বিষয়টা নিয়ে কানাঘুষা চলছে কয়েকদিন ধরে। আমি নিজেও শুনেছি। ছোট একটা পাড়ায় থাকি আমরা। এখানে কোনো কথা গোপন থাকে না।
আমাদের পাড়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। শহর থেকে দূরে, রক্ষণশীল একটা এলাকায়। কিন্তু এটা বদলে যাচ্ছে গত কয়েকবছর ধরে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন অনেকগুলো নিয়োগের পর।
ঘটনাটা প্রথম শুনি নতুন নিয়োগ পাওয়া এমন একজনের কাছে। সে সরকারি দলের পান্ডা টাইপের। বাজার করতে যাওয়ার পথে আমাকে পাড়ার বড় জারুল গাছটার আড়ালে নিয়ে যায় সে। চড়া গলা নামিয়ে রহস্যঘন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে।
তার কাছে শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয় না। বলি, আপনি শিউর এটা হয়েছে?
হ্যাঁ ভাই, নতুন ভবনের দারোয়ান দেখেছে! যা বলছে এটা তো ভাই...
সে তার বড় বড় দাঁত বের করে ফ্যসফ্যাসে একটা হাসি দেয়। আমার এখনই জিজ্ঞেস করা উচিত দারোয়ান কী বলেছে। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে হয় না।
মফস্বলের বাজার। প্রায় সবাই চেনে আমাকে। তন্ন তন্ন করে বোঝার চেষ্টা করি হুজুরের ব্যাপারটা কেউ জানে কিনা? হুজুর আমাদের পাড়ার ভেতরের মসজিদের ইমাম। কিন্তু কায়দা-আমপাড়া পড়াতে বাইরে অনেক বাসায় যান তিনি। ব্যাপারটা জানলে কেউ চুপ থাকবে না।
এরপর কয়েকদিন গল্পের ডালপালা গজায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভবনের পাশে বিশাল বড় আম কাঠালের বাগান। সেখানে ছেলে মেয়েদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে আগে কিছু অভিযোগ শুনেছি। কেউ তা নিয়ে ঘাঁটাতে যায়নি। কিন্তু হুজুর যে সেখানে যায় এটা আমরা জানতাম না।
তিনি নাকি প্রতিদিন ভোরে সেখানে যান হাঁটতে। প্রথমে শুনেছিলাম তিনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন। তখনই তাকে হাতেনাতে ধরে ছেলেরা। কিন্তু এরপর গল্পের ডালাপালা মেলতে থাকে। গিবত আনন্দময়। কিন্তু এ গল্প এমন এক পর্যায়ে যায় যে তা অসহনীয় হয়ে ওঠে।
আমাদের পাড়ার মিটিং বসে। মিটিংয়ে কয়েকজনকে শুধু ডাকা হয়। গিয়ে দেখি পাড়ার সভাপতি কথা বলছেন। এমন একটা মানুষের পেছনে নামাজ পড়া যায় না—এটা বলতে বলতে রাগে তার মোঁচ কাঁপতে থাকে। ফচকে যে অফিসারটা আমাকে প্রথম খবরটা দিয়েছিল, সে বলে, আজকেই বের করে দেই ব্যাটাকে। বাশার স্যার বলেন, তার মুখ থেকে শুনি আগে। পেছন থেকে কে যেন বলে, সে তো নাকি মানা করেছিল ছেলেটাকে এসব করতে। তখনই...।
কারো কথা শেষ হতে দেন না সভাপতি। হুজুর বলেছে সে যায় সেখানে হাঁটতে। কেন যায়? হুংকারটা দিয়ে আমার দিকে তাকান। আমি তার ঘনিষ্ঠ মানুষ। এ জন্যই হয়তো।
সেখানে আসলে কী ঘটেছে সেটা আর জানার চেষ্টা হয় না। হুজুর মানুষ যাবে কেন সেখানে? এ কথা মিটিংয়ে গুনগুন করে উচ্চারিত হয়। হুজুরের ভাগ্য ঠিক হয়ে যায় সেখানেই।
এরপরের ঘটনা ঘটে খুব দ্রুত। সকালে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় শুনি হুজুর বিদায় হয়েছে। পরের শুক্রবার জুম্মার নামাজে গিয়ে দেখি নতুন হুজুর এসেছে। নতুন হুজুরের মিঠা গলা, অতিমিষ্ট ব্যবহার।
কিছুদিন পর জানা গেল নতুন হুজুর একজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। সে আমার উপন্যাসেরও মহাভক্ত। আমি বাংলার শিক্ষক, সামান্য কিছু সাহিত্যচর্চা করি। হুজুরদের মধ্যে যে আমার ভক্ত আছে এটা প্রথম জানলাম। অন্যরকম আনন্দ হলো শুনে। এ সুযোগে নানা গল্প করা শুরু করে সে আমার সাথে।
একদিন পুরোনো হুজুরের কথাও বলে। তাকে চেনে সে। আমাকে ফিসফিস করে বলে, হুজুরের চাকরিটা আসলে কেন গেছে জানেন স্যার?
২.
মহুয়াকে তার বাবা একটা ল্যাপটপ দিয়েছে এবারের জন্মদিনে। এটা নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকে সে। আমার অবশ্য সুবিধা হয়েছে এতে। নিজের কাজ করতে পারি, তারপাশে লেপ্টে থাকতে হয় না। শুধু লেখার ফাঁকে মাঝে মাঝে গিয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে হয়। যেমন—কী অবস্থা তোমার? কী দেখো এত মন দিয়ে? শরীর ভালো তোমার? সে এতেই খুশি থাকে।
কিন্তু আজ তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। তাকে ল্যাপটপটা পজ করতে বলি। সে বলে, আশফাক নিপুনের নাটক, এটা বন্ধ করা যাবে না।
শোনো একটু গল্পটা!
তার শোনার তেমন আগ্রহ নেই। হুজুরের গল্পটা যতটুকু লিখেছি তবু বলি তাকে।
তারপর বলি, শেষ করব কিভাবে? কোনো গল্পের শেষটা বিরাট সমস্যা আমার। সেটা জানে মহুয়া। তবু বলে, আমি কিভাবে বলব?
আসলে কেন গেছে হুজুরের চাকরি? একটু ভাবো। চমকে দেওয়া একটা এন্ডিং দরকার।
সে ল্যাপটপে চোখ ফেরায়। তারপর বলে, লিখে দাও হুজুর আসলে মেয়ে ছিল। ছেলে সেজে থাকত। এটা বলে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে সে। তার এলোচুল ঢলে পড়ে চাঁদের গায়ে রাতের মেঘের মতো।
আমি তবু বিরক্ত হওয়ার ভান করি। কী বললা তুমি এটা!
আরো কয়েকদফা হাসাহাসির পর সে সিরিয়াস হয়। বলে, তুমি তো বলেছিলে কী হয়েছিল। সেটা লিখে দাও।
আচ্ছা শোনো। আমি তাকে গল্পের শেষটা বলি। নতুন হুজুর আমাকে বলে, হুজুরের চাকরিটা আসলে কেন গেছে জানেন স্যার?
কেন?
সে বিরোধী দল করত। জঙ্গী!
মহুয়া ভ্রু কুচকায়। সত্যি? এটাই বলেছিলে আমাকে?
কয়েকমাস আগের ঘটনা। কী বলেছিলাম তাকে ঠিক মনে নাই। বলি, এরকমই।
তাহলে লিখে দাও।
ভালো হবে এন্ডিংটা?
ভালোই! এটা বলে সে ল্যাপটপে ডুবে যায়। হাঁটু উঁচিয়ে স্ক্রিনটা এমনভাবে ধরে আমি আর তাকে দেখতে পারি না ঠিকমতো।
৩.
লেখার টেবিলে বসে থম ধরে বসে থাকি। হুজুরের চাকরিটা গিয়েছিল সে আসলে বিরোধী দলের লোক বলে—এটা কি ভালো এন্ডিং হয়?
এমন ঘটনা অবশ্য ঘটে আজকাল। নিজের লোক নিয়োগ দেওয়ার জন্য কত অপবাদ দেয় মানুষ।
আমাদের পাড়ার উল্টেদিকে খুব ভালো একটা মুদির দোকান ছিল। সেটা আগের আমলে বরাদ্দ পাওয়া। একদিন শোনা গেল সেখানে নাকি মুরগির ডিমের নামে প্লাস্টিকের চাইনিজ ডিম বিক্রি করা হয়। ঠিক দুদিন পর দেখা গেলা সেই দোকান ভাঙার জন্য প্রক্টরের গাড়ি চলে এসেছে। একমাসের মাথায় সেখানে নতুন দোকান বসল। সেখানে সত্যি সত্যি এখন নকল জিনিস পাওয়া যায়। এজন্য অভিযোগও করে মানুষ, কিন্তু কোনো প্রক্টরের গাড়ি আসে না ভাঙতে। শোনা যায় নতুন দোকান পেয়েছে প্রক্টরের কোন আত্মীয়।
এসব জিনিস জানে মানুষ। কাজেই বিরোধীদল করে বলে তার চাকরি গেছে এমন এন্ডিং দিতে পারলে খারাপ হবে না বিষয়টা। কিন্তু সেটা কি চমকপ্রদ হবে? গল্পের তো শেষ হতে হয় চমকপ্রদ!
মহুয়ার পায়ের শব্দ শুনি। হাতে ল্যাপটপ নিয়ে সে আমার জানালার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। ওয়াই-ফাইতে সমস্যা হলে এসব করে সে। কিন্ত এবার সে ফিরে আসে হঠাৎ। বলে, এত চিন্তা করো না। সত্যিটা লিখে দাও। ওকে!
বিরক্ত লাগে তার ওপর। সত্যি বললে কি তা গল্প হয়? আর সত্যি কি আমি বলিনি তাকে?
আমার জানলার অন্যপাশের আকাশ ঢেকে গেছে ঘন নিমগাছে। তার ভেতর ছোট্ট একটা ডাল শুধু নড়তে থাকে। মৃদু বাতাস? নাকি কোন চেনা পাখি হঠাৎ উড়াল দিল সেখানে?
আমার গল্পের হুজুরের চলে যাওয়া সত্যি। নতুন হুজুরের আসা সত্যি। নতুন হুজুরের সাথে আমার খাতিরটা সত্যি। কিন্তু খাতিরের কারণটা সত্যি না। পুরানো হুজুরের চলে যাওয়ার ঘটনাটাও পুরো সত্যি না। এসব বলা যাবে না গল্পে।
বললে আমাকে কোনো মহৎ মানুষ মনে হবে না। বললে আমার গল্প কেউ আর পড়বে না।
মানুষ ধরে নেয় আমরা লেখকরা খুব মহৎ মানুষ। কেন ধরে নেয় আমি জানি না। কিন্তু এটা যে সবসময় সত্যি না—তা বলা যাবে না। অন্তত এ গল্পে না।
এ গল্প লেখা যাবে না এখন। আমাকে আগে অসাধারণ একটা এন্ডিং বের করতে হবে। সেটা সত্যি না হলেও অসুবিধা নাই।