কবিতা কী যে নেশাদ্রব্য তার আর বিবরণে, ভনিতায় কাজ নেই। কবিতা খাদ্যদ্রব্যে মিশে যাওয়া অমৃত বা বিষের মতো কিছু! বিষ বলাই ভালো বিশেষত স্লো পয়জন পদ্ধতি যদি এর প্রকৃত গাঢ় রূপের সন্ধান পাওয়া যায় তবে—কারণ এর নির্মাণ জীবন নিয়ে নিয়ে তৈরি, হয়ে সম্ভবত জীবন খেয়ে খেয়ে। আর বলে না যা কিছুই খুব তীব্র তা সন্দেহের ফলে অমৃত না ভেবে তাকে সুস্বাদু বিষ বলাই ভালো। মনের ঘূর্ণিতে খুব একটা বই নিয়ে আলোচনা করিনি বা এমনিতেও সেটা করতে নিজেকে উপযোগী বলে মনেও হয় না। কারণ পড়া, বোঝা আর প্রকাশিত লেখা এই তিনটে ধাপের মধ্যে বেশ পার্থক্য থাকে—তাকে কায়দায় আনা মুশকিল! নিজের অনুভূতি ও মুহূর্তের যাপন দিয়ে একটি জিনিস বুঝেছি কোনো কবির কবিতা ভালো লাগলে সেই কবিতাকে একটি সিন্দুকে রেখে দেওয়া ভালো। সেই সৃষ্টিকর্তার কাছে পাঠকের আরোই যাওয়া উচিত নয় কারণ স্রষ্টাকে সাধারণ নৈকট্য নিয়ে ধরলে তার শিল্প বা সাহিত্যের প্রতি বিনাহেতুতেই আকর্ষণ লঘু হয়ে যায়—ফলে ভালো লাগাকে সংরক্ষণ করাও একটি দায়িত্ব উপভোগের সঙ্গে।
এই মুহূর্তে কিছু কবিতা নিয়ে আলোচনা করব। আলোচনা নয় শুধু ভাগ করে নেওয়া। কবির সঙ্গে আলাপ নেই অবশ্য আলাপের প্রয়োজনও নেই ফলে একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি থেকে এই লেখা লিখতে আগ্রহী হলাম। যে কটি বই থেকে আমি কবিতা নিয়ে আলোচনা করব তার নাম মদ, কাগজ ফুল, তিরিশটি প্রেমের কবিতা(ভাষালিপি প্রকাশনী), মেয়ে (শুধু বিঘে দুই প্রকাশনী)।
“স্তন থেকে চোখ তুলে তাকাই চোখের দিকে। দেখি, জল টলমল করে। নৌকা, ভাসাব কিনা ভাবি। তারপর জানালার বাইরে তাকাই। একবার দেখি, বারবার দেখি, মনের গহনে পৌঁছোনোর সুগম নিশ্চিত কোনো পথ আছে নাকি? পাহাড়ের গা বেয়ে, নদীর দু পাড় দিয়ে? নদীর প্রসঙ্গে এসে ফের মনে পড়ে যায় দুটি চোখ। স্তন থেকে কিছুটা উপরে। দেখি জল টলমল করে” (দর্শন, তিরিশটি প্রেমের কবিতা)
এই কবিতা নিয়ে কী বলা যায়—একটি অন্যরকম তীব্র গভীর কবিতা—শুধুই কি তাই? তবে কি একজন নারী লেখক বলে স্তনের চেয়ে চোখের উপমা পেয়েছি বলে অন্যরকম মনে হলো—না, কারণ দুটোর মধ্যে কোনোটাই কোনো নারী পুরুষ একেবারে বাদ দিয়ে চলবে না। তবে চোখ কি খুব সাধু, স্তন কি খুব যৌন তাও নয়—স্তন তীব্র বাৎসল্যের হতে পারে, চোখ তীব্র যৌনতার হতে পারে। বিষয় হলো পথ, বিষয় হলো মুখ—কবিতাটির শুরু ও শেষ স্তন ও চোখের সঙ্গে এক প্রহেলিকা করে খেলেছে। এই চোখ এই যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারী অঙ্গ তাকে ছুঁয়ে কবিতাটি অতলের হয়ে গেছে যা পড়ার জন্য এক নির্মোহ মায়া আহ্বান করে চলেছে। এখানেই এই দর্শন নামক কবিতাটি অমৃতরূপী বিষ এবং তীব্র।
“তাঁত বোনে। হয়তো তোমারই গায়ে উঠবে ওই কাপড়ের ডুরে। তুমি কোথায় কত দূরে কোন নদীর ধারের গ্রামে তোমার বাড়ি, জানে না ওই মগ্নতম তাঁতি। আর তুমি, কিশোরীনি, জানো নাতো ঐ যুবাটির নাম। তোমার জন্যই শাড়ি বুনেছে সে, তার ব্যস্ততম হাতে। শুক্র অথবা বুধবারের হাট থেকে কিনে নিয়ে যাবে তোমার বাবা। লণ্ঠনের আলোয় দেখা হবে তোমাদের” (তিরিশটি প্রেমের কবিতা)
কবিতাটির নাম “শাড়ি”, পড়ে দেখুন কবিতাটি একটি জীবনের খুব গূঢ় টানাপোড়েনে পূর্ণ নয় কিন্তু কবিতাটি চূড়ান্ত আলোকিত যখন এই দৃশ্যকল্প ভেসে উঠবে যে এক তাঁতির হাত, দেহ, খটাখট শব্দ একটি যাপনে পূর্ণ নির্মাণে ভরা শাড়ি মেয়েটি লণ্ঠনের আলোয় দেখছে—এই দৃশ্যের অন্তর্নিহিত ভাবের মূল্য এক বুক রক্তের আত্মায় ভরা নয় কি? ঐ “লণ্ঠনের আলোয় দেখা হবে তোমাদের”—কবিতাটির সব রস এনে এই হাঁড়িতে ভরে দিল। একটি শাড়ি একটি জীবন ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল কোন অনন্তে...
“তবু আমি ফুল। তবু আমি ফুল।/ রাতের আলকাতরায় ঢেকে রেখেছি নিজেকে।/ যেহেতু সৌরভ সুবাস কিছু ছড়াতে পারি না।/ আকর্ষণের কোনো প্রভাই আমাকে দেননি ভগবান।/ তবু আমি ফুল—এটাই সান্ত্বনা।/ পরজন্মে সত্যি কোরো—জানাই প্রার্থনা”
“তুমি আমার গন্ধ পেলে না।/ ঝড়ের মুখে আমার নাচ/ দেখলে ভুলতে না/ অপরিচয়ের ফলে তৈরি/ তোমার মনের বেদনা—/ আমার মর্মে এসে টুকি দেয় যদি/ তোমাকে দেখাবই, দেখাবই/ কুসুমের নদী”...
টুকরো টুকরো ১৪টি কবিতা নিয়ে এই উক্ত কবিতাদের সহযোগিতায় “কাগজ ফুল” বইটি প্রকাশিত হয়েছে ভাষালিপি প্রকাশনী থেকে। কাগজফুলকে কেমন দেখি আমরা? জানি নকল তবু কেন যেন ভালোবাসি, আসল কাগজও ফুলের মতোই সরল ফলে বিকল্প রূপেও সে নিরাময়ের প্রেম যেন। এই উক্ত কবিতাদুটি দেখুন প্রথমটি অভিমানের কবিতা—এ অভিমানে অভিযোগ নেই শুধু নিভৃতের পেলব প্রার্থনা আছে। সেই প্রার্থনা জুড়ে এক অসহায়তা আছে তবু তা অপরাজেয় কিছুতেই ন্যুব্জ নয়—সে ফুলেল মর্মে অসহায় হয়েও সেই জন্ম চেয়েছে আবার—যেন আঁধারের সঙ্গে প্রেম, যেন আঁধারের প্রতি, এ জীবনের প্রতি মায়া। দ্বিতীয় কবিতাটি একটি লুকাচুরি খেলা—এক প্রেমিকের অঙ্গীকার, তার প্রত্যয় অথচ আগ্রাসী নয় যেন খেলাচ্ছলে অনুযোগ অথচ শব্দের আর মুহূর্তের এমন সহবাস যে একবার পড়লে প্রথম দুটি লাইনে মুখের শীর্ষে এসে রাজত্ব করে।
“টান শুধু টান অনুভব করে গেছি আমি/ দূর পাহাড়ের মদ আমাকে ডেকেছে বারবার”—এভাবে কবিতাটি শুরু হয়ে শেষ হয়েছে এভাবে—“এত কাছে কখনো উঠে আসোনি যে/ তোমার ঠোঁটে অবিরাম চুমু খেতে পারি/ মায়াময় কত সন্ধ্যা জোনাকি-নিবিড় কত কত রাত/ মদহীন প্রেমহীন কেটেছে আমার।”
যদিও শুরু ও শেষ দিয়ে মধ্যযামের কিছুই বোঝা যায় না ফলে আগ্রহী পাঠককে কবিতাটি পড়তে হবে। কবিতাটির নাম “পাহাড়ি ঝিঁঝিঁর ডাক”। কখনো যদি গভীর রাতে একা বিছানায় শুয়ে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনেন বুঝবেন এর মতো ঘন তীব্র জীব বুঝি আর হয় না! যখন ডাক গভীর থেকে গভীরতর হয় তখন একই সঙ্গে হর্ষ, বিষাদ, রোমাঞ্চ এক তীব্র ঝিলমিলের মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়। এই কবিতাটিও সেইরকম শুরুতে স্বপ্ন, সম্ভোগ শেষে উদাস এই যে কাউন্টার এখানেই কবিতাটি নামে, দেহে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের এলগিন রোড, মৃত্যুর পর, আক্ষেপ, কথা, আমার মদ, পুরনো, শুভ জন্মদিন—প্রত্যেকটি তীব্র যাকে বলে ডার্ক , সান্দ্রতায় ভরপুর এবং এর গায়ের গহনা নিরীক্ষণের চেয়ে এর ভাবের কাছে এমনভাবে টেনে নেয় যে পার্থিবরা অসাড় হয়ে আসে।
“কালো দরজা খুলে তুমি বাইরে এসে দাঁড়াতেই, আমি বুঝে গেলাম শেষের সেদিনের আর দেরি নেই, খুলি ফাটিয়ে ঘিলুর রস খাবেই তারিয়ে তারিয়ে, তোমার চারহাত যখন সাঁড়াশির মতো ধরল জড়িয়ে, আমার নশ্বর হাড়সকল ভেঙে গেল তোমার বুকের চাপে, পুরুষাঙ্গ কেটে তুই ভরে নিলি অতিকায় যোনিটির খাপে”
এই কবিতাটির নাম কালী, এছাড়াও আছে লক্ষ্মী, দুর্গা, সরস্বতী এবং বইয়ের শেষে “ডানকুনি-গড়িয়া” বলে একটি কবিতায় একদম ভিন্ন থেকে ভিন্নতরভাবে নারীর যত যত রূপ কবির জীবনে, দর্শনে, ভাবকল্পে এসেছে তাকে বিভিন্ন মহিমায় পাঠক পাবেন এই “মেয়ে” কাব্যগ্রন্ত্রে। কিন্তু এটা ঠিক ঐ নারী তোমার একই অঙ্গে কত রূপের মতো নাটকীয় নয় এবং তা কত মুচড়ে দেওয়া অনুভূতির তা পূর্বোক্ত কালী কবিতাটি পড়লেই বোঝা যায়। যেখানে তুমি থেকে তুই আর জাপটানো সঙ্গম থেকে এক গভীর গ্রাসে পৌঁছে গেল কবিতাটি—একে বলে উজ্জ্বল সমর্পণ!
এবারে যেটা বলার, প্রকৃত ভালো লেগে যাওয়া কবিতাকে নিয়ে কিছু বলা নিতান্ত কঠিন। যেমন লেখা একটু দূরত্বে থাকলে পাঠযোগ্য হয় সেরকম একটু কম ভালো লাগলে ভালো আলোচনা করা যায়। কারণ ভালো লাগা মানে ইন্দ্রিয়ের বশীকরণ হয়ে গেছে এর পর একে নিয়ে বলা যায় না। বইগুলো পড়ে একরকম আচ্ছন্ন অনুভূতি এসেছিল তাই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই লেখা রইল। পরিশেষে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলি যাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা হলো সেই কবির নাম বিপ্লব চৌধুরী।