়া হয় সেটি হলো ‘লিঙ্গুয়েস্টিক ফিলোসফি’র সবচেয়ে প্রখর ব্যক্তিদের একজন তিনি। তিনি এমন এক দর্শনের নির্দেশনাকারী যেখানে দর্শন ভাষা ও যুক্তি ছাড়িয়ে যায় না। ভাষার সীমানা ও যুক্তির সীমানা যতদূর তত দূর দর্শন। সক্রেটিস-প্লেটো শুরু করেছিলেন সংলাপে, পরে অনেকেই দর্শনকে নিয়ে গেছেন বচনে বা প্রবচনে। যেমন নিৎসে, যেমন হ্বিটগেনস্টাইনও। তবে ছকে ফেলে দেওয়ার লোক কি তিনি? তিনি তো উড়ালপঙ্খি।
বাংলাদেশে হ্বিটগেনস্টাইনকে প্রথম পাই ২০০০ সালে, মঈন চৌধুরীর লেখা ‘হ্বিটগেনেস্টাইনের দর্শন: ভাষা, চিন্তা, বিশ্ব ও বাস্তবতার স্বরূপ’ নামের একেবারে ছোট্ট একটি বইতে। বইটি মাত্র ২৪ পৃষ্ঠার। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। মঈন চৌধুরী একেবারেই একটি উপক্রমণিকামূলক কাজ করেছিলেন, মানে ‘ইন্ট্রোডিউসিং হ্বিটগেনস্টাইন’। এতে একেবারে তার সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা তিনি হাজির করেছিলেন, তবে বইটির মূল অংশজুড়ে ছিল ‘ট্রাকটেটাস’ থেকে অনুবাদ। বিচ্ছিন্নভাবে করা ওই অনুবাদঅংশটি পড়ে যেটুকু বোঝা গিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল বস্তু, বাস্তবতা, জগৎ ভাষায় আসলে কতটুকু ধারণ করা যায়। আর সেজন্য যুক্তিকাঠামো কতটুকু কার্যকর হতে পারে। এছাড়া ভাষার সীমা, চিত্রের ভূমিকা ও ভাষার স্ফটিকীকরণ, সবমিলিয়ে স্পষ্টকরণ।
‘ট্রাকটেটাসে’র নানান মন্তব্যসমূহ থেকে নানান সময় চমকে চমকে ওঠা আর ভাবা সাহিত্যের ক্ষেত্রে হ্বিটগেনস্টাইন আসলে কিভাবে কাজে লাগে, সবচেয়ে বড় কথা উপন্যাস লিখতে। ‘বিশ্বই সব, এই হচ্ছে ঘটনা।’ বা বিশ্ব হলো সত্য ঘটনার সমষ্টি, বস্তুর সমষ্টি নয়।’—এ পর্যন্ত মগজ সহজভাবে নিতে পারে। ‘মগজে’র সঙ্গে ‘সহজে’র একটা সম্পর্ক আছে, মগজ কঠিন বিষয়কে সহজ করে নিতে পারে যদি মগজের সেই সক্ষমতা থাকে; কিন্তু দ্রুতই বুঝে নিতে হয় এই সহজ সূত্রে হ্বিটগেনস্টাইন টান দিলেন অনেক গভীরে। এতই গভীরে যে তা আমার মতো মানুষের জন্য অতল হয়ে ওঠে।
এর ভেতরে তার দিকে আরো আগ্রহ জাগে। পুরোনো বইয়ের দোকানে ‘দ্য ব্লু অ্যান্ড দ্যা ব্রাউন বুক’ পাই; ২০০৬ সাল তখন। এরপর বাংলা একাডেমি থেকে পাওয়া যায়, আফজালুল বাসারের অনুবাদে ‘ট্রাকটেটাস’। এটি ২০০১ সালে প্রকাশিত হলেও আমি পেয়েছি ২০১১ সালে। আর টের পাই হ্বিটগেনস্টাইনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে শুরু হয়ে যায় ভাষার খেলা। ভাষার খেলা অবশ্য সেই অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স থেকে শুরু, পরে জানি, যে-কারণে জেমস জয়েস বারবার অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স পড়তেন। জীবনকে ভাষার খেলায় নিতে পারার কাজটি যেভাবে দার্শনিক করেন, সেভাবে লেখক করেন না—এটিই হ্বিটগেনস্টাইন থেকে অনুভূত হতে থাকে। এরপর ২০১৩ সালে পেয়ে যাই তার ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’। বিপুল অর্থমূল্যের সেই বই। কিন্তু পেয়ে হাত ছাড়া করার কথা চিন্তাও করিনি। কারণ হ্বিটগেনস্টাইনের মূল যে দুটো বই ‘ট্রাকটেটাস’ ও এই ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’—এছাড়া তো তাঁকে জানা বোঝার উপায় এই বাংলাদেশে বসে তখন আর ছিল না। যদিও পরে জানি, তার আরো কতকগুলি বই আছে—যার প্রায় সবই এখন ইন্টারনেটে পিডিএফে পাওয়া যায়। এছাড়াও তার সম্পর্কে ছোটবড় নানান বইপত্র একে একে জোগাড় হতে থাকে। অক্সফোর্ডের কিছু, আইকন বুকস থেকে প্রকাশিত তাঁকে নিয়ে বই পাই, পাওয়া হয় কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার তুষার কান্তি সরকার, শেফালী মৈত্র ও ইন্দ্রাণী সান্যাল সম্পাদিত ‘হ্বিটগেনস্টাইন: জগৎ, ভাষা ও চিন্তন’ বইটি। এটি পাওয়ার ভেতর দিয়ে বাংলায় তাঁকে চর্চার একটি কার্যকর বই পাওয়া গেল। উল্লিখিত বইপত্র থেকে তাঁকে যতটুকু ধরতে পারা গেল, তাই বর্তমানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আমরা জানি, দর্শনচর্চাকারীর লক্ষ্য হলো জগৎটাকে বোঝা, জীবনকে বোঝা। একজন ঔপন্যাসিকের কাজও জগৎ ও এর মানুষকে বোঝা। আরো আগে জেনেছিলাম, দর্শনের কাজ হলো অস্তিত্বের স্বরূপ সন্ধান ও জীবনের সম্ভাবনাগুলি দেখানো। অল্পস্বল্প দর্শন বিষয়ক বইপত্র পড়ে এইটুকুই আমার মগজ নিতে পেরেছিল। এর ভেতরে হ্বিটগেনস্টাইন করেছেন কী, ভাষার কাজের জায়গাটির সন্ধান দিয়ে চিন্তার স্পষ্টতা ও জীবনের সম্ভবনাগুলি দেখাতে লাগলেন আমাকে।
বস্তু ও বাস্তবতা কী করে জীবন গড়ে দেয়, বা মেটেরিয়াল ও রিয়ালের সংযোগ কোথায়—এ নিয়ে মার্কসবাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আমি যদ্দূর বুঝতে পারি হ্বিটগেনস্টাইন তার জগতের ব্যাখ্যার জন্য ভিন্ন খুঁটিতে বোধের দড়িটা বাঁধতে চেয়েছেন। তার খুব চালু উক্তি হলো, যা ট্রাকটেটাসেই আছে, যা দিয়ে তিনি মূলত ‘ট্রাকটেটাসে’র আপাত ইতি টেনেছেন। তিনি ১, ১.২, ১.২৩...৪, ৪.১ এভাবে (এর মন্তব্যগুলি দিয়ে তো ‘ট্রাকটেটাস’ গড়া, যেগুলিকে আমরা আয়াতও বলতে পারি) বিন্যাস করেছেন, এর শেষ আয়াত হলো ৭, যেখানে বলছেন, “আমরা যে বিষয়ে আদৌ বলতে পারি না, অবশ্যই সে বিষয়ে নীরব থাকতে হবে।” কিন্তু এ দিয়েই কি ‘ট্রাকটেটাস’ শেষ হয়ে যায়? কত না বিষয় এসেছে তার এই বইতে। বলাবাহুল্য, জীবদ্দশায় তিনি এই একটি মাত্র বইয়ের প্রকাশনা দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যায় পরবর্তীকালে তার প্রকাশিত আরো কিছু বইতে যেমন এর ভেতরে সবচেয়ে বিখ্যাত যেটি যে ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’, তাতে ঠিক ‘ট্রাকটেটাসে’র জায়গায় পড়ে থাকেননি। তবে দর্শনের সাহায্য মানে ভাষার সাহায্যে যে জগৎকে পুরো ব্যাখ্যা করা যায় না—সেটিরও তো আভাস দিয়ে গেছেন তিনি। যে-তিনি ভাষার ভেতরে এত স্পষ্টতার অভিমুখে আমাদের নিয়ে যান, তিনিই বলেন যে, “জগতের মানে জগতের বাইরে বিরাজ করে।” তখন ফের চমকে উঠতে হয়। (একসময় কানে এসেছিল যে বৈজ্ঞানিক আবদুস সালামের চেষ্টা ছিল প্রাণ জগতের বাইরে থেকে এসেছে এটা বের করার, কিন্তু সেটি প্রমাণ করার আগে তিনি গত হলেন।) হ্বিটগেনস্টাইনের কথায় তাই ধাক্কা লাগে। প্রাণ তো প্রাণ, এর তো একটা বস্তুগত দিক আছে; কিন্তু জগতের ‘মানে’ জগতের বাইরে বিরাজ করে—এটা একটা বিরাট গোলকধাঁধায় আমাদের ফেলে দেয় না কি? তাহলে ভাষা দিয়ে জগতের আর কতটুকু ধরা যাবে, যেখানে মানেটাই জগতের বাইরে? আর জীবন? আর মানুষকে, যে মানুষকে নিয়ে লেখকের কাজ, একজন গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের কাজ? এখানে থমকে যেতে হয়, তাহলে মনে হয় জীবনের ক্ষেত্রে জীবিকার ক্ষেত্রে হ্বিটগেনস্টাইন যেমন এক মুক্ত স্বাধীন ছিলেন, কোথাও আটকে পড়তে চাইতেন না, সেরকম করে তিনি তার ভাবনাকে মুক্ত করে দিলেন, তার ভাবনাকে বেঁধে দিতে চাইলেন না? কারণ তিনি দর্শনকে (দেকার্তীয় ও তার সমকালের চল অনুযায়ী যা অনেক দিন রাজত্ব করেছিল দর্শনের জগতে) ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা মুক্ত করেছিলেন, ‘আমি’-র প্রাধান্যহীন করে কান্ট ও হেগেলের অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণতা দিলেন বলে উল্লেখ করা হয়, সেই তিনিই তো একটি বস্তু ও বাস্তবতা, যুক্তি, চিন্তা পেরিয়ে জগৎকে আমাদের সামনে রেখে গেছেন আরো অনুসন্ধানের জন্য। বিষয়টি যেন এমন, আমার দ্বারা এটুকু করার ছিল, বাকিটুকু তোমরা তোমাদের মতো করে করে নিও, তাই কি?
আরো প্রশ্ন তো হাজির হয়। আসলে প্রাচীন কাল ছিল প্রশ্নহীন বিশ্বাসের, আধুনিক কাল হলো প্রশ্ন ও উত্তরের, আর উত্তরাধুনিককাল হলো প্রশ্নই হয়ে ওঠে প্রশ্নের জবাব—এমন একটা জায়গায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা যারা অবস্থান করছি, সেখানে হ্বিটগেনস্টাইন তো কিছু বিষয় আমাদের কাছে হাজির করেছেন। বা উস্কে দিয়েছেন এমন কিছু যেখানে তাঁকে চর্চার যৌক্তিকতা তৈরি হয়। আমরা যেমন ফার্দিনান্দ দ্যা স্যোসুরের ক্ষেত্রে জানি তিনি শব্দকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বুঝে নেওয়ার জন্য বলেছেন, ঠিক তেমন হ্বিটগেনস্টাইন বলেছেন কোনো কিছুকে বুঝতে হলে ‘যাপনের প্রেক্ষাপটে’ বুঝতে হবে। তিনি সহজ একটি দিক হাজির করেছিলেন এভাবে যে, যদি সিংহ কথা বলতে পারত তাহলে কি আমরা তার ভাষা বুঝতে পারতাম? সিংহের ভাষা বুঝতে হবে সিংহের যাপনের পরিপ্রেক্ষিতে। এখানে এসে ফের মনে হলো হ্বিটগেনস্টাইন তো তাহলে যে কথাগুলি আসলে জগৎকে বোঝার মূল কথা সেই কথাগুলিই নিজের মতো করে বলে গিয়েছেন। ফলে তার সঙ্গে অনেকের তফাত থাকলেও মিলও বিপুল। জগৎ, চিন্তা ও ভাষা-র পরম্পরায় কোনটা কোনটাকে মেনে চলবে খেলাটা কেবল তিনি যেভাবে যা হাজির করেছেন। তাতে আমরা আমাদের মতো টের পাই যে জগৎ থেকে চিন্তা তৈরি হবে, তারপর চিন্তা থেকে ভাষা? নাকি উল্টোটা ভাষা তৈরি হলে তবে চিন্তা আর চিন্তা তৈরি হলে পরে জগৎকে বোঝা যায়। আমরা শিশুর ভাষা দিয়ে তো বিষয়টি দেখে নিতে পারি। তার ভাষা শেখা থেকে তার করা নানান প্রশ্নের ভিত্তিতে আমরা জগতের আরেকটি চেহারা পাই। একটি শিশু বা প্রতিটি শিশু তার মতো করে তার আশপাশকে চিনতে চেষ্টা করে, তার চিন্তা শক্তি যতটুকু সেসময় সে ধারণ করে। যদিও হ্বিটগেনস্টাইন দেখান তিনটিই সংযুক্ত।
আমরা জানি, হ্বিটগেনস্টাইন ‘মন’ নিয়েও গভীরভাবে ভেবেছেন। ফ্রয়েড ও তিনি প্রায় সমসাময়িক, আর দুজনেই অস্ট্রিয়ার মানুষ। ফ্রয়েড সাইকোঅ্যানালিসিস দিয়ে যেভাবে মানুষকে বুঝতে চেয়েছেন, হ্বিটগেনস্টাইন সেখানে তার ভাষা-দর্শন দিয়ে জগৎ-জীবন বোঝার জন্য বস্তু ও বাস্তবতার বিন্যাসকে লক্ষ্য করতেই তো বললেন। দুজনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায়, যে হ্বিটগেনস্টাইন আমাদের উপলব্ধি করান যে, ভাষা, বোঝাপড়া ও জানা বা জ্ঞান এক অতল গহ্বরের ওপরে পাতা পাতলা জাল ছাড়া আর কিছুই না। সেই জালটি সরিয়ে নিলে আমরা কোন যে অতলে তলিয়ে যেতে পারি—ফলে ভাষা, বোঝাপড়া ও জানার সীমানা আমাদের নির্ধারণ করে নিতে হয়। নইলে সমূহ সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।
একটি মানুষের বেঁচে থাকাকে, তার আবেগ-অনুভূতি, তার মমতা-নির্মমতাকে বোঝার ক্ষেত্রে এভাবে হ্বিটগেনস্টাইন আমাদের সহায়তা করেন বোধ করি। সেদিক থেকে ভাষার খেলা মানে জীবনের খেলা। কথার পেছনে যে মানুষ লুকিয়ে থাকে, লুকিয়ে থাকে তার অতল বা নির্জ্ঞান, সেদিকেও নিয়ে যান হ্বিটগেনস্টাইন। জীবন থেকে বিজ্ঞানে, বিজ্ঞান থেকে অভিজ্ঞতায়, বিশ্লেষণ, প্রয়োগ, ভাষা ও চিন্তার সীমা সসীম ও অসীম—কত দিকে ঘুরিয়ে আনেন তিনি। ‘ট্রাকটেটাস’ ও ‘ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশান’ বই দুটোকে ধারাবাহিক পড়ায় যেমন এক ধরনের পাঠ, তেমন হলো, এর নির্ঘণ্টে গিয়ে নানান বিষয় সম্পর্কে কোথায় কী বলেছেন, সেভাবেও আবার পড়া যায়, মানে জীবন, জীবিকা, অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন ভাষা ব্যবহার, সত্য, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি কত কত বিষয়ই না আছে।
ফলে হ্বিটগেনস্টাইনের কাছে যাওয়া ও তাঁকে চর্চা করার মানে এক ভ্রাম্যমাণ মন ও মস্তিস্কের সন্ধান পাওয়া। কারণ তাঁকেও তো বুঝতে হবে তার যাপনের পরিপ্রেক্ষিতে, যেখান থেকে তিনি তার পথনির্দেশক গটলব ফ্রেগে ও শিক্ষক বার্ট্রান্ড রাসেলকে পেরিয়ে হয়ে উঠলেন এক ও অনন্য হ্বিটগেনস্টাইন।