২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর অন্তত মাস ছয়েক সুপার মার্কেট, শপিংমল, টিউব স্টেশন যেখানেই গিয়েছি, কেনাকাটা করার সময় স্বতঃচালু হয়ে যেত আমার মানসিক হিসাবযন্ত্র (Mental calculator)। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম যেদিন সম্ভবত ৪০ পাউন্ড দিয়ে (স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট তখনও পাইনি) মান্থলি ট্র্যাভেল কার্ড কিনলাম, নিদারুণ মর্মবেদনা অনুভব করেছিলাম এই ভেবে যে, আহারে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা চলে গেল শুধু গাড়ি ভাড়ায় (তখন বাংলাদেশে একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার বেতন সাকুল্যে সাত আট হাজারের মতো)! একদিন ব্রিকলেনে হণ্টন করতে করতে চায়ের তেষ্টা পাওয়ায় বাংলা টাকায় সার্ধশতের শ্রাদ্ধ করে বারংবার নিকেশ করছিলাম এই টাকায় বাংলাদেশে কয়কাপ চা পান করা যেত! হারাম-হালাল না বুঝে KFC-তে একদিন চিকেন উইংস, ফ্রাইজ আর কোক খেয়ে ছয় পাউন্ডের মতো বিল দিয়ে (পাউন্ড-টাকা ১২০-১৩০ বিনিময় হারে প্রায় ৭৫০-৮০০ টাকা) ছয় পাউন্ডের বিরহব্যথায় ছয়দিন কাতর ছিলাম! এভাবেই পাউন্ড-টাকার অটো কনভার্শনের নাগর দোলায় দুলতে দুলতে মাস দুয়েকের শ্বেতদ্বীপবাস হয়ে গেল। মাথার চুল জানান দিচ্ছিল নরসুন্দর-সুন্দরীর কাছে দ্রুত না গেলে কদর্য এশীয়র নরাধম হতে বেশি সময় লাগবে না।
এরই মধ্যে প্রিয় বন্ধু ডা. হাসনাত যাকে আমরা ‘কবিরাজ’ বলে ডাকতাম, দেখি চুল কাটার সরঞ্জাম খরিদ করে রীতিমতো স্বনির্ভর হয়ে গেছে। কবিরাজ ইতোমধ্যে তার বিনেপয়সার সার্ভিস অফারও করেছে। কিন্তু তার ভাবসাব সুবিধের ঠেকছিল না। বন্ধুবর ছিল গোঁফের স্বঘোষিত বৈশ্বিক শত্রু। আমার গোঁফে সে এর মধ্যেই বার দুয়েক ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেছে। একবার তো সে ‘মোর ঘুমঘোরে’ নাপিত-মনোহর হয়ে এসেছিল। ভাগ্যিস, ত্বরিত প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়ায় দোস্তের ওই গোঁফ-বিরোধী অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়েছিলাম। তদুপরি, এই অনভিজ্ঞ কৈশিক শৈল্যবিদের কাছে মুফতে ‘ছিলা মুরগি’ টাইপ কাট লাভের সমূহ আশঙ্কা ছিল। ফলে, চিকিৎসক-নরসুন্দরের ছুরির নিচে সচেতনভাবেই গেলাম না। ইয়ারকে শুধু বললাম, ‘আমি একজন Ph.D-র কাছেই চুল কাটাব, MBBS, PLAB-1-এর কাছে না।’
‘Ph.D-র হাতে চুল কাটাবা মানে?’—রাগী ভীষণ দেমাগী ভঙ্গিতে জানতে চায়।
‘Professional Hairdresser এর কাছে’, দৃপ্তকণ্ঠে জবাব দিলাম।
আমার উত্তর শুনে মুহূর্তেই কবিরাজের রক্ত-চক্ষু চাহনি প্রীতিময় অট্টহাসিতে অনূদিত হয়ে গেল।
আগেই নিয়ত করে ফেলেছিলাম শ্বেতদ্বীপে এসে শ্বেতকায় নরসুন্দরের কাছেই কেশকর্তন করাব। জানতাম, টাকা হয়তো একটু বেশি যাবে। শখের তোলা আশি টাকা! ফলে ভাবটা ছিল ‘কুচ পরোয়া নেহি’। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম, বিলেতে এসে ভদ্দরনোক হবার নেশায় তিনি অনেক দাম দিয়ে স্যুট-কোট বানিয়েছিলেন, রীতিমতো টিউটর রেখে পিয়ানো-নাচা-গানা শেখার কোশেশ করেছিলেন। আমি তো আর গাঁধীর পথ মারাচ্ছি না—সামান্য চুল কাটাই তো! তাছাড়া, ‘আমরা সবাই রাজা’ ঘোষণানুসারে আমিও একজন রাজা। চুলই হচ্ছে আমার ‘কোহিনূর’—অমূল্য মুকুট! মহাজনেরা উমদা কথাই বলেছেন, ‘Invest in your hair. It is the crown you never take off.’
পরিকল্পনামতোই পরেরদিন এক সফেদ নরসুন্দরের সেলুনে গেলাম। খালি চেয়ার পেয়ে বসে পড়লাম। শ্বেতাঙ্গ নাপিত তার ঢাল-তলোয়ার নিয়ে রণপ্রস্তুতি সেরে ফেলল। ভদ্রলোকের ছুরত আর বয়স দেখে আশ্বস্ত হলাম। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের কথাটা এক্ষেত্রে স্মর্তব্য—Beware of the young doctor and old barber. যাক বাবা, কোনো বুড়ো নাপিতের পাল্লায় তাহলে পড়িনি!
বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
arts.barta@gmail.com
শুভ্র নাপিত দ্রুত রণদামামা বাজিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কথা বলে জানলাম, ভদ্রলোক পোলিশ, নাক উঁচা ইংরেজ নন। একটা ‘হালকা হইতে মাঝারি’ মাত্রার ধাক্কা খেলাম। বিশ্বব্যাপীই নাপিতরা Verbal diarrhoea-য় ভোগেন। এ মহাজন দেখি নাপিতকূলের প্রবাদপ্রতিম বাচালতার উল্টো দিকে অবস্থান করছেন। হয়তোবা ভাষাগত কারণেই তার এই অ-নাপিতসুলভ বাকসংযম। Let English barbers in Thames melt—এই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলাম যে লেসওয়ালেসার এই দিশি কমরেডও হয়তো ভাবেন—‘I speak hair. English is my second language.’ সত্যিই তো, তামাম জাহানের সব কেশশিল্পীর প্রথম ভাষা হচ্ছে ‘চুল’। সে জবানে এ কেশযোদ্ধা আমার সাথে মিনিট বিশেক ‘ঘ্যাচাঙ ঘ্যাচাঙ’ বাতচিত করলেন। আমিও ছোট্ট বেলায় বিনা প্রশ্নে সোনাইয়া নাপিতের কাছে মাথা সঁপে দেওয়া একান্ত বাধ্যগত বালক হয়ে বেজঙ্গম, লা-জবান থাকলাম। কর্ম সম্পাদন হলে আমি ‘Leave me mother, let me cry’ ভাব নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। ‘I am glad, it’s over!’ তবে ভদ্রলোক ছয় পাউন্ডের বিনিময়ে এমন হেয়ারকাট দিয়েছিলেন, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সপ্তাহখানেক ঊন-কোয়ারেন্টিনব্রত পালন করেছিলাম। মানবমুখে রীতিমতো জ্যামিতিক অসৌন্দর্য—কুরিদের দেশের ক্ষৌরকারের করকারিকুরিতে আমার চেহারা মোবারক অনেকটা অপ্রতিসম রম্বসের আকার ধারণ করেছিল!
এই এক পোলিশ কাট আমার কেশকর্তন ভাবনায় কোপার্নিকান বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল। আর ইউরোপীয় নাপিতের বেলতলায়? নৈব নৈব চ। এক কাটে মাস তিনেক কাটিয়ে দেওয়ার পর আরশিতে নিজের দিকে তাকিয়ে বারবার আমার নবতিপর পিতামহীকে মনে পড়ছিল। চুল একটু বড় হলেই দাদি বলতেন, ‘অ মুন্সি (আদর করে নাতিদের তিনি মুন্সি ডাকতেন) চুল তোর ফাঁস (সার বা পুষ্টি) টানি ফেলার। ক্ষেমাইশ্যাততুন চুল হাডি আগৈ (অনুবাদ: ও মুন্সি, চুল তোর শরীরের পুষ্টি শুষে নিচ্ছে। ক্ষেমাইশ্যা নাপিতের কাছে গিয়ে চুল কেটে আয়)।’ পরে জেনে অবাক হয়েছি, আমার দাদির তরিকায় অনেক মহাত্মাও চিন্তা করেছেন।
এই যেমন Weike Wang আমার পিতামহীর প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, ‘My mother has a theory about hair. It is that the longer the hair grows, the dumber a person becomes. She warns that too much hair will suck nutrients away from the head and leave it empty.’ দাদির অদৃশ্য নেত্র-রাঙানিকে প্রিয়তমার সৌন্দর্যতিলক মনে করে এবার চুল কাটাতে গেলাম ব্রিকলেনে। ট্যাকের টাকার চিন্তা না করে ঢুকলাম একটা ভদ্রদর্শন সেলুনে। কোথায় যেন দেখেছিলাম—
Cheap Haircuts
Are Not Good!
Good Haircuts
Are Not Cheap!
কথা খাসা, নিঃসন্দেহে। দেখলাম কয়েকজন Tonsorial artist শিল্পীর অভিনিবেশ নিয়ে কেশকর্তনে ব্যস্ত। আহা! এই লন্ডনের ফ্লিট স্ট্রিটেইতো একদা খুনের মচ্ছবের পুরুত হয়েছিলেন এক দানব-নাপিত (Demon barber of Fleet Street)! আমার সামনের এই ক্ষুরশিল্পীদেরই তো পেশাগত ভাই ছিলেন Sweeney Todd নামের ওই নাপিত যার রক্তপিপাসা নিয়ে বাজারে চালু আছে হাজারো গালগল্প। আমার পালা আসলে দেখলাম, নিতান্ত নিরীহ দর্শন নাপিতের ভাগে পড়েছি। সুইনিকে ভুলে নিশ্চিন্তে তার ছুরি-কাচির নিচে মাথা সোপর্দ করলাম।
মায়াবী মুখের এই ছোকরা পোলিশ নাপিতের মতো মিতবাক নয়। পাকিস্তানি এ যুবক বেশ কথাবার্তা বলল। সঙ্গত কারণেই, বাংলাদেশের চাইতেও তার আগ্রহ বেশি সিলেট নিয়ে। বেশ যত্ন করেই চুল কাটল। অভিজ্ঞ ভাষাবিদের মতো যথার্থই রায় দিল আমার কথা বলার ধরন সিলেটীদের মতো নয়। সন্তুষ্টচিত্তে বিল দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হলো এ নরসুন্দর আসলে Part artist, part therapist, part stylist! পরবর্তীতে এ হেয়ারকাট নিয়ে ডা. হাসনাত মন্তব্য করেছিল, ‘এই নাপিত তোমার চেহারার ছিনতাইকৃত মায়াবী ভাবটা পুনরুদ্ধার করেছে!’ যাক বাবা, পয়সা তাহলে উসুল হলো!
আশির আহমেদের ‘জাপান কাহিনী’ পড়ে জেনেছি, জাপানি ভাষায় নাপিতকে বলা হয় Riyoshi বা চুলকাটা প্রকৌশলী। আসলেই, একজন নাপিত বহুজ্ঞানকাণ্ডে বিচরণকারী এক প্রকৌশলী—তিনি একধরনের চলিষ্ণু বিদ্যাকল্পদ্রুম! একজন নাপিত জীবন্ত সংবাদপত্র, রাজনীতি বিশ্লেষক, কলাকৈবল্যবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, ভাষাবিদ, সর্বোপরি একজন টকারু বা বাকশিল্পী! তবে বহুজাতিক শহরে এথনিসিটি, ভাষা আর সংস্কৃতিও মনে হয় সেলুন পছন্দে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। তাই তো পোলিশ নরসুন্দর আমার চেহারাকে অপ্রতিসম রম্বস বানিয়ে দিয়েছিল। বিপরীতে, ব্রিকলেনের পাকিস্তানি-বাংলাদেশী নাপিত আমার দৃষ্টিতে হয়ে উঠেছিল ভিডাল স্যাসুন কথিত কৈশিক-স্থপতি (Architect of hair)! আর সেকারণেই বিলেতবাসের প্রায় তিন বছর পরিপূর্ণভাবে পরিপাটি হতে (এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য উক্তি—You are never fully dressed without great hair) অনেক দূরের শুটার্স হিল থেকে ছুটে যেতাম দেশীভাই শুক্কুর আলিদের কাছে। আমাদের একান্ত নিজস্ব কৈশিক স্থপতিদের কাছে।