আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: কর্মীর চোখে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

, যুক্তিতর্ক

অধ্যাপক ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া | 2024-06-24 01:20:19

নম্বইয়ের দশকের শুরুতে এসএসসি পাশ করে চট্রগ্রামের হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজে ভর্তি হই। স্কুল জীবনে ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্কুল কমিটির আহ্বায়ক বানিয়ে দিলেও ছাত্রলীগের অনেক কিছুই বুঝতাম না। কলেজে এসে ছাত্রলীগের আদর্শ, উদ্দেশ্য, করণীয়, দুই ভাগ সবই বুঝতে পারি। ১৯৭১ সালে আমাদের রাউজানের আবুরখিল গ্রাম ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি, আমার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে আসতেন এবং থাকতেন। আমার ছোটোবেলায় মুক্তিযোদ্ধা আঙ্কেলদের দেখতে খুব ভাল লাগতো, আমাকেও তাঁরা খুব স্নেহ করতেন। তাদের হাতে রাইফেল, বুলেট, গ্রেনেড, উঠানে আমার অনুরোধে ফাঁকা গুলি ছোড়া, খোসা কুড়ানো-সবই ছোটবেলায় ভালো লাগা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক শক্তি, সাহস, প্রশিক্ষণ, রাজনীতির শিশুমনে বীজ বপণও বটে।

কলেজে দুই ভাগ, জালাল-জাহাঙ্গীর এবং ফজলু-চুন্নু, আমাদের জালাল-জাহাঙ্গীর গ্রুপের চেয়েও ফজলু-চুন্নু গ্রুপটি বড় ছিলো, তবে নেতৃবৃন্দের মধ্যে সখ্যতা ছিলো। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করতে এসে ছাত্রলীগ আমাকে বা আমাদের খুঁজে বের করেননি, বরং আমি ও আমার গ্রুপ নিয়ে নেতাদের রুম খুঁজে বের করলাম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদানের কথা ব্যক্ত করলাম। এখানেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য সংখ্যা অনেক কম ছিলো, বরং জাতীয় ছাত্রলীগ শক্তিশালী সংগঠন ছিলো। এভাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল ও ময়মনসিংহ জেলায় আমার ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেবার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

তখন এরশাদ আমল, ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না, ছাত্ররাজনীতি যেন নিষিদ্ধ, স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু ছাত্রদের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের নির্বিচারে হত্যা, গাড়ি চাপা দেয়া সবই আমাদের জানা। “ছাত্র সমাজ নামক সন্ত্রাসী ছাত্রদের আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল। রুমি নামক একজন স্থানীয় মেডিকেল ছাত্রকে ছাত্র সমাজের দায়িত্ব দেয়া হল। তার সাথে তৎকালীন ময়মনসিংহের সকল খুনি, ডাকাত, সন্ত্রাসীদের সখ্যতা ছিলো। তাদের দিয়ে প্রায়শঃ আমাদের ওপর নির্যাতন, মারামারি, হত্যার হুমকি দেয়া হতো।

একদিকে পুলিশের নির্যাতন ও ছাত্রসমাজের ভয়ভীতি প্রদর্শন, সংঘর্ষ এবং অন্যদিকে ছাত্রদলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আমাদের ক্যাম্পাসে যেন ত্রিমুখী লড়াই ছিলো, প্রতি মাসেই মারামারি হতো। ছাত্রদলের সাথে সংঘর্ষ হতো, মামলা মোকাদ্দমা হতো এবং এমনকি ছাত্রলীগের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাইসুল হাসান নোমানকে পরীক্ষা হলে শিক্ষকের সামনে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এরকম এক বৈরি সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করি। নেতৃত্ব দিই ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচন ও জেলা ছাত্রলীগের, 

ছাত্রজীবন মানে অদম্য সাহস, যার পিছুটান থাকে না, ছাত্রাবাসে থাকি, পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবক বলতে কেউ নেই। সম্পূর্ণ স্বাধীন একসত্ত্বা, দুরন্তপনা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আদর্শ-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলন মেনে চলাই ছিলো তখনকার ছাত্র রাজনীতির নিয়ম। তখনকার আশি-নব্বই দশকের তুলনামূলক খাঁটি রাজনীতি দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। অর্থের কোনো সংযোগ ছিলো না, এমনকি ক্ষমতার কথাও ছিল না ছাত্র রাজনীতির ভাবনায়।

১৯৭৫-এর পর এমনিতেই ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ঘুরছে, পাকিস্তানী লিগ্যাসি তখনকার নষ্ট রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, সুযোগ সন্ধানী রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার হাতবদল, রাজনীতিতে অপশক্তির দাপট এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দ্বিধাবিভক্ত নেতৃত্ব আমাদের আত্মবিশ্বাসকে আরো দুর্বল করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদের আদর্শের বরপুত্র। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে এই জাতি, এই দেশ যেন দিশেহারা, আমরাও হলাম অভিভাবকশূন্য।

টুঙ্গীপাড়ার তরুণ শেখ মুজিব কিভাবে মুজিব ভাই হলেন, বঙ্গবন্ধু হলেন, জাতির পিতা হলেন সবই প্রাঞ্জল ভাষায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচায় সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৪২ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে তরুণ শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়েই ছাত্র রাজনীতি ও পরবর্তীতে তখনকার ভারতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হলেন। ভারতের সেই সময়ের জাতীয় নেতা মাহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরে বাংলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আকরাম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাশিম সহ সকল নেতাদের সংস্পর্শে এসে শেখ মুজিবের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল।

এভাবেই ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ছাত্রলীগের রাজনীতি ও গ্রগতিশীল ধারার মুসলিম লীগের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান অবিভক্ত ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনকেও ধারণ করতেন।

১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব বাংলার রাজনীতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে “মুসলিম” শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হবার পর বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস আর পিছনে তাকায় নাই। বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানী শাসকদের একচোখা নীতি, শাসন-শোষণ, নির্যাতন, সংস্কৃতিতে আগ্রাসন, ভাষার ওপর আঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিমাতাসুলভ আচরণ, বাঙালির অধিকার ক্ষুন্ন যেন ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রতিচ্ছবি।

শেখ মুজিব এগিয়ে এলেন, তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শক্ত হাতে হাল ধরলেন। ১৯৪৯ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ বা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হলেও বেশ কয়েকবার নেতৃত্বের মতদ্বৈততা ও দলকে ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে যা আমাদের সকলের জানা আছে। ১৯৫৫ সালে দলের নামে “মুসলিম” শব্দ বাদ দেয়া নিয়ে ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সিয়াটো চুক্তি এবং সেন্টো সামরিক জোটের যুক্ত হওয়া নিয়ে মতদ্বৈততা, আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে এই প্রস্তাবে ভোটাভুটিতে ভাসানী সাহেবের হেরে যাওয়া, নতুন দল ন্যাপ গঠন করা, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা নিয়ে বিরোধিতায় সভাপতি তর্কবাগিশ সাহেবের দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে হোঁচট খেয়েছে।

১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর মাথার ওপর আর কোনো হাত অবশিষ্ট রইল না। ১৯৬৬ সালে আবারো ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনে কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। মওলানা ভাসানীর নতুন দল গঠন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের দলত্যাগ, শেরে বাংলার নীরবতার রাজনীতিতে কেউ শেষ পর্যন্ত বাঙালির মুক্তি ও স্বাধিকারের প্রশ্নে অবিচল থাকতে পারেননি। বাঙালির মুক্তির একমাত্র আস্থা ও ঠিকানায় পরিণত হলো অবিচল শেখ মুজিবুর রহমান।

বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলন, চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার এই দীর্ঘ সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলো স্বর্ণালী গৌরবের বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি।

এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে সাথে নিয়ে, নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, নিজের ফাঁসির রজ্জু হাতে নিয়ে “বাংলাদেশ” নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

“বঙ্গবন্ধু” মানে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, “জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গৌরব ও অহংকারের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, যে সংগঠন একটি স্বাধীন দেশ দিল, জয় বাংলা স্লোগান দিলো, একটা পতাকা দিলো, জাতীয় সংগীত দিলো, একজন জাতির পিতা বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিলো ও বিশ্ব মানবতার নেত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনাকে দিলো, ধন্য ধন্য সেই সংগঠন।

১৯৭৫ সালের জাতির পিতা, বঙ্গমাতা ও শিশু রাসেলসহ পরিবারের সকল সদস্যদের ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো। ক্ষমতালোভীরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে ক্ষমতার ভাগাভাগি করে পবিত্র সংবিধানকে ও সংবিধানের মূল আদর্শিক কাঠামোকে এক এক করে ধ্বংস করা হলো। স্বাধীনতার সকল মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করলো। বাঙালির অমানিশা, ঘোর অন্ধকার, আওয়ামী লীগের ঘরের মধ্যে ঘর, দলে ভাঙ্গন, মীর জাফরদের দল থেকে পলায়নের ফলে এদেশের মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর নেতৃত্ব আর থাকল না।

এই পর্যায়ে ১৯৭৬ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নেন মহিউদ্দীন আহমেদ এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন বেগম সাজেদা চৌধুরি। ১৯৭৭ সালে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন দলের আহবায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে দলের হাল ধরেন সভাপতি আবদুল মালেক উকিল, সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক। ১৯৭৮ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ দিশেহারা, অবশেষে ১৯৮১ সালে সেই ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতে সর্বসম্মতভাবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী হিসেবে নির্বাচিত করে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে ঝড়-বৃষ্টি, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে লাখো লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি মহাকবির মতো উচ্চারণ করলেন, “বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি, আমি আওয়ামী লীগের হওয়ার জন্য আসিনি। সবকিছু হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।”

শুরু হয় দীর্ঘ সংগ্রামের পথ। ষড়যন্ত্রকারী এক জেনারেলের বদলে আরেক জেনারেল ক্ষমতায় এলেন। দল গঠনের কাজে তিনি হাত দিলেন। শুরু হলো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, দলের ভিতরে-বাইরে সমস্যা। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের বাকশাল গঠন ও ১৯৯১ সালে আবার আওয়ামী লীগে যোগদান, ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আরেক দফা ভাঙনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবারো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জেল-জুলুম, গৃহবন্দী, ছাত্র সমাজ গঠন, হত্যা, নির্যাতন, শেখ হাসিনাকে লাল দীঘির ময়দানে গুলি বর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা, অবশেষে স্বৈরাচারের পতন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জাতীয় নির্বাচন, সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পরাজয়, বিএনপি’র সরকার গঠন।

১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের আপোষহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বৈরাচার মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নেতৃত্বে বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আবদুর রাজ্জাক, বেগম সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বর্তমানে ওবায়দুল কাদের। তিনি কখনো স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কখনো ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, কখনো বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন, কখনো মাইনাস টু ফর্মূলার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করেন।

১৯৭১-এর পরাজিত শক্তিরা, মীর জাফররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭৫-এ বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকেও বারবার হত্যার পরিকল্পনা করেছে সেই একই শক্তি ও শক্তির প্রেতাত্মারা। বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রক্ষা করেছেন।

তিনি স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, এক-এগারো সরকারের পতন ঘটিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির দাত উপড়ে ফেলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই শেখ হাসিনাকে এ পর্যন্ত ২২ বার হত্যার প্রচেষ্টা করা হয়েছে এবং এই হত্যাচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তারা মনে করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে।

পাকিস্তানের ২৪ বছর, জিয়া-খালেদা-এরশাদের ৩১ বছর মিলিয়ে মোট ৫৫ বছর পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশে পাকিস্তাকি কায়দায় দেশ পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৬ বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি স্বাধীন দেশ বাঙালিকে উপহার দিয়েছে। তারই জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা ৪৩ বছর নেতৃত্ব ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বার বার গণতন্ত্র ও রাজনীতি রক্ষা করেছেন।

তিনি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৮ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র বিজয়, ৫৫ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে ১১১ টি ছিটমহল বাংলাদেশের সীমানায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান, অরক্ষিত আকাশসীমায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন, মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় প্রদান, মর্যাদার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, পদ্মাসেতু নির্মাণ, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন, কর্ণফুলি টানেল নির্মাণ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অভাবনীয় উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক সোনালী অর্জন এনে দিয়েছেন।

তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পর পর চারবার সহ মোট পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাঁচবার সরকার গঠন করেছে। তিনি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির আইনের আওতায় বিচার করেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে যতবড়ই ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা পার্টির নেতা হোন না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে তার দায়িত্বকালে সকল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ও সংস্থার চাপ মোকাবেলা করেছেন।

উপমহাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক সফল দল হিসেবে বিশ্বে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ২৬ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৮১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা ৪৩ বছর বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা সভানেত্রীর দায়িত্বে থেকে মোট ৬৯ বছর বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।

একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করে এবং দেশের মানুষের সত্যিকারের মঙ্গল, উন্নয়ন ও মুক্তির জন্য এই পরিবার রক্ত দিয়ে বাঙালিকে ও বাংলাদেশকে ঋণী করেছেন। এই ঋণ শোধ হবার মতো নয়, বাংলাদেশের মানুষ কখনো তা শোধ করতে পারবে না। আমরা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আজীবন ঋণী হয়ে থাকতে চাই। এই রাজনৈতিক দল টিকে থাকলে বাংলাদেশ টিকে থাকবে। এই রাজনৈতিক দল ও দলের আদর্শ চিরদিন অটুট থাকুক সেটাই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে আদর্শ নিয়ে তাঁরই হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগে একজন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছিলাম সেই আদর্শ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেন আজীবন সমুন্নত রাখে সেটাই ৭৫-তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমার প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ চিরজীবী হোক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

অধ্যাপক ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া: চিকিৎসক, লেখক-গবেষক ও সংগঠক

এ সম্পর্কিত আরও খবর