এত কিছু চিন্তা করেননি তিনি মোটেও। কখনো নিজেকে এমিলি ডিকিনসন কিংবা সিলভিয়া প্লাথ হিসাবে ভুলেও ভাবেননি। এমনকি আদৌ কোনো কবিতাও লিখতে চাননি তিনি। বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর ভয়ানক আগ্রাসনে আর পাঁচজন সামাজিক মানুষের মতোই কোয়ারেন্টাইনে আবদ্ধ হয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিটি ও’মিয়ারা একজন অবসরপ্রাপ্ত চ্যাপলেন (ধর্মীয় নির্দেশক) ও সাবেক শিক্ষিকা। তিনি বসবাস করেন আমেরিকার উইসকনসিন স্টেটের ম্যাডিসনের কাছে। তার সহবাসী হলেন তার স্বামী ফিলিপ ও’মিয়ারা আর পাঁচটি কুকুর।
তবে হ্যাঁ, ফেসবুক আইডি আছে তার, লেখেন যখন যা খুশি স্টেটাস—যেমন আজকাল প্রায় সবাই ব্যবহার করে এই সামাজিক মাধ্যম। আর তিনি ব্লগে লেখেন।
যখন জানা গেল যে মহামারি ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে এবং সেটাকে ঠেকাবার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই তখন তিনি উদ্বিগ্ন, ক্রুদ্ধ ও বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। তিনি তো আগে হাসপাতালে রোগীদের আধ্যাত্মিক পরামর্শ দিতেন, তার বন্ধুরা অনেকেই সেখানে কর্মরত ছিলেন তখনও। সেই বন্ধুরা কেমনভাবে সময় কাটাচ্ছেন, তাদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা এইসব তাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছিল। তখন তার স্বামী তাকে পরামর্শ দেন যে কিটি যেন তার ভাব ও ভাবনাগুলো লিখে ফেলেন।
ফিলিপের এই প্রণোদনাতেই কাজ হয়েছিল। মিনিট বিশেকের মধ্যে গদ্যছন্দে শিরোনামহীন একটা রচনা তৈরি হয়ে গেল। রচনাটি তিনি নির্মাণ করলেন, নাকি তার মধ্য দিয়ে নাজেল হলো—এ নিয়ে কাব্যতাত্ত্বিকেরা বরাররের মতোই বিতর্কে লিপ্ত হতে পারেন। কিন্তু এটি যে কোনো কবিতা ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির নিছক উৎপাদন নয়, বরং কিটির অন্তর হতে একটি স্বতোৎসারণ, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না লেখাটি পাঠ করলে : ওয়ার্ডসওয়ার্থ যাকে বলেন, ‘spontaneous overflowing of powerful feelings’। আর আধ্যাত্মিক উপদেষ্টার ধ্যানী ও কল্যাণকামী মনের পরিচয়টাও পেয়ে যাই আমরা কবিতাটি পড়ে।
করোনাকালে কী কী করে সময় কাটানো যেতে পারে তা বলবার পর করোনাকালের পরবর্তী কেমন পৃথিবী আমরা চাই তারও একটা সম্ভাব্যতা আঁকা হয়েছে কবিতাটিতে। এই বিপর্যয়ের কালে, এই বিষণ্ণতার যুগে স্বেচ্ছায় গৃহে অন্তরীণ থেকে কী কী করে আমরা শারীরিক-মানসিক-আত্মিকভাবে ভালো থাকতে পারি আর কাটিয়ে দিতে পারি এই করোনাগ্রস্ত সময়, তার একটি সহজসরল তালিকা রয়েছে কবিতাটিতে। অথচ কোনো হিতোপদেশের ভঙ্গিমায় নয়, নিছক সহজ সরল বর্ণনায়, ছোট-ছোট বাক্য ও বাক্যাংশে উল্লিখিত হয়েছে সব কিছুই। বলতে পারি এটি একটি মহান স্তোত্র ও দেশনা।
তিনি এটা তার ফেসবুক দেয়ালে পোস্ট করলেন। কবেকার কথা? তার ব্লগ “The Daily Round”-এ ১৬ মার্চ ২০২০ তারিখে কবিতাটি রয়েছে। সেই সময়ের দিকেই কবিতাটি লেখা, ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ফেসবুকে প্রকাশ হবার পর অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল কিটির জীবনে।
প্রথমে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল ফেসবুকে। তারপর এটি পড়লেন ধ্যানগুরু দীপক চোপড়া। তিনি এর সবিশেষ প্রশংসা করলেন একটি পত্রিকায়। এর ফলে তারপর এটি ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি তাবৎ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ল। কেউ এটায় সুরারোপ করতে চাইল, কেউ চাইল গ্রন্থভুক্ত করতে। পত্রপত্রিকায় কবিতাটি নিয়ে লেখালেখি শুরু হলো। তার সাক্ষাৎকার ছাপাতে লাগল বিভিন্ন গণমাধ্যম।
তখন উল্টোস্রোত বইতে শুরু করল। তা তো করবেই, নইলে কাহিনী জমবে কী করে? পাশ্চাত্য সংগীতে পয়েন্টের পর কাউন্টার পয়েন্ট আসে। ভারতীয় সংগীতে বাদী স্বরের বিপরীতে আছে বিবাদী স্বর।
তো, কী ঘটল?
সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন জন পোস্ট দিয়ে দাবি করতে থাকলেন, এই কবিতাটি আগের কারো রচিত। কেউ বললেন, এটা ১৮৬৯ সালে রচিত। ঊনিশ শতকের ফরাশি-আইরিশ ঔপন্যাসিক ও জীবনীকার ক্যাথলিন ও’মিয়েরা (এটা তার কলমি নাম, আসল নাম গ্রেইস র্যামসে) কবিতাটির রচয়িতা বলে দাবি তুললেন তারা। আবার অন্য কেউ-কেউ বললেন, এটি ১৯১৯ সালে লিখিত কিংবা পুনর্মুদ্রিত কবিতা। তারা বললেন ১৯১৮ থেকে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুর পটভূমিতে এটা রচিত। কিন্তু সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এটা ১৮৬৯ বা ১৯১৯ সালের রচনা নয়, ২০২০ সালের মার্চ মাসে ক্যাথারিন (কিটি) ও’মিয়ারা এটা রচনা করেন।
এই কবিতা রচনায় তার কৃতিত্ব বিষয়ে কিটি বলেন, “এই কবিতার জন্য আমি কোনো কৃতিত্ব দাবি করি না। কারণ আমি জানি, যে-সামর্থ্য দিয়ে আমি শব্দগুলো গ্রথিত করেছিলাম তার চেয়ে অনেক বড় শক্তি আমার আত্মা, আর ওই মুহূর্তটিতে সে-ই ওইসব কথা ঢেলে দিয়েছিল। আমি আসলেই কোনো কৃতিত্ব নিই না কেবল এইটুকু ছাড়া যে, আমি গ্রাহক হয়ে উঠেছিলাম, লিখেছিলাম ও পোস্ট করেছিলাম। আমি জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্স বা ডিলান টমাস বা টি এস এলিয়ট বা ম্যারি অলিভার নই। আমি কেবল ওটা পোস্ট করেছিলাম আর ওটা চলে গিয়েছিল।”
এই কবিতার জন্য অনেকে কিটিকে ‘পোয়েট লরিয়েট অব প্যান্ডেমিক’ অর্থাৎ ‘মহামারির মুখ্য কবি’ অভিধায় ডাকতে শুরু করেছেন। সমকালীন প্রবল বিষয়ের সাথে সম্পর্ক রেখে, দুঃসময়ের অন্ধকারে আশাব্যঞ্জক ভাবের আলো-ফেলা ও ধ্যানমগ্ন উচ্চারণের এই কবিতা সঙ্গত কারণেই সাড়া জাগাতে পেরেছে।
শুধু একটি কথাই রয়ে গেল। পৃথিবীর অসুখ পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে হলে মানুষের আগে নিজেদেরকে সারিয়ে তুলতে হবে। শুধু শারীরিকভাবেই নয়, বুদ্ধিগতভাবে, অনুভূতিগতভাবে, আত্মিকভাবেও। তবেই আমরা সুস্থ-সুন্দর পৃথিবীকে পাব। এই কথাটি একটু নিভৃত ভঙ্গিতে ইশারায় বলে গেছেন কবি।
মহামারির সময়ে
কিটি ও’মিয়ারা
এবং লোকেরা সব ঘরেই থেকেছে।
এবং শুনেছে তারা, পড়েছে গ্রন্থরাজি, নিয়েছে বিশ্রাম আর ব্যায়াম করেছে আর শিল্প বানিয়েছে আর মেতেছে খেলায় এবং শিখেছে তারা হয়ে উঠবার নানা পথ এবং থেকেছে স্থির।
এবং শুনেছে তারা আরো বেশি গভীরতা নিয়ে। কেউ-বা থেকেছে ধ্যানে, প্রার্থনায় মগ্ন রয়েছে কেউ, কেউ-বা নেচেছে। কেউ-কেউ আপন ছায়ার সাথে করেছে সাক্ষাৎ। এবং লোকেরা সবে ভাবতে থেকেছে খুব ভিন্ন রকম।
এবং লোকেরা সেরে গেছে।
এবং যখন সেই মানুষেরা উপস্থিতিহীন ছিল—যারা বাঁচে মূর্খতায়, বিপদজনকভাবে, নির্দয়তায়—পৃথিবীও ক্রমে সেরে উঠতে লাগল।
এবং যখন নিল আপদ বিদায়, লোকেরা মিলল ফের পরস্পর, দুঃখ করল ক্ষয়ক্ষতির জন্য, নতুন-নতুনভাবে বেছে-বেছে নিল, দেখল নতুন স্বপ্ন, আর বেঁচে থাকবার নতুন নতুন পথ তৈরি করল, আর পৃথিবীকে তারা পুরোপুরি সারিয়ে তুলল—যেহেতু নিজেরা তারা উঠেছে সেরে।