নিদা ফাজলির পাঁচটি গজল

অনুবাদ কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

ভূমিকা ও অনুবাদ: সৈয়দ তারিক | 2023-09-01 04:18:11

নিদা ফাজলির পুরো নাম—মুকতিদা হাসান নিদা ফাজলি। জন্ম তার ১৯৩৮ সালে। হিন্দি ও উর্দু ভাষার খ্যাতনামা কবি, গীতিকার ও সংলাপ রচয়িতা। সাহিত্যে অবদান রাখবার জন্য ২০১৩ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করে।

দিল্লিতে জন্ম তাঁর একটি কাশ্মিরী পরিবারে। গোয়ালিয়রে বড় হন ও সেখানেই পড়াশোনা করেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। তাঁর বাবাও উর্দু ভাষার কবি ছিলেন। দেশবিভাগের আঠার বছর পর ১৯৬৫ সালে তাঁর পিতৃপরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। ফাজলি ভারতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জীবিকার সন্ধানে মুম্বাইতে চলে গিয়েছিলেন। পরিবারের সাথে এই বিচ্ছেদ তাকে সারাজীবন বেদনাবিদ্ধ করেছে।

তরুণ বয়সে একবার এক মন্দিরের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলেন এক গায়ক সুরদাসের ভজন গাইছে। রাধা তার সখিদের কাছে কৃষ্ণবিরহে তার মনোবেদনা ব্যক্ত করছিলেন। মানুষের মধ্যকার নিবিড় প্রেমবন্ধন বিষয়ক এই পদ শুনে ফাজলি অনুপ্রাণিত বোধ করেন। তিনিও কবিতা লিখবেন, এই ইচ্ছা জাগে তাঁর মনে।

এইসময় তিনি মির্জা গালিব ও মির তকি মিরের কবিতার সারবস্তু ভালো করে আত্মস্থ করেন। মিরা বাই ও কবিরের ভজনের ভাব তাকে মুগ্ধ করে। টি এস এলিয়টের কবিতা, গোগল ও চেখভের কথাসাহিত্য তাঁর সাহিত্যবোধকে সমৃদ্ধ করে।

ধর্মযুগ ও ব্লিৎস পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে। তাঁর কাব্যশৈলী সিনেমানির্মাতা এবং হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের লেখকদের আকৃষ্ট করে। বিভিন্ন মুশায়েরায় কবিতা পড়বার আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। তাঁর গজল, নজম ও দোহায় মৌখিক ভাষা ও ভঙ্গি ব্যবহার করেন তিনি। কঠিন বা জটিল শব্দ ও শৈলী এড়িয়ে সহজ ও সাবলীল করে তোলেন তাঁর কবিতা। এইটা তাঁর কবিতাকে খুব জনপ্রিয় করে তোলে। সিনেমায় তাঁর লেখা গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

এর মধ্যে এক ঘটনা ঘটে। তাঁর সমকালীন ষাট দশকের কবিদের নিয়ে তিনি সমালোচনামূলক লেখা লেখেন। এর ফলে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সাহির লুধিয়ানভি, আলি সরদার জাফরি ও কাইফি আজমি’র মতো কবিরা খুব ক্ষেপে যান তাঁর ওপর।

১৯৬৯ সালে তাঁর কবিতার বই প্রথম প্রকাশিত হয়। শৈশবের স্মৃতিকাতর বিষয়আশয়ের চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ তাঁর কবিতা। জীবনের দ্বন্দ্বসঙ্ঘাত, উদ্দেশ্য সন্ধান, মানব সম্পর্কের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বলা ও করার মধ্যে বৈপরীত্য, হারিয়ে যাওয়া বিষয়ের জন্য বেদনা, ধর্মের সারবস্তু ও তার প্রচলিত রূপের বৈপরীত্য—এইসবই তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু।

নিদা ফাজলির কবিতায় মনের নানারকম ভাব ফুটে উঠেছে। তিনি মনে করেন অন্তরপ্রেরণা ও সৃষ্টিশীল অনুভূতিই কবিতার উৎস। চিত্রকর কিংবা বাদকের মতোই কবিরও অনুভূতি। অন্যদিকে সিনেমার জন্য গান লেখা খানিকটা যান্ত্রিক ব্যাপার, যা চিত্রনাট্য ও পরিচালকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হয়। তিনি অবশ্য জীবিকার প্রয়োজনে সিনেমাগীতি রচনার কাজটিকেই গ্রহণ করেছিলেন।

তাঁর প্রিয় কবি কবিরের মতো তিনি সহজ ও সরাসরি ভাষায় কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতা তাঁর অভিজ্ঞতার প্রকাশ, নিছক শব্দের খেলা নয়। নিদা ফাজলির কবিতা অন্তরের ঐশ্বর্যে পূর্ণ। দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার ভাষা হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণ। ফলে প্রতীকীভাবে এটি ভারত-পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক।

নিদা ফাজলি সুফি ভাবধারাকে অনুসরণ করতেন। তিনি পছন্দ করতেন কবির ও আমির খসরুর রচনা। কারণ এই ভাবধারা ঈশ্বরকে উপাসনালয়ে নয় বরং মানব হৃদয়ে উপস্থিত দেখে, এই ধারা সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদের বাইরে অবস্থান নেয়।

চমৎকার অনুভূতিশীল মানুষ ছিলেন নিদা ফাজলি। একবার জানুয়ারি মাসের রাতে গোরখপুরে ওয়াসিম বারেলভি আর নিদা ফাজলি কবিতা পড়তে মঞ্চে উঠেছেন। বারেলভি অনুযোগ করলেন যে ঘন কুয়াশায় দর্শক-শ্রোতাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ফাজলি মন্তব্য করলেন, তাদের কবিতার আলো জ্বললেই দর্শকদের মুখ আলোকিত হয়ে উঠবে।

নিদা ফাজলি ২০১৬ সালে প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সমকালীন আরেক বিখ্যাত কবি ওয়াসিম বারেলভি বলেন, ‘তার কবিতার মাঝে একটি পুণ্যবান মানব হৃদয় ধ্বনিত হয়। তাঁর উদ্দীপনাময় রচনাবলি বেঁচে থাকবে।’


গারাজ বরস পিয়াসী ধারতি পার ফির পানি দে মাওলা

আবার দাও গো পানি পিপাসিত পৃথিবীকে, ওগো মাওলা,
দাও শস্যদানা পাখিদের, মিষ্টি দাও শিশুদের, ওগো মাওলা।

দুই আর দুই যোগ দিলে চার হয়,
দাও সরলতা বুদ্ধিওয়ালাদের, ওগো মাওলা।

বিষের পেয়ালা করো উজ্জ্বল আর ক্রুশ করো ঝলমলে আবার,
মিথ্যার এ জগতে সত্যকে ক্ষমতা দাও, ওগো মাওলা।

মূর্তি হতে বের হয়ে আরো একবার নিজেকে ছড়িয়ে দাও,
মন্দিরকে দাও কোনো মীরাকে আবার, ওগো মাওলা।

তুমি থাকতেও কেন একে অপরের জানের দুষমন হতে পারে?
জীবিতদের শান্তিতে মরতে দাও, ওগো মাওলা।

জব কিসি সে কোই গিলা রাখনা

যখনই তোমার রাগ হয় কারো ওপর,
নিজের সামনে আয়না রেখো।

আলোর সাথে এমন সম্পর্ক রেখো
যেন বাতাসেও মোমবাতি রাখতে পারো।

তোমার বাড়ির নকশা যেমনই হোক,
একা একা কাঁদবার জন্য একটু জায়গা রেখো।

কারো সাথে মিলিত হওয়া যদি জরুরি হয়,
মিলনের জন্য যেতে সাহসটুকু রেখো।

বহুত খুবসুরত হ্যায় আখে তুমহারি

দারুণ সুন্দর চোখদুটো তোমার

যদি আশীর্বাদ পায় আমাদের প্রেম

ভাগ্য তবে প্রসন্ন হবে।

সবচেয়ে অনবদ্য শৈলী তুমি

আমার হৃদয়ের গোপন রহস্য তুমি

যখন থেকে তোমার কমনীয়তায় মুগ্ধ হয়েছি

সব অস্থিরতাই আমার জন্য শান্তি
হয়ে গেছে।

যখন তুমি আমার নজরের সামনে ছিলে না

তখন না ছিল কোনো চন্দ্রলোক না কোনো সূর্যকিরণ

তোমার অনুমতি আর তোমার হুকুমত

আমার কাছে বেহেশত, আমার কাছে পৃথিবী।

ধূপ মেঁ নিকলো ঘাটাওঁ মেঁ নাহা কার দেখ

বাইরের রোদে যাও, বৃষ্টিতে ভিজে দেখো;
জীবন যে কী তা বই সরিয়ে ফেলে দেখো।

সে এক তারকা, তাকে চোখে চমক তুলতে দাও,
কোন দরকারে তাকে শরীর বানিয়ে দেখো?

এমনকি পাথরেরও মুখ ও হৃদয় আছে,
আপন ঘরের দেয়াল ও দরজাকে সাজিয়ে দেখো।

চোখের দূরত্ব ধোঁকা দিতে পারে,
তাকে পাও কি পাও না তা হাত বাড়িয়ে দেখো।

দুনিয়া জিসে কেহতে হ্যাঁয় জাদুকা খিলোনা হ্যায়

যাকে দুনিয়া বলে সেটা একটা জাদুর খেলনা,
যদি পাও তবে সে কাদামাটি, হারালে সে সোনা।

কোথাও সে মনোহর ঋতু, নির্জন জগৎ;
যদি থাকে বিষাদ সারাক্ষণ, তো অনন্ত কান্না।

বৃষ্টিভরা মেঘ তো পাগল, জানে না সে
কোন রাস্তা শুকনা রাখবে, ভেজাবে কোন উঠান।

দুঃখ আর সুখ দুটোই ক্ষণিকের;
আবার পথের পর পথ, কোনো উঁচু-নিচু নাই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর