“বাগান বিক্রি করে দিব।”
“ওখানে তিহানকে নিয়ে যাব।”
রান্নাঘর থেকে শায়লা, আর শোবার ঘর থেকে আমি বেরিয়ে দুজনে মুখোমুখি হয়ে একযোগে কথা বলে বাক্যহারা হয়ে গেলাম!
শায়লা ওড়না মুখে চেপে কাঁদতে শুরু করল, যেন শব্দ না হয়, যেন তিহানের ঘুম ভেঙে না যায়। সে বাগান বিক্রির ঘোর বিরোধী।
তাহলে এখন কি উপায়? প্রবল মাথা নাড়ে সে, জানে না। সে শুধু ছেলেকে নিয়ে আব্বার বাগানে যেতে চায়।
এটা দুদিন আগে দুপুরের ঘটনা।
আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনে ফলফলাদির গাছ নিয়ে যে বাগানটা নোঙ্গর করা জাহাজের মতো নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছে, আমার কখনো সেদিকটায় যাওয়ার আগ্রহ হয়নি। শায়লা আর তিহান মিলে সেই জাহাজটা সচল করে দিয়েছে। আমি এখন বাগানটাকে ভরসা করার মতো করে দেখছি।
লক-ডাউন উপেক্ষা করে অফিসে এসেছি। ইশতিয়াক স্যারও এসেছেন। স্টাফদের বেতন দেওয়ার আগে কিছু কাজ বাকি। ফাইলগুলো আমার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চান।
আজকে প্রথমবারের মতো হেঁটে অফিসে এলাম। শেষ কবে এতটা পথ হেঁটেছি, মনে নেই। মাস্ক মুখে, ক্যাপ, সানগ্লাস, ব্যাকপ্যাক নিয়ে বাইরে বের হওয়ার আগে ভেবেছি একটা রিক্সা অন্তত পেয়ে যাব। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা, রিক্সা তো দূর মানুষই হাতে গোনা। কিছুদূর হাঁটার পর অবশ্য শরীরের ম্যাজম্যাজে ভাব কেটে গেল। রিক্সায় যে রাস্তা চল্লিশ মিনিট লাগে, সে পথে আধঘণ্টা হেঁটে অফিসের দরজায় পৌঁছে গেলাম! দুপাশের বাড়িঘর, গাছপালা দেখতে দেখতে রাস্তার পাশের একসারি দেবদারু গাছের কচি মসৃণ পাতায় চোখ আটকে গেল! আব্বা আমাদের বাড়ির সামনে দেবদারু গাছ লাগিয়েছিল। বাড়ির পেছনে বাগানেও কি ছিল?
ইশতিয়াক স্যার আগেই পৌঁছে গেছেন। এমন নিশ্চুম অফিসেও আগে কোনোদিন আসিনি। স্বাভাবিক সময়ের সরগরম পরিবেশ মাথার ভেতর ঢুশ দিয়ে যাচ্ছে। ফোন, কম্প্যুটারের ঘড়ি এখন আর সেকেন্ডের কাঁটা দেখায় না। আমি পালস দেখার মতো ধীরে ধীরে সেকেন্ড গুনি মনে মনে। এক গোনার পর নাতিদীর্ঘ একটি শ্বাস, বুড়ো আঙুল কব্জির কাছের নীলচে শিরাতে তিনটে আঙ্গুলে অল্প চাপ দিয়ে ধরে রাখতে হবে। দুই, তিন...পাঁচ। তিহান এভাবে শিখেছে তার দাদুর কাছে। আমি শিখেছি তিহানের কাছে।
এগারটা চল্লিশে ইশতিয়াক স্যার জুতার মচ মচ শব্দ তুলে অফিস থেকে চলে যাওয়ার আগে আমাকে বলবেন—“ফাহমিদ সাহেব আর ঘণ্টাখানেক থাকেন।”
কিন্তু আমার থাকতে হবে আরো ঘণ্টা তিনেক, আমি জানি। ইশতিয়াক মাহমুদের একঘণ্টা মানে আমার তিন ঘণ্টা। আশিদিনে ভূ-প্রদক্ষিণের কাহিনীর মতো আমার সময় পৃথিবীর গতির মধ্যে হাপিশ হয়ে যায়।
এখন মাত্র দশটা বেজেছে, আমি একটা-দেড়টার আগে বের হচ্ছি না। শায়লা পাথুরিয়া যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করতে চাইছে আগামীকাল। আসলে আমারও যেতে ইচ্ছে করছে। যে ইচ্ছে আব্বা বেঁচে থাকতে তেমন একটা করেনি।
দেবদারু গাছের কি বনসাই হয়? তিহানের মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তার বনসাইয়ের শখ এখন নেশায় রূপ নিয়েছে। বাড়ির ছাদ থেকে শুরু করে আনাচে কানাচে রকমারি বনসাই। বনসাই জিনিসটা শায়লা অপছন্দ করে। শ্লেষের কণ্ঠে ভাইকে বলে—“মানুষকেও তাইলে বাইন্ধা বাইন্ধা ছোট করে রাখার ব্যবসা খুলতে পারো। এত বড় ঘরবাড়ি লাগবে না। মুরগির খোপের মতো খোপ বানায়া ঢুকায় দিয়ো। গাছেদের যে কষ্ট হয় সেইটা কি সে বোঝে?”
শায়লা নাকি শৈশব থেকেই এমন গাছ পাগল মেয়ে। বন জঙ্গলে গেলে মাথা ঠিক থাকে না। তিহানের মামা গাছ নিয়ে বোনের নানা কীর্তি বলে, উলটো বোনকে খ্যাপায়—“কপাল খারাপ তোর, এই দেশে তো আর জঙ্গল নাই, সব সাফ। বনসাই ভরসা।”
গতকালকে সকালে তিহানের জ্বর আসেনি। ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে ভাত খেয়েছে বলে শায়লাও খুশি। আমার কাছে ওকে ঘুম পাড়াতে দিয়ে সে বাথরুমে গোসল সারতে ঢুকল।
তিহানকে বুকের ওপরে নিয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি, বড় হয়ে কী হতে চায়, এসব কুটুর কুটুর গল্পে এসে আমি বললাম—“তিহান, বাইশ বৎসর বয়েসের মধ্যে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করতে হবে। তারপর তোমাকে বিয়ে করায় দিব।”
তিহানের ক্লান্ত কিন্তু তখনও উৎসাহী স্বর। বলে—“বাবা দাদুবাড়িতে বিয়ে করব? খুঁজতে হবে তো!” ছেলেটা দাদুকে ভুলতে পারে না। ওর শিশুমনের জন্য খুব তাজা স্মৃতি রেখে আব্বা না ফেরার দেশে চলে গেছে আজকে চারমাস।
আমার চোখে ঘুম নেমে আসছে, কিন্তু তবু সিরিয়াস কথা চালিয়ে যাই—“আমাদের দেশে পড়ালেখা করতে গেলে খালি খালি কতগুলি বছর নষ্ট হয়। ক্লাস ওয়ানে উঠতে প্লে-গ্রুপ, কেজি ওয়ান, কে টু কত হাবিজাবি! সিস্টেম লস। ছেলেমেয়েদের জীবন শুরু করতে ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যায়। তুই একুশ বছরে পড়া শেষ করে বাইশ বছরে চাকরি পাবি। তারপর খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দিব। বউ নিয়ে ব্যবিলন ঘুরতে যাবি।” হঠাৎ আমার ঘুমভাব চটে যায়। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি যে, এতক্ষণ ছোটবেলায় বলা আব্বার ছাড়া ছাড়া কথা ঘুরিয়ে বাড়িয়ে বলছিলাম!
“বাবা, শীত লাগে, বাবা পিঠে ব্যথা করে।” তিহানের সাত বছরের মসৃণ কপাল আগুন গরম, আবার জ্বর বেড়েছে। ও ঘুমিয়ে গিয়ে একটু পরে আবার ব্যথায় কঁকিয়ে জেগে ওঠে। শায়লা দৌড়ে এসে আমার কাছ থেকে প্রায় ছোঁ মেরে ওকে নিয়ে নিল। কম্বলে জড়িয়ে কোলে নিয়ে হাঁটে, আর নিজে গরমে ঘামতে থাকে। কালকে রাতে প্রায় সারারাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। বেরিয়ে আসার আগে ওকে জাগাইনি।
ফাইলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বাসায় বসে কাজ করব। কিন্তু পারব কি? তিহান ওর বিছানা থেকে প্রায় নামেই না বলতে গেল, অথচ পুরো বাসা জুড়েই সে। কোথায় বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারব, ভাবছি। মনোসংযোগ করার দক্ষতা আমার আয়ত্তে ছিল, কিন্তু ইদানীং বড়শি ফসকে যাওয়া মাছের মতো চলে যাচ্ছে।
এখন আমার মন পরে আছে টিফিন বক্সের লাঞ্চে। আজকে অফিসে লাঞ্চ আনতে হলো। বাইরে দোকানপাট বন্ধ, খোলা থাকলেও খাওয়া চলবে না। মিষ্টিকুমড়া নিরামিষে কালোজিরা আর রসুনের ফোঁড়ন। শায়লা আগে রুটি দিয়ে দিত, কিন্তু আজকে ভাত নিয়েছি আমি। ফ্রিজ খুলে একটা বালুসাইও এনেছি। তিহানকে দেখতে এসে ওর মামা দু সপ্তাহ আগে এনেছিল। তখন আমরা ওর পাসপোর্ট করার কথা বলছিলাম। দেশে না। মুম্বাই, না কি ঠাকুর পুকুর যাব, এইসব। ওর মামা বলছিল একেবারে বাম্রুনগ্রাদ নিয়ে যেতে। ব্লাড টেস্টের পর শিশুরোগবিশেষজ্ঞ আরো কতগুলি টেস্টের সঙ্গে বায়োপসি করতে দিলেন, তখন থেকে আমরা অস্থির হয়ে আছি, কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। এখন ঘরবন্দী দিনে দেশের ডাক্তার হাসপাতালই ভরসা। তাই এসব আর বলে লাভ নেই, বলি না। কিন্তু বিরতিহীন ভাবছি, যাব। কিন্তু যাওয়ার জন্য রসদ চাই।
বাড়ির পেছনের বাগান বেচে দেয়ার কথা শুনে শায়লা কাঁদতে শুরু করল। আব্বা কোনো কোনো ভয়াবহ বিপদেও এই বাগান বিক্রির কথা ভাবেনি, সে শুনেছে সেসব গল্প। গাছগুলো তিহান আর তার দাদুর যৌথ স্মৃতি। হেন ফলের গাছ নেই যা আব্বা লাগায়নি। একটা ভালো জাতের পেয়ারা চারা আনতে আরেক জেলায় গেছে।
আমি ধমক দিলাম—“এই সময়ে কিছু বেচব বললেই কি বিক্রি করা যায়? গাহেক পাব?”
“তিহান ঐখানে গেলে ভালো হয়ে যাবে।”
“বেকুবের মতো কথা বলবা না”—একথা শায়লাকে বলি না। ওইই ঠিক এটা বিশ্বাস করতে মন চায়।
এসব কথা তখন এক কান দিয়ে শুনে অন্য কানে যাতায়াতের পথে যেটুকু অবশিষ্ট থেকেছে, তা-ই এখন তিহানকে শোনাই।
অথচ আমি যখন হাইস্কুলে, পরিষ্কার সাদা ড্রেস, জুতো মোজা পরে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে আম্মা আঁচলে হাত মুছে কপালে চুমু খেয়ে বিদায় দেয়ার সময় আব্বা পেছনবাড়ির দরজা থেকে সুড়ুক করে হাজির হতো। তার কাদামাখা পা, হাতে মাটির দলা, দাড়িগোঁফেও আগাছা ঘাস লেগে আছে। আমার ধোপদুরস্ত কাপড় জামার পাশে আব্বা ছিল দূরের, অনাত্মীয়ের মতো। টিফিনের জন্য লুঙ্গির খুট খুলে আধময়লা টাকা দিলেও আমি বিরক্ত হতাম। হাতে ধরে আমার টিফিনের জন্য আনা গাছপাকা কোনো পেয়ারা বা আতাফল নেওয়ায় কোনো আগ্রহ ছিল না আমার।
আব্বা কি আমার মনের ভাব টের পেত? তার মুখের ওপর কড়া রৌদ্রে আচমকা মেঘের মতো একটা পাতলা ছায়া এসে নামত। বুঝতে পারলেও পাত্তা দিইনি।
আমার সঙ্গে আব্বার দূরত্বকে নিকট বানিয়ে নিয়েছিল শায়লা।
দু বছর আগে অফিসের ট্রেনিংয়ে সিঙ্গাপুর গেলাম। শায়লা বায়না ধরল পাথুরিয়ায় গিয়ে থাকবে। তিহানের স্কুল? সে নিজেই পড়াবে। দাদুর সঙ্গে নাতির প্রকৃতি পাঠ হবে। স্কুলে পিছিয়ে যাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আমি, কিন্তু শায়লা শুনলে তো! একবছর না কি দেখতে দেখতে কেটে যাবে, এটা নাকি তিহানের জন্য বিরাট সুযোগ। অবশ্য ঢাকায় একা বাসায় মা ছেলে থাকার চেয়ে গ্রামের বাড়ি নিরাপদ, এই যুক্তি মেনে নিতেই হলো। ভাইয়ের বাসায় কিছু জিনিসপত্র রেখে তারা পাথুরিয়া গেল।
সেই একবছরে মুখচোরা লাজুক ছয় বছরের ছেলেটা দিন দিন দুরন্ত হয়েছে। শায়লা খুশিতে ডগমগ করতে করতে খবর দিত—আজকে তিহান নারকেল গাছ বেয়ে ওপরে উঠেছে। দাদুর সঙ্গে খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়েছে। পরেরদিন, সে ভাত খায়নি, বড় এক ফজলী আম একবসায় খেয়ে ঘুম দিয়েছে। সাঁতার শিখছে! দাদুর সঙ্গে মাছ ধরতে গেছে। নাতির জন্য খেলনা কাস্তে এনেছে দাদু, ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছে। সফেদা ফল খেতে ভালোবাসে বলে গাছের সব ফল পেড়ে খাটের নিচে রেখে দিয়েছে। কাদামাটি মাখা তিহানের ছবি তুলে পাঠায় শায়লা। আমি রাগ করতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করি। আর মাত্র কয়েকটা মাস, তারপর পাথুরিয়া যাওয়া বন্ধ। পড়ালেখা বাদ দিয়ে যত্তসব হাবিজাবি শেখায় উৎসাহ।
এক বৎসরকাল দাদুবাড়িতে কাটিয়ে তিহান ফলের বাগান সমন্ধে রাজ্যের তথ্য নিয়ে ফিরেছে। ওর অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার অনীহাপ্রসূত স্মৃতি জোড়াতালি দিতে গেল ধরা পড়ে যাই।
তিহান ডাইনে বাঁয়ে মাথা দোলায়, বলে—“হলো না বাবা, আরেকটু ঐদিকে, লম্বা কদবেলগাছের পাশে দাদুর যে মিস্রিদানা আম আছে না? তারও আরেকটু পরে মিষ্টি জামগাছ। ঐ জাম খেয়ে আমি আর দাদু জিভের রঙ বেগুনী করে ফেলতাম।”
আমার স্কুলজীবনে ঐ জামগাছটা কি ছিল?
“আর তুমি তো আমাদের পাতার ঘর দেখোই নাই। দাদু ঐ জামগাছের নিচে একটা সত্যি সত্যি সবুজ পাতার ঘর বানায় দিছিল আমাকে! আমরা ওখানে দুপুরে ঘুমাইছি। ঝি ঝি পোঁকা কানে তালা লাগায় ডাকত। দাদু আমাকে নারকেল পাতা দিয়ে কত কিছু বানায় দিত! ঘড়ি, আংটি, মুকুট। আর বলত—আমি হচ্ছি পাতা রাজকুমার, হি হি হি।”
ঐ ঘর আছে এখনো?
জাহান্নামে যাক বাগান। বিক্রির বাজারদর যাচাই করতে এখানে সেখানে ফোন করি। যত দ্রুত পারা যায় বিক্রি করতে হবে। তিহানের ডাক্তার চেম্বারে বসছে না। ফোন করলে ধরছেও না।
পিজি হাসপাতালে শায়লার ভাইয়ের বন্ধুর পরিচিত ডাক্তার আছে, তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছি।
এগারোটা পঁচিশ। অফিসের সময় কি নড়ছে না? অনেকদিন হলো হাতঘড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছি। হাতঘড়ি তিহানের খুব পছন্দ। সিঙ্গাপুর থেকে ওর জন্য একটা ক্যাসিও ঘড়ি এনেছিলাম। মিনিটের পর সেকেন্ডগুলি লটারি খেলার স্লট মেশিনের বলের মতো সরসর করে নেমে যায়। আজকাল ঘড়িটা নিয়ে তিহান বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে। চারপাশে অনেকগুলো হাবিজাবি খেলনা ছড়িয়ে রাখে, স্পাইডার ম্যান, লোগোর বাক্স। একেক সময় সে তার ঘড়ির ছোট নীল রঙ প্লাস্টিকের ডায়ালের দিকে পলক না ফেলে চেয়ে থাকে। তখন মনে হয় যে, সাত না। ওর বয়স অনন্তকাল। আগের মতো খেলার জন্য হুটোপুটি করে না। ফ্যানের বাতাসের সঙ্গে সখ্য করতে বাইরের বাতাস উড়ে এসে ঢোকে। বারান্দার গ্রিলে অহেতুক একটা ধূসর পাখি এসে বসে। গুরুক গুরুক ডাকে। তিহান চমকে একঝলক দেখে। তারপর আবার ঘড়ির ডায়ালে চোখ ফেরায়।
দুদিন হলো ঘড়িটায় সেকেন্ডের সংখ্যাগুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। আগের মতো গড়গড়িয়ে জলপ্রপাতের মতো নামছে না। কোনোভাবে পানি ঢুকে গেছে কি? তিহানের ফুসফুসের মতো! ওর মিনিট থেকে সেকেন্ডের সংখ্যাগুলি নাই হচ্ছে?
তিহান কালকে রাতে কিছু খেতে চাইছিল না। শায়লা খাবার নিয়ে যতবার মুখের কাছে ধরছে, ততবার সে বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল। ওর ছলছল চোখে বুকভর্তি বিতৃষ্ণা। অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে একসময় শায়লা আবারও ওড়নায় চোখ চেপে শোবার ঘরে ঢুকে গেল শায়লা।
কিছুসময় পরে শান্ত হয়ে ফিরল। ছেলের কাছে বসে বলল—“দাদুবাড়ি যাবি?”
তিহানের চোখ যেন চকচক করে উঠল!
“আমি ভাইয়াকে বলছি গাড়ি ভাড়া করতে। আমরা পাথুরিয়া যাচ্ছি।” তারপর স্যুটকেস নামিয়ে কাপড় গুছিয়েছে শায়লা।
এগারোটা পয়তাল্লিশ বাজল। ইশতিয়াক স্যার বেরিয়ে গেল। এবার আমি একহাতে টিফিনবক্স খুলি।
অন্যহাতে একটা করে অক্ষর টিপে বিক্রয় বিজ্ঞপ্তি টাইপ করতে থাকি “এক বিঘা জমিতে অতি যত্নে তৈরি ফলদায়িনী গাছভর্তি বাগান বিক্রি হবে। ”
ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। একপাশে সরিয়ে রেখে শুরুতেই বালুসাইতে কামড় দিলাম। চিনির সঙ্গে দাঁতের ফাঁকে বালু কড়মড় করে উঠল।