সম্ভবত ২০০৬ সালের ঘটনা। পূর্ব লন্ডনের কোনো এক জায়গা থেকে লুইশামের দিকে যাওয়ার জন্য বাস স্টপের দিকে যাচ্ছিলাম। টের পেলাম আচম্বিতে এক দলা শ্লেষা-মিসাইল আমার হেড অফিসের টার্ফের ওপর এসে অবতরণ করেছে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার স্বতঃস্ফুর্ততায় পিছন ফিরে দেখলাম, এক শ্বেতকায় লোক জগৎ সংসারকে থোড়াই কেয়ার করে আপনমনে আমার পিছন পিছন হাঁটছে। চলন্ত অবস্থাতেই শুভ্র বর্ণের কিন্তু কৃষ্ণ মনের দ্বিপদীর সুরত পড়ে বুঝলাম, এ বান্দা ‘সরি’ বলার চিজ নয়। ক্রুর চেহারায় তার লিখিত আছে কদর্য এশীয়র প্রতি তামাম জাহানের সমস্ত তাচ্ছিল্য বা ঘৃণা। জন্তুটার রক্তহিম করা চাহনি-তাড়িত হয়ে জোর কদমে হাঁটতে শুরু করলাম। শরীরগুলানো অনুভূতি আর বিবমিষাভাব নিয়ে হাঁটার মধ্যেই একরাশ স্বস্তির হিমেল হাওয়া হয়ে সামনে হাজির হলো লন্ডনের আইকনিক ডাবল ডেকার রেড বাস। ‘মাবুদ তুমি সহায়’ জাতীয় বিশ্বাস-জারিত আনন্দ নিয়ে নিজেকে শকটোদরে নিক্ষেপ করে ককেশীয়র ক্রোধ-সুনামি হতে রক্ষা পেলাম।
২.
মুখের তূন থেকে লালা-তীর নিক্ষেপ করে ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করার এই Paralinguistic habit উত্তর-দক্ষিণ, পুব-পশ্চিম, ঈশান-নৈঋত সর্বত্র বর্তমান। করোনার এই দহনকালে শ্লেষা-শর নিক্ষেপের বেশ কিছু ঘটনা সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন, প্যালেস্টাইনিরা জানাচ্ছে, হালে ইজরাইলিরা তাদের ঘরের দরজার নব বা গাড়ির দরজায় পরিকল্পিতভাবে থুতু লেপন করে আরবদেরকে করোনায় কুপোকাত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। আহা! কী ভয়ঙ্কর চরিত্র-বৈপরীত্য! যে জাতি দেখা সাক্ষাতে একে অপরকে Shalom (শান্তি) বলে কথাবার্তা শুরু করে, তাদের দ্বারা অশান্তির এমন সযত্ন চাষবাস সত্যিই পীড়াদায়ক। ইসহাক-সূতদের প্যালেস্টাইনের জলপাই বাগানে এই ঘৃণা-বিষবৃক্ষের সযত্ন পরিচর্যা সম্পর্কে নবনীতা দেবসেন তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে কিছুটা আলোকপাত করেছেন। নবনীতা তাঁর ‘ডেমাস্কাস গেট’ শীর্ষক রচনায় জেরুজালেমের জনৈক আরবের বাড়িতে কফি খেতে গিয়ে দেখেছেন আরবদের বাড়ির দেয়ালে আর দরজায় উৎকীর্ণ ঘৃণা-শব্দ (Hate words)। ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা রাতের বেলা সদলবলে এসে আরব পাড়ায় এই গ্রাফিতি-মাস্তানি করে বেড়ায়। তার সাথে এখন যোগ হয়েছে করোনা ছড়ানোর মহৎ মিশন! অন্যদিকে, ভারতে উগ্রবাদী শিবির অভিযোগ করেছে, মুসলমানরা ফলমূল, দুধ ইত্যাদিতে থুতু ছিটিয়ে বিক্রি করে হিন্দু নির্মূল অভিযানে নেমেছে! ইসলামোফোবিক গোষ্ঠী একে ‘করোনা জিহাদ’ আখ্যায়িত করে টুইটারে বেশ শোরগোল পাকিয়েছে। নিজামুদ্দীনের ঘটনার প্রেক্ষিতে এই অভিযোগ ভারতের সাধারণ্যেও কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
৩.
রাজনৈতিক বলয়ের বাইরেও থুতুর যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে। ক্রীড়াঙ্গনে, বিশেষ করে ফুটবলে, লালার রয়েছে দর্শনীয় দাপট। শাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গানের উন্মাতাল ভিডিওতে আমরা ক্রোয়েশীয় এক জাঁদরেল খেলোয়াড়কে মাঠে থুতু ফেলতে দেখি। বাস্তবেও ফুটবল মাঠে খেলোয়াড়দের থুতু ফেলা একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। খেলাটির সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই মহাতারকা মেসি আর রোনালদোও প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে থুতু মারার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। আর্সেনালের প্যাট্রিক ভিয়ারাতো ওয়েস্টহ্যামের নেইল রুডককে থুতুসিক্ত করে প্রায় ৬০০০০ ডলার জরিমানা গুনেছিলেন। তবে ফুটবলে সবচেয়ে উর্বর থুতু উৎপাদকের স্বীকৃতি আর রেকর্ডটা এখনো সাবেক লিভারপুল ফরোয়ার্ড, সেনেগালের খেলোয়াড় এল হাজি দিউফের দখলে। আর ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তেজনাময় থুতু ছিটানোর ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯০ বিশ্বকাপে জার্মানি বনাম নেদারল্যান্ডস ম্যাচে। হাই প্রোফাইল এই খেলায় নেদারল্যান্ডসের ফ্রান্ক রাইকার্ড জার্মানির রুডি ভয়েলারকে থুতু মেরে শাস্তি পেয়েছিলেন। পদগোল্লা ক্রীড়ার বাইরে, বেসবলেও আমরা খেলোয়াড়দের থুতু-তাড়িত হতে দেখি। আবার, তুলনামূলকভাবে অভিজাত বা ধ্রুপদী-ঘরানার খেলা, যেমন গলফ এবং টেনিসে থুতুবাজির কোনস্থান সচরাচর দৃষ্ট হয় না। তাহলে কিছু খেলায়, বিশেষ করে, গতিময়, শারীরিক পরিশ্রম প্রধান খেলায় লালা-লীলার শানে নুজুল কী? খেলার মাঠে থুতুকর্ম কি কেবলই রুচি, সামাজিক মর্যাদা বা শ্রেণীর প্রশ্ন? গবেষকরা বলছেন, যেসব খেলায় প্রচুর দৌড়াদৌড়ির ব্যাপার রয়েছে, সেখানে কোনো খেলোয়াড় হঠাৎ পড়ে গেলে বা ট্যাকলের শিকার হলে শারীরবৃত্তীয় কারণে তারা মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়। এসময় মুখের ভিতর মিউকাস বা লালা জমে বা অনেক সময় মুখের অভ্যন্তরে শুকিয়ে যাওয়া ভাব হয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা বেশির ভাগ সময় থুতু ফেলে। এর অন্যথাও অবশ্য হয়। সেক্ষেত্রে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হয়, যেমনটি আমরা ভিয়েরা বা রাইকার্ডের ব্যাপারে দেখেছি।
৪.
ধর্মীয় বা জাতীয়তাভিত্তিক পরিচিতি, মূলধারার ক্রীড়াঙ্গন, জাতিতাত্ত্বিক পরিচিতি, সর্বোপরি রাজনীতি এসব জায়গায় থুতুর সিরিয়াস প্রয়োগ যেমন আছে, ঠিক তেমনি থুতু নিয়ে আছে বেশ কিছু হালকা বিনোদনধর্মী টুর্নামেন্টও। যেমন, মার্কিন মুলুকের মিশিগানে অনুষ্ঠিত হয় ‘Cherry Pit Spitting Competition’। এতে একটি পাত্র থেকে চেরিফল মুখে পুরে নিয়ে নির্দিষ্ট দিকে ছুঁড়ে দিতে হয়। যার চেরি লালা-সান্দ্র হয়ে যত দূরে যাবে, তার পয়েন্ট তত বেশি। এই ট্রাম্পচাচার দেশের দক্ষিণাঞ্চলেই আয়োজিত হয় থুতুভিত্তিক আরেকটি চ্যাম্পিয়নশিপ যার নাম ‘Watermelon Seed Spitting Competition’। নামেই বোঝা যাচ্ছে মুখগহ্বর থেকে সজোরে লালাসিক্ত তরমুজ বিচি উদ্গীরণ ক্রীড়া এটি। আরেকটি বিখ্যাত থুতুক্রীড়া অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় যার নাম ‘Kudu Dung Spitting Tournament’। এটি আফ্রিকার নাটাল আর ইস্টার্ন কেপ অঞ্চলে রীতিমতো এক পর্যটন আকর্ষণ! কুডু নামের একধরনের এন্টিলোপের শুষ্ক বিষ্ঠাগোল্লা মুখের অভ্যন্তরে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারাই হচ্ছে এই খেলাটির মূল বিষয়।
৫.
থুতুর সমাজতত্ত্ব (Sociology of spitting) নিয়ে আলোচনায় শিল্প, সাহিত্য আর চলচ্চিত্রকে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। থুতু বিষয়ে লেখকদের মনোভাব কী? শেক্সপিয়ারের কথাই ধরা যাক। তার Richard II-তে থমাসকে আমরা বলতে শুনি, “I do defy him and I spit at him/ Call him a slanderous coward and a villain”। থুতুর সার্বজনীন দ্যোতনাকে ধারণ করে এভনরাজের Henry IV (Part1) নাটকে Falstaff-কে বলতে দেখি, “I tell thee what, Hal, if I tell thee a lie, spit in my face”। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মার্কিন রাজধানীতে থুতুর থিকথিক উপস্থিতি দেখে চার্লস ডিকেন্স বলেছিলেন, “Washington can be called the headquarters of tobacco-tinctured saliva”। ইংরেজি ভাষার হালের লেখকদের মধ্যে সালমান রুশদি তার Midnight’s Children এ Spittoon-এর মাধ্যমে থুতুর প্রসঙ্গ এনেছেন। বলা প্রয়োজন, রুশদি এখানে Silver spittoon টিকে, যা আমিনার বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে দেওয়া হয়েছিল, প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই রুপালী চিলমচি সালিমের করুণ বর্তমানের সাথে হৃত অতীতের সেতু বন্ধন রচনা করেছে।
শিল্প সংরক্ষণবাদীরা থুতু কীর্তনে রুশদির চাইতে বেশ কয়েক কাঠি সরেস। তারা মনে করেন, লালা অতি মূল্যবান ছবি বা বিরল শিল্পকর্মের দাগ দূরীকরণে সবচে কার্যকরী।
আর চলচ্চিত্রে তো থুতুকে Non-verbal communication-এর বেশ শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হিন্দি ছবি ‘শোলে’র কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। ছবিটিতে আমরা কিংবদন্তীতুল্য চরিত্র গব্বর সিংকে দেখি বারবার থুতু ফেলে সমাজের উঁচু শ্রেণীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে।
৬.
তাহলে, সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, থুতু কি শুধুমাত্র হিংসা, ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে? মোটেই না। এক্ষেত্রে থুতু অন্য Non-verbal behaviour থেকে দ্যেতনায় অনেক এগিয়ে। যেমন ধরুন, আপনি ভয় পেলেন, অমনি একটু থুতু বুকে লাগিয়ে ভয় দূর করেন। অনিন্দ্য সুন্দর বাচ্চার কেউ তারিফ করল, সাথে সাথেই মাতৃদেবী বাচ্চার শরীরে প্রতীকী থুতু ছিটিয়ে দেন নজর কাটানোর জন্য। অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য তিনবার থুতু দেওয়ার রীতি প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। আর কেনিয়ার মাসাই গোষ্ঠীর লোকেরা তো খুব সম্মানিত কারো সাথে করমর্দন করতে গেলে হাতে লালা মালিশ করে নেয়। এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি বা সৌজন্যের পরিচায়ক! আবার থুতু ছিটিয়ে প্রশংসাও যে করা যায় সেটা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে Punk Movement-এর কর্মীরা। তাহলে দেখুন, সামান্য থুতু কী পরিমাণ দ্যোতনা-ধনী (Connotation-rich)!
৭.
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ‘থুতু’ বিষয়টাকে ‘ওয়াক থু’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার বিশেষ সুযোগ নেই। থুতু, যা কিনা গাঠনিকভাবে ৯৮% পানি আর বাকি ২% মিউকাস, এনজাইম, ইলেকট্রোলাইট, ইমিউনোগ্লোবিউলিন, মানুষের অস্তিত্বের সমার্থক। কারণটা জলবৎ তরলম—লালা তৈরি না হলে মানুষ খাবার খেতে পারত না আর খেতে না পারলে মানুষের অস্তিত্ব কি থাকত?
মানব অস্তিত্বের এরকম প্রধান একটি অনুষঙ্গ অর্থাৎ থুতু এশীয়বাসীদের জন্য একটি বিশাল তোহফা নিয়ে এসেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি Spit personality বা থুতু-ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ আমার আপনার সাথে এই মহাদেশের জল-হাওয়াতেই বসবাস করে! এ বিষয়ে আমাদের মহাদেশীয় অর্জনের আরেকটা স্বীকৃতি মুক্তমুখে দিয়েছেন বৃব্রিটিশ সমাজ বিজ্ঞানী রস কুম্বার। আমাদের সাফল্যে নুতন পালক যুক্ত করে রস সাহেব সরসভাবে বলেছেন—“China, India and Indonesia are global capitals of phlegm”। ঢাকার জন্যও এই সম্মান বয়ে আনতে, তিলোত্তমা নগরীর দেয়ালে দেয়ালে অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্রের মতো থুতু-শ্লেষা-পানের পিকের ত্রয়ী শিল্পকর্মের চির-চলমান প্রদর্শনী দেখে মনে হয়, আমাদের খুব বেগ পেতে হবে না। চলুন, আমাদের আপন মহাদেশীয় থুতু-ভ্রাতৃসংঘে (Spitting fraternity) যোগদান করে থুতুতন্ত্র (Salivocracy) কায়েম করি!