সেতু পার হলেই অন্য শহর। ট্রাক থেমে গেল সেতুতে ওঠার আগে। রাস্তা থেকে নিচের দিকে নামিয়ে রাখা হলো ট্রাকটি। রাশেদ লাফ দিয়ে নিচে নেমে পড়ে। উচুঁ রাস্তা থেকে দেখা যায় নিচে ট্রাক আর ট্রাক। কোনো ট্রাকেই মালামাল নেই। অন্য সময় দেখত খালি ট্রাকের পাশাপাশি পণ্য বোঝাই ট্রাকও থাকত। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাবার সময় বিশ্রাম নিয়ে নিত এখানে। নদীতে ভেসে থাকা কার্গোও খালি পড়ে আছে। চারদিকে মানুষজন নেই। মধ্যরাত হলে কী হবে, কখনো এই জায়গাটিকে ঝিঁমুতে দেখেনি রাশেদ। ও এখন চায়ের দোকান খুঁজছে। গাভীর দুধের চা এখানে ভালো পাওয়া যায়। এখানে চা না খেয়ে শহর ছাড়ার অভ্যেস নেই রাশেদের। ট্রাক থেকে লাফ দেওয়ার সময় পেছন থেকে বউ ডেকে বলছিল—এই সময় কোন মরা তোমার জন্য চায়ের দোকান খুলে বসে আছে? চা, বিড়ি, সিগারেট এমনকি পরাটা ডিমের খুপড়িও বন্ধ। একটা খুপড়ির সামনে চটের ছালা ঝুলে আছে, কিন্তু বেঞ্চিটা রয়ে গেছে আগের মতোই। রাশেদ বেঞ্চিটার ওপর বসে পড়ে। পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট বের করে। কিন্তু ওর সঙ্গে তো লাইটার, দেয়াশলাই নাই। চায়ের দোকানই যখন নাই, দেয়াশলাইর খোঁজ করে কী লাভ? বাসা থেকে বের হবার সময় চুলোর পাশে দেয়াশলাইর একটা বাকসো দেখেছিল। নিয়ে আসলেই হতো। কিন্তু এদিকটা যে মরুভূমি হয়ে আছে কে জানত।
বউ তো ট্রাকে ছেঁড়া তেনা তুলতেও ভুল করেনি। কিছুই রেখে যাবে না এই শহরে সে। শহরের প্রতি রাশেদের বউ ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। রাশেদ মালপত্র গোছাতে গোছাতে বলছিল—আর গরম হলে বিপদ আছে। ঘরে আগুন ধরে যেতে পারে। শেষ বেলায় কেলেঙ্কারী নিয়ে শহর ছাড়তে হবে। বউ আরো জ্বলে ওঠে—কেলেঙ্কারীর বাকি রইল কী? হুম রাশেদ কথা বাড়ায়নি। বাড়তে দিতেও চায়নি। সত্যি, কেলেঙ্কারীর বাকি তো কিছু থাকছে না। লজ্জা, অপমানের ষোল আনা নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। এই বাড়িটায় যখন উঠেছিল ওরা, রাশেদের বউ এক দেখাতেই পছন্দ করে ফেলে। শোবার রুমের জানালা দিয়ে সামনে একটা তালগাছ দেখা যায়। অনেক লম্বা তালগাছ। সেদিন তালগাছে পাকা তাল ঝুলে ছিল। তাহলে ওরা কি ভাদ্র মাসে এই বাড়িতে এসে উঠেছিল? কী জানি। এখন তো আর পঞ্জিকা ধরে ফুল ফোটে না। আষাঢ়-শ্রাবণেও কাঁঠাল পাকে। জৈষ্ঠ্যে মাত্র মুচি আসে। পাপন তখন কথা বলতে শুরু করেনি। বউ ছেলেকে ঐ তালগাছ দেখিয়ে ছড়া কেটে যেত দিনরাত। পাপনের মুখে যখন কথা ফুটতে থাকে, তখন ও নিজেও তালগাছ নিয়ে কথা ছড়া শোনাত বাবাকে। অফিস থেকে ফিরে তিনজনের সময় কেটে যেত তালেতালে। একদিন পাপন নিজেই একটা ছড়া বানিয়ে ফেলেছিল—তালের পাতায় বৃষ্টি পড়ে, বাপ তোমাকে মনে পড়ে। মোবাইলে সে বাবাকে এই ছড়া শোনানোর পর, অফিসের কাজে সেদিন আর রাশেদ মন বসাতে পারেনি।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ট্রাকে পাপনকে নিয়ে বউ একলা বসা। পলিথিন দিয়ে ট্রাক ঢেকে নিতে হবে। আকাশের দিকে তাকায় রাশেদ—মেঘ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। খুব তোরজোর করে নামার মুরোদ নেই। রাশেদ ভাবে মেঘের অবস্থাও ওর মতোই। অভিমান, ক্ষোভে ওর মনটাও বিক্ষিপ্ত, কিন্তু তা প্রকাশের মুরোদ নেই ওর। আসলে ও বুঝতেই পারছে না, কার প্রতি ওর ক্ষোভ, অভিমান। ও তো নিজের ছোট মফস্বল শহরের থেকে যেতে পারত। কবিতা, গান, রাজনীতির পাশাপাশি বাড়ির সামনেই বসে পড়তে পারত ছোটখাটো কোনো দোকান দিয়ে। গ্রামে যতটুকু ফসলী জমি ছিল, সেখানে খামার করেও দিন চালিয়ে নেয়া যেত। ওর তো কখনো তালগাছের চূঁড়োতে ওঠার স্বপ্ন ছিল না। তাহলে এমন স্বপ্ন ওর করোটিতে বুনে দিল কে?
গ্রাম ছেড়ে শহরে চলো। এই গান তো কয়দিন আগেও ফুল ভলিয়মে চলেছে গ্রামে গ্রামে। কোনো ভবিষ্যত নেই গ্রামে। অবিশ্বাস হারাচ্ছিল গ্রামের ছনের ঘর, টিউবওয়েল, পুকুরের মাছ, নকশা পিঠা, লাল বিরুই চাল, ঝুঁটিওয়ালা মোরগ, কচু ঘেচু, ডেউয়া থেকে শুরু করে গ্রামে পাওয়া জ্বরের বড়ির ওপরও। শিক্ষা নেই, রোজগার নেই, চিকিৎসা নেই। সব গ্রামের নাম এক হয়ে গেছিল—নেই। সেই নেই থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে সবাই শহরের পথ ধরে। জমিতে ফসল সোনারঙ ধরে থাকে, সেই ফলন তুলে আনার মানুষ শহরে মোটরসাইকেলে গতি তোলে কিংবা যন্ত্র রিকশা নিয়ে ছুটে বেড়ায় গলি থেকে গলিতে। শহরে গাড়ির জানালায় গিয়ে হাত পাতাও গৌরবের।
রাশেদ সেই গৌরবের সৌরভ মাখতে কখন যে রওনা হয়ে গেল, কেন যে শহরে এলো, কোনো অঙ্কই মেলাতে পারে না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখানো। অঙ্কের মাস্টার হওয়া। বায়িং হাউজের মার্চেন্টডাইজারের চাকরি। মেরাদিয়া বস্তির মেস থেকে, দিলু রোডের ফ্ল্যাটে ব্যাচেলার মেস, সেখান থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে একা ভাড়া থাকা। কত দ্রুত তালগাছ বেয়ে উঠে যাওয়া। এই উঠতি পথেই দেখা বউ চুমকির সঙ্গে। চুমকিও এই শহরের মেয়ে না। চুয়াডাঙ্গার এক অজ পাড়া গাঁয়ের মেয়ে। কল সেন্টারের চাকরি নিয়ে শহরে এসেছিল। মেয়েদের হোস্টেলে শহর জীবনের শুরু। কল সেন্টার থেকে সুপার শপে। সেখানেই রাশেদের সঙ্গে পরিচয়। সুপার শপে বাজার করার অভ্যেস ছিল না। একদিন সময় কাটাতে এমনিতেই সুপার শপে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেখানেই চুমকির চোখে চোখ আটকে যায়। তারপর নিয়মিত যাতায়াত, রেজার কেনার উছিলায়। চুমকিই ধীরে ধীরে ওকে ঝামেলামুক্ত রান্না বান্নার লোভ দেখিয়ে প্যাকেটে কুটে রাখা মাছ, সবজি কিনতে অভ্যস্ত করে। নাস্তাটাও দুধ আর কর্নফ্ল্যাক্সে নিয়ে আসে।
রাশেদ উঠে পড়ে। শহরের শেষ চা খাওয়া আর হলো না। ওদিকে পাপনকে নিয়ে ট্রাকের মালপত্রের ওপর বৃষ্টিতে ভিজছে চুমকি। বৃষ্টির গতি বাড়ছে। রাশেদ মুখ হা করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জল খেয়ে নেয়। এমনটা সেই ছোটবেলা থেকেই অভ্যেস। ওরা যেদিন নিজেরা কাজী অফিস থেকে বিয়ে করে ফিরছিল, তখন হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ে। হুডখোলা রিকশায় সেদিন ওরা দুজনেই হা করে মেঘের শরবত পান করেছিল। ওমন মুহূর্ত খুব একটা আসেনি। দুজনে কাজ শেষ করে যখন ঘরে ফিরত, তখন ক্লান্তি নিয়েই পরের দিনের যুদ্ধের প্রস্তুতি। পাপন আসার পর চুমকি আবদার করে—আমি একটু বিরতি নেই, তোমার খুব কষ্ট হবে না? কষ্ট হচ্ছিল কিনা রাশেদ বুঝতে পারেনি। রোজগারে বাড়িভাড়া, পাপনের স্কুল, খাওয়া-দাওয়া, মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্ট, কক্সবাজারে চলে যাওয়া, বেহিসেবি হয়েও চুমকি কেমন করে যেন সব সামলে নিয়েছে। কিন্তু এবারের আষাঢ়ে এসে মাথার ওপর ঠিক আকাশ ভেঙে পড়লই। শহরটাই কেমন গ্রামের মতো নাম নিয়ে নিল। বেতন না। চাকরি না। বাড়িভাড়া না। খাবার না। চিকিৎসা না। নতুন স্বপ্ন না। শহরের নাম এখন—না। এই যে গাভীর দুধের চা খেতে ইচ্ছে করল সেখানেও না।
রাশেদ দূর থেকে দেখে ট্রাক ঘিরে কিছু মানুষের জটলা। চুমকি চিৎকার করে কী যেন বলছে। কাছে যেতেই ভিড়ের লোকগুলো ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরা রাশেদদের ট্রাক আটকে দিয়েছে। টাকা ছাড়া শহর ছাড়তে দেবে না। রাশেদ কিছু বলে না। হাসে। ওর হাসি দেখে চুমকি বিস্মিত। রাগও হয়। ওর আর এক মুহূর্ত এ শহরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সেতু পেরোতে পারলেই বাঁচে। রাশেদের হাতের সিগারেট বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। ও হাসতে হাসতে লোকগুলোকে বলে—ভাই এককাপ গাভীর দুধের চা খাওয়াতে পারবেন? না হলে একটা দিশলাইর কাঠি। গরিবের শেষ ইচ্ছা ভাই।