সড়ক পথে বাংলাদেশ থেকে নেপাল যাওয়ার ঝক্কি কম নয়। মধ্যবিত্তের পকেটের দিকে তাকিয়ে অন্যান্য ব্যয় বাদে রাহাখর্চা যা থাকে, তা দিয়ে বিশেষ কিছু হয় না। তাই এয়ারে যাওয়ার বিলাসিতা ছাড়তেই হলো। তাতে একদিক থেকে ভালোই হলো। কারণ ১৭ ঘণ্টার সবচে বড় জার্নি দার্জিলিং থেকে কাঠমুণ্ডুর ভৌগোলিক বৈচিত্র্যটা উপভোগ করলাম। যদিও সেটা চোখের দেখা। কেননা অনাত্মীয় বিদেশে স্বজন কই যে, মধ্যি পথে নেমে, একটু গা জুড়িয়ে নেব। প্রাইভেট কোম্পানির ট্যুরিস্ট ভ্রমণ, একবারেই ফরমায়েশি। রাস্তা তার মাপা, থাকা-খাওয়া-বিশ্রামটাও তাই আঁটসাঁট।
ভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমবার ইংল্যান্ড গেলেন, ফিরে এসে তার ফিরিস্তি শোনালেন—“সেই প্রথম বয়সে যখন ইংলন্ডে গিয়েছিলুম, ঠিক মুসাফেরের মতো যাইনি। অর্থাৎ রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে বাহির থেকে চোখ বুলিয়ে যাওয়া বরাদ্দ ছিল না—ছিলেম অতিথির মতো, ঘরের মধ্যে প্রবেশ পেয়েছিলুম।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম, জন্ম শতবার্ষিক সংস্করণ, পৃ. ৩৪০)।
এ-রকম ভ্রমণে হৃদয় মন উৎসারিত হয়। জীবনের গভীর আকাঙ্ক্ষাগুলো সার্থকতার হাওয়া-প্রাপ্ত হয়। তবুও বলতে হয়—যা দেখেছি তার তুলনা নেই। একটা বিরাট ভূমিকম্প নেপালকে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রাকৃতিক অপূর্ব শোভাকে এখনো এতটুকু টলাতে পারেনি বোধহয়। হিমালয় কন্যা যে-বিশাল ক্রোড়ে শুয়ে আছে, তাকে অতিক্রম করার সাধ্য কার? নেপালের পাহাড়-পর্বত-মেঘ, তাদের উচ্চতা, মেঘের লুটোপুটি, উপত্যকা, দর্শনীয় স্থান সত্যি অভূতপূর্ব। মনে পড়ছে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তিব্বত প্রসঙ্গসহ দার্জিলিং ভ্রমণ-কথা। ‘সখা’, ‘সাথী’, ‘সন্দেশ’, ‘মুকুল’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল সেসব। উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা ছবি মনোহরণ করে। তাঁর রচনার সুখপাঠ্যতার নমুনা পেশ করা যায়—“পর্বতের কোলে মেঘের নিদ্রা দেখিতে বড়ই সুন্দর। চঞ্চল মেঘ সমস্ত দিন ধরিয়া ছুটাছুটি করে। তাই কি সন্ধ্যাকালে তাহার ঘুম পায়? ওই দ্যাখো, তাহারা কেমন শান্ত হইয়া পর্বতের গায়ে শুইয়া পড়িয়াছে। সমস্ত রাত্রি তাহারা ওই রূপ ভাবে কাটায়। সকালবেলা সূর্যের আলো তাহাদের গায়ে পড়িবামাত্র তাহাদের ঘুম ভাঙিয়া যায়।”
দার্জিলিং ও নেপাল সত্যিই পর্বত-মেঘের ক্রীড়াকৌতুক। বাংলাদেশ থেকে দার্জিলিং, তারপর নেপালের কাঠমুন্ডু থেকে পোখারা, সেখান থেকে আবার কাঠমুন্ডু হয়ে নাগরকোট-কোডারি-ভক্তপুর-ধূলিখেল—সেসব স্মৃতি ভোলার নয়।
বাংলাদেশে অবস্থিত নেপাল দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে যেতে হলো ভারতীয় দূতাবাসে। কারণটা ট্রানজিট ভিসা। একই রঙের চামড়া কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে ভারতে যেতে দিতে কত যে আপত্তি! ভিসা নিতে হলো রীতিমতো সাক্ষাৎকার দিয়ে। অবশ্য অফিসার খাতির কম করেননি। বললেন, “স্যার, আপনার সঙ্গে সহধর্মিনী যাচ্ছেন বুঝি? তা ভ্রমণ করবেন নেপাল? মানে এভারেস্ট যাবেন?” বললাম, “হ্যাঁ, মানে, কখনো যাইনি তো তাই?” ভেতরে ভয় ছিল; যদি একজনের ভিসা মিস হয়! তাহলে যাত্রা-ইস্তফা হবে ওখানেই। একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এখানে সই করুন, আর লিখে দিন ইনি আপনার স্ত্রী। মানে একসঙ্গে নেপালে যেতে চান।” মনে হচ্ছিল কাজীর কাছে বিয়ের কাবিন হয়েছিল প্রথমবার, এটা ঠিক দ্বিতীয়বার। অগত্যা বিলম্ব তফাৎ যাও। ঝড়ের গতিতে একখানা সই করে দিলাম। ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিমূলক মুচলেকা প্রদান করলাম। অবশ্য ঐ দেশ থেকে আমাদের ফিরে আসা নিয়ে তিনি বিচলিত ছিলেন না! ভিসা অফিসারের মুখমণ্ডলে বিন্দুমাত্র টেনশানও পরিলক্ষিত হয়নি! ভয়টা কেবল আমাদের পক্ষ থেকেই অমূলক। একথা ভাবলে এখনো নিজের ভেতর কৌতুক অনুভব করি।
যাই হোক, নির্দিষ্ট তারিখে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হলো। ট্যুরিস্ট টিমে সদস্য সংখ্যা ১৩-১৪ জন, নানা বয়সী। বাংলাদেশের বুড়িমারি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করলাম। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস-এর ঝাক্কিঝামেলা তো সাপের পাঁচ পা দেখা। যেন মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছি, জীবনের সমস্ত রস ওখানেই শুষে নেবে। টাকাকড়ির বদলও করতে হবে। অনেকে বলল, “নিয়ে নিন, ওদিকে ঝামেলা হবে, এক্সচেঞ্জে বেশি দিতে হবে।” ওপারে বাসে করে প্রায় ২.৩০ ঘণ্টার মধ্যেই শিলিগুড়ি পৌঁছানো গেল। এদিকে হোটেলে দুপুরের খাবার বিশ্রাম সেরে, একখানা জিপগাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ। ও-জায়গায় আরো একবার গিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতা যা বলে, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আবহাওয়ার এমন তড়িৎ পরিবর্তন আর কোথাও লক্ষ করিনি। আস্তে আস্তে গায়ে গরম কাপড় ওঠা শুরু হবে, চলবে দার্জিলিং পৌঁছে রাত্রি অবধি। কারণ রাত যত গভীর ঠান্ডার পরিমাণ ব্যস্তানুপাতিক। আর পানি, ওরে বাবা, বরফ গললেও এতটা ঠান্ডা নয়। এদিকে এমন পিচ্ছিল পানি যেন অবিরাম গ্লিসারিন সাপ্লাই করছে। মুহূর্তেই ঘন কুয়াশা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেতে পারে মুখ-চোখসহ সোয়েটার-জ্যাকেট-চাদরের উপরিভাগ। কখনো চলছে ঘন তুলার মতো মেঘের হুটোপুটি, অযথা ছোটাছুটি। মোটামুটি সন্ধ্যা হলেই দার্জিলিংয়ের দোকানপাট বন্ধ। ‘ম্যাল’ চত্বরটি সরগরম থাকে অনেকটা সময় ধরে। সেখানটায় বসা, বিশ্রাম, ঘোরাঘুরি, ছবি তোলা এবং এর কাছেই বিগবাজারে শপিংয়ে যাওয়া বেশ আনন্দের।
“শল (শাল) লিজিয়ে ভাইসাব।”—দোকানিদের আন্তরিক বচন। কেউ কেউ হাতে হাতেই ফেরি করে শাল আর চা পাতার প্যাকেট বিক্রি করতে আসে। তাদের বিক্রি করার কৌশল সম্মোহিত করে ফেলতে পারে যে-কাউকেই। ধরাশায়ী ট্যুরিস্টরা একটু বেশি দামেই লোকাল দার্জিলিং চায়ের প্যাকেট কেনে। এদিকে অদূরেই অবস্থিত একটি বৌদ্ধ স্বর্ণমন্দির, পাহাড়ি ঢালু পথের সিঁড়ি বেয়ে সেখানে উঠতে হয়। অন্যদিকে আর একটি বৃহৎ বুদ্ধিস্ট মনাস্ট্রি কাছেই। বড় বড় ঘণ্টা আর গোল গোল গম্বুজগুলো দাঁড়িয়ে আছে সদর্পে। দার্জিলিংয়ের সুদৃশ্য স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলোর বারান্দা নাম না জানা ফুলে ফুলে সজ্জিত। বাহারি এই ফুলগুলো দেখে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়!
দার্জিলিংয়ের ‘ম্যাল’ চত্বর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুবই স্পষ্ট। খুব কাছে মনে হলেও দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটারের কম নয়। দার্জিলিং যাবার আগেই পথে পড়বে ছোট ছোট পাহাড়ি জনপদ, শহর। কখনো কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়া, কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে কুয়াশাময় পথ। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ, আশপাশের দৃশ্য, সারি সারি গাছ সৌন্দর্যপিয়াসী মনকে পাগলপাড়া করবেই। দার্জিলিং যাবার পথেই মিরিক, কর্সিয়াং। কুয়াশা-মেঘের অপূর্ব দোস্তি সেখানেও মোহনীয়তা তৈরি করে। বিশেষ করে মিরিকের লেক। উঁচু পাহাড়ের কোলে এমন লেক বিরল। সেই সঙ্গে সিমসাম এই শহরটাও মজার। উইলো আর ঘন পাইন বন, পাহাড়ের ঢালুতে চা-বাগানের ঘনত্ব অতিক্রম করে এমন একটি শহর প্রকৃতির উদরে ঠাঁই নিয়েছে, লেকে ঢোকার পূর্বে ঠাহর করার উপায় নেই। পথের ধারেই কিছু খাবারের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ‘মমো’—এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার। এদিকে পানীয় বলতে ‘আপেল জুস’ না খেলে অসম্পূর্ণতাই থেকে যায়। তাদের নিজেদের বাগান থেকেই সংগৃহীত হয় এই আপেল। দার্জিলিংয়ের ‘র-টি’র কথা কী আর বলার! ওখানকার চায়ের বিশেষ ঘ্রাণটা সাইকোলজিক্যাল কিনা জানি না। তবে স্বাদটা বোধ হয় আলাদাই। সরাসরি রোদে শুকানো পাতার দার্জিলিং-টি কফিকেও যেন হার মানায়। এর স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে।
দার্জিলিংয়ের হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরের আলো না ফুটতেই ছুটতে হলো টাইগার হিল। একটি জিপগাড়ি ভাড়া করে সবাই রওনা হলাম টাইগার হিল বরাবর। সূর্য সেখানে আলাদা প্রত্যয়। ওখানকার সূর্যোদয় না দেখলে বোঝা যাবে না মেঘ আর সূর্যের আলো কতটা খেলা তৈরি করতে পারে। যেন মেঘের চাদর বিছানো রয়েছে পৃথিবীময়। সেই চাদর উড়ছে কমলা-লাল-সাদার অপূর্ব বর্ণালীতে। বাতাসে সমুদ্রের অথৈ ঢেউয়ের মতো সেই চাদর বিস্তৃত ভুবন জুড়ে দোল খাচ্ছে। এমন দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। অনুভবের গহন-গভীরতা দিয়ে তাকে বিস্মিত বোধে পরিমাপ করতে হয়। পৃথিবী সেখানে অধরা কিন্তু তার মাধুরী চোখের সামনে দৃশ্যমান।
দার্জিলিং-ভ্রমণ শেষে নেপালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। দার্জিলিং থেকে ১৭ ঘণ্টার টানা জার্নি শেষে কাঠমুন্ডু শহর। জীবনে এত লম্বা বাস জার্নি করিনি। ভারত সীমান্তে কাঁকর ভিটা পার হয়ে নেপাল প্রবেশ গেট। ইমিগ্রেশনের ঝক্কি পোহাতে হলো বাংলাদেশি বলে। ভারতীয়দের আসতে-যেতে বাধা নেই। তাদের কাছে ভারত-নেপাল যেন আলাদা কিছু নয়। তবে সময়ের অপচয় হলো না। ওদিকে নেপালে প্রবেশ করেই ওখানকার বাস স্টপেজের একটি বাসে ৯ জন যাত্রী ওঠা গেল। বাকিদেরকে তারা একটি প্রাইভেট কারে পৌঁছে দিল পরের স্টপেজে। কী এক অদ্ভুত নিয়মে টিমের নয়জনের বেশি একসঙ্গে ওঠা নিষেধ। কিন্তু প্রাইভেট কারটি ধরা পড়ল। কী কারণে ধরা পড়ল বুঝলাম না। চুক্তি ভঙ্গ করে পরের স্ট্যান্ডে বাসে ওঠার দায়ে জরিমানা গুনল ট্যুরিস্ট কোম্পানি। নেপালিদেরই চাল কিনা বুঝে উঠতে পারলাম না। এদিকে বাস চলছে মধ্যম গতিতে। আমাদের দেশের মতো হিনো লাক্সারি চেয়ার কোচ ২০০৯ সালের নেপালেও বিরল। ইন্ডিয়ান লোকাল-মেড ঝক্কর-মক্কর বড় গাড়িগুলোই তখনও তাদের ভরসা। এদিকে পাহাড় পর্বতময় নেপালে নেই ট্রেন লাইন। কিন্তু স্থলপথের ঐ সীমান্ত থেকে অন্তত ৮ ঘণ্টারও বেশি দূরত্বে সমতলভূমি। এটাই নেপালের উর্বর ‘তরাই’ অঞ্চল। এখানকার উৎপাদিত ফসলেই নাকি পুরো নেপালের খাদ্য। কাঁকর ভিটার আশেপাশেই মেচি নদী। চারু মজুমদারের নারিকেলবাড়ি-খড়িবাড়ি নকশাল অঞ্চলও এই সীমান্তে। ইতিহাসের বাঁকটা মনের মধ্যে ভেসে উঠল।
আমাদের গাড়িটি এগিয়ে চলছে। দিনের শেষে রাত। কিন্তু বড় রাস্তার আশেপাশে কোথাও ভালো খাবার হোটেল এমনকি বিশ্রামাগার মেলাও দায়। মনে হচ্ছে গোটা পরিবেশটাতেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। হোটেলে আলুর (অতিরিক্ত ঝোলের) তরকারি, সামান্য সব্জি, রুটি (চাপাতি), কখনো আধাসিদ্ধ ভাত—এসবই আনাড়ি পরিবেশকদের হাতে পরিবেশন করা। ধুলোমলিন চেহারার বেচারা পরিবেশকদের আচরণে সভ্যতার ছিটেফোঁটাও নেই। ভালো প্রক্ষালন স্থান নেই রাস্তার পাশে কোথাও। যারা বিমানে গিয়ে কাঠমুন্ডু-পোখারার উজ্জ্বল হোটেলগুলোতে অবস্থান করেন তারা এই নেপালের কিছুই জানেন না বলতে গেলে। গভীর রাতেও বাস স্টপেজগুলোতে নারীরা দিব্যি দোকানি হয়ে বসে রয়েছে। চা-বিস্কুটের সরবরাহ চলছে। দিনের বেলায় বাচ্চাকাচ্চারা সঙ্গেই রয়েছে। মনে হচ্ছে তাদের স্বামীরা ঘুমঘুম চোখে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। তাদের কাউকে কাউকে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে লক্ষ করা গেল। অভিজ্ঞ ট্যুরিস্ট কোম্পানির ব্যক্তিটি জানালেন, লোকাল নেপালে মেয়েরাই সব। পুরুষরা নাকি খায় দায় ঘুমায়, মদ্যপান করে নেশায় বুদ হয়ে থাকে। কৃষি খামারেও নারীদের আধিপত্য। যেন পুরো সংসারটা তারাই সামলাচ্ছে, পুরুষ সেখানে নিমিত্ত মাত্র। পথের আশপাশেই চমৎকার সব ক্ষেত খামার। অনেক দূর জার্নি করার পর আস্তে আস্তে পাহাড়ি অঞ্চল শুরু হয়। এই পাহাড়ের শরীর অপূর্ব সুন্দর শৈলিতে সাজানো। চা বাগানসহ বিচিত্র ফসল সেখানে ঢালুময় বিস্তার তৈরি করেছে। সেইসব ঢালু ক্ষেতখামারের মধ্য দিয়ে দূর থেকে দৃষ্ট সরু গলি পথগুলো হাঁটা পায়ের ছাপেই তৈরি হয়ে গেছে। সেসব পথ সৌন্দর্যকে আরো খানিকটা বাড়িয়ে তুলেছে। পথে যেতেই স্থানীয় নেপালীদের সমবেত ধর্মীয় কৃত্য হিসেবে নাচ দেখার সৌভাগ্য হলো।
কিন্তু এই অপূর্ব সুন্দরের মধ্যখানেও লোকাল নেপালিদের খিটমিটে মেজাজ মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। গাড়ি থামলে কোথাও চা খেতে বসি কিংবা দাঁড়িয়ে থাকি। বড় টিনের গ্লাসে চা সরবরাহ হয়। কিন্তু চা খেতে চাইলেও তাদের মেজাজ খটমটে, এমনকি বিল দিতে গেলেও। দু চারজন কর্মী পুরুষের জন্যই বোধ হয় এই মেজাজসমূহ পথেঘাটে ছড়ানো। যাই হোক, ম্যারাথন জার্নি শেষে কাঠমুন্ডু পৌঁছানো গেল। কাঠমুন্ডু মূলত ভ্যালি বা উপত্যকা। চারদিকে তার পাহাড়বেষ্টিত, মাঝখানে শহর। কাঠমুন্ডু ঢোকার সময়ই অনেক বিস্তৃত মনে হয়েছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম খাড়া পাহাড়গুলোর ভূ-দৃশ্য মনে লেগে আছে এখনো। পাহাড়ি মূল বড় রাস্তাটির সৌন্দর্য অতুলনীয়। এই রাস্তার বাঁকসমূহ বাস থেকে একবার ওপরে একবার নিচে দৃশ্যমান হয়। কেননা পথটা অনেকখানি ঘুরে ঘুরে দেখি একই জায়গায় রয়েছে, শুধু উচ্চতা বদল হয়েছে। কতদূর ওপরে উঠলাম ঠিক বোঝা গেল না। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথগুলো পেরিয়ে মূল শহরে পৌঁছানো গেল। ‘থমেল’ ওখানকার শহরের প্রাণকেন্দ্র। থমেলে অবস্থিত হোটেল তিব্বতে আসন গাড়লাম। মনোমুগ্ধকর হোটেলের রিসিপশন হাউসটি ট্রেডিশনাল নেপালি স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। সেখানকার অভ্যর্থনার উষ্ণতাও চোখে পড়ার মতো। কাঠমুন্ডুতে উঁচু মন্দির ‘শম্ভুনাথ’। শম্ভুনাথ মন্দিরের আলাদা বিশালত্ব বা মাহাত্ম্য আছে। বৌদ্ধমন্দিরটির অভ্যন্তরের আয়োজন বাড়তি মোহনীয়তায় ভাস্বর। সিদ্ধার্থ গৌতমের বিচিত্র মূর্তি, দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বুদ্ধ যেন চিরকালের আত্মীয়।
আমরা মূলত দুবার কাঠমুন্ডু প্রবেশ করি। শেষবার পোখারা ও নাগরকোট ভ্রমণ শেষে এই তিব্বত হোটেলেই অবস্থান করি। কাঠমুন্ডুর থমেলে এই হোটেলের আশপাশটাই রাজধানীর অভিজাত এলাকা। এখানেই সার্কের সদর দপ্তর। বাইরে থেকে প্রধান ফটকটির কারুকাজ ঐতিহ্যবাহী। এখান থেকে রিক্সায়, ঘোড়ার গাড়িতে কিংবা ট্যাক্সি-অটোরিক্সায় শহরের নানাস্থানে যাওয়া যায়। সিমসাম শহরটাতে বিশেষ ভিড়ভাট্টা নেই। নেপালি ঐতিহ্যের আরেকটা প্রধান সড়কে ঘোড়সওয়ারি ট্রাফিক পুলিশ। এটাও তাদের পুরনো এতিহ্য। স্থানে স্থানে ঝুরিতে করে ফলমূল ও শাকসব্জি নিয়ে বসে রয়েছে নেপালি মহিলা। খাবারের দোকানগুলো বেশ চড়া দামের। অনন্ত ২৫০ রুপি না হলে, একবেলার মোটামুটি ভালো খাবার বলতে, মুরগি সব্জিও মেলে না। সঙ্গে দুটো বা তিনটে চাপাতি (তন্দুরি)। চায়ের অর্ডার দিতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েছিলাম। ওরা চাপাতি নিয়ে হাজির। ভাগ্যিস তা বাংলাদেশি অস্ত্র নয়! অন্যদিকে গো-মাংস ভক্ষণ করতে হলে যেখানে আসতে হয় তার নাম মদিনা হোটেল। আমরা রাতের অন্ধকারে বুভুক্ষু মন নিয়ে সেখানে হাজির হলাম। রান্না এখানে বেশ ভালো। তৃপ্তির খাবার ঐ একবারই জুটেছিল নেপালে।
কাঠমুন্ডু সেই অর্থে পর্যটন শহর। কাজেই মার্কেটগুলোতে নানাদেশি পণ্যসামগ্রীর ভিড়। ট্রেডিশনাল নেপালি পোশাক কিংবা আসবাবপত্রের দোকানও লক্ষ করা গেল। সবজি ও ফলের দোকানগুলো চমৎকারভাবে সাজানো। এদিকে নেপালের রোদ গা ফুটানো অস্বস্তির। পাহাড়ি শহরটায় কিঞ্চিত ঠান্ডা আবহাওয়াতেও দুপুর বেলার রোদে যেন ত্বক পুড়ে যায়। রিক্সাগুলো একটু ভিন্ন গড়নের। স্প্রিং বসানো গদিঅলা রিক্সা, ক্রিংক্রিং বেলের বদলে ভুভুজেলা আওয়াজের ভেপু লাগানো। রিক্সাওয়ালার পোশাক হাফপ্যান্ট, মাথায় হ্যাট, তার মাথার ওপরে একটা সুবৃহৎ ছাতা। ছাতাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিক্সায় আটকানো। সহ্যাতীত ভয়ঙ্কর রোদের আঁচ থেকে সুরক্ষার জন্য এই ছাতার বিকল্প নেই। বাতাসের আর্দ্রতা সেখানে খুবই কম, তাই ঘাম হয় না কিন্তু সূর্যটা গনগনে। রিক্সাওয়ালার সঙ্গে বাংলা মিশ্রিত ভাঙা-ভাঙা হিন্দি ভাষায় আমাদের ‘বাতচিত’ চলল শহরের কেন্দ্রীয় মার্কেটপ্লেস অবধি। মনে হলো তারা সবাই কিছু হিন্দি-বাংলা এমনকি দু চারটি ইংরেজি শব্দও বোঝে। বিদেশিদের আনাগোনা বেশি বলেই তাদের এই ধরনের সংযোগ ভাষা বা ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ তৈরি হয়েছে। কিছু বুঝি বা বুঝি না, তবুও যোগাযোগের কমতি হলো না। কাঠমুন্ডু শহর রাতেও ঘুমায় না। তবে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে রাতের বেলা। মধ্য মে-তেও রাতে দু ফর্দ মোটা কম্বল না হলে চলে না। দিন আর রাতের আবহাওয়া সেখানে সত্যিই আলাদা। কাঠমুন্ডুর দু দিনের সফরে দরবার স্কোয়ারসহ পুরো শহর-দর্শনের অনেকখানি সম্পন্ন হলো। দরবার স্কোয়ারের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এবং খিলানগুলো চোখ জুড়ানো। অনেকগুলো ছোটবড় দ্বিতল-ত্রিতল ঘর, সিংহদ্বার প্রবেশগৃহ, স্তম্ভের মাথায় সর্প আসনকৃত দেবতা শিব স্থানটিকে অনন্য করে তুলেছে। বিগত ভূমিকম্পে এরই কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ইট-কাঠ-টালির গৃহ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
কাঠমুন্ডু থেকে ১৪-১৬ সিটের একটি বড় মাইক্রোবাস আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয় কয়েকদিন। প্রথমে পোখারা ভ্রমণ। পোখারার ফেওয়া লেকের কথা মনে পড়ে। সেখানকার দৃশ্য চমৎকার। সারি সারি রঙিন নৌকা শোভা পাচ্ছে পোখারা লেকে, তার ধার ঘেঁষে পরিবেষ্টিত স্বল্প দূরত্বের পাহাড় মনোমুগ্ধকর। বিকেলের সূর্যালোক লেকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে শতগুণ। পোখারার হোটেল মনিলায় আমাদের রাত্রিযাপন। ভাটায় পোড়া ইটের বদলে রকমারি পাথরের প্রাচুর্যে গড়া পোখারা যেন স্বর্গীয় নগরী। পোখারার শহরতলীতে ‘রাধাকৃষ্ণ মন্দির’। এর চূড়ায় অবস্থান করে পোখারাকে মনে হচ্ছিল স্বপ্নের শহর। রোদের ঝলক বিচিত্র স্থাপত্যের প্রাসাদোপম বাড়িগুলোর পাথরের টাইল্স করা দেয়ালে পড়ে চকচক করে উঠছে। পাথরের প্রাচুর্যকে তারা উপযুক্তভাবেই কাজে লাগিয়েছে।
পোখারার পাহাড় বন ভ্রমণ করলাম। আবার কাঠমুন্ডুর দিকেই ফিরে আসা হলো। তবে কাঠমুন্ডুর পাশ ঘেঁষে নাগরকোটের দিকে আমাদের যাত্রা তখনও অব্যাহত। মাঝখানে ‘মনোকামনা’ একটি চমৎকার স্থান। তবে বাইরে থেকে যতটুকু প্রত্যক্ষ করা যায় ততটুকুই পর্যবেক্ষণ করতে হলো। ছুটির দিন বলে তার রাজকীয় প্রবেশদ্বারটি বন্ধ। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার কেবল কারের লাইন পরিদৃষ্ট হলো। তবে পোখারা-মনোকামনা-কাঠমুন্ডু ভ্রমণপথের কোনো দৃশ্যই ফ্যালনা নয়। এর মধ্যেই একটি মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। একটি গুহা বা বড় সুরঙ্গ মাটির নিচ দিয়ে। ঐ-সুরঙ্গে যাদের শ্বাসকষ্ট আছে না প্রবেশ করাই শ্রেয়। এখানেই একটি পার্কের মধ্যে দেখলাম ‘ডেভিস ফল’। বছরের পর বছর অনবরত পানি ঝরছে পাথরের মাঝখান দিয়ে একটি বড় কুপের ভেতর। এখান থেকে আরেকটু দূরেই আশ্চর্য দুধের নদী ‘শ্বেতী গজ রিভার’। গভীর ও সরু সাংঘাতিক স্রোতস্বিনী। গজ খানেক প্রশস্ত নদীটি অসম্ভব সুন্দর কলকল শব্দে বয়ে চলছে। নেপালের পর্বত থেকে চুনাপাথর গলে প্রবাহিত বলেই শ্বেতী গজের পানির বর্ণ এমন দুধসাদা। শ্বেতী গজ রিভারের পাশেই ‘গুর্খা মেমোরিয়াল’ মিউজিয়াম।
কাঠমুন্ডু থেকে মধ্যরাতের পরেই পোখারা রওয়ানা হতে হয়েছিল। যদিও সময়ের শিডিউল মেলাতেই এই মধ্যরাতের অযাচিত ভ্রমণ। কিন্তু ভোর হতেই অন্নপূর্ণা আর মচ্ছপুচ্ছের শুভ্র পর্বত-চূড়া যেন রাস্তার অপর পাশেই বলে বিভ্রম হয়। রাস্তার মধ্যখানে নেমেই সেই অপূর্ব দৃশ্যের উপভোগ মনটাকে খানিক আলগা করে দিল। একি শুভ্রতা! একি সুন্দর সকাল! জীবনে এমন সকাল কমই আসে। হিমালয়ের এই পর্বত চূড়াগুলোর ভেতর দিয়ে প্রতিদিনকার সূর্যেই নতুন ভোরের অপেক্ষায় অপেক্ষমান আমাদের প্রত্যেকের দুচোখ।
পরদিন বিকেলেই নাগরকোট গিয়ে পৌঁছালাম। নাগরকোট বিস্মিত সৌন্দর্যের ভূমি। হোটেল ভিউ পয়েন্ট আমাদের বিশ্রামস্থল। সেই হোটেল নাগরকোটের পূর্বপ্রান্তে। পাশেই নিচের ফাঁকাস্থান তার বিশাল শূন্যতা নিয়ে হাজির। কারণ ওপারেই মাউন্ট এভারেস্ট চূড়া পরিদৃশ্যমান। কুয়াশা আর মেঘের ভিড় মাঝেমধ্যেই অস্পষ্ট করে তুলছে পর্বত চূড়া দর্শনকে। নাগরকোটের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘ। যেন মেঘের দেশে ডানা লাগানো অশরীরী হয়ে উড়ে যাচ্ছি স্বর্গীয় আমেজে। শুধুই নাগরকোটের বর্ণনা করব বলে অনেকখানি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যে-দৃশ্য হৃদয়ের গহন-গভীরে নাড়া দিয়ে যায় তার বর্ণনা বুঝি দুষ্কর। সন্ধ্যার দিকে ‘ফোর সিজন রিসোর্টে’র বিশাল লবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন সময় অস্ট্রীয় তরুণের সঙ্গে আলাপ। সে কয়েকদিন থাকবে বলে এসেছিল কিন্তু যেতে তো মন সরছে না তার। নাগরকোটের প্রেমে না পড়ে কারো উপায় কী? অগত্যা কী করা ক্যামেরাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “দুজনের ছবি তোলো।” মুখে হাসি ধরে রেখেই তুলল ছবি। আমাদের ব্যক্তিগত ছবি বলতে ঐ-কয়েকটিই সেরা। আরো কিছুক্ষণ তার সঙ্গে আলাপ করে, পাশের অপরূপ সৌন্দর্য গায়ে মেখে হোটেল রুমে ফিরলাম।
নাগরকোট থেকে পরদিন আমাদের মাইক্রোবাসটি এগিয়ে চলল চীন-তিব্বত সীমান্তে। সেখানে যাওয়া-আসার পথের দৃশ্যই পরম উপভোগের। একটি এঁকেবেঁকে চলা স্রোতস্বিনী নদী যেন পুরো নেপাল-চিন-তিব্বতকে আলাদা করে রেখেছে। কিছু দূর পরপরই ছোট-বড় অসংখ্য ঝর্না। এত ঝর্নার সমাহার পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানি না। সেসব দৃশ্য নয়, যেন মনের পাতায় আঁকা বিপুল চিত্রশালা। মাইক্রোবাসটি আমাদেরকে নিয়ে চলছে একটি বিপদসঙ্কুল পথে। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। যেদিকে পাহাড় তার উল্টোদিকে বিশাল বিশাল খাদ। ওখান থেকে পড়ে যাওয়া মানে হাড়গোর দুমড়ে-মুচরে নির্ঘাৎ মৃত্যুদর্শন। কিন্তু দৃশ্য যে চোখ থেকে সরছে না। আর ওসব মৃত্যুও কেউ যেন পরোয়া করছে না। মাঝে মধ্যে খাড়া পাথরের পাহাড়। প্রাকৃতিক বিচিত্র ক্ষয়েও সেগুলো মাথা-ঘাড় কেশবাস নিয়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ি ঝর্নায় নেমে পা ভেজালাম। নুড়ি পাথরের বড় একটির ওপর এক পা রেখে আরেকটিতে অন্য পা রেখে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ সম্পন্ন হলো। পাহাড়ি নদীটি ঠিক কতটা এলাকা জুড়ে তা অনুমান-অসাধ্য। তবে ৫/৬ ঘণ্টার জার্নিতেও পুরোটা শেষ হয়নি।
আমরা তিব্বত-চিন সীমান্তে উপস্থিত। এই এলাকাটার নাম কোডারি। পাশ দিয়ে বয়ে চলা আমাদের দীর্ঘ পথসঙ্গী নদীটির নাম ‘তাতোপানি’—এর অর্থ উষ্ণ জল। এর পানি শীতল তবে উষ্ণতা কি তার চরম অভ্যর্থনার নাম? সীমান্তটি একটি ব্রিজ দিয়ে আলাদা করা। বিরাট দীর্ঘ লম্বা একটি উঁচু ঘর ব্রিজের ওপাশে। তার গায়ে বড় দাগ টানা টানা হরফে কিছু লেখা। ইংরেজিতে এই লেখার অর্থ ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’। কিন্তু আমাদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। শুধু জানা গেল, ঐ ঘরটিরই বাঁ দিকটায় তাকালে তিব্বত। সেখানে জঙ্গল গাছপালা ঘন অরণ্য। শহরের কিঞ্চিতধিক খালি চোখে দেখা যায়, যায় না। ওদিককার পাহাড় থেকেই কোডারির ‘তাতোপানি’র উৎপত্তিস্থল। তবুও মনে বড় উথাল-পাথাল অবস্থা—তিব্বত-চিন তাহলে ছুঁয়ে এলাম! ব্রিজটির মাঝখান অবধি যাওয়া যায়। ওখানে গেলাম, হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওপারের পাহাড়-ঝর্না। সীমান্ত থেকে বিশাল চীন দেশটির দিকে হাত নাড়লাম।
এদিকে পেটের অবস্থা তথৈবচ। কিন্তু এই মরার সীমান্তে ভালো খাবার হোটেলই বা কই? একটিতে কোনো রকমে প্রবেশ করলাম। বললাম, খাবার কিছু হবে কিনা? ভাষা তো বড়ই যোগাযোগহীন। তবুও ওয়েটার বলল ‘মাটন’। কিন্তু যা খেলাম তাতে মনে হলো অন্যকিছু। আমার সহধর্মিনী নোনতা স্বাদ চেখে কী ভেবেছিল জানি না, আমাকে তখনও বলেনি। সামান্য খেয়ে আমারই পাতে মাংসটা তুলে দেয়। পরে আশঙ্কার ভাষায় বলল, শুকর-টুকর না তো! আমি সে-কথায় গা করলাম না। প্রচণ্ড ক্ষুধায় বধির হয়ে আছি। ক্ষুধা মিটেছে এই বেশি। কিন্তু এখনো মনে পড়লে সন্দেহ জাগে—সত্যিই নিষিদ্ধ জিনিসটা গিলে এসেছি কিনা! তবুও মনকে বলি, ‘জেনে কি খেয়েছি?’ সে-ও অবশ্য তা-ই বলে। এখনো মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি নোনতা স্বাদটা... মানে... সত্যি টের পাওনি! আমি তো ... পেয়েছিলাম। আর হ্যাঁ,ওগুলোর স্বাদ নাকি নোনতাই হয়।”—“আহা, তখন কেন বলোনি!”—“তোমার যা অবস্থা… বললেই আর কী।”
আমরা দুপুরের খাবার সেরেই খুব দ্রুত মাইক্রোবাসে উঠে পড়ি। কারণ সন্ধ্যের আগেই ‘ধূলিখেলে’র সূর্যাস্ত দেখতে হবে। সন্ধ্যের আগে সে-দৃশ্য নাকি অপূর্ব হয়ে ওঠে। যতটা মনে পড়ছে ভক্তপুরের মধ্য দিয়ে আমরা ধূলিখেল পৌঁছাই। ভক্তপুর পুরনো শহর। এর বাড়িঘরের জীর্ণতাও প্রাচীনত্বের ভাব স্মরণ করিয়ে দেয়। বিকেল নাগাদ মাইক্রোবাসটি এক স্থানে রেখে ড্রাইভারসহ আমরা পাশেই পাহাড়ের ওপরে নির্মানাধীন একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়াই। ধূলিখেলের ‘ল্যাঙট্যাঙ হিলে’র অস্তগামী সূর্যাস্তটা পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে যাবে। আর আমরা এই স্থানটা থেকে সে-দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি আসতে বড্ড দেরি। আসলে ফেরার তাড়াও রয়েছে, রয়েছে দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি। ড্রাইভার একসময় রসিকতা করে বলে ওঠে, “ক্যায়া আপকো দেশমে সুরিয়া (সূর্য) নেহি ডুবতা?”
কথাটা বড়ই নির্মম। আসলে ড্রাইভার তো এ-পথে বারবার আসতে-যেতে ভাজাভাজা। ফলে আমাদের ঐ ভূ-দৃশ্য ধারণ আর পাগলামি দেখে একঘেয়ে ক্লান্তির ক্লেশ চেপেও তার রসিকতাটা উপচে ওঠে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আব্দুর রশীদ। তিনিও রসিকতা করতে কম যান না—“আপ তো জানতে নেহি মেরা ভাই, ও, সুরয বাংলাদেশকো নেহি হ্যায়, ও নেপালি হ্যায়।”
আসলে নেপালের সূর্যটাই আলাদা! যাই হোক আমাদের এই সূর্যাস্ত দেখার ফাঁকে পাহাড় ও বনের ভেতরের হালকা গাছপালাবেষ্টিত কিঞ্চিৎ আঁকাবাঁকা সুন্দর পথটি পরিভ্রমণ করা গেল। জীবনে যে-জায়গায় হয়তো আর একবারও যাওয়া হবে না তার সবটা দেখে নিতে মন্দ কী!
আমরা পুনরায় কাঠমুন্ডু ফিরে গেলাম। সেই হোটেল তিব্বতেই রাত্রিযাপন শেষে পরদিন বিদায়ের পালা। হোটেল ম্যানেজার পুরো নামটা মনে নেই। তবে উপাধিতে তিনি চোপড়া। তাঁর শেষ অভিবাদনের ভাষা এখনো পরিষ্কার মনে আছে। তিনি গভীর আন্তরিকতার সাথে বললেন, “আপনারা আমাদের আত্মীয়।” ভাবলাম বাণিজ্য বিশ্বের বাইরেও মানুষের অন্তর্গত মনের অস্তিত্ব এখনো মুছে যায়নি। একখানা করে ঘিয়ে-ধূসর রঙের উত্তরীয় তিনি নিজ হাতে পরিয়ে দিলেন একে একে সবার গলায়। তারপর ছবি তোলার হিড়িক পড়লো ক্যামেরাগুলোয়। অনাত্মীয় দেশে এমন উষ্ণতা অভাবনীয়। তিনি পুনরায় ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। কাঠমুন্ডুর শেষ দৃশ্যগুলো মনের ভেতরে গেঁথে পথ চললাম। আবারও ক্লান্তিকর বাস জার্নির ১৪ ঘণ্টা অতিক্রম করে নেপাল সীমান্ত পার হলাম। সেখান থেকে শিলিগুড়িতে আমাদের বিশ্রাম। এরপর পুনরায় ভারত-বুড়িমারি সীমান্ত পেরিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এদিকে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্কটা পেতেই মনে হলো—স্বদেশের ফুরফুরে বাতাস মনটাকে ঘরে ফেরার তাগাদা দিচ্ছে। তবুও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পুনশ্চ ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই।’ সে দেখা হয়তো মুসাফের/অতিথির মতো। কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু এই দীনহীনের পোষায় কি? শেষ-পর্যন্ত পোষায় কারণ সাদা মেঘে সবুজ পাহাড় ছেয়ে গেলে জীবনটাও হয়ে ওঠে শুভ্র-সবুজ।