খোলা আকাশের নিচে অভিনব পাঠদান

, ক্যাম্পাস

আরিফ জাওয়াদ, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-31 16:26:06

হরহামেশাই টিভির পর্দা কিংবা পত্রিকার পাতাতে দেখা যায় খোলা আকাশ কিংবা গাছ তলায় বসে চেয়ার বেঞ্চ পেতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার দৃশ্য। সেই দৃশ্য পেছনে গল্প থাকে শ্রেণিকক্ষে জায়গা সংকুলান কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে শ্রেণিকক্ষের ক্ষয়ক্ষতি। তবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) সাম্প্রতিক “খোলা আকাশের নিচে” অভিনব পন্থায় দর্শন বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের স্নাতক ১ম বর্ষের ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ ক্লাস অনুষ্ঠিত হওয়ার পেছনে শ্রেণি কক্ষে জায়গা সংকুলান কিংবা প্রকৃতিক দূর্যোগের মত কোন ঘটনার কারণ নেই।

জানা যায়, প্রত্যেক সেমিস্টারের শেষ ক্লাসটি উন্মুক্ত স্থানে নেয়ার চেষ্টা করেন দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোছা. রেবেকা সুলতানা। গেল সপ্তাহে ২০২০-২১ সেশনের স্নাতক ১ম বর্ষের ১০৬ কোর্সের (ইন্ট্রোডাকশন টু সাইকোলজি) এই ক্লাসটি নেন তিনি। এসময় প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ ঘটানো ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে পঠনপাঠনের অনুভূতি কী রকম হয় সেটা অনুভব করাতে ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্লাসের আয়োজন।


খোলা আকাশের নিচে এমন ব্যতিক্রমধর্মী ক্লাসের ব্যাপারে কথা হয় অধ্যাপক রেবেকা সুলতানার সাথে। তিনি বলেন, ক্লাস রুমে ক্লাস করতে করতে শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। শিক্ষার্থীরা তাঁদের পড়াশোনাতে সব সময় ভিন্ন একটা স্বাদ চায়। তাছাড়া পরবর্তী সেমিস্টারে যেন শিক্ষার্থীদের ক্লান্তি চলে না আসে সেজন্য এ অভিনব পন্থায় ক্লাস নেয়া।

অধ্যাপক সুলতানা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমরা একেবারেই ক্লাসরুমের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছি। বিশ্ববিদ্যালয় মানে হলো বৈশ্বিক জ্ঞানের জায়গা। যেখানে বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানকে একীভূত করবে। সেই জ্ঞান তো ক্লাসের মধ্যে নাও পেতে পারে একজন শিক্ষার্থী। শিক্ষাবিদ নুনামের কথা টেনে এনে বলেন, everything isn’t learning in the class... সবকিছু তো ক্লাসের মধ্যে পাবেন না, আপনাকে বাহিরে যেতেই হবেই। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের বাস্তাবাদের সঙ্গে যে ভাববাদের একটি মিল রয়েছে, সেই ভাববাদ ভাবতে গেলেই তো প্রকৃতির কাছে যেতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমি দেখেছি বিশ্ব ভারতীতে বা শান্তিনিকেতনে বেশিরভাগ ক্লাসই গাছের নিচে হয়। সেখান থেকে যারা পড়াশোনা করেছে তাদের অনেকেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছে বা বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তাদের সুখ্যাতি রয়েছে। তাছাড়া বদ্ধ শ্রেণিকক্ষে যতটা না মনযোগ থাকে, তার চেয়ে বেশি মনোযোগ বৃদ্ধি পায় যদি ভিন্ন পরিবেশে হঠাৎ করে ক্লাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেকারণে এদিন যে বিষয়ে লেকচার দেয়া হয়, পুরোটায় তাঁর জীবন ভিত্তিক।


কেন জীবন ভিত্তিক ক্লাস নেয়া হয় জানতে চাইলে অধ্যাপক রেবেকা সুলতানা জানান, আমাদের শিক্ষার্থীরা কেউ দীর্ঘ সময় হতাশায় ভোগেন কেউবা শেষমেশ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। জীবনের এ চলার পথে একজন শিক্ষার্থী যদি কারো যদি সহযোগিতা নাও পায়, সে যেন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে পারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাছাড়া এদিনের লেকচারটি পুরো সিলেবাসের মধ্য রেখে কোন বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিলে পরীক্ষায় ভাল করবে এবং নিজেকে একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে সে নিয়ে আলোচনা করা হয়।

লাইব্রেরি প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক রেবেকা সুলতানা বলেন, প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষার্থীদের নানা নিয়ে গেলেও তাদের সেখানে নতুন কথা বলা হয়। যেমন- আমি তাদের বলি ‘পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশান্তির জায়গা লাইব্রেরি’। যেখানে বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে। যেসব মানুষদের বই রয়েছে, তাঁরা সবাই পৃথিবীকে ভাল কিছু দিয়ে গেছেন। তাঁদের চিন্তা-চেতনা কিন্তু ওখানে রয়েছে। এবং এগুলোর সঙ্গে যেন তাঁদের চিন্তার মিলন ঘটে, সেই বিষয়েও কথা হয়। যার ফলে একজন শিক্ষার্থীর মনে সংকীর্ণতা কমে আসবে, মোহকে কিভাবে ত্যাগ করবে, কিভাবে অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে, কিভাবে বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠবে, পারস্পারিক সহানুভূতিসহ কিভাবে সে জয়ী হবে এমন বিষয়গুলো চলে আসে এমন ক্লাসগুলোতে।

২০১৬ সাল থেকে কখনও গাছের তলায়, কখনও খোলা আকাশ এমন ক্লাস নিয়ে আসছেন তিনি। এমন অভিনব ক্লাস করতে পেরে শিক্ষার্থীর চোখে-মুখেও যেন তৃপ্তির ছাপ। ব্যতিক্রমধর্মী এ ক্লাস যেন তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এক নতুন সংযোজন।


শেখ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, এমন ক্লাস আগে করা হয় নি। তবে বেশ উপভোগ করেছি। তাছাড়া ম্যাম এ ক্লাসে জীবনকে কীভাবে পরিচালিত করতে হবে, জীবনে চলার পথে কোন সমস্যা আসলে তা কিভাবে সমাধান করতে হবে ; তাও শিখিয়েছেন। হয়তো তাঁর উপদেশগুলো জীবনে চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে।

রাইসুল নামে একজন বলেন, খোলা আকাশের নিচে ক্লাসটা অন্যদিনের গতানুগতিক ক্লাসগুলোর মত চারদেয়ালের মাঝে বন্দি, বিরক্তিকর কোন শ্রেণিকক্ষে ছিল না। প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছিল, যার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে শিখতে পারি কিভাবে উদার মনের মানুষ হওয়া যায়।

জুয়েনা আলম মুন আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অভিজ্ঞতার ঝুলতে এক নতুন অভিজ্ঞতা যুক্ত হল ক্লাসের বাহিরে গিয়ে ক্লাস করা। প্রতি সপ্তাহে ম্যামের ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। তবে ক্লাসের বাহিরে এ ক্লাস অন্য ক্লাসগুলোর তুলনায় অধিক বেশি উপভোগ্য হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এমন বন্ধুসুলভ, প্রাণোচ্ছল শিক্ষক পাবো তা কখনো ভাবিনি।

তামিম ইকবাল নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, খোলা আকাশের নিচে যে ক্লাস, ম্যামের এমন অভিনব উদ্যেগ ছিল সত্যি প্রশংসনীয়। সূর্যের পর্যাপ্ত আলোতে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশেও যে জ্ঞান চর্চা করা সম্ভব। তা আমার জীবনে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

অধ্যাপক রেবেকা সুলতানার এমন ব্যতিক্রমধর্মী ক্লাস তাঁর সহকর্মী কিভাবে নেয় জানতে চাইলে এ অধ্যাপক বলেন, প্রথমের দিকে অনেকই বিষয়টি ভালভাবে দেখত না। তবে শিক্ষার্থী স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে অনেকেই ক্লাসটিকে ইতিবাচকভাবে নেয়া শুরু করেছেন। তাছাড়া পৃথিবীতে নতুনত্ব যাঁরা এনেছে, তাঁরা সবাই কোন না কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। আমি ওই জায়গা থেকে এগোতে চাচ্ছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর