অচেনা চোখ

অনুবাদ গল্প, শিল্প-সাহিত্য

হানান আল শাইখ ।। ভাষান্তর: আদনান সহিদ | 2023-09-01 23:48:05

বৃদ্ধ লোকটি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টি নিমগ্ন ছিল টেবিলের ওপাশে বসা লোকটির দিকে। তিনি হাত উঠিয়ে তাঁর কপাল ও বেশ কুঁচকানো মুখমণ্ডলের ঘাম মুছলেন। ঘাড় ও কপালের দুই পাশ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে‌ টের পেয়েও তাঁর ঐতিহ্যবাহী রুমাল এবং মাথার ব্যান্ডটি ঘাম মুছতে ব্যবহার করলেন না তিনি। টেবিলের ওপারে বসা লোকটার কথার উত্তর দেবার প্রয়োজনও বোধ করলেন না, যে ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করেই যাচ্ছে, “আপনি কেন আপনার স্ত্রীর সন্ধানে ওয়ার্ডের প্রতিটি দরজা খুলে খুলে দেখেছেন? কেন এখানে সরাসরি অনুসন্ধান কক্ষে চলে এলেন না?”

বৃদ্ধ লোকটি নিশ্চুপ রইলেন। টেবিলের ওপাশে বসা লোকটি বারবার ড্রয়ারটি খুলছে এবং বন্ধ করছে। লোকটির দিকে নিবন্ধ দৃষ্টি রেখে তিনি বললেন, “আমি গতকালের আগেরদিন আমার বাচ্চাদের মাকে খুঁজতে এই হাসপাতালে এসেছিলাম‌।”

টেবিলের ওপাশে বসা লোকটি বিড়বিড় করে নিজেকে দোষারোপ করল কেন সে বৃদ্ধ লোকটিকে ঠিকভাবে প্রশ্নটি করতে পারল না যাতে তাদের কথোপকথনটি সহজে আগায়। ফলশ্রুতিতে, এখন তার নিজ প্রশ্নের উত্তরই তার কাছে খুব ব্যাখ্যামূলক এবং বিরক্তিকর লাগছে। সে সিগারেটে একটা টান দিল এবং বৃদ্ধকে অনুসন্ধানী সুরে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার স্ত্রীর নাম কী?”

বৃদ্ধ লোকটি উত্তর দিলেন, “জয়নাব মোহাম্মাদ।”

টেবিলের ওপাশে বসা লোকটি বিশাল এক রেজিস্টার খাতা নিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগল। প্রত্যেকবার পৃষ্ঠা ওল্টানোর সময় এমন সজোরে শব্দ হচ্ছিল যা পাশের অপেক্ষমান কক্ষ থেকে সকলে শুনতে পাচ্ছিল। খুব ঔদাসীন্যের সাথে ঠোঁট কামড়ে সে রেজিস্টার খাতার পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকল। একসময় ঘাবড়ে গিয়ে রেজিস্টার খাতার খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, “আপনার স্ত্রী কি গতকালকের আগের দিন এখানে এসেছিলেন?”

বৃদ্ধ লোকটি এবার একটু আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “জ্বি জনাব, যখন তার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল।”

পুনরায় বিরক্ত হয়ে টেবিলের পেছনে বসা লোকটি অস্ফুটস্বরে বলল, “তার হৃদস্পন্দন যদি বন্ধ হয়ে যেত তাহলে সেও এখানে আসতে পারত না, এমনকি আপনিও না!”

রেজিস্টার খাতায় চোখ রেখেই সে জানাল, “আপনার স্ত্রী চার নাম্বার ওয়ার্ডে আছে কিন্তু আপনি সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাবেন না কারণ সেখানে অন্যান্য মহিলারাও আছেন!”

এইবার হাই তুলে সে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সেবিকাকে ডাকল। একটি কাগজের তৈরি কাপে চা পানরত অবস্থায় সেবিকাটি এগিয়ে এলো। বৃদ্ধ লোকটির দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে সে সেবিকাকে বলল, “ওয়ার্ড নাম্বার ৪—জয়নাব মোহাম্মদ।” সেবিকাটি কাপ থেকে মুখ না তুলেই সামনে এগিয়ে গেল।

বৃদ্ধ লোকটি মনে মনে ভাবতে লাগলেন এটা কিভাবে সম্ভব যে আরবিভাষী একজন মহিলা হাসপাতালে এভাবে পুরুষদের সাথে কাজ করে‌!

ওয়ার্ডে পৌঁছে সেবিকাটি বৃদ্ধ লোকটিকে একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে বলল। কিছুক্ষণ পর সে বেরিয়ে এসে বলল, “জয়নাব মোহাম্মাদ নামে তো দুজন আছেন। তাদের একজনের আবার চোখ একটি। এর মধ্যে কোনজন আপনার স্ত্রী হতে পারেন?”

বৃদ্ধ লোকটি পুরোপুরি দ্বিধান্বিত হলেন। একটা চোখ! তাই কি? তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন লম্বা গাউন এবং বোরখা পরিহিতা তাঁর স্ত্রীকে দেখায়। সমস্ত চোখ মুখ ঢেকে রাখা তাঁর স্ত্রী জয়নাবকে কেমন দেখায় কিংবা মাঝে মাঝে যখন সে মুখের উপরের কালো আবরণটি উঠিয়ে ঘাড়ে ফেলে রাখে তখনই বা কেমন দেখায়। তিনি আরো ভাবতে লাগলেন তাঁর স্ত্রী যখন হাঁটে এবং বসে থাকে তখন তাকে কেমন লাগে? এমনকি যখন প্রথম ছোট্ট বাচ্চাটির খাবার চিবিয়ে নরম করার জন্য তা চিবাত এবং মুখ থেকে বের করে আবার বাচ্চাকে দিত তখনই বা কেমন লাগত? এক চোখ! কিভাবে জানব আমি? তিনি কল্পনায় তাঁর স্ত্রীকে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতেও দেখলেন। অত্যন্ত দ্বিধায় পড়ে বললেন, “আমি যখন তাকে ডাকব তখন সে আমার গলার স্বর শুনে ঠিক চিনতে পারবে।”

লোকটি আসলেই কি তাঁর স্ত্রীকে খুঁজতে এসেছে? সেবিকাটি সন্দেহপ্রবণ মনে ভাবল একবার। পুনরায় বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকিয়ে সংশয় দৃষ্টিতে হেসে জিজ্ঞাসা করল, “আপনাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর হলো?”

বেশ বিভ্রান্ত কণ্ঠে বৃদ্ধলোকটি উত্তর দিলেন, “আল্লাহই ভালো জানেন...তা ৩০, ৪০ বছর তো হবেই!”


হানান আল শাইখ লেবাননের জাতিগত শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালের প্রারম্ভে তিনি কায়রোতে আমেরিকান উইমেন্স কলেজে অধ্যয়ন করেন। চার বছর পর কায়রো থেকে ফিরে বৈরুতে যুগপৎভাবে সাংবাদিকতা এবং ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা শুরু করেন। তাঁর সকল সাহিত্যকর্ম মূলত লেবাননে আরবি ভাষায় প্রকাশিত হলেও বেশ কিছু কাজ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্রে প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাঁর অনূদিত উপন্যাসের মধ্যে দ্য স্টোরি অফ যাহরা (১৯৮৬), উইমেন অফ স্যান্ড এন্ড মির (১৯৮৯) এবং বৈরুত ব্লুজ (১৯৯৫) এবং ছোটগল্প সংকলন, আই সুইপ দ্যা সান অফ রুফটপ (১৯৯৮) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর