তোমার এসব বুঝতে পারার কথা না, তুমি এসবের সামনে আগে পড়োনি; কী বলব বুঝতে পারি না, এটুকু ছেলে আমার সঙ্গে তর্ক করছে, জানি না, তবে ওর বাপের আস্কারা তো আছেই, ওর বাপ নিজের জীবনে শুরু থেকে একটা পর একটা কাণ্ড করেছে, আমি কিছু বলতে পারিনি, কারণ সংসারে আমার তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, সবই ওর মায়ের হাতে ছিল, আর আমি আসলে কোনো ভূমিকা পালনও করতে চাইনি, আমি তো জানি আমার জীবনে কী ঘটেছিল, অথচ আমার ছেলেও গোড়া থেকে যে পথে গিয়েছিল, সেই পথেই যাচ্ছে তার ছেলে, রক্ত! রক্তের গতিপথ আর কে ঠেকাবে? তবুও আমি বলি, বলতে শুরু করি, আর বলতে বলতে ভুলে যাই, আমার সামনে পাভেল আছে কিনা উঠে গেছে, কারণ একটানা বলছিলাম কথাগুলি, ওকে জানানো দরকার, আমি তো জানি নিজের ভালো বোঝাটা ছাড়া আর জগতে কিছু করার থাকে না, আর থাকতে পারে—পরের জন্য কিছু করা, এ-ই; তাই আমি বলছিলাম, বলছিলাম যে, আমার বয়স এখন প্রায় পঁচাত্তর, পঁচিশ বছর বয়সে যখন যুদ্ধ এলো, এম এ পাশ করে বাপের মায়ের ভাষ্যমতে আমি ‘দেশউদ্ধার’ করতে নেমেছি, চাকরিবাকরি করার কোনো লক্ষণই ছিল না, আমার তখন সোজা কথা, আগে দেশের স্বাধীনতা তারপর চাকরি, কিন্তু কী হলো, জানো না তুমি, আমি যুদ্ধ থেকে ফেরার অল্প কদিন পর বলা হয়, আবারও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে, বোঝো তো আন্ডারগ্রাউন্ড কী? পার্টিতে আবার ভাঙন, বোঝো পার্টিতে ভাঙন হলে কেমন লাগে জানবাজ কর্মীদের কলিজায়? সেসময় আমার বন্ধু দিব্য ভট্টাচার্য, তোমার দিব্যদাদু, বলল, আর পারা যাবে না, যাবি আমার সঙ্গে? কোথায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে, লন্ডন, আমি বলি, লন্ডন? কেন তুই কি ভেবেছিলি, আমি তোকে আমার সঙ্গে আবারও কলকাতায় যেতে বলব? শোন, যুদ্ধ করে জিতে এসেও যদি ফের কানে বানের মতো শুনতে হয়, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, তাহলে আর কী করার থাকে, সারা জীবন যুদ্ধ করা যায় না, নাকি করা যায়? দিব্য আমার গুরু ছিল, সেই আমাকে মার্কস-এঙ্গেলস সব পড়িয়েছিল বুঝিয়েছিল, তবে সে আমাকে বলেছিল, সে মার্কসবাদী নয়, মানে, যে অন্ধ মার্কসের অনুসারী নয়, অন্ধ অনুসারীই যদি হবে, তাহলে মার্কস পড়বে কেন, বা পড়ে তাহলে তার কী লাভ হলো? বলেছিল, আমার তো মনে হয় মাও সে তুং-ও মার্কসিস্ট নন, নইলে তিনি বিপ্লবই করতে পারতেন না, সে আরো বলেছিল, আমি তো নিজেকে মার্কসের চেয়ে শক্তিশালী মনে করি; আমি হতবাক! বলে, হাঁ করে রইলি যে! এটা তো হাঁ করার কিছু নয়, দেখ, মার্কসের ভেতরে আমি ছিলাম না, কিন্তু আমার ভেতরে মার্কস আছে আবার আমিও আছি, ফলে আমি ও আমার ভেতরে থাকা মার্কস দুয়ে মিলে আমি যা, সে কি মার্কসের চেয়ে শক্তিশালী নয়? আমি বলি, পার্টির লোকজন জানলে...; জানলে কী করবে, বের করে দেবে? দিক, কেবল বেরই করে দেবে না, তো কী মেরে ফেলবে? মারুক; দিব্য এত স্বাভাবিকভাবে বলছিল, দিব্যির জেঠু এদেশ ছেড়েছিলেন ব্রিটিশ আমলেই, আর ছোটকাকা যুদ্ধের পর আর আসেনি, তিন ভাই ছিলেন, এর ভেতর দিব্যর বাবাই রয়ে গিয়েছিলেন দেশে, যুদ্ধের আগে অবশ্য দিব্য মা-বাবাকে কলকাতা রেখে আসে, মহিম ভট্টচার্য অবশ্য সরকারি চাকরি করতেন, ভালো মাইনা, কলকাতায় সেটা কোথায় পাবেন, পাকিস্তান আমল হলেও তার চাকরির বদৌলতে সম্মানের জীবন ছিল এখানে, তারপর দিব্যর রাজনীতিতে যাওয়াটা গোল বাঁধাল; দিব্য বলছিল, রাজনীতি করেছিলাম বলেই হাওয়াটা বুঝতে পেরেছিলাম, রাজনীতির মূলনীতি হলো: ঝোপবুঝে কোপ, আজ যে বন্ধু, কাল সে শত্রু, আবার শত্রুই হয়ে যায় বন্ধু, যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন—আমি মনে করেছিলাম যে মার্কসবাদ আমাকে মুক্তি দেবে, সেটা দিয়েওছে, কিন্তু ব্যক্তি আমাকে—জগৎ চিনিয়েছে, পার্টি করতে গিয়ে আরো বেশি চিনিয়েছে—রাজনীতি বইয়ে পড়া দিয়ে হয় না, মাথা লাগে, “যাহা মস্তকে নাই, তাহা পুস্তকে খুঁজিয়া কী লাভ”; দিব্যর এই কথাটা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু এও ঠিক রাজনীতি ছাড়া মুক্তি কোথায়, তারপর দ্বিধা কাটে না, আগে ব্যক্তির মুক্তি, না কি আগে সমষ্টির, ব্যক্তি ধরে ধরে মুক্ত হতে হবে সমস্ত বিভেদ থেকে, না উল্টোটা? এই নিয়ে দিব্যর পাগল হওয়ার দশা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পর পর, তারপর হঠাৎ সে বলে, আমি একটা জিনিসে পৌঁছাতে পেরেছি, খুবই সাধারণ তস্য সাধারণ একটি জিনিসে; কিন্তু দিব্যকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমি বলেছিলাম, আমি মনে হয় তোর আগে তাতে পৌঁছে গেছি; দিব্য বলে, ঠিক আছে খেলাটা হোক, তুই আগে লিখে ফেল—এই কাগজে, তারপর আমি মুখে বলি, তারপর মিলে কিনা দেখ; আমি লিখেছিলাম, লিখে কাগজটা ভাঁজ করে ওর হাতে দিয়েছিলাম, আর দিব্য মুখে যখন বলে যাচ্ছিল, আমি দেখলাম দুয়েকটা শব্দ ছাড়া আমি যা লিখেছিলাম তা-ই সে বলছিল, যার সার কথা হলো: মানুষের কল্যাণ ছাড়া আর জগতে আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করার বা রাখার দরকার নেই, কল্যাণ যদি না করতে পারো তো অন্তত তোমার কথা ও কাজে এমন একটা কিছুও যেন না হয় যা থেকে কারো ক্ষতি হতে পারে; আসলেই আমার পরানের বন্ধু বলতে যা বোঝায়, আর দিব্যও বলেছিল, তুই আমাকে ঠিক বুঝতে পারিস, চিন্তা করে দেখ এই অতি সহজ কথাটা বুঝতে আমাদের এত সময় লেগে গেল! এজন্যই দিব্য আর দেরি করেনি, কারণ আসল কথা—মানুষ, জগতের যেখানেই থাকি মানুষের ভালো যাতে হয়, এমন কিছুর জন্যই আমরা কাজ করব, তাই লন্ডন হোক, কি কলকাতা হোক কি ঢাকা; আমি বলেছিলাম, তাহলে আমেরিকা চল, না, না, আমেরিকা এখন না, আগে লন্ডন, তারপর বাকি দেখা যাবে, সেই বাকি দেখতে আমি ও সে, এক সুন্দর সকালে, আমরা প্রায় কাউকে কিছু না বলে লন্ডন চলে যাই, পার্টির লোকজন আমাদের কদিন হন্যে হয়ে খুঁজে হাল ছেড়ে দেয়, তারপর জেনে যায়, কারণ আমরা এমনভাবেই গিয়েছিলাম যে আমাদের দুজন ছাড়া আর কেউ টুঁ শব্দটি টের পায়নি, জানি না, আমাদের এই যাওয়াটুকুকে পালানো তুমি বলতে পারো, কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে তুমি কোথাও পালাতে পারবে না, কিসের জন্য পাগল হচ্ছো গার্মেন্টশ্রমিক ও মালিকদের ইন্দুর-বিলাই খেলার ভেতরে তুমি কী করতে পারো? কদিন আগে পাটুরিয়া ঘাটের অবস্থাটা দেখেছো, সামাজিক দূরত্ব, সোশ্যাল ডিসটেন্স! ফুঃ! অবস্থাটা এমন যে নিজেকে ঠিক রাখার মানেই তুমি অন্যের উপকার করবে, কী আশ্চর্য ভাবা যায়, জগতের সমস্ত ক্ষমতা অকেজো হয়ে গেছে আজ, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা দিয়ে এত অস্ত্র, এত বোমা কোনো কাজে লাগছে না, দিব্য আমাকে কদিন আগে মেইল করল, ইচ্ছা করেই, কারণ ওই কথাগুলি মুখে বলা যায় না, মুখে বললে আসলে কথাই হয়ে ওঠে না, তাতে ও এটাই লিখেছে, জগতের সমস্ত বিশ্বাস মতবাদ আসলে এই পারমাণবিক বোমার মতো, কোনো কাজে লাগে না, স্রেফ পড়ে থাকে, এই মতবাদের জন্য পাগল না হয়ে, যত তাড়াতাড়ি কেউ বুঝতে পারবে যে, মানুষের মঙ্গল করা ছাড়া মানুষের আর কোনো কিছুর দরকার নেই, ততই তাড়াতাড়ি আমাদের মুক্তি মিলবে, আমি ও তুই সেটা আজ থেকে মোটামুটি পঞ্চাশ বছর আগে টের পেয়েছিলাম, একসাথে একযোগে, অবশ্য আমরাই তো জগতে প্রথম নই, সারা দুনিয়ায় এমন কোটি কোটি মানুষ পাওয়া যাবে, তারপরও অনেকেরই মনে এখনো গেঁড়ে আছে—এশীয়রা তাদের নোংরা ধর্মের মতোই নোংরা, যেমনটা ভারতীয়দের সম্পর্কে চার্চিল মনে করত, আর আফ্রিকার কালো মানুষদের নিয়ে ঘৃণা অবজ্ঞার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে বহু সাদারা এত এত জ্ঞানচর্চার পরও শিক্ষাদীক্ষার পরও আজও পারেনি, ফলে তুমি যেখানে থাকো, সাদা বা কালো যাই হও, যেমাত্র তোমার ভেতরে কোনো কিছুর প্রতি অযৌক্তিক ঘৃণা দেখা দেবে, সেই মাত্র তোমার সমস্ত জ্ঞানবিদ্যা ‘হুরুসফাডা’ হয়ে যাবে, বরিশালের এই কথাটা দিব্য দারুণভাবে বলবে, মানে যে নারকেল ভেতরে পুরো পচে বাতিল হয়ে গেছে তাই হলো ‘হুরুসফাডা’, সোজা বাংলায় ‘ফোঁপরা’ হয়ে যাওয়া, ‘ফোঁপরা’ আসলে তো বাংলা না, এসেছে হিন্দি থেকে, হিন্দি ভাষার ‘পাছিনা’ মানে ঘাম শব্দটা আমার খুব পছন্দ;... দিব্য বেঁচে গেছে কারণ এখানে সে এমবিবিএস পাস করে গিয়েছিল, সেখানে কী কীকরে আবার পড়া শুরু করে, আমি কদিন এদিক-ওদিক করে আমেরিকা চলে যাই, কিন্তু আমার কোথাও ভালো লাগেনি, কত কিছু করেছি বিদেশে, থিতু হতে পারিনি, আসলে চাইনি, তাছাড়া আমার তো আস্ত একটা নিজের দেশ রয়েছে, ভাবা যায়—ইহুদিদের জন্য ছোট্ট একটা দেশের জন্য থিওডর হার্জেলের উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল, ‘জ্যুইস কোয়েশ্চেনে’র একটাই জবাব ছিল ‘নিজেদের একটা দেশ’, তো সেই দেশ আমাদের আছে, ছিল, হাজার বছর ধরে ছিল, কেবল সেই দেশটা নিজেদের করে পাওয়ার বাকি ছিল, সেই দেশটা পেয়েও আমরা মূল বিষয়টা বুঝতে পারলাম না, তাই সব কিছু ফোঁপরা হয়ে গেছে, যা-ই করেছি আমরা;—আমি কথাগুলি দিব্যকেও নানান সময়ে বলেছি, কিন্তু দিব্য আর পরে ভরসা পায়নি ফিরে আসার, বলেছিল, আমি একটু হলেও তো জীবনে রাজনীতি করেছি, হাওয়াবদল তো টের পাই, সত্যিই! কে নাকি ইন্দিরাকে বলেছিল, জয় বাংলাদের স্বাধীন করার জন্য যে সাহায্য সহযোগিতা করছেন, কোনো লাভ হবে না! তিনি বললেন, কী বলতে চান? তখন তাকে বলা হলো, আগে ছিল একটা পাকিস্তান, এখন হবে দুটো পাকিস্তান; আমি বলেছিলাম, দিব্য কী বলিস এটা! তুই!—আমি আবেগ থেকে কথা বলি না তুই জানিস, জগতটাকে নির্মমভাবে দেখতে না পারলে মমতা জন্মায় না, সেই মমতার তো সবচেয়ে বেশি আমার নিজের জন্য, তাই না? তোকে হামসফর বা সাথী হতে বলেছিলাম কারণ নিজের পরই আমি তোকেই বুঝতাম, তারপর আমি মার্থাকে বিয়ে করেছি, বাঙালি কাউকে বিয়ে করিনি, কারণ বাঙালি মেয়েরা আমি যে জীবনে যে যাপনে বিশ্বাস করি তা ধরতে পারবে না; আমি বলি, আহা লোকে আর বাঙালিদের বিয়ে করেনি; আমি দেখতাম দিব্যর অনেক কিছু আমার সঙ্গেও আর মিলছে না, একটা দেশ কেবল দেশ না, আরো অনেক কিছু, সবচেয়ে বড় কথা এই ‘বাংলা’ ভাষার জন্য আমার এমন পিপাসা, বাংলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে দেখতে না পারলে আমার দিনটাই শুরু হতো না, এটা কি ম্যাটেরিয়ালিস্টিক? খবরের কাজ নামের বস্তুটা না বাংলা অক্ষর মালা দিয়ে সাজানো, এমন কিছু স্পর্শ করার টান কি অবস্তুগত কিছু? আমি জানি না, রাসেল তার সারা জীবনে দর্শনচর্চা করে একটি জিনিসই নাকি বুঝেছিলেন যে, দর্শনের সার কথা মাত্র দুটো বিষয়ে নিহিত, “হোয়াটই ইজ ম্যাটার নেভার মাইন্ড, হোয়াট মাইন্ড নো ম্যাটার”, আমি সেটাকে নিজের মতো করে বুঝেছিলাম, ‘মন বস্তু নয়, বস্তু মন নয়’, যদিও এই দুটো কথার ভেতরে আমি নিজে সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম অনেক পরে, আসলে তো কিছুই বুঝতে পারি না, এই যে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে জীবন গেল, তার নিজের যে ব্যক্তিগত লড়াই, স্ট্রাগল বলা হয় যা, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামই জীবনের নিয়ম, সে কথা হিটলার বুঝুক কি আমি নিজের মতো বুঝি, আসলে তো বুঝি—একটা কিছু চাই যা নিজের মতো করে পাওয়া যাবে, ভরসা করা যাবে, আসলে কী বলব, ওই ট্রাস্ট-টাই নষ্ট হয়ে গেছে গোঁড়া থেকে, জাতিতে জাতি পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অসুস্থ প্রতিযোগিতার বলি আর গোটা জগতের মানুষ; দিব্য আরো নির্মমভাবে বলেছিল, এভাবেই দুনিয়া চলবে, যেভাবে চলে আসছে, এর তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, মাঝে মাঝে দুয়েক একজন লেনিন মাও ক্যাস্ট্রো আসবেন, কিন্তু আর কী, ফলে তুমি আমি যে গোঁড়ামিমুক্ত হয়েছি, তাতে কেবল নিজেদের মুক্তি হয়তো হয়েছে, কিন্তু এই জগতের কারোরই কিছছু যায় আসেনি, আসবেও না, আমি মনে করি, কেবল মানুষের জন্য ভালো করা ও নিজে ভালো থাকাটাই সবচেয়ে বড় কাজ, জগতের যেখানে যে লোকটা ভালোমানুষ হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, সে-ই আসলে একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট; আমার একটু হাসিও পেয়েছিল, কারণ দিব্য এত কিছু থেকে সরে গেলেও সবার উপরে কমিউনিস্ট হতে হবে, বিপ্লবী হওয়া নয়, নিজে সৎ ও সাহসী জীবনযাপন করা, বুদ্ধির সঙ্গে জীবনযাপন করা,—এমন লোকমাত্রই আসলে নিজের অজান্তেই কমিউনিস্ট—এ থেকে দিব্য সরে আসতে পারেনি, কিন্তু আমারও সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, আমি নিজেও কি সরে আসতে পেরেছি, আধুনিকতা বলতে কি আধুনিক বলতে যা বুঝি—তা ওই মার্কসবাদই, এর পর আর কিছু আসেনি, ফ্রয়েড নির্জ্ঞানের কথা বলেছেন, রাসেল ক্ষমতার কথা বলেছেন, কিন্তু সবই তো তলিয়ে ভাবলে বলা যায় আছে ওই একটাই শ্রমের ওপরে, শ্রম দেওয়া ও শোষণের ওপরে,—এটাই সব তফাত তৈরি করে দিয়েছে, কারণ শ্রম ছাড়া আর কিছুই বস্তুত সত্য নয়, ফলে রক্ত আর যাবে কোথায়, বিদেশ থেকে ফিরে আসি আশির দশকের ঠিক মাঝখানে, বড় ভাই নিজের ব্যবসায় আমাকে লাগিয়ে দেয়, সেই ব্যবসাটা দূর গ্রামে ছিল বলেই আমি রাজি হই, আমি কেন জানি না, সারা পৃথিবী ঘুরে, এত সব আধুনিক শহরে থেকে আমার শহর জিনিসটা আর সহ্য হচ্ছিল না, একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করি, আসলে করানো হয়, গ্রামের একদম সাধারণ একটি মেয়ে, যদিও সে স্কুলে পড়াত, বছর ঘুরতেই পুত্র সন্তানের পিতা, হ্যাঁ এভাবে ফের আটকা পড়ি জগতের সবচেয়ে মায়াময় কারাগার, যার নাম সংসার, পরিবার, সেই ছেলে বড় হয়েছে, বিপ্লবীর রক্ত, রাজনীতিতে বিপ্লব না করলেও কলেজ পাশ করার আগেই গোপনে বিয়ে করেছে, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, দেখিয়েছে বটে ছেলে আমার, বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি, সেই সংসার যা করার রুবিনাই করেছে, আমি কেবল টাকা জুগিয়ে গেছি, আর বসে বসে খবরের কাগজ পড়েছি, জানি না কেমন নেশার মতো জীবন না কি ঘোরের মতো জীবন, দিব্যর সঙ্গে তারপর যোগাযোগ কখনো কেটে যায়নি, মাসে না হলেও তিন মাসে কি ছয় মাসে দিব্য একটা চিঠি লিখত, এখন তো মেইল করে, ওর মেইলের উত্তর দেওয়ার জন্য, এই বুড়া বয়সে আমাকে কম্পিউটার শিখতে হলো, তারপর তো মেইলও গেল, মোবাইল ফোন এলো, এখন তো কত কিছুতে দিব্যর সঙ্গে কথা, হোয়াটস আপ, ইমো—এখানটাতেই দিব্য ফোন করল, আমার কলেজে পড়া নাতি কদিন আগে ফেসবুক খুলে দিয়েছে, তা দিয়েও যোগাযোগ হয় দিব্যর সঙ্গে, সময়কালে যা যা লাগে; সেই মেসেঞ্জারেই ফোন করেছে সে, দিব্যকে বলি, তোমার কথাই হচ্ছিল নাতির সঙ্গে, বলে, তুইই আছিস ভালো, কারো হুকুমাদরি করতে হলো না, হুকুমহীন একটা জীবন কাটিয়ে গেলি; সত্যি তো এটা কখনো ভাবিনিরে, আসলেই; দিব্য বলে, তুই বলেছিলি, তোর মনে পড়ে কিনা, বলেছিলি, যে তুই এমন একটা জীবন চাস যেখানে তোকেও কেউ হুকুম করবে না, তুইও কাউকে হুকুম করবি না, ভেবে দেখ, তুই কিন্তু সেই জীবনটাই পেলি, সত্যি, কথায় বলে না, মানুষ আসলে যা চাওয়ার মতো করে চায়, ভেতরে ভেতরে গভীরভাবে যা চায়, সেটাই সে পায়, পেয়ে যায়, ইয়ু আর সো লাকি ম্যান, আর আমি তো একটা অন্য মানুষের জীবন কাটিয়ে গেলাম, চেয়েছিলাম বিশ্ববিপ্লব, লেনিনের মতো, আর নিজের জীবনটাতেও বিপ্লব হলো না, আমি টের পাই দিব্যর গলাটা বহু বহু দিন পর একটু ধরে এসেছে, কিন্তু সে চট করে বুঝতে পেরে, একটু কেশে নিয়ে, ফের স্বাভাবিক গলায় বলে, দে তোর নাতিকে ফোনটা দে, একটু কথা বলি, আমি পাভেলকে দিয়ে বলি, তোমার দিব্যদাদু কথা বলবে, পাভেল ফোন নিয়েই বলে, আরে বলো না, দাদু বলে কী জানো, তুমিই নাকি আমাকে কমিউনিস্ট বানিয়ে দিচ্ছো, যার কোনো ভবিষ্যত নেই; ওপার থেকে দিব্য কিছু একটা বললে, পাভেল হো হো করে হেসে ওঠে, ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস থেকে আমার ছেলে ফরহাদ তার ছেলের নাম রেখেছে পাভেল, আমি পাভেলকে দেখতে দেখতে বুঝতে পারি না, আমার মধ্যে আসলে কী কাজ করছে বা করছে না।