ইশরাত তানিয়া: সাহিত্যে আবেগ, নীতিবোধের প্রকাশ আপনার কাছে কেমন মনে হয়? অতি সতর্কতা কিংবা অসচেতনা কি সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ করে?
নাসরীন জাহান: সাহিত্যে আবেগের গুরুত্ব আছে বৈকি, নীতিবোধেরও, কিন্ত এটা লেখক যেন আরোপিতভাবে লেখার ওপর না চাপান। বিষয়, চরিত্র যদি ডিমান্ড করে তখনই এর কার্যকারিতা সম্পর্কে বোঝা যাবে। অবশ্যই বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে। লেখার শাদা পাতা যদি হয় নদী, লেখক সেখানে দক্ষ সাঁতারু। সাহিত্যে শুরু থেকে একটা পোক্ত ধারণা নিয়েই লেখক বই বের করার প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে বসবে। সেই সাঁতারুর মতোই নদী-কাগজ তাঁকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। কাগজকে যদি নদী ভাবি, আমি দক্ষ সাঁতারুর মতো সেখানে কলমের সাঁতার কাটব। নদীতে ঢেউ এসে মাঝে মাঝে সাঁতারকে আটকে দেয়। তেমনই লেখকের কলমও পরে কী লিখব, এমন ভাবনায় লেখককেও থামিয়ে দেয়। ভেবে লেখক যেভাবে ফের কলম চালায় সাঁতারুও একটু থামার পর ফের ঢেউ উপেক্ষা করে ফের সাঁতারে ছুটতে থাকে। সচেতন, অসচেতনতাকে উপেক্ষা করে কাজ করে স্বতঃস্ফুর্ততা।
ইশরাত তানিয়া: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির আর হাসান আজিজুল হকের পর একটি শূন্যতার কথা বলেন অনেকে। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাই।
নাসরীন জাহান: এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে আগের উত্তরের মিল আছে। কিভাবে বিচ্ছিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন এই তিনজনকেই বাংলাদেশের ভালো লেখক হিসেবে এক করে পেল, বিস্মিত হচ্ছি। আর আমি নিশ্চিত এখানে দুজন অনেক সিনিয়র লেখকের পরে এক লাফে আশির দশকের শহীদুল জহিরের নাম আসতই না, তিনি যদি মারা না যেতেন। জীবদ্দশায় কতটা অবহেলিত ছিলেন তিনি, আমি কাছ থেকে দেখেছি। আর এটা কার বানানো তালিকা? আরো অনেক ভালো লেখক আছেন, আমি নাম নিচ্ছি না। কারণ শিল্পের ব্যাপারে আমি তুমুল আপোসহীন। দেখা গেল কেউ অনেক প্রাণের মানুষ কিন্তু তার লেখা আমার ভালো লাগে না বলে তার নাম নিলাম না। সাথে সাথে তার সাথে আমার বন্ধুত্বে জীবনের জন্য চিড় ধরে গেল। লেখালেখির প্রথম জীবনে আমি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। যা হোক এ লেখাটা যাঁরা পড়বেন, প্রত্যাশা করি, তাঁরাও ওই তিন লেখককেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের লেখক মেনে ক্ষান্ত হবেন না। আমরাও তো নিশ্চয়ই ঘাস কাটছি না, হা হা। এই প্রথম নিজের কথা বললাম। প্রশ্ন শুনে ক্ষোভ থেকে এটা বললাম।
ইশরাত তানিয়া: নারীবাদ দর্শনটিকে কিভাবে দেখছেন? আপনার গল্পে, উপন্যাসে বোঝা যায় নারীবাদে সামগ্রিকভাবে আস্থা রাখেন। আপনার লেখায় নারীবাদ পরিস্ফূট হয়েছে। এই প্রবণতা আপনার ভেতরে এবং লেখায় কী করে সঞ্চারিত হলো বিশ্লেষণ করে বলবেন কি?
নাসরীন জাহান: আমাদের বেশিরভাগ নারী পুরুষের মধ্যে নারীবাদের ভুল ব্যাখ্যা হয়। কিছু পুরুষের মতো নারী, পুরুষদের গালাগাল করে, ব্রা উড়িয়ে নিজেকে নারীবাদী প্রমাণ করতে চাইতেন।
আমার একটা নিবন্ধের বই আছে ‘নারীর প্রেম ও তার বিচিত্র অনুভব’, ওই বইয়ে এ বিষয়ে আমার বোধ ঢেলে দিয়েছি। বলেছি, নারীবাদ মানে এই নয় যে পুরুষ ইট মারল তো নারী পাটকেল মারবে। জার্মানিতে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলাম, নারীবাদ মানে সন্ধায় কর্মক্লান্ত স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে একগ্লাস পানি। প্রশ্ন এলো, মানে? বললাম, হাসব্যান্ড ওয়াইফ ঘরে ফিরে একজন আরেকজনের দিকে তাকাবে, যার মুখ বেশি ক্লান্ত, তার দিকেই আরেকজন গ্লাস এগিয়ে দেবে। শুধু নারী এ কাজ করবে এ ঠিক না। বিভ্রান্ত সৃষ্টিকামী নারীবাদীদের জন্য প্রচুর নারী তোতলায়, বলে, আমি সেই অর্থে নারীবাদী... তোতলানোর কী আছে? অনেক পুরুষকে আমি প্রশ্ন করেছি, এই পৃথিবীটা পুরুষ শাসিত, এ নিয়ে দ্বিধা আছে? তাঁরা বলেছেন, না। আমি বলেছি এই পৃথিবীতে নারী পুরুষের সমান যোগ্যতা যেখানে, সেখানেও যদি নারীকে শোষিত হতে হয়, তবে তাকে নারীবাদী হতেই হবে। এক্ষেত্রে যেমন শ্রমিকরা শ্রমিকবাদী, নারীরা নারীবাদী। আমি জানালা দিয়ে দেখেছি স্বামী স্ত্রী ইট ভাঙছিল। স্ত্রীর কোলে একটা বাচ্চা। ঘরে গিয়ে রাঁধতে হবে বলে স্ত্রী ইটে তিনবার হাতুড়ি বসালে, স্বামী বসাচ্ছিল এক বার। অথচ স্ত্রীর চাইতে স্বামী মুজুরি পাচ্ছিল ডাবল। এক্ষেত্রে স্ত্রীর অবশ্যই নারীবাদী হওয়া উচিত। আমি বেগম রোকেয়ার নারীবাদকে ব্যাপক সম্মানীয় মনে করি।
ইশরাত তানিয়া: পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান আমরা জানি, লেখক সমাজ কি এর বাইরে? একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটুকু চ্যালেঞ্জিং? এর সমাধানই বা কী?
নাসরীন জাহান: অবশ্যই আমাদের পৃথিবী পুরুষ শাসিত এ অমোঘ এক সত্য। লেখক সমাজ এর বাইরের কেউ না। আমাদের লেখার শুরুতে প্রায় সব পত্রিকায় মহিলা আর সাহিত্য আলাদা পাতা ছিল। কিন্তু সেই সাহিত্য পাতার নাম পুরুষ পাতা ছিল না। নারী পাতাকে পুরুষরা বড় অবহেলার চোখে দেখত। সাহিত্য পাতায় মহিলাদের লেখা ছাপা দুর্লভ এক ব্যাপার ছিল। তখন তিনজন শক্তিশালী লেখকের লেখা সাহিত্য পাতায় মাঝে মাঝে ছাপা হতে দেখতাম। তাঁরা হলেন রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন। আমি ব্রত নিয়েছিলাম, বছরে একটা গল্প ছাপা হলেও সাহিত্য পাতায় দেব। মরলেও মহিলা পাতায় লিখব না। এ জন্য অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাকে। অবশ্যই আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল তা। কিন্ত সুখের বিষয়, দারুণ পজেটিভলি সময় বদলেছে। এখন নারী পাতায় নারীর সাহিত্য ছাপা হয় না। সেখানে নারী বিষয়ক নানা ফিচার যায়। আর সাহিত্য পাতায় লেখা ভালো হলে সমানভাবেই নারী পুরুষের লেখা যায়।
আবার বিভ্রান্তিতে পড়া নারীবাদীরাও আছেন। তাদের জন্য এমনটা হয়েছে যে, অনেক পুরুষ কোনো মেয়ে নিজেকে নারীবাদী বললে, তার সাথে নিজেকে জড়াতে ভয় পায়।
ইশরাত তানিয়া: এবার একটি অন্য প্রসঙ্গে আসি। প্রকাশনা শিল্প সাহিত্যচর্চা ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ লেখক-প্রকাশকের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের বিষয়টি খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। আপনার অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষন কী বলে? সমাধান সম্ভব?
নাসরীন জাহান: লেখক-প্রকাশকের মূল সংঘাতের জায়গা হলো, একজন লেখক কিছুতেই জানতে পারে না তার ক’ কপি বই বেরোচ্ছে। বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে রসিদ, ডক্যুমেন্ট থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকাশককে বিশ্বাস করা ছাড়া লেখকের আর পথ থাকে না। ক’জন অসহায়ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, কিভাবে পেতে পারি, আপা?
প্রকাশক তো একজন ব্যবসায়ীও। লেখকের সাথে তিনি যদি এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে পারেন, তবে খুব ভালো হয়। লেখকেরা পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে এক কিস্তি, এরপর ছ’মাস পর পর আরেক কিস্তি, যা-ই সম্মানী হোক, যদি পান, বিষয়টা সুন্দর হয়। কিছু প্রকাশনা সেটা করে। অনেক প্রকাশনীতে লেখক ধর্ণার পর ধর্ণা দিয়েও সম্মানী পায় না।
ইশরাত তানিয়া: লিটল ম্যাগাজিন। বলা হয় এটি একটি আন্দোলন। লিটল ম্যাগের লড়াই ও টিকে থাকা প্রসঙ্গে আপনার চিন্তা ভাবনা শোনা যাক।
নাসরীন জাহান: লেখালেখির শুরু ক্লাস টেনে থাকতেই। কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় আমার লেখা ছাপা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে সংবাদ, ইত্তেফাক। এর মধ্যেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে লিটিলম্যাগে যুক্ত পারভেজ হোসেন, সেলিম মোরশেদ, মামুন হুসাইন, শহীদুল আলম, কাজল শাহনেওয়াজ এদের সাথে নারী পুরুষ সমান্তরাল বন্ধুত্বে মিশে যাই। প্রতি সপ্তাহে হয় ওখানে, নয় আমার বাসায় আড্ডা হতো। ওদের মাধ্যমেই বিশ্বসাহিত্য পাঠ। আমি আর শহীদুলই বেশি পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব নিয়ে লিখতাম। সেখানে প্রতি সপ্তাহে কে কী লিখল, তা পাঠ হতো। কিন্তু আমি যেহেতু বড় কাগজে লিখি, ওরা আমাকে নিয়ে মুশকিলে পড়ে গেল। ওদের সম্পাদিত সাহিত্য পাতায় কিছুতেই আমার লেখা ছাপাত না। একবার আমার একটা নিরীক্ষামূলক গল্প হুট করে পারভেজ তাঁর সম্পাদিত ‘সংবেদ’ পত্রিকায় ছাপল। গোলমাল শুরু হলো। কট্টর লিটিলম্যাগের গুরুই বলা যায়, সেই সেলিম মোরশেদ আমার পক্ষ নিল। বলল, আমাদের নিরীক্ষামূলক লেখা বড় কাগজ বের করে না বলেই আমরা লিটিলম্যাগ করি। নাসরীনের আপোসহীন লেখা ওরা প্রকাশ করে। আমরা কি লেখা দেখব না লেখক? যা হোক, আমার আদর্শবিরোধীরা অনেকে বিপরীত কাণ্ড করলেও, এক এক করে সেলিম মোরশেদ ছাড়া বাকি সকলেই বড় কাগজে চলে এলো। এখন বড় কাগজের লেখকদের নিয়ে যেসব ম্যাগাজিন বেরোয়, সেগুলোকে তখন লিটিলম্যাগ বলা হতো না।
পশ্চিমবঙ্গেও একই অবস্থা ছিল। আমি বছর বছর সেখানকার লিটিলম্যাগের সাথে যুক্ত ছিলাম বলেই আমার লেখার প্রকাশ্যভক্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের সাথে প্রাণের সম্পর্ক থাকলেও ‘দেশ’ থেকে শুরু করে ওদের কোনো বড় কাগজে লেখা দিইনি।
ইশরাত তানিয়া: ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? তখন থেকেই কি ঘোরের মধ্যে থাকতেন? নাকি চঞ্চলতা আর দুষ্টুমিটাও ভর করত?
নাসরীন জাহান: প্রশ্নটা যেন আমার জন্যই করা। কল্পনার ঘোরে যেমন থাকতাম, দুষ্টমিও করতাম। আমার জন্ম হয়েছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট গ্রামে। আমার আব্বা ওখানে তখন বদলির চাকরি করতেন। আমরা নানা বাড়ির তেপান্তরে রাজকন্যার মতো উড়ে বেড়াতাম। মামারা বিয়ে করেনি, খালার বর শহরে পড়াশোনা করতেন। বাচ্চা বলতে আমরাই। আমি সর্ষে বনে শুয়ে আসমানের মেঘ দেখতাম। দেখতাম তার আশ্চর্য বদল, কখনো হাতি, কখনো অজগর, কখনো মানুষ এমন কত নানা রূপ আমাকে বিমূঢ় করে তুলত। দূরের নীল পাহাড় ছিল আমার প্রধান বিস্ময়। কতবার আমি ওটাকে কাছে পেতে চেয়েছি। যত হাঁটি ততই দূরে চলে যেতে দেখতাম। ব্যথা পা নিয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতাম।
এরমধ্যে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের পরিবার ভাগ হয়ে গেল। আমি আর আমার পিঠাপিঠি বড়ভাই আলোক দূর সম্পর্কের নানার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাউশা নামের গ্রামে। যুদ্ধ তীব্রতর হলে অভাবের কারণে তারা আমাদের বাইরে রেখেই দরজা বন্ধ করে দেয়। ক্ষুধার্ত আমাকে ভাই শালুক এনে দিল। ভয়ে ভয়ে এক গাছতলায় রাত কাটালাম। রাজকন্যা থেকে ঘুঁটেকুড়ানী হলাম। আর্মিরাও এসেছিল, সে বিশাল গল্প। আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসে এসব ব্যাপার এনেছি। এই যুদ্ধ সারাজীবনের জন্য আমার আত্মাটাকে ফুটো করে দিল। শৈশব থেকেই তাই হয়তো সুখের গল্প তেমন লিখি না।
শহরে এসে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম। তখন ছেলেদের সাথে আমি আর আমার বান্ধবী রুবী (কথাসাহিত্যিক পারভীন সুলতানা) মাঠে দাবিয়ে খেলতাম। আজানের আগে ঘর থেকে বেরিয়ে ফুলগাছ চুরি করতাম। ঘরের কাজ সেরে রাজ্জাক কবরীর পোস্টার দেখতে যেতাম। এত গপ্পো আছে! বলে শেষ করা যাবে না।
ইশরাত তানিয়া: শুদ্ধতম অনুভূতির নাম প্রেম। আপনার চেতনায় প্রেমকে কী রূপে দেখেন? ঈশ্বরপ্রেম বলুন কিংবা নারী-নরের প্রেম বলুন, সৃষ্টিশীল মানুষের বোধে এর প্রভাব কতটুকু? মানে, সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করে কি?
নাসরীন জাহান: প্রেম একটা স্বর্গীয় অনুভূতির নাম। নর-নারীর প্রেম আর ঈশ্বর প্রেমের ধরনটা আলাদা। প্রাণ থেকে যখন প্রগাঢ় প্রেম উৎসারিত হয়, তার মধ্যে অলৌকিক এক কামনা দুজনকে রোমাঞ্চকর প্রচ্ছায়ায় ঘিরে রাখে। নরনারীর প্রেমের স্পর্শে নতুন প্রজন্মেরও জন্ম হয়। যদি নর-নারীর প্রেমহীন তাও হয়। যে প্রেমে দুটি আত্মার মিলন ঘটে সেই প্রেমের মধ্যে শরীর এলেও আমি তাকে অশুদ্ধ বলব না। প্রেমময় দুটি দেহে অগ্নির প্রজ্জ্বলন ঘটে। যদি সত্যিকারের প্রেম হয়, তবে সৃষ্টিশীল মানুষের সাথে সাধারণ মানুষের প্রেমের পার্থক্য ঘটে না। যদিও সৃষ্টিশীল মানুষের প্রেম অনেক নান্দনিক হয় প্রায় ক্ষেত্রে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রেমও যদি প্রগাঢ় হয়, তখন অলৌকিকভাবে তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা ঢুকে যেতে পারে।
ঈশ্বরপ্রেমকে তথাকথিত মৌলবাদীরা যেভাবে দেখে, আমি সেভাবে দেখি না। ঈশ্বরকে মহান এক আর্টিস্ট মনে করি আমি। পুরো পৃথিবীকে পাহাড়, সমুদ্র থেকে শুরু করে গ্রীষ্ম, শীতে অপূর্ব করে নানা রঙে সাজিয়েছন। তারপর আছে সূর্য, চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন রংধনুময় কোটি কোটি রহস্যময় অস্তিত্ব উজাড় করা সৌন্দর্যের রহস্য। শুনেছি, পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে ঈশ্বর পাওয়া যায়। চোখ বন্ধ ধ্যানে যেমন তার দেখা মেলে, তেমনই পৃথিবীর সব সুন্দরের মাঝে চোখ খুলেও বিমুগ্ধতার মধ্যে তার স্পর্শের স্বাদ মেলে। বর্ষার তীব্রতায় যেমন তছনছ হয়ে সব ভেসে যায়, এরপরই পলিমাটি এসে সেইসব ভাঙন সব বিন্যস্ত করে দেয়।
ইশরাত তানিয়া: উড়ুক্কুর জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিপ্স পুরস্কার পান। এই অর্জনের আগের ও পরের কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি?
নাসরীন জাহান: আমার পাঁচটা গল্পের বইয়ের পর আমি তড়পাতাম, কেন উপন্যাস লিখতে পারি না? একসময় ঠিক করলাম, মার্কেজ, সুবিমলকে টা টা করে আমার শৈশব থেকে জীবন যা দেখেছি, তার সাথে আমার গড গিফটেট ইমাজিনেশনের জলরঙ তেলরঙ মিশিয়ে যা হোক লিখে যাই। আমার বাড়ির কাছের অপার্থিব মেথর পট্টির দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে একের পর এক কত কী দুর্বিষহ জীবন সে লেখায় এসেছে।
বইটি মোটা হয়ে গেল। বন্ধু পারভেজের সাহায্যে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘উড়ুক্কু’ বইটা বেরোলো। দিন যায়, বই বিক্রির নাম নেই। প্রকাশকের মুখে ছায়া। একদিন মেলা থেকে ফিরতে গিয়ে কান্না আটকাতে পারিনি। চোখের জল মুছতে মুছতে সিদ্ধান্ত নিলাম, জীবনে আর বই করব না। লিখতে ইচ্ছে হলে লিখব। পাণ্ডলিপি ফেলে রাখব।
কিভাবে ‘উড়ুক্কু’ ফিলিপসে গেল, কিভাবে কী হলো সেই ইতিহাস থাক। একদিন রিং বেজে উঠল। রিসিভার কানে নিতেই ওরা জানাল, “এই বছর উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য আপনি...” আমার কথা বলছে? রিসিভার হাত থেকে খসে গেল। এরপরের বইমেলায় মনে হলো, এটা যে আগের মেলায় বেরিয়েছে কেউ জানেই না। বিক্রি...বিক্রি... অটোগ্রাফ... অটোগ্রাফ... বিদেশে আমন্ত্রণ... প্রায় এক বছর বিখ্যাত হওয়ার কী সুখ, কী অস্বস্তি বুঝেছি। কিন্তু আজীবন আপোসহীন আমি নিজের কানে শুনিয়েছি, পুরস্কার যদি লেখকের দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়, তবে লেখকের চাইতে সেই পুরস্কার বড়। পুরস্কার প্রেরণা হয়েছে, কিন্ত আমার লেখার ভালো মন্দের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তখন ফিলিপস পুরস্কার এত নিরপেক্ষ ছিল, বলা যায় আমার আগে যাঁরা পেয়েছেন, তাদের তুলনায় আমি পিচ্চিই ছিলাম। কিন্তু এই পুরস্কার দিয়েই আমি জীবনকে আরেকভাবে চিনলাম। যেহেতু মরলেও কোনো দলবাজি করিনি, বড় জায়গা থেকে বড় বড় অফার পেয়েও, ক্রমশ জাগতিক পৃথিবীতে কোনঠাসা হয়ে যেতে থাকলাম। কারণ পৃথিবীতে আমি লিখতে এসেছি।
খুব কমই প্রোগ্রামে যাই। আরেকটা ভয়ঙ্কর নেগেটিভ দিক আছে আমার, আমি মহা মহা অলস। এইজন্যই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান সাহিত্য। এটার ওপর উপুর হয়ে থাকি। মরণপণ চেষ্টা থাকে, এই বইটা যেন আগের বইটার মতো না হয়।
ইশরাত তানিয়া: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বরাজনীতি কি আপনার লেখাকে প্রভাবিত করে? ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট তেমনটিই বলে।
নাসরীন জাহান: প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষভাবে আমার লেখায় বিশ্বরাজনীতি প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলে মনে করি। আমার উড়ুক্কু উপন্যাসের পরতে পরতে মূল চরিত্র নীনার চলা একদিকে, অন্যদিকে উপসাগরীয় যুদ্ধের বর্ণনা পাশাপাশি চলেছে। যুদ্ধ শেষে বুশ ব্যাপক লাভবান হয়েছে, আমার উপন্যাসও শেষ হয়েছে। না, রাজনীতি প্রকট হয়নি।
নীনার জীবনটা ডিটেইলে এগিয়ে গেছে আর যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে পত্রিকার টাইটেল হয়ে হয়ে। এখন বিশ্বায়নের যুগ। আগেই বলেছি পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তাঁদের অনেকের লেখার প্রচ্ছন্ন রাজনীতিবোধ আমাকেও প্রভাবিত করেছে। ‘সেই সাপ জ্যান্ত’ উপন্যাসটা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে, একটা দেশের যুদ্ধ বাতাসে উড়ে উড়ে আরেক দেশের যুদ্ধের সাথে একীভূত হয়।
আমার কষ্ট, এই বইটার নাম কেউ নেয় না। তুমি নিলে, অনেক ধন্যবাদ। আরেকজন, কর্ণেল তাহেরের ভাই ড. আনোয়ার হোসেন। উনি এত অভিভূত হয়েছিলেন, আমি রীতিমতো স্থবির হয়ে পড়েছিলাম।
কাফকার উপন্যাস ‘মেটামরফোসিস’-এর কথাই ধরা যাক, যে বই পড়ে মার্কেজ প্রথম উপন্যাস লেখার তাগদা পান। এই উপন্যাসটার মূল চরিত্র গ্রেগর, যে ছেলে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে পোকা হয়ে গেছে। এরপর গ্রেগরের স্ট্রাগল, ধীরে ধীরে তার প্রতি পরিবারের অবহেলা। বহু বহু আগে পড়েছি, কোথাও রাজনীতির ছিটেফোঁটা পাইনি। একসময় শুনি, এই উপন্যাসটা ওদেশের বুর্জোয়া শ্রেণি, পলিটিক্সের মধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। পরে ফের উপন্যাসটা পড়ে এর রূপকের আড়ালে সত্যটা বুঝতে পারি।
আমার মতে আমার নিজের সবচাইতে জোরাল রাজনৈতিক উপন্যাস ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’। রূপকের আড়ালে ঢাকা রূপকথার আদলে লেখা উপন্যাসটি বোদ্ধামহলের অনেক জায়গা থেকে জাদুবস্তবতা ঘেরা পলিটিকাল উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে।