গৌরীবাক্যে
কাহার গ্রীবায় আহা আমার হরফ, কাহার চিবুকে বহে আমার বাক্যরীতি, আমাদের বাগগরিমায় এই তো ভোর-ভোর নদী বহে যায়, দেহে লাগে স্নান...
এমনই তো বান্ধা আছিল সুন্দরী-গাছের জাদুতে মগ্ন সুতীব্র বনাঞ্চল! আছিল মোম ও মধু, হালুম তীক্ষ্ণ, মৎস্য শিকার আর সুখের আহার... সেইসব আতপের দিনকাল! ছিল গৌরীর সুখে পুরানো নগরে এক গোষ্ঠের রীতি... আজ ছিঁড়া-ছিঁড়া স্মৃতির মাধুরী ভীত দেয়ালায় পাক খায়! শ্বাসবন্ধ উচ্চারণ হেতু জাগে না হরফ আর! বাজে না খঞ্জনি, বিপর্যস্ত শব্দেরা সকলে ঘুমায়।
এই আন্ধারে, মালভূম-তৃণভূমে, রুখাশুখা মাটিতে রক্তিম, ঝরে যায় মেটাফর... দেহের ভগ্নাংশ হতে মিথগুলি খসে খসে যায়!
যদিও তো সুন্দরবন জেগে থাকে। নামাজ আদায় করে নৌকা ছাইড়া দ্যান শিব। তরী এসে লাগে পার্বতীপুরে। মানুষের নাথ, প্রকৃতির প্রাণনাথ, খন্দকারের দাওয়ায় খাড়ান। তখন গোধূলি, হলদে জামদানী একখান মাটিতে ছড়ানো... তখন অতিধীরে জোছনা ফুটিতেছে শিবের জটায়! পরিশ্রান্ত শিব, বিচলিত শিব, তবুও তো অটলই থাকেন। ধীর ও গম্ভীর, পরম যত্নে কাঁধে তুলে নেন দেহ কার! ভাঙ্গে পাহাড়, নদীতে বিপর্যয়, সমুদ্রে ঢেউগুলি বিস্ফারিত হতে থাকে, অরণ্য আছাড়ি-পিছাড়ি... দেহের ভগ্নাংশ হতে মিথগুলি খসে খসে যায়, ঝরে পড়ে মেটফরগুলি।
আমার বাক্যরীতি পরিসর ভাঙে, দেশ গড়ে দেহের ভিতরে ভিতরে, বালুচরে, জোয়ার-ভাটায়
কোজাগরী তোমারে আবার
তোমারে পেয়েছি এক আঁধারের দিনে কোজাগরী!
নদীতে রক্ত ছলকায়
ফসলের মাঠে ওড়ে অগণন ড্রোন
লাশগুলো বড়রাস্তার মোড়ে নীরবে নীরবে
পড়ে থাকে আমাদের ব্যর্থ কবিতায়
ঠান্ডাঘরে ছাপা হয় প্রেসনোট,
দূর এক মাঠে ইস্পাত নেমে আসে,
দাঁত চেপে বসে তোমার ভুবনে আজ
হিন্দিপেরেকে আর দিল্লিপেরেকে
কারা যেন দেওয়ালে দেওয়ালে
গেঁথে রেখে গ্যাছে তোমার সে সকল বান্দার শরীল
শস্যক্ষেতের ওপর পূর্ণিমা দেখে যারা
আজন্ম আশিকান হতে চেয়েছিল,
তাহাদের জিভ হতে, বাগমুখরতা হতে
কারা যেন ভাষা ছিঁড়ে নেয়!
আমাদের পানিতে পানিতে
দ্রুতবেগে ছুটে যায় দস্যুট্রলার
তবু তুমি মায়াময় আলো,
ফসলের অপারমহিমা!
যেমন এ ব্যক্তিগতে ক্যামনে ক্যামনে খুব
স্মৃতিলেখা হয়ে গ্যাছো, সকলই তো জানো,
কিছুই নয় ধারণাতীত,
তোমারে চেনে নাই যারা
তারাই তো তস্কর
চুরি করে মধু খেয়েছিল, তারা খুব
ধানের কসম খেয়ে তাসের আড্ডায়
তোমারে বেচতে চেয়েছে!
তোমার ওই আলোমুখ
ভরে গ্যাছে হরেক বিষাদরেখায়;
আবডাল হতে পাঠ করি সেই গ্রহণসংকেত!
নদীতে তাকাই, দেখি রক্তের ঢেউ
চন্দ্রমা আলোতে স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে আবার
মাঠের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
মাতাল দয়ালচাঁদ!
তার গানে তৈরি হওয়ার সাধ জাগে আমাদের,
তোমারে পাবার সাধ পুণরায়
এই নাড়ির ভাষায়, চিরন্তন পাঁচালীর ঘোরে
এবাদত জাগে পুনর্বার
একদিন আলোর নীচেতে ওই আলোমুখ জুড়ে
পড়ে নেবো ফের
আমাদের পিরিত যা কিছু, যা কিছু পার্বণ,
শস্যস্বপ্ন আর ধানভাঙা মদের নরম গান
সে অনেক যুগলসাধনায় ডুব,
অনেক যুদ্ধের...
তোমারে ব্যক্তিগতে, সমষ্টির আকাশে পুনরায়,
সফল সে প্রবরণায়,
সফল সে পূর্ণিমায়, কোজাগরী
তোমারে আবার, তোমারে আবার
ব্লার
(জীবনানন্দকে)
বুঝি না আমরা
আমাদের ভিতরে কিভাবে
একটা হেমন্ত আসে
মৃদু শীতলতায়...
স্থির জলে একটি নৌকা কেমন
নীরব আলাপের কত
ছলাৎ জাগায়
মিশে যায় ফের, আমরা বুঝি না
আমাদের শিরা ও ধমনী জুড়ে
হেমন্ত বয়ে যায়
পুরানোকালের সিনেমায়
আলোছায়া, টেলিফোন...
কথার বিপরীতে
কী বলা যায়, ভাবনার আগেই
ঝিঁঝিপোকা জুড়ে
ঘন হয় নীরবতা!
কবিতা লেখার চেয়ে
বড় বেশি আমাদের
হেমন্তে পায়!
তবুও তো বুঝি না আমরা
আমাদের ভিতরে কিভাবে
একটা হেমন্ত আসে
চুপিসারে
মৃদু শীতলতায়
‘...অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল’
হেমন্তে দৃশ্যেরা মরে যায়
ছাই
কেননা মানুষেরই কোনো দাম নেই
তাই সে যা উচ্চারণ করে
গলাভর্তি জলে ডুবে
তাই সে সূর্যোদয় দেখে পাহাড়ে যে
গোপনে ওড়ার কথা বলে
কিম্বা স্বপ্নের ভিতর নক্ষত্রস্নানের দৃশ্য
দেখে সে যখন সবুজ সবজির কাঙ্ক্ষা
আর বনাঞ্চলে কিশোরীর গানের ভিতর
বৃষ্টি নামার আশা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে,
কিছুই চায় না তবু শ্বাসের আড়ালে থাকা
পরমার্থের খোঁজে সে যখন
উচ্চারণ করে ধ্বনিমধুরিমা
সেটুকুই কবিতা কি না কিম্বা
জানলার রোদ ত্বক স্পর্শ করে গেলে
মনে পড়ে, বৌদ্ধমঠের দিকে ধেয়ে আসা
বৈকালিক পাখিদের ঝাঁক কিম্বা নেহাত
ওষ্ঠের স্বাদ, গ্রীবার তন্দ্রা, নাভির আখ্যান—
হয়তো কবিতা হতে পারে
যেভাবে জগতের সমস্ত মঙ্গল ঝরে পড়ে বর্ষামঙ্গলে—
সেসবের কী বা মূল্য অবশিষ্ট আছে
মূল্যের অধিক তো কিছু নাই
এমনকি আমাদের রাত্রিজাগরণ—‘বাবু ঘুমায়ে যাও আমি জেগে আছি,
তোমার ঘুমের পাশে, জ্বরের শিয়রে...’
—রূপাকাঠি দিয়ে লেখা এমন উচ্চারণ
আর কিছু বাকি আছে নাকি!
মানুষেরই দাম নাই আর
মানুষের লেখা কবিতা তাও কবেই
আত্মধ্বংসের চিৎকার হয়ে পুড়ে গ্যাছে
সুতরাং কবিতা লেখার কোনো মূল্য চাইনি এখানে
বাছারা তোমরা লেখো দিস্তাদিস্তা
ছাপাও, পিঠ চাপড়াও একে অপরের
আমি দেখি বনাঞ্চলে ছাই উড়ে যায়
গাছেদের, হরিণের, বাঘের, এমনকি
মানুষেরও ছাই...
কবিতাটবিতা আমার এখন ছাইপাঁশ মনে হয়!