শিক্ষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার দাবিতে ছাত্র ফ্রন্টের ছাত্র সমাবেশ-মিছিল ও কমিটি পরিচিতি অনুষ্ঠিত হয়।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা পাদদেশে শিক্ষা দিবসের ছাত্র সমাবেশ-মিছিল ও কমিটি পরিচিতি অনুষ্ঠিত হয়।
সংগঠনের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ এর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা রাখেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ। আরও বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবু সাঈদ খান, বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও এই রাষ্ট্র তার ঘোষিত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার বদলে টাকা যার শিক্ষা-স্বাস্থ্য তার এই নীতিতে পরিচালিত হয়েছে দেশ। শিক্ষার সংকট বহুগুণে বেড়েছে। তাই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে আইয়ুব সরকারের যে শিক্ষা সংকোচন নীতি এদেশের ছাত্রসমাজ প্রতিহত করেছিল, তারই ‘প্রেতাত্মা’ সওয়ার হয়েছে স্বাধীন দেশের শাসকশ্রেণির উপর। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের চেতনাকে পদদলিত করা হয়েছে। শরীফ কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি আর স্বাধীনতাত্তোর দেশে প্রণীত সবকটি শিক্ষানীতির অন্তর্গত মৌলচরিত্র এক ও অভিন্ন। নতুন মোড়কে হাজির করা হয়েছে শিক্ষার বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার বৈষম্যহীন একই ধারার গণতান্ত্রিক শিক্ষার দাবি উপেক্ষিত। শিক্ষার প্রধান ধারাই এখন বেসরকারি ধারা। বর্তমানে দেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৯৫ ভাগই বেসরকারি। শিক্ষার মর্মবস্তুকে ধ্বংস করে সিলেবাসে যুক্ত করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারনা। জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমছে প্রতিবছর। এ বছর শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের মাত্র ১১.৫৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে নানান পরীক্ষা-নীরিক্ষা। সম্প্রতি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২০’ এর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কারিকুলামে বিজ্ঞান শিক্ষাকে সংকুচিত করা হয়েছে, শিক্ষাকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কারিগরিকরণের দিকে। পাঠদান ও পরীক্ষাপদ্ধতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা চমকপ্রদ হলেও অবকাঠামোসহ শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদল ব্যতীত এটির প্রয়োগ নতুন করে শুধু জটিলতাই তৈরি করবে। নতুন পদ্ধতির সাপেক্ষে দক্ষ শিক্ষক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। বছরের শুরুতে ভুলে ভরা নিম্ন মানের পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে। এ যেন শিক্ষা আর শিক্ষার্থীদের প্রতি শাসকশ্রেণির নির্মম পরিহাস। প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তার সাথে যুক্ত আছে বর্ধিত বেতন ফি। এই ক্রমবর্ধমান শিক্ষা ব্যয়ের ফলে সৃষ্ট আর্থিক সংকটে ঝরে পড়ছে দেশের বিশাল অংশের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারের অনুগামী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকার আয়োজন চলছে।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলিতে বজায় আছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব। শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে নেয়া হচ্ছে। কেউ ভিন্ন মত পোষণ করলে গেস্টরুমে নির্যাতন, মারধোর, হল থেকে বের করে দেয়া সারাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তার সাথে যুক্ত আছে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর পরিলক্ষিত হয় না। দীর্ঘদিন ধরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হয় না। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, শিক্ষা সংকোচন, ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্টকরণসহ শিক্ষার উপর শাসকশ্রেণির সর্বগ্রাসী আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
ছাত্র সমাবেশ শেষে আগামীর ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী হিসাবে মুক্তা বাড়ৈকে সভাপতি ও রায়হান উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৮ সদস্যের ২০তম নতুন কমিটিকে পরিচয় করিয়ে দেন বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ।
নতুন কমিটির তালিকা, সভাপতি-মুক্তা বাড়ৈ, সহ-সভাপতি-সুস্মিতা মরিয়ম, সাধারণ সম্পাদক-রায়হান উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক-সুহাইল আহমেদ শুভ, দপ্তর সম্পাদক-অনিক কুমার দাস, অর্থ সম্পাদক-সুলতানা আক্তার, প্রচার ও প্রকাশনাসম্পাদক-হারুনু-অর-রশিদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক-রিনা মুর্মু, স্কুল সম্পাদক-বিশ্বজিৎ নন্দী।
সদস্য-যুগেশ ত্রিপুরা, ধনঞ্জয় বর্মণ, লাবনী সুলতানা, আনারুল ইসলাম, বিজয় শিকদার, ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ, রিদম শাহরিয়ার, খালেদা আক্তার, মিরাজ উদ্দিন।
উল্লেখ্য, নতুন কমিটি ছাত্র সমাবেশে আগামী দিনের শিক্ষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের পরিপূরক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন।