পাঁচজন আমেরিকান কবির কবিতা

অনুবাদ কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

ভূমিকা ও অনুবাদ: রাজিয়া সুলতানা | 2023-09-01 18:12:52

চার্লস সিমিককে বর্তমান সময়ের এক অনন্যসাধারণ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর জন্ম সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেদে ১৯৩৮ সালে। ১৯৫৪ সালে বাবার সাথে যোগ দিতে তিনি মা এবং ভাইয়ের সাথে আমেরিকায় চলে আসেন। পরে সেখানেই নাগরিকত্ব নেন। একুশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই হোয়াট দ্য গ্রাস সেইজ। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন একাডেমিক ফেলোশিপ এবং পুলিৎজারসহ বহু পুরস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলগ্রেদে নিজের শৈশব এবং কৈশোরে যুদ্ধের যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয় তাঁর, পরবর্তীতে সেই অভিজ্ঞতাই তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে আধুনিক জীবনের আত্মিক শূন্যতার কথা।

আংশিক ব্যাখ্যা
চার্লস সিমিক

মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ হলো
ওয়েটার আমার খাবারের অর্ডার নিয়েছে।
দুপুরের খাবারের এই রেস্তোরাঁটা খুব ছোট আর নোংরা
বাইরে বরফ পড়ছে।
মনে হচ্ছে আরো বেশি অন্ধকার হয়ে এসেছে
আমার পেছনে যখন শেষবার রান্নাঘরের দরোজার শব্দ পাই
তখন লক্ষ করি রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে।
বরফ দেওয়া একগ্লাস পানি
আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে
এই টেবিলে প্রথমে ঢুকেই জায়গাটা আমি বেছে নিয়েছি।
এরপর তৃষ্ণা জেগেছে এক
অসম্ভব এক বাসনায়
রাঁধুনেদের কথোপকথন
শোনার জন্য আড়ি পেতেছি।


মেরি কর্নিশের জন্ম ১৯৪৮ সালে। প্রধানত লেখক এবং শিশুদের বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী। তিনি তাঁর শেষজীবনে কবিতার দিকে ঝুঁকেছিলেন যখন তিনি সারাহ লরেন্স কলেজে ক্রিয়েটিভ ননফিকশনের ওপর কোর্স করতে যান।কবিতায় গৃহস্থালীজীবনের ওপর চিন্তাশীল তদন্তকার্য চালানোর জন্য তিনি সুপরিচিত। কবিতায় শিল্প, দক্ষতা এবং অতীতের মাঝে সম্পর্ক অন্বেষণে তিনি নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর কবিতাসংকলনের নাম রেড স্টুডিও (ওবার্লিন কলেজ প্রেস থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত)। তিনি ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।

সংখ্যারা
মেরি কর্নিশ

সংখ্যাদের উদারতা আমার পছন্দ
যেভাবে ওরা কোনোকিছু বা কাউকে গণনা করেঃ
দুটো আচার, ঘরে যেতে একটা দোর
রাজহাঁসের পোশাকে নর্তকী আটজন।

যোগ অংকের গৃহস্থালী আমার পছন্দ—
দুইপেয়ালা দুধ যোগ করো আর নাড়ো
প্রাচুর্য্যের বোধটাই ধরোঃ মাটিতে ছয়টা বরই
গাছ থেকে পড়ছে তিনটে আরো ।

আর গুণনের বিদ্যায়
মাছ দিয়ে যদি মাছ গুণ করো,
নৌকোর ছায়ার নিচে রুপোলি শরীরে তাদের জন্ম।

এমনকি বিয়োগেও নেই ক্ষতি কোনো
অন্য কোথাও তো হচ্ছে যোগ-বাড়ন্ত
ধরো পাঁচটা চড়ুই, তাত্থেকে নিলে দুটো
অন্য কারো বাগানে এখন ওদের দিব্যি পাচ্ছ।

ভাগ অংকেও রয়েছে বিস্তার,
‘টেক আউট’ চাইনিজ খাবারের বাক্স যদি খোলো
ভাঁজ করা প্রত্যেক কুকির ভেতর
খুলে যাবে নতুন এক ভাগ্য।

বিস্মিত হই না কখনো
উপহারে যখন বেজোড় অবশিষ্ট,
এবং অবশেষে মুক্ত
সাতচল্লিশকে এগারো দিয়ে ভাগ করো
পাবে চার ভাগশেষে রবে তিনও।

তিনটে বালককে মা ফোন করে পাচ্ছে না
দু’জন ইতালীয় সমুদ্রের দিকে গেছে
একটা মোজা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না


ক্যারল স্নো কবি ও লেখক। তাঁর ছয়টি কবিতাগ্রন্থের মধ্যে প্লেসড কেউরসেন্সুই [২০০৮] উল্লেখযোগ্য। তাঁর কবিতাকে বর্ণনা করা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক হিসেবে—যেটি অর্ধেক দেখা, অর্ধেক স্মরণের মাঝে ঘুরপাক খায়। সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন পুশকার্ট পুরস্কার।

ভ্রমণ
ক্যারল স্নো

জাপানে এক মন্দিরের কাছে সে পথে ঝাড়ু দিত
তারপর ক্যামেলিয়া ফুল বিছিয়ে রাখত সেখানে

অথবা—জানার কোনো উপায়ই নেই—
সে সেই পথে ঝরে পড়া ক্যামেলিয়াগুলোর মাঝখানে ঝাড়ু দিত কিনা


ট্রেসি কে. স্মিথ ম্যাসাচুসেটসে ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে উঠেছেন নর্দান ক্যালিফোর্নিয়ায়। এ যাবত তাঁর চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বডি’স কোয়েশ্চেন [২০০৩ ] বইটির জন্য কেইভ কানেম পুরস্কার পান। যেটি আফ্রো-আমেরিকান লেখক হিসেবে তাঁর সেরা প্রথম বইয়ের জন্য দেওয়া হয় তাকে। লাইফ অন মার্স [২০১১] বইটির জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন ২০১২ সালে। তিনি আমেরিকান পোয়েট লরিয়েট হিসেবে ছিলেন ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত। তাঁর কবিতায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জীবনের গভীর সত্য বিশেষ করে তাদের সমাজ-সংস্কৃতি এবং টিকে থাকার যুদ্ধ বিশাল জায়গা অধিকার করে আছে। তবে নারীসত্তার গহন-মগ্ন উদ্ভাস পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়, যা তাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ান।

উত্তম জীবন
ট্রেসি কে. স্মিথ

যখন কেউ টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলে
এবং এমনভাবে বলে যেন এগুলো কোনো রহস্যময় প্রেমিক অথবা প্রেমিকা
যারা দুধ ক্রয় করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি,
ভাবতে ভাবতে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি
কতগুলো বছর যে আমি শুধু কফি আর রুটির ওপর বেঁচে ছিলাম,
পেটে খিদে থাকত সারাক্ষণ, বেতন পাবার দিন সেই স্ত্রীলোকটির মতো পায়ে হেঁটে কাজে যেতাম
গ্রামে কুয়ো না থাকায় পানি সংগ্রহের জন্য যে অন্যগ্রামে যেত
তারপর এক কি দুই রাত অন্য সবার মতন
চিকেন-রোস্ট আর রেড ওয়াইন খেয়ে বেঁচে ছিলাম।


স্টিভ কোইট নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন (১৯৩৮-২০১৫)। তিনি একাধারে কবি, প্রবন্ধকার, শিক্ষক ও ওয়ার্কশপের কাজে সহযোগী। তরুণ বয়সে কফিশপে নিয়মিত কবিতা পড়েছেন। ঘোর যুদ্ধবিরোধী, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকান সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি, বরং সেই যুদ্ধকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আমেরিকা কতৃক ভিয়েতনামী মানুষদের পশুর মতো বধ করার আয়োজন’ বলে। পুশকার্ট পুরস্কারসহ পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। কবিতার পাশাপাশি তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্ম পাবলো নেরুদার, ইনসাইটমেন্ট টু নিক্সনিসাইড এন্ড প্রেইজ ফর দ্য চিলিয়ান রেভ্যুলেশন-এর ইংরেজি অনুবাদ। তাঁর তেরটি কবিতাগ্রন্থের মধ্যে চেরিশঃ নিউ এন্ড সিলেক্টেড পোয়েমস (২০১৫) অন্যতম।

কিছু মেঘ
স্টিভ কোইট

এখন যখন ফোন খুলে রেখে দিয়েছি,
কেউ আর আমাকে পাবে না—
অন্তত এই বিকেলে তো নয়
এখন আমার পরামর্শ আর মতামত ছাড়াই তাদের চলতে হবে।
এখন কেউ আর আমাকে কল করবে না
দ্বিধান্বিত কণ্ঠে শুধাবে না
একদা যে মেয়েটিকে আমি ভালোবাসতাম
তার মৃত্যুর খবর আমি শুনেছি কি না—
শহরের ওপর যে ছাইগুলো উড়ছিল যেখানে সেখানে
সেগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হয়েছে।
জ্বি, ধন্যবাদ, আমি শুনেছি।
আজ সকালটা এত সুন্দর ছিল যে
তারই আমাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল।
সূর্যটা ছোট কমলালেবুগুলোকে মাতাল করে তুলেছে
আর জ্বলজ্বলে লাল আর হলুদ ফুলগুলো যেন অযুত মোমবাতি।
আজকের এই বিকেলে আমাকে তাদের ছাড় দিতে হবে
অনেক আগের ঘটনাগুলো আবার ঘটছে সেগুলো দেখতে আমি ব্যস্ত
জোসেফিনের বাগানে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দেখছি অসম্ভব নীল আকাশ,
ভেঙে গেছে—বলা যায়—
সাদা সাদা অসম্ভব কমনীয় উত্তাল কিছু মেঘের তরঙ্গ
এক শূন্যগর্ভ থেকে আরেক অনস্তিত্বে ধাবিত হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর