চরিত্র :
নিরি (ছয় বছরের বালিকা, চঞ্চল)
মা (বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, মধ্যবিত্ত মুখ),
বাবা (বয়স চল্লিশ প্রায়, কাঁচাপাকা চুল আর চেহারায় আভিজাত্য)
বৃক্ষ (মাঝারি সবুজ নারিকেল গাছ, চিরল-বিরল পাতা তার)
ব্যাঙ (বেশ বড়সড় কোলাব্যাঙ)
কথক :
বহুদিন আগে,
পাতালের অন্ধকারে অন্য এক জগৎ ছিল
কেবল যেখানে শুধু উন্মুক্ত প্রান্তর, আর শীতল রাতের গন্ধ
সারাদিন ওম ধরা ম্লান রোদে সব যেন হৃদয়ের কাছে নুয়ে আছে।
ওইখানে মানুষের মনে কোনো ব্যথা নেই;
দিনে কোনো তাড়া নেই।
সব ছিল সুনশান—পরমায়ু উৎসব—
কিন্তু একদিন রাতে অজানা কারণে,
কিংবা হয়তো কারণ নেই কোনো—
কৌতূহলী শরীরে কেবল
গোলাপের ভাঁজে উড়ে, জোছনায় নিঝুম লুকিয়ে
চিহ্নহীন হয়ে গেল এক পাতালকুমারী।
বাইরে প্রথম...
পৃথিবীর আলো তাকে অন্ধ করে দেয়—
উড়ে যায় স্মৃতিগুলো।
দুইদিন পর তাকে মরে যেতে হয়।
তবু তার পিতা বিশ্বাস করত
একদিন সে আবার ফিরে আসবে কোথাও
সম্ভবত অন্য কোনো দেহে,
অন্য কোনোখানে,
অন্য কোনো ইতিহাসে।
..................
দৃশ্য : ০১
[গাড়ি চলছে, মায়ের সঙ্গে
বালিকা একটা মেয়ে।
পুরাতন গাড়ি—মাটির সরল পথ,
গাড়ি দোলার অভ্যাসে মনে হয়
নিচে যেন জলাভূমি।
পথের দুধার ঘেঁষে ঘন বনভূমি]
—মা, আমরা কোনখানে যাচ্ছি? শহর ছাড়ছি কেন?
—আমরা চলেছি তারা গুনতির দেশে, সেখানে মেঘের পরে মেঘ
আর সবুজের ঘ্রাণ মহাকায় মেলে আছে।
—রূপকথার মতন কোনো কিছু আছে?
—তুমি সারাদিন এসব আজব ভাবো কেন? এসব শুধুই গল্প ভেবো।
বলো যেন গাড়ি থামে—আমাকে নামতে হবে—কিছুটা হাঁটতে হবে।
ঝাঁকুনিতে বাড়ছে ব্যথাটা—কিছুদিন বাদে আসবে তোমার ভাইটা।
[গাড়ি থামে, থেমে থেমে হেঁটে হেঁটে, কুসুম নরম স্বস্তি আসে।
পেটে ব্যথা কমে,
নিরি এ সময়ে বনের ভেতর গিয়ে
যেন কিছু দ্যাখে]
—নিরি, আর যেও না ওদিকে, ফিরে এসো। আমরা এখন যাত্রা শুরু করবো আবার।
—মা, একটা পরী দেখেছি ওখানে।
—এসব চোখের ভুল। মন দিয়ে শোনো—আমরা একটু পরে যেখানে তোমার বাবা থাকে, সেখানে পৌঁছাব।
তাকে বাবা ডাকবে, বুঝেছো? আমি চাই তুমি বাবা ডাকো। সেটা তোমার জন্যই ভালো। এটা কেবল একটা শব্দ।
—তিনি আমার বাবা নন। আমার বাবার এরকম ধনী নন। তিনি মারা গেছেন অনেক আগে।
—যা বলেছি সেটা শোনো মা আমার।
[নিরি চুপ থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা
একটি সুন্দর খোলা, মাঠ-ঘেরা বাড়ি পৌঁছে।]
—প্রিয়তমা স্বাগতম। আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না তোমার। আমার সন্তান, ও তো ভালো আছে?
[গর্ভবতী-পেটে হাত রেখে] এইতো নড়ছে, সম্ভবত বাবাকে চিনেছে, আহা! হয়তো গাইছে।
—ভেবো না, ও ভালো আছে।
—নিরিকে কোথায় রেখে এলে?
ওকে তো দেখছি না।
[নিরিকে গাড়ির অন্য পাশ থেকে দেখা যায়]
—এই যে বালিকা কেমন আছো?
[নিরি ভ্রূক্ষেপ করে-না। মাঠের ভেতর দিয়ে বনের নিকটে দৌড় দেয়।
সেখানে পুরোনো কুঠিবাড়ি—পরিত্যাক্ত। ধীরে ধীরে সে ভেতরে ঢোকে।]
দৃশ্য ০২
[নিরি চোখ খোলে। বিছানায় শুয়ে আছে। তার দিকে মা তাকিয়ে]
—আমাকে না বলে ওদিকে গিয়েছো কেন?
—মা, একটা পরী দেখেছি ওখানে।
—চুপ করো। সেখানে অজ্ঞান পড়ে ছিলে।
তোমাকে রহিমা খালা না-দেখলে হতো কী-যে!
এখন দরজা আর আলো বন্ধ করো, যাও সোনামনি।
[নিরি মায়ের আদেশ শোনে]
—এবার আমার কাছে এসো। লেপের তলায় ঢোকো। তোমার পা জমে গিয়েছে দেখছি।
মা আমার—আমাকে না বলে, এভাবে কোথাও আর যাবে না, বুঝেছো?
তোমাকে খুঁজতে কষ্ট হয়। আমি এই দেহ নিয়ে হাঁটতে পারি-না।
তুমি কি শুনছো?
[নিরির দু’চোখ জানালার ফাঁক গলে বাইরের অন্ধকারে ওড়ে।
সেখানে চাঁদের আলো, আর সাদা কিছু নড়ে]
—ভয় পাচ্ছো তুমি?
—বাইরে কিসের শব্দ, কেউ কি ওখানে থাকে মাগো?
—কিছু না, বাতাস হবে। শহরের রাত থেকে এখানে গ্রামের রাত কিছুটা আলাদা। শহরে প্রচুর গাড়ি চলাচল করে। এখানে সেসব শব্দ নেই। এখানের বাড়িগুলো বেশ পুরাতন। হাওয়ায় টিনে শব্দ হয়। কখনো দরজা ক্যাচ-ক্যাচ করে। ঘুম দাও। সকালে অনেক কিছু নতুন দেখবে। খেলার অনেক সাথি পাবে। এখন ঘুমাও।
—মা একটা গল্প বলো—
—অনেক দূরের দেশে, বিরাট পর্বত ছিল।
সেইখানে পাথর কেবল কালো।
সূর্য অস্ত যেত ঠিক পাহাড়ের মাথার ওপরে—
সেখানে ফুলের গাছ ছিল হাজারে হাজারে—
একটা জাদুর ফুল প্রতি রাতে ছড়াত মধুর ঘ্রাণ।
সে কখনো শুকাত-না। যেন অমর হয়েছে—ম্লান
কিন্তু কেউ এর কাছে যেতে সাহস পেত না—
তার কাঁটা ছিলো বিষে ভরা।
—তারপর কী মা?
[নিরি দেখে মা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। সে বিছানা ছেড়ে ওঠে।
বাইরে জোছনা, জলের মতন ঘন হয়ে ঝরছে যেনবা।
সে আবার কিছু দ্যাখে, বাইরে উড়ছে। তার পিছু পিছু কুঠিবাড়ির ভেতরে চলে যায়]
—কেউ কি এখানে আছে?
[কুঠিবাড়ির ভেতরে সাদা উঠানে তখন দেখা যায় একটি মাঝারি বৃক্ষ। চিরল-বিরল পাতা তার।
পাতা দুলিয়ে দুলিয়ে সে কথা বলছে]
—ভয় পেয়ো-না-গো মেয়ে। আবার এসেছো ফিরে?
কী নাম তোমার? তাকাও, আমার দিকে।
[নিরি গাছটির দিকে দ্যাখে]
—আমি নিরি। তুমি?
—আমার অনেক নাম ছিল...অনেক পুরনো নাম। কেবল বাতাস আর গাছ সেইসব নাম উচ্চারণ করতে পেরেছে।
আমার আসল পরিচয় হলো আমি একজন দাস। তোমার বাবার দাস।
অনেক আগের কথা। সে আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।
তুমি পৃথিবীর আলোতে মরেছো, আমি বেঁচে গেছি অলৌকিক, কিংবা গাছ হয়ে গিয়ে।
—মিথ্যা বলছো এগুলো।
আমার বাবার কোনো দাস নেই। তিনি ছিলেন গরীব লোক।
বরং দাস অভ্যাসের জীবন তারই ছিল।
—আমি মিথ্যা কখনো বলি-না।
চেয়ে দেখো তোমার বামের কাঁধ।
সেখানে রয়েছে উল্কি আঁকা চাঁদ।
এটাই প্রমাণ। তুমি পাতালপুরির রাজার প্রাণ।
—আসলেই তাই—বাম পাশে উল্কি আঁকা,
চাঁদ আর দুটো তারা।
—চলো তবে ফিরে যাই।
তুমি গেলে রাজা খুশি হবে যারপরনাই।
তোমার আসল বাবা সে-ই। চলো দ্রুত, চলো যাই।
—কিভাবে সেখানে যাব?
—সবকিছু এত সোজা নয়, কোরো-না রাতের অপচয়।
—কী এমন সে কঠিন কাজ।
—এই বই নাও।
[নিরি নেয় এবং খোলে]
—এখানে তো কিছু লেখা নেই। বইজুড়ে সাদা পাতা।
—একা থাকলে খুলবে—তোমাকে দেখাবে ভবিষ্যত।
বই খুলে বলবে সকল কিছু, যা জানতে চাও।
[বইটি জামার মধ্যে নিয়ে, নিরি হেঁটে আসে কুটির প্রান্তরে।]
দৃশ্য ০৩
[চারদিকে ঝলমলে আলো।
গ্রামের সবুজ দিন। শীতের আভাস নেই যেন।
শান বাঁধানো পুকুর—স্বচ্ছ টলোমলো।]
—আজ ভালো করে স্নান সেরে নাও নিরি। তারপর এই জামা পরো
[নিরি দ্যাখে একটি সবুজ জামা—দারুণ মখমলের]
—মা, এখানে স্নান করব না। পুকুরে আমার ভয়। তাছাড়া এখানে শীত।
—আচ্ছা। ঘরে যাও। গরম পানির আয়োজন করতে বলি।
দৃশ্য ০৩ (০১)
[গোসলের ঘর—
গরম পানির ধোঁয়া সারাঘরে—
নিরি গোসল করে না
কিংবা দেরি করে—
এক কোণে লুকিয়ে বইটি খোলে—
তার চারপাশে ঝুঁকে যেন কুয়াশারা
যেন বকুল গাছের নিচে কেউ একা
মুখ নামিয়ে গুনছে ফুল।]
—আমাকে জানাও পাতালপুরিতে ফিরে যাবার উপায়।
[ধূসর পাতায় আঁকা লাল দীর্ঘ পথ
হয়ে উঠছে সতেজ—
সেই পথে আহ্নিকের ভিড়
আর হলুদ হাওয়া চলে গেছে
সবুজ বনের ধার ঘেঁষে।
সে দেখতে পায় সবকিছু
জেনে যায় বহুকিছু।
এই বাড়ির অদূরে, বনের ভেতর গিয়ে
মরা পথটির প্রান্তদেশে, নিঝুম গহিনে
আছে এক গাড় সবুজ পানা-পুকুর,
তার কাছে বাদামী একটি গাছ আছে
তাতে কয়েকটা সজনে হয়েছে।
সেই গাছের গোড়ায় জল ছেড়ে উড়ুক্কু মাছের মতো
মাঝে মাঝে শ্বাস নেয় একটি গোলাপি ব্যাঙ
তার গলার ভেতরে চাবিটি বাঁকানো।
ওই চাবি নিতে হবে
কুটিরের ভেতরের ঘরটি খুলতে হবে
তারপর পাতালপুরে যাওয়া যাবে।]
—নিরি স্নান করা হলো?
—এইতো হয়েছে প্রায়।
[বই বন্ধ করে, স্নান সারে নিরি। তার চোখে এক অজানা ভাবনা দেখা দেয়]
দৃশ্য ০৪
[আবছায়া অন্ধকার
জনশূন্য যেন গোলাঘর
সেখানে একাকী এক কোণে বসে আছে নিরি
বাইরে নেমেছে সন্ধ্যা, হালকা ঝরছে বৃষ্টি।
নিরি আবার বইটি খোলে]
—পাব কিভাবে ওই কুটিরের চাবি?
[এখন সে দ্যাখে অফুরন্ত মাঠ—
আর জেনে যায়—
অনেক বছর আগে পৃথিবীর ফুলগুলো আরো সাদা ছিল।
এই বন তখন অনেক ছোট,
এখানে অদ্ভুত সব প্রাণী বসত করত
তারা একে অপরের জীবন বাঁচাত
আর ঘুমাত বিশাল এক বট গাছের ছায়ায়।
সেই বট গাছ এখনো রয়েছে
শুধু শাখাগুলো শুকিয়ে গিয়েছে—
গাছটির ডানদিকে—সূর্য যেদিকে সন্ধ্যায় হেলে
শিকড়ের পাশে পোতা আছে জাদুর দুইটি মুক্তাদানা
ওই দানা তুলে নিলে গাছ আবার সবুজ হবে।
বাসা বাঁধবে পাখিরা। লাল লাল ফল হবে।
আর যদি মুক্তদুটো হাতে করে যাও
সেই পানা পুকুরের সজনে গোড়ায়—
ব্যাঙটাকে খুঁজে পাও
তার সামনে রাখবে
দেখবে সে খেয়ে নেবে মুক্তদুটো
তারপর গলগল করে বমিতে ভাসাবে
বেরিয়ে আসবে চাবি]
—এসব কি আসলেই সত্যি? কিভাবে বুঝব সব সত্যি?
[নিজ মনে ভেবে ভেবে, বইয়ের অন্য পাতা খোলে]
—বলো আমার মা, কী করছে এখন?
[বইয়ের পাতাগুলো ধূসরতার নিকটে চলে যায়।
মাঠ ছাপানো বৃষ্টিতে চাঁদ ঢেকে গেছে
লণ্ঠনের চারপাশে লাফাচ্ছে কাদুলে পোকা
একটি কেবল ছায়া একা, যেন আরো ঘোলা হয়ে যায়।
নিরির মা কাতরাচ্ছে পেটের ব্যথায়।
আরও জানতে পারা যায়—
পূর্ণিমার আগে মারা যাবে সন্তানসম্ভাবা
যদি তাকে বাঁচাতেই হয়,
যেতে হবে কুটিরের পাশটায়
জমে ওঠা অন্ধকার কিংবা দিনের সবুজে
বেঁচে রয়েছে সেখানে—বুনো হলুদের শটিবন
গোলাপের কাঁটার অভ্যাস রয়েছে তাদের—
তবু
দিনে কিশোর পাখিরা ওইখানে পোকা খুটে খায়
আর রাতে ঝুঁকে পড়া অন্ধকারে
নীল পাখনার ফসফরাসের আলোতে জোনাকি জ্বলে।
যে কোনো সন্ধ্যায় সবথেকে রোদে-পোড়া শটিগাছ তুলে ফেলে
তার মূল যদি, দুধে ভিজিয়ে খাটের নিচে, রাখা যায়
গর্ভব্যথা হবে উপশম, পাবে পরমায়ু।]
দৃশ্য : ০৫
[বিছানার চারপাশে মহিলারা। সন্তানের অপেক্ষায় বাইরে পুরুষ।
চাদর ভিজছে রক্তে। তবু কোনো সমাধান নেই। বেড়ে যাচ্ছে ব্যথা
লুকিয়ে ভেতরে ঢোকে নিরি।
বিছানার নিচে রাখে দুধভরা বাটি।
তাতে হাসছে শেকড়। যেন সহসা থিতিয়ে যায় কান্নার চিৎকার।
...
নিরি বেরিয়ে আসছে। কে বলছে যেন, ভাই এলো তার।]
দৃশ্য : ০৬
[আজ আলোর আঘাত নেই কোনো
মধ্যদিনে বনের ভেতরে সন্ধ্যা উঁকি মারে যেন।
পানাপুকুরের ‘পরেও আলোর দেখা নেই
চারপাশের গাছেরা জড়ো হয়ে
অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টির ফারাক
ভুলিয়ে দিয়েছে।
সজনে গাছের গোড়াতেই
ভুস করে ভেসে ওঠে বিশাল কোলাব্যাঙ]
—এই যে গোলাপি ব্যাঙ। তাকাও আমার দিকে।
আমি পাতালপুরির রাজকুমারী, শুনছো?
আমি তোমাকে পাই না ভয়।
খাবার এনেছি দেখো।
[নিরি মুক্তাদুটো ছুঁড়ে দেয়,
শুকনো পাতার ’পরে ঝিকিমিকি করে মুক্তাদুটো
ব্যাঙ শুধু চেয়ে যায়—অতঃপর গিলে ফেলে—অনায়াসে।
যেন গোলমরিচ খেয়েছে খালি মুখে—
এরপর বিশাল হা করে উগরে দিয়েছে
পেটের সকল জল। তাতে বেরিয়ে-আসে সোনার-চাবি।]
দৃশ্য : ০৭
[গাড়ি চলছে, মায়ের সঙ্গে
বালিকা একটা মেয়ে।
পুরাতন গাড়ি—মাটির সরল পথ,
গাড়ি দোলার অভ্যাসে মনে হয়
নিচে যেন জলাভূমি।
পথের দুধার ঘেঁষে ঘন বনভূমি।
মায়ের কোলের মধ্যে মেয়েটির
ঘুম ভেঙে যায়। সে কেবল দেখে
তার মা’র মুখ, নীল ডালিয়ার দেশ যেন
কাছেই কোথাও আছে।
গাড়ি চলছে পুরনো অভ্যাসে
পথের দুধার ঘেঁষে ঘন বনভূমি
আরো ঘন হয়ে আসে]