দেশের এভিয়েশনকে সমৃদ্ধশালী করে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত দেশের অন্যতম সেরা এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই দেশিয় যাত্রীদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা হচ্ছে ইউএস-বাংলা হবে শতভাগ যাত্রী বান্ধব বিমান সংস্থা। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা হবে সেবায়, আর সাশ্রয়ী ভাড়ায় দেশের প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী যাত্রীদের পাশে থাকার অভিপ্রায় নিয়ে চলাচল করছে ইউএস-বাংলা।
দু’টি ৭৬ আসনের ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলার বহরে এখন ২৪টি এয়ারক্রাফট রয়েছে। এর মধ্যে ৪৩৬ আসনের দু’টি এয়ারবাস ৩৩০-৩০০ এবং ৯টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটও রয়েছে। যাত্রীসেবাকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ রুটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সই প্রথম ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। খুব শীঘ্রই ইউএস-বাংলার বিমান বহরকে আরো সমৃদ্ধ করতে এবং নতুন নতুন রুট সম্প্রসারণের জন্য নতুন এয়ারবাস ৩৩০ সহ বোয়িং ৭৩৭-৮০০ যোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা থেকে যশোর রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মধ্য দিয়ে শুরু করা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সুনামের সাথে জাতীয় বিমান সংস্থার পাশাপাশি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে দেশিয় বিমান সংস্থা হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা। সারাবিশ্বে অবস্থান করা প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সিংহভাগই অবস্থান করে মধ্যপ্রাচ্যে। এ অঞ্চলের প্রায় ২৮ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বাস করে সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে। আর চার ভাগের এক ভাগ বাস করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন অঞ্চলে।
সিংহভাগ প্রবাসীদের সেবা দেয়ার জন্য ইউএস-বাংলার যাত্রা শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দোহা, মাস্কাট, দুবাই, শারজাহ, আবুধাবী, জেদ্দায় ফ্লাইট পরিচালনা করছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবস্থান কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। দেশিয় পর্যটকদের চাহিদা পূরণে ব্যাংককে প্রতিদিন ফ্লাইট পরিচালনা করছে। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্য বিশেষ করে কলকাতা ও চেন্নাইতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা। যার বেশির ভাগই পর্যটক, উন্নত চিকিৎসা সেবা ও ব্যবসার উদ্দেশ্যে গমন করে থাকে।
বিজ্ঞাপন
স্বাধীনতার পর প্রথম কোনো বাংলাদেশি বিমান সংস্থা হিসেবে চীনের গুয়াংজুতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা। চলতি শতাব্দীতে অতি মহামারিতে আক্রান্ত কোভিডকালীন সময়েও একমাত্র দেশিয় বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা ঢাকা-গুয়াংজু রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। দেশের এভিয়েশনকে আরো বেশি গতিশীল রাখতে এবং আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে ইউএস-বাংলা খুব শীঘ্রই সৌদি আরবের রিয়াদ, মদিনাসহ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নতুন রুট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
২০২৬ সালের মধ্যে লন্ডন, রোমসহ ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্য এবং ২০২৮ সালের মধ্যে টরেন্টো, নিউইয়র্কে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়েছে ইউএস-বাংলা। অদূর ভবিষ্যতে ইউএস-বাংলা অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনাও আছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স শুরু থেকে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। যাত্রী সাধারণের একনিষ্ঠ সমর্থন ও আস্থাই ইউএস-বাংলাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে।
সর্বোপরি দেশিয় এয়ারলাইন্সের অগ্রযাত্রাই দেশের এভিয়েশনের অগ্রযাত্রাই প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
লেখক মোঃ কামরুল ইসলাম মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে একের পর এক জয়ের মুখ দেখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর দখলে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে আরাকান আর্মি রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৩টি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের মংডু ও বুথিডাং এবং চিন প্রদেশের পালেতোয়া এই তিনটি শহরেরই নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করছে, পালেতোয়ার সাথে ভারতেরও সীমান্ত রয়েছে। আরাকান আর্মি এখন দক্ষিণ রাখাইনের গাওয়া, তাউনগুপ ও আন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করছে।
মংডু দখলের সময় আরাকান আর্মি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরিন তুনসহ মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের কিছু রোহিঙ্গাকেও গ্রেফতার করে। মংডুতে রোহিঙ্গাদের প্ররোচনা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র দেওয়া, ভয় দেখিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিতে বাধ্য করা এবং মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে জাতিগত বিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন সামরিক জান্তার হয়ে আরাকান আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত আলোচনায় যাতে কোন সংকট তৈরি না হয় সেজন্য এর যৌক্তিকতা সকল পক্ষের কাছে তুলে ধরতে হবে। রাখাইনে সংঘর্ষের সময় আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের জোর করে তাদের এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তাদের বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলে জানা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে। বহির্বিশ্বে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ইসলামী জঙ্গি হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে, এর বিপরীতে রোহিঙ্গা কিংবা তাদের স্বার্থরক্ষাকারী সংস্থার উল্লেখযোগ্য কোন প্রচারণা নেই। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জোর করে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করছে তা আন্তর্জাতিক মহলকে ভালভাবে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে। রাখাইনে এখন প্রায় পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে, চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশে বাধ্য করতে পারে।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ উচ্ছেদের পর আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত ক্যাম্পগুলোতে দায়িত্ব পালন করছে ফলে সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির সদস্যদের সাথে নতুন করে বোঝাপড়া এবং সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। অরক্ষিত সীমান্ত মাদক ও অস্ত্র পাচারকারীদের জন্য সুযোগ এনে দিবে এতে নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়বে। বর্তমানে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
রাখাইনের চলমান সংঘাতে দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ও রফতানি বন্ধ রয়েছে, সীমান্ত বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে। সংঘর্ষ চলমান থাকায় রাখাইন অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতিগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। জান্তা সরকার সড়ক ও জলপথ অবরুদ্ধ করায় সেখানে খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধসহ আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। রাখাইনের প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পুনরায় বাণিজ্য শুরু হলে তা রাখাইনের জনগণের দুর্দশা কমাতে সাহায্য করবে।
রাখাইনে চীনের ভূ-কৌশলগত, বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ স্বার্থ রয়েছে। আরাকান আর্মি চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু করছে না, মিয়ানমার সরকারও চীনের স্বার্থ রক্ষা করছে। রাখাইনে ভারতেরও বাণিজ্যিক এবং ভূ-কৌশলগত স্বার্থের পাশাপাশি চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য মোকাবিলায় তাদের উপস্থিতির বিষয় রয়েছে। ভারত আলাদাভাবে জাতীয় ঐক্য সরকার, আরাকান আর্মি, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং চিন ব্রাদারহুডের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে যদিও এর ফলাফল এখনও জানা যায় নাই। চীন তার সীমান্ত বাণিজ্য চলিয়ে যাচ্ছে এবং ভারত পুনরায় কালাদান মাল্টি মোডাল প্রকল্প চালু ও সিতওয়ে বন্দরের কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
সামনের দিনগুলোতে রাখাইনের পরিস্থিত কি হবে এবং আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রাখাইন কতদিন থাকবে, তা এখনো অস্পষ্ট। তবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সীমান্ত পার হয়ে নতুন করে বাংলাদেশে যাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ না হয় সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান করতে চায় বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার বিষয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ রোহিঙ্গা ইস্যুতে যারা খুবই আগ্রহী, তারা সবাই এই সম্মেলনে থাকবে বলে আশা করা যায়। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময়ে এই পরিকল্পনার কথা জানায়। সার্বিক রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টা একজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি গভীরভাবে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং সব অংশীজনদের সাথে আলোচনা ও সমন্বয় করবেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারে একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য সকল অংশীজনদেরকে একত্রে কাজ করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে সীমান্তের ওপারের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত খবরাখবর জানতে পারে এবং জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে পারে। কক্সবাজারে কর্মরত জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে আরাকান আর্মি, ইউ এল এ এবং এন ইউ জি’র প্রতিনিধিরা যোগাযোগ করতে পারে। রাখাইনের মুক্ত এলাকায় নিরাপদ অঞ্চল ও মানবিক করিডোর স্থাপন করে ত্রাণ সহায়তা ও রোহিঙ্গা স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মিয়ানমারের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ামারের সাথে তাদের বাণিজ্য চলমান রেখেছে। রাখাইনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে দুদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এগিয়ে আসতে পারে।
রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোস্ট গার্ড ও বিজিবি সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ চলমান পরিস্থিতিতে নাফ নদীতে টহল বাড়িয়েছে এবং নাফ নদীর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে এবং বাংলাদেশের জলসীমার ভেতরে নৌ টহলও জোরদার করেছে।
২০২১ সালে জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ এন ইউ জি, আরাকান আর্মি কিংবা রাখাইনের রাজনৈতিক দল ও জনগণের সাথে যোগাযোগ ও স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু করতে না পারলেও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে মিয়ানমার সৃষ্ট সংকটের বিপুল বোঝা বহন করে চলছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুদেশের মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে চাইলে বাংলাদেশকে আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও আলোচনা শুরু করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বার্মা অ্যাক্টসহ, রোহিঙ্গা অ্যাক্টসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক কৌশল কাজে লাগাতে সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন।
রোহিঙ্গাদেরকেও তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকতে থাকে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করা প্রয়োজন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করা গেলে তারা নিজেদের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে পারবে।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারী জনগণ কিছুদিন পরপরই আতঙ্কের মধ্য দিয়ে সময় পার করে, নাফ নদীতে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। রাখাইনে সংঘর্ষের কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাখাইন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসলেও সামনের দিনগুলোতে এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান না হলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করার জন্য আক্রমণ করবে। ইতিপূর্বে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। পুনরায় আক্রমণ শুরু হলে আরাকান আর্মির সদস্যরাও পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিতে পারে। তখন নতুন ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশকে চলমান সংকটের পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে নতুন ধরনের সংকট মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদেরকেও তাদের দাবি আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। ভূকৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সবাই তাদের নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে কাজ করে, তাই নিজের অধিকার নিজেদেরকেই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। আঞ্চলিক ও বিশ্বের যে সব দেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে ও নিচ্ছে এই সংকট সমাধানে তাদেরকে ও সাথে রাখতে হবে। রাখাইনের জনগনের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়বে ও বিদ্বেষ কমবে। এর ফলে এই অঞ্চলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।
মিয়ানমার সরকার সব সময় রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী ও বাংলাদেশি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। একই সাথে রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে তারা দাবি করে। এন ইউ জি ও আরাকান আর্মির যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমার ও রাখাইনের জনগণের মধ্যে প্রোথিত মুসলিম ভীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করে দিতে হবে যে, বাংলাদেশ সবসময় তার প্রতিবেশী দেশের ভেতরে অশান্তি সৃষ্টির বিপক্ষে।
আগামী দিনগুলোতে মিয়ানমারে যে সরকারই আসুক না কেন আরাকান আর্মি রাখাইনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আরাকান আর্মিকে বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান অসম্ভব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ করেছে যা একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। নিয়োগপ্রাপ্ত উপদেষ্টার দিকনির্দেশনায় এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সফলতার মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়।
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অব.) মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক
নির্বাচনের বছর বলা হয়েছিল ২০২৪ সালকে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এবার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু বছর শেষে বাংলাদেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, সিরিয়া এবং আরও অনেক দেশে গণআন্দোলন, সংঘাত ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ২০২৪ নামক বছরটিকে দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত রাজনৈতিক পর্বান্তরের পটভূমিতে।
বছর শেষের প্রাক্কালে যে প্রশ্নটি বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলেছে, তা হলো, কেন সিরিয়ায় আসাদের নাটকীয় পতন হয়েছে? দ্রুততম ও অভাবনীয় এই পতনের নেপথ্য কার্যকারণগুলো কি ছিল? যদিও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের সাথে সুপরিচিত এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্যের বন্যা বইছে। অনেকেই ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে এবং কেন তার শাসন এত দ্রুত পতন হল। তথাপি সিরিয়া নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায় নি।
বিশেষত, প্রবীণ সিরিয়ান সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক হাসান হাসানের এক্স-এর একটি পোস্টে উত্থাপিত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর এখনও বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। তিনি বলেছেন যে, "সিরিয়া বিষয়ে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত উত্তর নেই। এখনও অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা বাকি।" তার মতে, "আসাদের অনুগত বাহিনী ছিল অন্তত কিছু সময়ের জন্য দামেস্ককে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্ত তারা কেন হাল ছেড়ে দিল, তার কোন সদুত্তর নেই।
তিনি মনে করেন, "দামেস্কের কাছে এটি পরিষ্কার ছিল যে পুরো দেশের বেশিরভাগ অংশে যুদ্ধ করতে অক্ষম ছিল আসাদের শাসন ও সৈন্যদল। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয়, কেন তারা রাজধানী রক্ষার যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা কোনও ঘোষণা ছাড়াই পরিত্যাগ করেছিল? এটি কখন ও কেমন করে হলো, তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি কোনও সূত্রের পক্ষেই।"
হাসান আরও বলেন, "আসাদের কাছে লড়াই করার জন্য সবচেয়ে প্রশিক্ষিত এবং অনুগত বাহিনী ছিল, কিন্তু তারা রাজধানী ছেড়ে পালালো কেন? যদিও সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে আসাদের অনেকগুলো শক্তিশালী ঘাঁটিতে অনুগত ইউনিটগুলে লড়াই করতে ইচ্ছুক ছিল। রাজধানীর আকস্মিক পতন ঘটায় তারাও হতাশ আর নেতৃত্বহীন হয়ে রণাঙ্গন পরিত্যাগ করে।"
হাসানের মতো আরও অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, "তাহলে কেন সেনাবাহিনী আসাদকে সম্পূর্ণরূপে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে পরিত্যাগ করল অপেশাগত পদ্ধতিতে?" পশ্চিমা গ্রেগরি ওয়াটার্স এবং সিরিয়ার মুহসেন মুস্তাফার মতো বিশ্লেষকরা একাধিক কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যা গত কয়েক বছরে সামরিক সংহতি এবং প্রস্তুতিকে ক্ষুণ্ন করেছে, যার মধ্যে কয়েক হাজার অফিসার এবং সৈন্যকে রিজার্ভে স্থানান্তর করার ঘটনা রয়েছে। এতে, সক্রিয় এবং রিজার্ভ উভয় ধরনের সৈন্যদের পেশাগত জীবনযাত্রার মান মারাত্মক ক্ষয় হয়েছে। তাছাড়া, সংরক্ষিত কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও দুর্নীতির ফলে বেতন আত্মসাৎ এবং খাদ্য সরবরাহের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় আসাদের সামরিক শক্তি ভঙ্গুর হয়েছে। সর্বোপরি, রাশিয়া, ইরান এবং হিজবুল্লাহর কাছ থেকে যে ধরনের সামরিক সহায়তা আসাদ-শাসনের টিকে থাকার চাবিকাঠি ছিল, শেষ দিকে পর্যাপ্ত ছিল না।
আসাদের পতনের ঘটনা থেকে কর্তৃত্ববাদী আরব রাষ্ট্রগুলো এই সামরিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা পেতে পারে যে, বাইরের সাহায্যে ভেতরের সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়। আসাদ পতনের ঘটনাবলি এই দরকারী অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে যে, জনবিচ্ছিন হলে ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব। তদুপরি, জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে রাজনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা শাসনের অবক্ষয় নিয়ে আসে। সিরিয়ার অভিজ্ঞতায় আরব বিশ্বের দেশগুলোতে আগামী দিনে শাসন ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ককে আরও জনমুখী করার প্রয়োজনীয়তা প্রকট হচ্ছে।
উত্তাল আরব বিশ্বে অভ্যুত্থান ও গণবিক্ষোভ তীব্র হয়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটালেও সিরিয়া এসব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তবে, ২০১১ সালে মিশর এবং লিবিয়ায় এবং ২০১৯ সালে আলজেরিয়া এবং সুদানে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাধারণ কারণের মধ্যে অন্তত একটি সিরিয়ার আসাদ সরকারের শেষ দিনগুলোতে দৃশ্যমান হয়েছিল। অন্যান্য আরব দেশের মতো সিরিয়ায় যখন জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয়েছিল, তখন সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছিল যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনগণের সঙ্গে বোঝাপড়ায় পর্যুদস্ত হয়েছেন, আর তখনই কর্তৃত্ববাদী শক্তির প্রধান নোঙ্গর এবং শাসনের স্থায়িত্বের গ্যারান্টার হিসাবে সামরিক বাহিনী তার ভূমিকা স্থগিত করেছে।
২০২৪ সালে সিরিয়ায় যা হয়েছে, তা ২০১১-২০১২ সালে হয় নি। তখনকার জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের হুমকির কারণে আসাদ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়নি। তবে শাসনের প্রতিটি সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষয় শুরু হয়েছিল অল্প অল্প করে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধকালীন বাস্তুচ্যুতি এবং রাষ্ট্রীয় ঋণের ক্ষতির কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি বৃহৎ চাষি শ্রেণি, এবং একটি ব্যবসায়িক খাত যা বারবার ঝাঁকুনি এবং পতনের মুখোমুখি হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে, আসাদ একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সাথে একটি অন্তর্নিহিত চুক্তি ভঙ্গ করেছেন বলে মনে হচ্ছে যেটি তার প্রতিরক্ষায় হাজার হাজার লোককে হারিয়েছে। ক্রমাগত অবনতিশীল জীবনযাত্রার মান এবং সরকারী খাতে আয়ের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে আস্থায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতির অন্তহীন চক্রের পতন ঠেকাতে পারে নি।
সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডের মধ্যে এই ধারণা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি একটি সংকটময় মুহূর্তে বিদেশি সামরিক বা আর্থিক সহায়তার সুবিধা নিতে পারছেন না। এর আনুমানিক কারণগুলো ছিল, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, ইরানের অবক্ষয়, কৌশলগত প্রতিরোধ এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর সামরিক ক্ষয়ক্ষতি, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে আসাদের হাতের বাইরে। অন্য চারটি আরব দেশে অতীত দৃষ্টান্তে দেখা যায় যে, একজন প্রেসিডেন্টের বিদেশি সমর্থন বা সামরিক নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা করার ক্ষমতার প্রকৃত বা সম্ভাব্য ক্ষতি তাকে রক্ষা করতে বা পরিত্যাগ করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সিরিয়ার একদিকে, সমাজ ও রাজনীতির সামরিকীকরণ এবং কয়েক দশক ধরে শাসনের স্তম্ভ হিসাবে সেনাবাহিনীর দ্ব্যর্থহীন ভূমিকা সত্ত্বেও, সিরিয়ার সেনাবাহিনীর আরব প্রতিপক্ষদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। হাস্যকরভাবে, আসাদের অনানুষ্ঠানিক কন্ট্রোল নেটওয়ার্কের সাথে এর আনুষ্ঠানিক কমান্ড স্ট্রাকচারের আন্তঃসংযোগের অর্থ হল যে তিনি এর সংহতি রক্ষা করতে এবং গৃহযুদ্ধের সময় এটির টিকে থাকা নিশ্চিত করার চেয়ে বেশি করেছিলেন তার ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য। অতি সম্প্রতি, একটি সঙ্কুচিত অর্থনীতি থেকে আয় কমানোর বিষয়ে তার বিভ্রান্তির মধ্যে এই ফাংশনটির প্রতি তার অবহেলা, সেনাবাহিনীর সংহতিকে আরও দুর্বল করেছে। অন্যদিকে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। সেনাবাহিনীতে আসাদপন্থী আলাভি সম্প্রদায়ের নিয়োগের উপর অত্যধিক নির্ভর করে শাসনের টিকে থাকার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সেনা প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যর্থ করেছে। যদিও সামরিক বাহিনী দীর্ঘকাল ধরে এবং নিজের মধ্যে একটি প্রধান পাবলিক সেক্টর নির্বাচনী প্রতিনিধিত্ব করেছে ও এটিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার একটি হাতিয়ার হিসাবে অপরিহার্য করে তুলেছে, তথাপি আসাদের রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের বাকি অংশের দরিদ্রতা থেকে রক্ষা করতে আসাদের অক্ষমতা তার উপর সেনা আস্থা হ্রাস করেছে।
সিরিয়ার বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের এই পাঠ থেকে একটি চূড়ান্ত, আশাব্যঞ্জক প্রভাব হল যে দামেস্কে যা ঘটেছিল তা ২০১১ সালে মিশরে যা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি নয়, যখন সশস্ত্র বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারককে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতা থেকে সরে গিয়েছিল। তাদের অবস্থান এবং মূল শাসন সংরক্ষণ, অথবা যখন আলজেরিয়ান এবং সুদানী সেনাবাহিনী ২০১৯ সালে একই কাজ করেছিল। সিরিয়ার কয়েক ডজন সিনিয়র সেনা কমান্ডার যারা আসাদের শাসনের শেষ দিনে দামেস্কে থেকে যাওয়া হয়তো তাকে বলেছিল যে তারা তার পক্ষে লড়াই করবে না এবং তাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে। যাইহোক, তাদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের অভ্যাসের অভাব ছিল এবং সিরিয়ার রাজনৈতিক রূপান্তর বাতিল করতে এবং তাদের নিজের হাতে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল। ফলে সিরিয়ার ক্ষমতা আসাদের কাছ থেকে কোনও সামরিক জেনারেলের হাতে যায় নি। জেনারলগণ নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে পুরো সেনাবাহিনী সমেত রণাঙ্গন থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য বিদ্রোহীদের সামনে মসৃণ পথ তৈরি করে দিয়েছেন। সেই পথে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরেক দিক থেকে ইসরায়েল আক্রমণ ও আগ্রাসন চালিয়েছে সিরিয়ায়।
সিরিয়ায় আসাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসন ও কর্তৃত্ববাদ দেশটির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শক্তি ও সামর্থ্যের যে চরম ক্ষতি করেছে, তার দায়ভার সিরিয়াকে ভোগ করতে হচ্ছে চারদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
সামরিক জান্তার অধীনে বসবাস করে মিয়ানমারের জনগণ তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সুসংবাদের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন অপরাধী সামরিক শাসন ব্যবস্থা ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়তে যাচ্ছে-এমন পরিবর্তনের জন্য জনগণ মুখিয়ে আছে। গত রোববার এমনই কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনাকেই অনুভব করতে পেরেছেন তারা।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অত্যাশ্চর্য বিজয়ে বাশার আল-আসাদের কয়েক দশকের শাসনের অবসানে বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনীর রাজধানী দখল এবং রাষ্ট্রপতিকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য করা, দামেস্কের রাস্তায় সিরিয়ানদের স্বাধীনতা উদযাপন করার খবর এবং ছবি মিয়ানমারের জনগণ ব্যাপকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। মিয়ানমারে বিরোধী বাহিনী এবং বেসামরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন বিমান হামলা চালানোর নির্দেশদাতা জেনারেলদের প্রতি এটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। যা কোন ডিজাইনকৃত ভুল প্রচারণা ছিল না, জনগণের স্বতোস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল এ প্রচারণায়।
মিয়ানমারেও কি সিরিয়ার মতো একই রকম পরিস্থিতি হতে পারে? এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় দেখতে পাচ্ছি—আসাদ সরকারের মত পতন মিয়ানমারে ঘটতে পারে কিনা তা নিয়ে সীমাহীন চর্চা চলছে। মিন অং হ্লাইং যদি একই পরিণতির মুখোমুখি হয়, তবে রাশিয়া বা চীন কি তাকে এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে? যদিও এই মুহুর্তে এটি কিছুটা দূরবর্তী বিষয়, তবে মিয়ানমারের বিপ্লবের অনেক কট্টর সমর্থক এমন একটি ফলাফলেরই আশা করছেন।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে আরও বিশৃঙ্খলা, এমনকি দেশটি নতুন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে; তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের মানুষ সাগ্রহে দামেস্কে খুনি শাসনের পতনের খবর শেয়ার করেছেন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রগুলি আসাদের পরাজয়ের বা রাশিয়ায় তার ফ্লাইটের কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি, যখন আসাদ সরকারও অব্যাহতভাবে মিয়ানমার জান্তার শক্তিশালী মিত্র ছিল।
আকস্মিক পতন প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসনের জন্যই দুঃস্বপ্নের, তবে এটি যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে এবং মিয়ানমারও এর ব্যতিক্রম নয়। সিরিয়ার জনগণকে এতে আনন্দিত হতে দেখে মিয়ানমারের জনগণও অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। মিয়ানমারের জনগণ এবং বিরোধী দলগুলো নিজেদের সেই দিনের স্বপ্ন দেখছেন, যেদিন নেপিদোতে মিন অং হ্লাইং সরকার একই পরিণতির মুখোমুখি হবে।
আসাদের মতো, মিন অং হ্লাইং গত চার বছরে তার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সীমাহীন অপরাধ করেছে এবং জনগণ সেই নৃশংসতা জনগণ সহজে ভুলবে না। আসাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের জনগণও দেশটির জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনীর রাখাইন এবং চিন রাজ্যে আরও কৌশলগত শহর দখলের খবর জেনেছে। আরাকান আর্মির কাছে রাখাইনে মংডুর পতন এবং জান্তা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনকে বন্দী হতে দেখেছে। এখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত আরাকান আর্মির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই বিজয়ের আবহেই চীন প্রদেশে প্রতিরোধ বাহিনী রাজ্যের রাজধানী হাখা এবং থানলাংয়ের মধ্যবর্তী কৌশলগত সমভূমিতে শেষ নিরাপত্তা ফাঁড়িটি দখল করে নিয়েছে। দেশটির উত্তরে কাচিন রাজ্যে, চীনের চাপকে উপেক্ষা করে, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) ভামো এবং মানসি শহরে সরকারী চৌকিতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য স্বৈরশাসকদের মতোই তবে কি মিন অং হ্লাইং একটি বিভ্রান্তিকর স্বপ্নের জগতে বাস করছেন? এমনকি তার সৈন্যরা যখন বিরোধী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে এবং তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলি সারা দেশে ক্রমাগত সঙ্কুচিতত হয়ে আসছে তবুও তিনি বিশ্বাস করেন যে মিয়ানমার ‘সোনার ভূমি’ ‘স্থিতিশীল’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’!
প্রকৃতপক্ষে ২০২১ সাল থেকে তার শাসনকালে মিয়ানমারের বেশিরভাগ অংশ ছাই হয়ে গেছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা চরমে পৌছেছে। তার সেনাবাহিনী প্রতিরোধ শক্তির অভূতপূর্ব চাপ এবং এখন বিস্ফোরণের সম্মুখীন। কিন্তু মিন অং হ্লাইং এখনও বিশ্বাস করেন যে তিনি চীন এবং রাশিয়ার মতো তার প্রধান বিদেশী মিত্রদের সহায়তায় দেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
কিন্তু সিরিয়ার বিদ্রোহীরা যখন দামেস্কের পথে ছিল তখন আসাদের মিত্র ইরান এবং রাশিয়ার কাছ থেকে কোনো সহায়তা আসছিল না, আসাদ এবং তার পরিবারকে তাদের জীবনের জন্য দৌঁড়াতে বাধ্য করেছিল, এই সত্যটি তার মনে রাখা ভাল।
এমন অবস্থাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান। আজ দেশব্যাপী প্রতিরোধ প্রচেষ্টাগুলো চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসক আসাদের মতো একই পরিণতির মুখোমুখি হবেন না এমন সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দিতে পারছে না। আজ নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আসাদ সরকারের পতন ৬০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের মিয়ানমারের জনগণের জন্য আনন্দের উৎস এবং অবশ্যই নেপিদোর নেতৃত্বকে এটি নাড়া দেবেই।
মিয়ানমারের জনগণের কাছে ইতিহাসের সান্ত্বনাদায়ক স্মৃতি হিসাবে কাজ করছে যে সমস্ত স্বৈরশাসকেরই শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে, তাদের যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন। মিয়ানমারের মানুষ তাদের নিজ দেশে দমনমূলক শাসনের উত্থান-পতন দেখেছে। তারা কষ্ট পেয়েছিল এবং অবশেষে তারা তা কাটিয়ে উঠবেই। মিন অং হ্লাইং এর ক্ষমতায় আরোহণ ও তার বিরোধিতায় অটল প্রতিরোধ আন্দোলনে মিয়ানমারের জনগণ বর্তমানে আরেকটি বিশৃঙ্খল সময় সহ্য করছে। নিঃসন্দেহে যখন কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে জনগণ পরবর্তী অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাবেই। মিন অং হ্লাইং-এর জন্য এটি ভয়ের কারণ।
দ্য ইরাবতী’র সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে ভাষান্তার: আশরাফুল ইসলাম
একটি চৌবাচ্চায় যতই পানি ভরা হোক, সেখানে ছিদ্র থাকলে পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। একদিক দিয়ে পানি ঢালা হলেও ছিদ্রের কারণে অন্য দিক দিকে সব পানি বের হয়ে যাবে। চৌবাচ্চা পরিণত হবে শুষ্ক ও পানিশূন্য ভাণ্ডে। ফলে পানি সংরক্ষণ করতে হলে সবচেয়ে আগে চৌবচ্চার ছিদ্র সারাতে হবে।
দুর্নীতি হলো চৌবাচ্চার ছিদ্রের মতো। যতই আয় হোক, উৎপাদন হোক, দুর্নীতি থাকলে সঞ্চয় ও সমৃদ্ধি বলতে কিছুই হবে না। অভাব ও হাহাকার লেগেই থাকবে। তাই সমাজকে উন্নত, দারিদ্র্য মুক্ত ও আর্থিকভাবে মজবুত করতে হলে অবশ্যই দুর্নীতি দূর করতে হবে।
জুলাই বিপ্লবের পর যে সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে, তা অতীতের গতানুগতিক সরকারের মতো নয়। এই সরকারের শরীরে লেগে রয়েছে মানুষের রক্ত-মিশ্রিত অঙ্গীকার পালনের দায়বদ্ধতা। যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য রোধ করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালনের পথে বেশ কিছু কাজ করেছে। যার ভিত্তিতে কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন সম্ভব হবে এবং দুর্নীতি, অনিয়ম ও বৈষম্য রোধ করা সহজ হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের লক্ষ্যে শ্বেতপত্র প্রকাশ। যাতে এসব সেক্টরে অনিয়ম, বৈষম্য ও দুর্নীতির প্রকৃত কার্যকারণ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। দেশের নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রণীত এইসব শ্বেতপত্র বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত দলিল স্বরূপ, যার সুপারিশের ভিত্তিতে দুর্নীতি, বৈষম্য ও অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে এবং প্রতিরোধের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্নহলো, এইসব শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা? নাকি এগুলোর বাস্তবায়ন করাই জরুরি বিষয়? অবশ্যই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নচেৎ অতীতের মতো বস্তাবন্দী হয়ে এগুলো পোকার পেটে যাবে। যদি পোকা খাদ্য হয়, তাহলে এতো আয়োজন করে এগুলো প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হলো কেন? এই প্রশ্ন জনমতে সৃষ্টি হবেই।
অতএব, জরুরি ভিত্তিতে এসবের বাস্তাবয়ন করতে হবে। কিন্তু কে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে? যে সরকার এগুলো প্রণয়ন করিয়েছে, বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তায়। ভবিষ্যতের সরকার এসব কাজের দায় দিতেও পারে কিংবা না-ও নিতে পারে। তাছাড়া ভবিষ্যতের সরকারগুলো জুলাই বিপ্লবের রক্তরঞ্জিত চেতনা বাস্তবায়নে কতটুকু তাগিদ অনুভব করবে, সেটাও এখনই বলা সম্ভব নয়। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই এইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে একটি সংশয় রয়েছে। তাহলো, বর্তমান সরকারের পক্ষে শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব হবে? নাকি মতলববাজ মহল এসব বাস্তবায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে? এই সংশয় অমূলক নয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো দুর্নীতি ও অনিয়মের দেশে সমস্যা চিহ্নিত করার পর সমস্যার প্রতিরোধ বা সমাধান করতে গেলে পদে পদে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়। এদেশে ভালো ভালো কথা ও ভালো পরিকল্পনা করা যত সহজ, সেগুলো বাস্তবায়ন করা ততই কঠিন। অতীতে বহু ভালো ও মহৎ উদ্যোগ নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানেও এমনটি হয় কিনা, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি, সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে।
কারণ, বাংলাদেশ বছরের পর বছর অনিয়ম, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতকে পুষ্টি জুগিয়েছে। সমাজ ও রাজনীতিতে স্বার্থ গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। এইসব স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দু্র্নীতি ও বৈষম্য প্রতিরোধের পথে কালাপাহাড়ের মতো অবরোধ সৃষ্টি করবেই। বাস্তবায়নের কাজগুলো সম্পন্ন হলে এইসব অপশক্তির স্বার্থ নষ্ট হবে। বিধায় তারা রাজনৈতিক দিক থেকে, প্রশাসনিক দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়ন হতে দেবে না। তারা চাইবে দুর্নীতি ও অনিয়ম থাকুক। এতে জনগণকে ঠকিয়ে তাদের পক্ষে ফায়দা হাসিল করা সহজ হবে।
কিন্তু বর্তমান সরকারকে স্বার্থগোষ্ঠীর বিরোধিতা, প্রতিবন্ধকতা ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে মারাত্মক ভুল হবে। সকল বিঘ্ন ঠেলে সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব ও সুপারিশ তাদেরকেই বাস্তবায়ন করে যেতে হবে কিংবা বাস্তবায়নের ধারার সূচনা করে যেতে হবে। এতে দুর্নীতি ও বৈষম্যের অতীত মুছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে। কিংবা তাদেরকে এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে, যাতে শ্বেতপত্র, সংস্কার প্রতিবেদন, সুপারিশ প্রকাশই শেষ কথা না হয়, সেগুলোর বাস্তবায়নও নিশ্চিত হয়। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের শাসন কাঠামোতে এমন একটি পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া থাকা দরকার, যেখানে ছিদ্র-রূপী দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ হয় এবং দেশ ও জনগণের সম্পদ বেহাত ও লুটপাট হতে না পারে।
প্রসঙ্গত, শ্বেতপত্র নিশ্চয় কোনও ঐশ্বরিক দলিল নয়। এর ভুলভ্রান্তি থাকলে সেগুলোকে সংশোধনের এবং সময় সময় আপটুডেট করার রাস্তাও খোলা রাখতে হবে। একটি চলমান পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সুশাসনের পক্ষে শাসন ব্যবস্থার অব্যাহত গতিই হওয়া উচিত যেকোনও সংস্কার ও পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি, এই সত্যটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সরকার পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই মনে রাখতে ও পালন করতে হবে। আর এটা বর্তমান সরকারের মতো ভবিষ্যতের সরকারগুলোকেও বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের প্রয়োজনেই।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।