ইংরেজি বা অন্যান্য বহুল ব্যবহৃত ভাষায় একাডেমিক নকল বা চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার কম্পিউটার প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে এবং সেগুলা ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় এ্যন্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার বা বাংলায় লেখা পান্ডুলিপির আসল-নকল যাচাই করার জন্য কোনরূপ কম্পিউটার প্রযুক্তি অথবা সফটওয়্যার এখনও চালু হয়নি।
বাংলাভাষার জন্য আত্মত্যাগের বিরল ঘটনা স্মরণে রাখতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করায় আমরা বিশ্ব দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছি। এজন্য আমরা এখন গর্বিত। কিন্তু কোথায় যেন বাংলাভাষার প্রতি চরম অবহেলার পাখা গজাতে সাহায্য করা হচ্ছে। যার জন্য দিন দিন আমরা দ্রুতলয়ে সামনে চলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছি এবং ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চ্চা এখনও বিদেশি ভাষা নির্ভর। তাই অনেক কিছুই অব্যক্ত ও অজানা থেকে যাচ্ছে। বিদেশী ভাষা নির্ভরতার কারণে আমাদের জ্ঞান ক্রমশ বিশ্ব সমাজে মূল্য হারাচ্ছে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় হযবরল অবস্থা এই দুর্বল দিকে প্রতি সহজেই তর্জনী নির্দেশ করে। পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট একটি দেশের অধিকারী আমরা। কিন্তু জনসংখ্যায় বিরাট বড় দেশের দাবি রাখি। এখানে অনেক মানুষ, ছত্রিশটি উপজাতিসহ বহুভাষাভাষি মানুষজনের বাস। কিন্তু শতকরা ৯৮% মানুষের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা বাংলা। তবে আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট হলেও এদেশের প্রায় সকল মানুষই সবার মুখের বাংলা বলাটা বোঝে ও বাংলায় লিখতে-পড়তে জানে, টিভি দেখে। পাবলিক পরীক্ষায় দেশের সকল শিক্ষার্থীকে একটি আবশ্যিক বাংলাকোর্সের বই পড়ে পরীক্ষা দিতে হয়। তবে এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও অনেক বৈসাদৃশ্য থাকায় সর্বস্তরে বাংলাভাষা শেখা ও এর ব্যবহার করা দিন দিন বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। এই বৈসাদৃশ্যের প্রধান অন্তরায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি ছোট দেশে একসংগে ১১ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকাটা এই সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে।
আমরা এমন একটি পর্যায়ে চলে গিয়েছি যে, মঞ্চে উঠে কেউ হিন্দি, আরবী বা ইংরেজিতে গান গাইলে বা কথা বললে তাকে বেশী বাহবা দিই। চাকরির ভাইভা বোর্ডে ইংরেজিতে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে তাকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এই বৈপরিত্য আজকাল ঘরে-বাইরে সব জায়গায় লক্ষ্যণীয়। মনে করা হয় ইংরেজিতে কথা বলতে না পারলে তার লেখাপড়াই বৃথা। তা হবে কেন? তাহলে জাপান, ফ্রান্স, চীন, জার্মানি, কোরীয়া, স্পেন, ইতালি এর কীভাবে উন্নত হলো? এসব দেশে শিশুশ্রেণি থেকে পিএইডি গবেষণা পর্যন্ত নিজ নিজ মাতৃভাষায় করানো হয়ে থাকে। সেসব দেশে বিদেশি কেউ স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেলে সর্বাগ্রে ওদের মাতৃভাষা শিখিয়ে দেয়া হয়। তারপর এন্ট্রান্স বা ভর্তি পরীক্ষায় ওদের নিজ মাতৃভাষা বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে না পারলে সেখানে পড়া বা গবেষণার সুযোগ দেয়া হয় না। সে যতবড় ইংরেজি ভাষার বিদ্বান হোক না কেন তাকে এন্ট্রান্সে ওদের মাতৃভাষায় পাশ করতেই হবে। এটাই নিয়ম। তাদের ভাষা শিখে তাদের কৃষ্টি ও জীবন প্রণালীর সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য এই আবশ্যিক ব্যবস্থা তারা চালু রেখেছে। এজন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করে তারা এবং এক থেকে দুবছরের বেশি সময় বরাদ্দ দেয়া হয়। এভাবে তারা নিজেদের মাতৃভাষাকে বিশ্বদরবারে আরো বেশি পরিমাণে বিকাশ লাভের সুযোগ করে দেয়ায় সেগুলোর ব্যাপ্তি ঘটছে।
আর আমরা বাংলাকে বাদ দিয়ে শিশুকাল থেকে কিন্ডারগার্টেনের নামে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সেখানে অধিকাংশ শিক্ষকরাই তো ঠিকমতো ইংরেজি জানে না। বাচ্চাদের শেখাবে কী? এছাড়া প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনার নামে যেসব পাঠদান করানো হয় বাংলায় স্কুল-কলেজ ডিঙ্গিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের দ্বারা তার যথার্থ পাঠোদ্ধার করে পরীক্ষা দেয়াটাই তো বেশ কঠিন। এরা অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে সেখানে ভর্তি হয়। তাদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ণ যদি কেউ করে থাকেন তাহলে আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবেন যে তারা চার চার পাওযার যোগ্য কি-না। অথচ তাদের সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট ক্রেডিটে বেশ ভারী হয়ে উঠে। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা ও অনাদরে এরা একটা বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত হয়ে যায়। যাদের ইনডিজিনাস জ্ঞানের গভীরতা জন্মায় না ফলে দেশজ মায়া-মমতার প্রতি তাদের আকর্ষণ থাকে না। তারা সুযোগ খুঁজে বিদেশে চলে যাবার। এবং অভিভাবকের অর্থের জোরে স্কলারশীপ ছাড়াই বিদেশে চলে যেতে পারে এবং চলেও যায় তাদের গন্তব্যে।
এর ফলে দেশের সম্পদ দেশের কাজে লাগে না। বরং তাদের বিদেশে পড়াশুনার অর্থ জোগাতে দেশে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিপুল পরিমাণে অবৈধ কালো টাকা প্রয়োজন জন্মে। তা বিভিন্ন উপায়ে উপার্জিত হয় ও তা অবৈধভাবে পাচার হয়ে যায়। এর কোন সরকারি পরিসংখ্যান আমাদের জানামতে নেই। যারা দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় রত তাদের বিরাট অংশ বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। তাদের অনেকের কোন স্কলারপিপ থাকে না। আর্থিক চাপে অনেকে গবেষণায় অমনোযোগী হয়ে উঠেন। আমাদের দেশে পরীক্ষায় নকল, অসদুপায় অবলম্বন করা একটি সামাজিক ব্যাধি। দুর্নীতি, জালিয়াতি, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি আমাদের মজ্জাগত ও মানসিক ব্যাপার। এদেশে যার যত বেশী সম্পদ, পেশী ও কুবুদ্ধি আছে তিনি তত বড় অপরাধ করতে কুণ্ঠিত হন না। এ ঢেউ শিক্ষা সেক্টরে আরো প্রকট। আমাদের আপাদমস্তক অনৈতিকতার ছড়াছড়ি দেখে শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভাল হবার উপায় খুঁজবে? দেশের কাকে দেখে নৈতিকতা শিখবে?
কিছু মানুষ অবৈধ উপায়ে সবকিছু অর্জন করতে চায়। এজন্য তারা ভাল নীতিকে ট্যারা চোখে দেখে। এজন্য অনেকে অর্থ ও ক্ষমতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে টিকে থাকতে চায়। কেউ কেউ আবার টাকা খরচ করে বড় ডিগ্রী কিনে তা অর্জনের নামে ব্যবহার করতে আগ্রহী। সহজ পন্থায় বড় বড় ডিগ্রী প্রদানের জন্য অনেক সাইনেবোর্ডধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠন রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। যাদের পড়ার কক্ষ নেই, জমি, ল্যাবরেটেরি, খেলার মাঠ কিছুই নেই। আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায় বা মার্কেটের ছাদে অনেকের শিক্ষাপ্রদানের ব্যবস্থা। এর জন্য দেশের নানা স্থানে পদে পদে পদে জালিয়াত, দালাল এবং ঘাটে ঘাটে তাদের অসৎ দোসররা ওঁত পেতে থাকে।
এককালের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামধারী ঢাবি শিক্ষকের গবেষণায় যখন জালিয়াতি ধরা পড়ে তখন আর কাকে কি বলার থাকে? পাবলিক পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে প্রতিটি কেন্দ্রে কতজনকে বহিষ্কার করা হয় তার পরে কেউ কি তাদের খোঁজ রাখেন? শিক্ষকের নিজের ডিগ্রী নকল হলে তিনি অন্যদের কি পড়াবেন? পাহারাদার নিজে চোর হলে তো কথাই নেই।
অধুনা নোট ছাড়াও টেক্সট বইও নকল করা হয়। বই মেলায় কতটি নকল বই এলো-গেল, বিক্রি হলো, তা কি ধরার কোন অবকাশ আছে? কারণ বাংলাভায় এজন্য কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা আধুনিক প্রযুক্তিসম্বলিত সফটওয়্যার অদ্যাবধি তৈরি হয়নি।
ইংরেজিতে একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার জন্য ডুপলিচেকার, পেপার রেটার, প্লেজারেজমা, কপিলিক, প্লাগস্কান, কোয়েটেক্সট, স্মল এসইও, টারনিট ইন, আইথেনটিকেট, ইউনিচেক, নোপ্লাগ, গ্রামারলি, উরকুন্দ ইত্যাদি নানা নামের সফটওয়্যার বাজারে প্রচলিত। যেগুলো অনলাইনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমরা ভাড়ায় ইংরেজি ভাষার চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার জন্য ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু বাংলা ভাষার নকল বা একাডেমিক চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার জন্য প্রযুক্তিসম্বলিত সফটওয়্যার নেই। তাই বই, গবেষণা, এমনকি বাংলায় লেখা এমফিল বা পিএইচডি থিসিসের আসল-নকল যাচাই বা জালিয়াতি ধরার কোন ব্যবস্থা নেই।
যদিও এই এ্যন্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার বা একাডেমিক নকল বা চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার কম্পিউটার প্রযুক্তিকে কেউ কেউ শতভাগ গ্যারান্টি দিতে নারাজ তথাপি এর মাধ্যমে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তেলা যায় তা সবাই স্বীকার করবেন। বিশেষ করে মানুষকে কিছুটা পাঠমূখী ও গবেষণামূখী করার জন্য এই সফটওয়্যার বিশেষ ভূমিকা রাখতেই পারে।
কোন লেখার আসল-নকল যাচাই করা যায় এবং যাচাই করা হবে এই প্রসঙ্গ থাকলেই শিক্ষার্থীরা সাবধান হয়ে বইমুখী হবে এবং ভাল পড়ুয়া হয়ে উঠতে পারে।
পাশাপাশি যারা গবেষণা পেপার ও থিসিস মূল্যায়ণের কাজ করেন তাদের কাজের সময় ও চাপ কমে যাবে। ভাল মানের নির্ভেজাল রিপোর্ট প্রাপ্তি সহজ হবে। তাই আমাদের প্রযুক্তিবিদগণকে অচিরেই বাংলায় একাডেমিক নকল বা চৌর্যবৃত্তি যাচাই করার কম্পিউটার প্রযুক্তি সম্বলিত সফটওয়্যার উদ্ভাবনে এগিয়ে আসাটা জরুরি।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd